বাবা থানকুনির পাতা খেতে পছন্দ করেননি কোনো দিন। অথচ আজ !
বাবার যেদিন ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। বিষণ্ণমুখে তিনি মায়ের দিকে চেয়েছিলেন।
ডাক্তার বললেন, এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আপনি যদি এটাকে পজিটিভ দৃষ্টিতে নেন তবেই মঙ্গল। অনেক ডায়াবেটিসের রোগী সুস্থ মানুষের চেয়ে ভালো থাকে।কারণ তারা একটা ভালো লাইফ স্টাইল মেন্টেইন করে।
ডাক্তারের কথায় বাবা আশ্বস্ত হতে পারেন না।তাঁর চোখে তা স্পষ্ট ছিল। তবে মুখে তিনি কিছু বললেন না।
বাবাকে ডাক্তর আরো বলেন, আপনাকে একটা বই করে দিচ্ছি। এখানে সব নিয়ম লেখা আছে। কী খেতে পারবেন, কতটা খেতে পারবেন, কোনটা একেবারেই খাওয়া যাবে না। সব এখানে লেখা আছে। আপনার পরিবারে কারো ডায়াবেটিস আছে?
বাবা বলেন, বাবা-মায়ের ছিল কি না বলতে পারব না। তবে বড় ভাইয়ের ডায়াবেটিস ছিল।
ওহ,আজ থেকে আপনার মিষ্টি জাতীয় যেকোনো খাবার নিষেধ। সবুজ শাক-সবজি বেশি করে খাবেন। প্রতিদিন একটু করে টক খাবেন। বিকেলে চিনি ছাড়া রং চা বা গ্রিন টি খেতে পারেন। রাতে পাতলা দুটো রুটি খাবেন। দুপুরে ভাত খাবেন এক কাপ। সালাদ আর সবজি দিয়ে পেট ভরাবেন। কমপক্ষে আধা ঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করবেন…
ডাক্তার সাহেব মুখস্থ বলে ফেললেন। বাবাকে নিয়ে যখন আমরা বের হলাম ক্লিনিক থেকে বাবাকে ভীষণ বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
বাবাকে বললাম, মন খারাপ করার কিছু নেই আব্বা।এই রোগ এখন ঘরে ঘরে।পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরমের ডায়াবেটিস আছে।অনেক আগে থেকেই।এই রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন খেলা চালিয়ে গেছে সে। এখন তিনি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাথে ডায়াবেটিস সচেতনতার জন্য কাজ করেন।বাবা খেলার পাগল।বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের পর তাঁর পছন্দের টিম পাকিস্তান ক্রিকেট টিম।বাবা নিজেও একজন ফুটবলার ছিলেন।
উত্তরে বাবা শুধু ‘উঁ!’ শব্দটি করলেন।
বাড়ি ফিরে মা কাপড় না ছেড়ে রান্না ঘরে গেলেন।বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঠেকল।আমি গেলাম রান্না ঘরে।মা টানা টানা চোখ দুটোতে জল ধরে রেখেছেন।আমাকে দেখে তিনি বিব্রত হলেন।চোখের জল আঁটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন। মাকে বললাম, ডায়াবেটিস এখন ঘরে ঘরে। এই নিয়ে অহেতুক দুঃশ্চিন্তা করে লাভ নেই।
মা বললেন,তোর ভার্সিটির পড়া শেষ হলো না।মেয়েটা কলেজে।এখনই রোগ বাঁধিয়ে ফেলল।
বললাম,ভয় পেয়ো না।ডাক্তারের নিয়মগুলো মেনে চললে ভালো থাকবে আব্বা।তোর আব্বা তো অসুখের ব্যাপারে উদাসীন।চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘরে এসে বাবার ডায়াবেটিসের বইটা মনোযোগ দিয়ে মা পড়লেন।
এরপর শুরু হলো বাবার উপর মায়ের বিধি নিষেধের স্ট্রিম রোলার।মায়ের কড়াকড়ি নির্দেশ দুপুরে এক বাটি ভাত খেয়ে থাকার অভ্যাস করতে হবে।বাবা সারাদিন মিটসেফ, ফ্রিজের আসে-পাশে ছোঁ ছোঁ করে বেড়ায়।যে মানুষটা মিষ্টি একেবারেই পছন্দ করত না সেই বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে মিষ্টি খায়।মায়ের হাতে ধরা পড়ে বকুনি খায়।বাবা মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে এসে আরো দু ঘণ্টা ঘুমাতেন।সেটাও চলবে না।নামাজ পড়ে এক ঘণ্টা হেটে আসতে হবে।মায়ের এসব ভালোবাসার অত্যাচার বাবা মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছিলেন।আমিও মায়ের পক্ষ নিয়ে বাবাকে মাঝে মাঝে দুটো শক্ত কথা শুনাতাম-
আল্লাহ সবার জন্য রিজিক বরাদ্দ করে রেখেছেন। যে আগেই বেশি খেয়ে ফলবে তার আয়ু শেষ হয়ে যাবে।তাই আগে বেশি খেয়েছেন এখন যেটুকু রিজিক বাকি আছে তা একটু একটু খেয়ে আয়ু বৃদ্ধি করেন।
বাবা জানতেন এই কথাগুলো আমি কোথায় শুনেছি। আমার নানা এ কথাগুলো বার বার বলতেন।বাবার খাদ্যপ্রেম দেখে নানা বিরক্ত হয়ে দু’চারবার এসব কথা শুনিয়েছিলেন। আমার নানার আশি বছর বয়সেও তেমন কোনো রোগ ছিল না।তিনি স্বল্পাহারি ছিলেন।তিনি আরো বলতেন, খানা শব্দটির মাঝে একটা রহস্য আছে ‘খা’ অর্থ খাও, আর ‘না’ অর্থ খেও না। পেটের তিন ভাগের একভাগ খাবার দিয়ে, আরেক ভাগ পানি দিয়ে ভরাতে হয় আর আরেকটি ভাগ ফাঁকা রাখতে হয়।
বাবা বলতেন, তোর নানার মতো খাবারের ব্যাপারে সংযমী হওয়া সত্যি খুবই কঠিন।
নানা আপন পুত্রের মতোই বাবাকে স্নেহ করতেন।বাবা ছোটবেলাতেই মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন। বাবার বড় ভাই পড়াশোনা ও দেখাশোনার অজুহাতে বাবার পৈত্রিক সম্পত্তির একটা বড় অংশ লিখে নিয়েছিলেন। বড় ভাইয়ের সংসারে অনেক কষ্টে বাবা মানুষ হয়েছিলেন। বাবা স্নাতক হওয়ার পর অনেক চেষ্টায় নিজের ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছিলেন।
ডায়াবেটিস নিয়ে বাবার পাঁচটি বছর কেটে গেল। বাবা হঠাৎ একদিন হার্ট এ্যাটাক করলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকি।খবর পেয়ে গেলাম হাসপাতালে।মার দিকে তাকিয়ে চোখ ভরে জল এলো।কোনো রকমে সেটা লুকিয়ে বাবার কাছে দাঁড়ালাম। সেখানে শুনলাম বাবার হার্ট এ্যাটাক হলে মা নিয়ে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে।ওখানকার ডাক্তার এ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত রাজশাহী বিভাগীয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।আমার সেজো মামার সাহায্য নিয়ে বাবাকে রাজশাহী নিয়ে আসা হয়।গতকাল থেকে আমার মা-বাবাকে কতটা যে ধকল সহ্য করতে হয়েছে ভেবেই বুকটা ফেটে যেতে লাগল।নিজেকে বড় অপরাধী লাগছিল ঐ সময় পাশে থাকতে পারিনি বলে।ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন, ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে না থাকায় বাবার হার্টের প্রবলেম দেখা দিয়েছে।অবস্থা খুব একটা ভালো না। কমপ্লিট রেস্টে থাকতে হবে।বেশি কথা বলা যাবে না। দোকানে বসা যাবে না।বাবা আমাকে ডেকে বললেন, তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার পড়াশোনাটা মন দিয়ে চালিয়ে যাও। সামনে তোমার মাস্টার্স পরীক্ষা।ভালো ফল করতে হবে। বাবা একটু সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিল। আমিও বাবা-মায়ের সাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে এলাম।সিদ্ধান্ত নিলাম কয়েকদিন ক্লাস বাদ দিয়ে বাবা-মায়ের কাছে থাকব।বাড়িতেই পড়াশোনা করব।
মা আর ডাক্তারের ভরসায় থাকতে পারলেন না।যার কাছে যা শুনে তাই ট্রাই করতে লাগলেন।পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা মাকে বললেন, থানকুনির পাতার রস নিয়মিত খাওয়ালে ডায়াবেটিস ভালো হয়ে যায়। আগেকার মানুষের রোগ বালাই কম হতো কারণ তারা জড়িপুটির উপর ভরসা করত।
মা আমাকে ডেকে বললেন, তুই খুঁজে দেখিস তো কোথাও থানকুনির পাতা পাওয়া যায় কি না।
সে সময় বাজারে থানকুনির পাতা পাওয়া যেত না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিজনদের বাড়ির পেছনে পরিত্যক্ত কলতলায় লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে থানকুনির পাতার সন্ধান পেলাম। মাকে সামান্য পাতা তুলে এনে দিলাম। মা সেটা পেয়ে কী যে খুশি হল!যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন।রস করে মা দিল বাবাকে।বাবা সামান্য মুখে নিতেই তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। ‘থু’ করে ফেলে দিলেন। এ কী! তিতা আঁশটে গন্ধ!
মা হতাশ হয়ে ভললেন, ফেললে কেন? এটা থানকুনির পাতা। সব রোগের মহাষৌধি। ডায়াবেটিসের জন্য অনেক কার্যকর। সামান্য তিতা হতে,পারেআঁশটে কেন হবে!
তিতা বুঝলাম। কিন্তু এ তো অখাদ্য। মুখে দেয়া যায় না।
ঔষধ কি মানুষ স্বাদ করে খায়। তোমার যেমন কথার ছিরি। তোমার সব রোগের মূলে আছে ডায়াবেটিস আর এই রসটা খেলে তোমার সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
খাচ্ছি খাচ্ছি। আর লেকচার দিও না। না খাইয়ে তুমি ছাড়বে।
মায়ের মুখে স্বস্তির হাসি ফিরে এলো।
মা থানকুনির পাতা দিয়ে নানা ধরনের রেসিপি তৈরি করতে শুরু করলেন। থানকুনি পাতার বড়া-উপাদান হচ্ছে থানকুনির পাতার পেস্টের সাথে খেশারির ডাল, সামান্য ময়দা, কাঁচা মরিচ, পিয়াজ। থানকুনির পাতার পাঁচ প্রকারের ভর্তা। থানকুনির পাতার ঝোল। আরো কত রকমের আইটেম। কিছু কিছু রেসিপি আবিষ্কার করতে গিয়ে মা রীতিমত হতাশ হলেন। তিনি নিজেও মুখে তুলতে পারলেন না। কোনটা বাবা পছন্দ করবে সেই আশায় মায়ের এতো প্রচেষ্টা কিন্তু বাবার কোনোটাই পছন্দ হতনা। আমি একদিন বাবাকে বললাম, মাকে তুমি হতাশ করছ কেন। একদিন তো বলতে পারো বেশ হয়েছে।
বাবা বললেন, তাই তো! তোর মা আমার জন্য এতো কষ্ট করছে একবার তো প্রসংশা করা দরকার। তোর মায়ের এই থানকুনির অত্যাচারটা আসলে তোর মায়ের ভালোবাসা আমি সেটা বুঝি। তাই তো কষ্ট হলেও খাই। এ দিয়ে যে রোগ সারবে না সে আমি ভালো করেই জানি।
রোগ না সারুক উপকার নিশ্চয় পাবেন। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ তো এসব লতা-পাতা দিয়েই ঔষধ বানাত। সেসব কি মিথ্যা!
বাবা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাকে ডাকলেন, হাসানের আম্মা এদিকে এসো।
আসছি থামো। মা রান্না ঘরে ছিলেন। হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। কী বলছ বলো।
বলছিলাম, তোমার থানকুনির পাকোড়াটা বেশ মজা।চাইলে ওটা দিতে পারো।
প্রথমে মা বাবার কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।এমন কথা বাবার কাছে আশা করেননি।পরে যখন মা’র মনে হল বাবা মন থেকেই কথাটা বলেছেন তখন মা বললেন, আর ভর্তা?
ভালো।বাবা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন।বুঝতে পারছিলাম বাবা চোখের ভাষা ‘তোর কথা শুনে ফেঁসে গেলাম।’
কালজিরার সাথে থানকুনি পাতার মিক্সড ভর্তাটা কত মজা।তা দিয়েই গরম গরম এক থালা ভাত খেয়ে ফেলা যায়।
দেখলি ব্যাপারটা।বাবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।বাবা মায়ের এসব খুনসুটি দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। বাবা-মা কখনো সহজ করে একে অপরের সাথে কথা বলতেন না।তাদের কথায় একে অপরের প্রতি সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ ও ভর্ৎসনা থাকত।এ নিয়ে আমি ভীষণ বিরক্ত ছিলাম। কিন্তু তাঁদের ঐসব কথার মাঝেই ছিল তাঁদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসর প্রকাশ। মাকে কখনোই বাবাকে রেখে নানা বাড়িতে গিয়ে থাকতে দেখিনি।কখনো গেলেও মা বাবাকে সাথে নিয়ে যেতেন। সব সময় বাবার জন্য ভালো মাংসটা, ভালো মাছের টুকরোটা উঠিয়ে রাখতেন।এটা ভালোবাসা ছাড়া কী।যা হোক বাবার শত আপত্তির পরও মা বাবার উপর তাঁর থানকুনি নামক অত্যাচার চালিয়ে গেলেন।
এক বছর হল বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।এখন আমি ঢাকায় একটা ছোট্ট জব করি। মাকে বলি চলো মা আমার সাথে ঢাকায় থাকবে।তোমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।ঢাকায় থাকলে নিয়মিত চেকাপ করাতে পারবে।মা রাজি হয় না।বলেন, স্বামীর ভিটাতে জীবনের ভালো সময়টা কাটিয়েছি। বাকি দিনটা সেই সব স্মৃতি নিয়ে কাটিয়ে দিতে চাই।আমি যখনই ঢাকা থেকে বাড়ি যাই মা বলেন, যা বাবার কবরটা জিয়ারত করে আয়। কবরে যে নিম গাছটা লাগিয়েছিল ওটাতে পানি দিবি।
খালঘাট গোরস্থানে বাবার কবর। বাড়ি থেকে বেশ দূরে।মা প্রায় দিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে গোরস্থানের কাছের বড় রাস্তাটা পর্যন্ত যায়।মেয়েদের ভেতরে ঢোকা নিষেধ।দূর থেকে গোরস্থানের বড় গেইটটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মা।মাকে বললাম, তুমিও চলো।
নাহ আজ তুই যা। আমি তোর জন্য কালাইয়ের রুটি বানাচ্ছি।
আজ বাবার কবরের শিয়রে দাঁড়িয়ে অবাক হলাম। বাবার কবরের পুরো শরীরটা থানকুনির লতায় ছেয়ে গেছে। যে পাতা বাবা একেবারে পছন্দ করত না সেই পাতা বাবা বুকে ধারণ করে রেখেছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন
খুব সুন্দর আবেগমাখা গল্প৷প্রতীকী৷ভাল লেগেছে৷