ভাদ্রের কুকুরেরা

ভাদ্রের কুকুরেরা
নন্দিনী নাগ
।। ১।।


আজ আবার একটা! এই নিয়ে একমাসে তেরটা কুকুর বেঘোরে মরল এ পাড়ায়। রাস্তার কুকুরের মৃত্যু অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা,নেড়ি কুত্তার দল ঘুরে বেড়ায় সব পাড়াতেই, তারমধ্যে কোনটা বাঁচল কোনটা মরল কে হিসাব রাখতে যায়! তিনদিনের ব্যবধানে প্রথম দুটোকে যখন রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছিল তখন জয়াও মাথা ঘামায়নি,ভেবেছিল অসুখবিসুখে মারা গেছে হয়ত,কুকুরদের নানারকম ভাইরাসঘটিত অসুখ হয়, নিজের কাজের সুবাদে সেটা জানাই আছে জয়ার। কিন্তু তিননম্বরটার বেলায় মাথা ঘামাতেই হল।কারন তিননম্বর শহীদটি আদতে রাস্তার হলেও পুরো অনাথ ছিল না,জয়ার পড়শী গৌরিকাকিমা,ভুতুর পালিকা মা।
“শিগগিরি দেখবে চল, আমার ভুতুটাকে কে যেন মেরে ফেলেছে”
গৌরিকাকিমার সঙ্গে জয়াকে যেতে হয়েছিল রাস্তার মোড়ে, যেখানে ভুতু পড়েছিল। জয়া ‘ক্রুয়েলটি এগেইনস্ট অ্যানিম্যাল’ নামে একটা বেসরকারী সংস্থার সঙ্গে কাজ করে,তাই এটা তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
গৌরিকাকিমা সন্তানস্নেহে বড় করে তোলা আদরের ভুতুর মাথাটা দুহাতে তুলে ধরে কান্নাকাটি করছিল, তখনই জয়া দেখেছিল ভুতুর মাথায় একটা গভীর ক্ষত, যেন ধারালো কিছু দিয়ে খানিকটা অংশ খুবলে তুলে নেওয়া হয়েছে।
“কুকুরের আনন্যাচারাল ডেথেও যদি পোস্টমর্টেম করার ব্যবস্থা থাকত!তাহলে ভুতুর মৃত্যুর কারনটা অন্তত জানা যেত ” ভেবেছিল জয়া।

চারনম্বর কুকুরটাকে যেদিন রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল সকালবেলাতে,সেদিন পাড়ার অনেকেরই টনক নড়ল। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে চারখানা কুকুর কেন মরল, এ নিয়ে অনেককেই আলোচনা করতে দেখা গেল।
“কিছু নতুন ভাইরাস ছড়ালো নাকি যেটা শুধু কুকুরদেরই অ্যাটাক করে?”
“তা হলে কি কুকুরটা মরার আগে কদিন ভুগবে না?গতকালও তো কালুকে দেখলাম দিব্যি সুস্থ,মুরগীর দোকানে ছাট খাচ্ছে!”
“তা বটে!তাছাড়া মরছে কেবল রাস্তায় ঘোরা গুলোই,বাড়ির পোষাগুলোর তো কিছু হচ্ছে না!”
কুকুর নিয়ে গবেষণা আর বেশিদূর এগোয়নি সেদিন।দিনকাল এমনিতেই বড় খারাপ, বাজারে আলু,পেঁয়াজ, আনাজ সবই তেতে আছে, গায়ে হাত ছোঁয়ালেই ছ্যাঁকা লাগছে, তার ওপরে আবার ব্যাঙ্কের সুদও ক্রমাগত কমছে! সকালবেলার বাজারমুখো মানুষের আলোচনার মোড় স্বাভাবিকভাবে সেদিকেই ঘুরে গেল, কুকুরের কথা ভুলে যেতে বেশি সময় লাগল না।

হৃষ্টপুষ্ট, তাগড়াযোয়ান পাঁচনম্বরটার দেহ পড়েছিল মিউনিসিপালিটির ভ্যাটে,যেখানে ময়লার গাড়িগুলো আবর্জনা জমা করে। প্রথম যে ছেলেটা ময়লার গাড়ির মাল খালাস করতে গেছিল,তার চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা।পরপর কদিন কুকুরের বডি ফেলতে হয়েছে বলে,এই রহস্যমৃত্যুর কথাটা ওর জানা ছিল। সে-ই
এসে জয়াকে জানালো কথাটা।
“আজকে আর রাস্তা থেকে আমাকে তুলতে হল না দিদি, কাজ এগিয়ে রেখেছে আমার, একবারে ভ্যাটে গিয়েই মরেছে “
কথাটা শুনে জয়া গিয়ে দেখে এসেছিল,এই কুকুরটার গলায় সরু একটা তার প্যাঁচানো আছে,মানে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।
“তার মানে আগেরগুলোকেও নিশ্চয়ই এভাবেই মারা হয়েছিল, এটার গলা থেকে তারটা খুলতে ভুলে গেছে “
মনে মনে ভাবল জয়া। এগুলো যে কোনো বিকৃতমস্তিষ্ক মানুষের কাজ, এব্যাপারে ওর মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না।
প্রায় প্রতিটি পাড়াতেই এমন কিছু মানুষ থাকে, রাস্তার কুকুরদের ওপর তাদের জাতক্রোধ থাকে। বেওয়ারিশ এই কুত্তাগুলো পালে পালে জন্মায় আর কারনে অকারনে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে বলে খুবই বিরক্ত বোধ করেন তারা। তারওপর আবার যদি কখনো বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়, তাহলে তো আর কথাই নেই। এমনভাবে চিৎকার করে পিছু নেবে যে মনে হবে, শালাদের বাপের প্রপার্টিতে সিঁধেল চোর ঢুকেছে। রাগ হওয়াটা খুবই সঙ্গত।
কিন্তু তাই বলে এমন নৃশংসভাবে মেরে ফেলাটা মোটেও মেনে নেওয়া যায়না।
পাড়ার কয়েকজন পশুপ্রেমীর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হল, কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে রাতে পাহারা দেওয়া হবে,জয়াদের এনজিওর ছেলেমেয়েরাও থাকবে।কে বা কারা রাস্তার কুকুরদের ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে, সেটা জানা না গেলেও,ব্যাপারটা বন্ধ তো হবে পাহারা থাকলে।
“এতদিন কুকুরেরা মানুষকে পাহারা দিত রাত জেগে, এখন মানুষরা পাহারা দেবে কুকুরদের!কি দিন এল!”
প্ল্যান শুনে একজন তো বলেই বসল।
“জয়াদি, একটা জিনিস খেয়াল করেছ, যেগুলোকে মারা হয়েছে সবই কিন্তু ছেলে কুকুর। মনে হয় খুনি পুরুষজাতটাকে সহ্য করতে পারেনা, কুকুর মেরে গায়ের জ্বালা মেটাচ্ছে ” আর একটা ছেলে বলল।
কথাটা জয়াও ভেবেছিল। যদি নির্বিচার কুকুর হত্যাই লক্ষ্য হয়, তবে মারা যাওয়া পাঁচটা কুকুরই পুরুষ কেন? সম্ভাব্যতার তত্ত্ব তো তা বলে না! তাহলে কি কোনো মহিলা এই কাজ করছে? কোনো বিকৃতমস্তিষ্ক মহিলা?
কিন্তু কোনো মহিলার পক্ষে একা একটা কুকুরকে নিঃশব্দে তুলে নিয়ে গিয়ে, গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে আবার বডিটা বয়ে এনে ফেলে যাওয়া সম্ভব? তাহলে কি একজন নয়, অনেকে আছে এর পেছনে? কিন্তু কেন?
ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পারে নি জয়া, তাই ভাবা ছেড়ে দিয়েছে। আপাতত কুকুরগুলোর প্রাণ বাঁচানো দরকার উন্মাদটার হাত থেকে, পরে অপরাধী নিয়ে ভাবা যাবে।

পাড়ায় পাহারাদারী শুরু হবার পর দিনকয়েক আর কোনো কুকুরকে মরতে হয়নি। জয়ারা খুশি হল এটা ভেবে যে, ঠিক পথেই এগিয়েছে ওরা।কিন্তু ঠিক পাঁচদিন বাদে খবর এল আবার একটাকে মেরেছে, এটাও পুরুষ আর সুস্থ,শরীরে কোথাও ঘা বা পোকা হওয়ার চিহ্ন নেই।এটার গলায় তার পেঁচানো নেই, হয়ত বিষ খাইয়ে মেরেছে।ছয়নম্বর ভিকটিম অবশ্য জয়াদের পাড়ার নয়, ওদের পাশের পাড়ার, যেখানে রাতে টহলদারী থাকে না। তবে একটা ব্যাপার বেশ পরিষ্কার,ঘাতক যেই হোক না কেন, সে এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা।

।। ২।।


বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা দিনও বেকার বসে থাকতে হয়নি মিলনকে, একটা বড় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে জুনিয়ার সায়েন্টিস্ট হিসাবে জয়েন করেছে ভালো মাইনেতে। চিরকাল পাড়ায় এবং স্কুলে ভালোছেলে হিসাবে পরিচিত মিলন বরাবরই একটু চুপচাপ,অন্তর্মুখী প্রকৃতির। পড়াশোনাতে ভালো হলেই যে মিলনের মত, মানে সমবয়সী ছেলেরা যাকে আড়ালে বলে ‘মেনিমুখো’,হতে হবে এমন কোনো নিয়ম সামাজিক ব্যকরণে ‘নিপাতনে সিদ্ধ ‘ হয়ে আছে বলে জানা নেই, বরং এর উল্টোটাই সকলে পছন্দ করে।লেখাপড়া,ক্রিকেট, ক্যারাটে, ফুটবল, সাঁতার, ড্রইং, গিটার সবকিছুতেই দক্ষ হলে, তবেই তাকে ‘মানুষের মত মানুষ’ হিসাবে গন্য করা হয়, সে ছেলে হোক বা মেয়ে।আর কৈশোরকালে বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু পটাতে যে যত দক্ষ, বন্ধুমহলে তার রেলা তত বেশি।
কিন্তু মিলন যে এইসব থেকে দূরে দূরে থেকেই স্কুল এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজজীবন কাটিয়ে দিল,সেটা যে মায়ের কাছে ‘ভালছেলে’ সাজার তাগিদ থেকে নয়,সেটা আর কজন জানে? সঠিকভাবে বলতে গেলে কেউই জানে না। মেয়েদের প্রতি ও যে কোনো আকর্ষণ বোধ করে না, কোনোদিনই করেনি, এই কথাটা লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনি।এমনকি বন্ধুরা যখন মেয়েদের নিয়ে নানারকম উত্তেজক আলোচনা করত, তখনও মিলন বিন্দুমাত্র উত্তেজনা বোধ করেনি কোনোদিন। ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক নয়, সেটা বুঝে মিলন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সবার কাছ থেকে।
এসব মুখচোরা,লাজুক টিপিক্যাল ‘ভালোমানুষ’ গোছের ছেলেদের যা হয়, মিলনেরও তাই হল।
মিলন যখন কলেজে পড়ছে, তখনই ওর মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ল। পাশ করে বেরনোর আগেই যখন ওর চাকরি পাকা হয়ে গেল, মিলনের মা ছেলের সম্মতির তোয়াক্কা না করে তার বিয়েও পাকা করে ফেললেন, যাতে মরার আগে বৌয়ের মুখ দেখে যেতে পারেন।
নরমসরম ভালোমানুষ ছেলেটাকে যাতে অভিভাবকের মত আগলে রাখতে পারে,তাই মিলনের মা দেখেশুনে বেশ বলিয়েকইয়ে চৌকশ মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে ঠিক করেছিলেন।
“আমার অবর্তমানে যে ছেলেটা ভেসে যাবে না, সেটা দেখে আমি শান্তিতে মরতে চাই ”
মৃত্যুর দিকে নিরানব্বই পা এগিয়ে যাওয়া একটা মানুষের অন্তিম ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, মিলনেরও যে কোনো কিছু বলার থাকতে পারে সেটা কারো মাথাতেই আসেনি।
ফলতঃ যা হবার তাই হল। বৌভাতের দুদিন পর মিলনের বউ সেই যে চলে গেল, আর এল না। শাশুড়িমায়ের পছন্দের ‘বলিয়েকইয়ে’ মেয়ে বলে, কোনোকিছুই বলতেও সে বাকি রাখলো না।পাড়ায়, অফিসে,মিলনকে সবাই চেনে ‘ওই যে ছেলেটার বউ চলে গেছে’ এই পরিচয়ে।আর এলাকার বদমাস ছেলেরা আগে আড়ালে বললেও, এখন প্রকাশ্যেই ওকে বলে ‘ধ্বজো’।
মিলন অনেকবার ভেবেছে, এ পাড়া ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু বাবার জন্য পারে না। মা মারা যাবার পর, মায়ের স্মৃতি হিসাবে এই বাড়িটাকেই আগলে ধরে বাঁচছেন মানুষটা। মিলনের প্রস্তাব শুনে তিনি সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন, “তুই যেখানে খুশি গিয়ে থাক, আমি যতদিন বাঁচব, এ বাড়ি ছেড়ে কোত্থাও যাব না। “
বাবাকে একলা ফেলে রেখে মিলনই বা যায় কি করে! অগত্যা সবরকম টিটকারি হজম করে পুরনো জায়গাতেই পড়ে থাকতে হচ্ছে ওকে।

পাঁচপাঁচটা বছর পার হয়ে গেছে,আঠাশ পেরিয়ে উনত্রিশে পড়েছে মিলন। পাড়ার যেসব ছেলেমেয়েরা সেইসময় স্কুলে ছিল, তারা কলেজ, ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে গেছে,যারা ওর সহপাঠী ছিল তারা এখন সবে
দিল্লিকা লাড্ডু খাওয়া শুরু করেছে।অনেক বন্ধুর মা আবার সহানুভূতি থেকে বলেন, “তোর মা বড় তাড়াহুড়ো করেছিল। অত তাড়াতাড়ি কেউ ছেলের বিয়ে দেয়!যা হবার হয়েছে, তুই ওসব ছাড়, আবার বিয়ে কর। নিজে না পারিস তো বল, মেয়ে দেখি “
মিলন এখন শিখে গেছে কিভাবে এসব কথাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। কারন মা না থাকলেও, আত্মীয়দের মধ্যে মাতৃস্থানীয়ার তো অভাব নেই, আর মিলনের বিয়ে নিয়ে তারা দুশ্চিন্তা করতে কসুরও করেন না।
যেসব ছেলেরা ওর নামকরণ করেছিল, তাদের বেশিরভাগই পাড়াছাড়া, কাজকর্মের ধান্দায় ব্যস্ত। যারা আছে তারাও আর ঠেকে বসে না। তবে পারিবারিক বা সামাজিক ঐতিহ্য যেমন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাহিত হয়ে যায় এই সুভাষণও তেমনই পৌঁছে গেছে। পার্থক্য শুধু এই যে, জিনবাহিত না হয়ে এক্ষেত্রে এই গুণটা ছড়িয়েছে কানবাহিত হয়ে।
সেদিন পাড়ায় নতুন আসা একটি কমবয়সী ছেলে যখন ওকে সিরিয়াসভাবেই ‘ধ্বজাদা’ বলে ডেকে কথা বলল, তখন মিলন রাগ করতে পারল না ছেলেটার ওপর। কিংবা সাইকেলে হাফপ্যাডেল করা এক দেড়ফুটিয়া বাচ্চাছেলে, ঘন্টি না থাকায় মুখ দিয়ে সেই অভাব পূরণ করছিল যখন,তখন তার ‘ধ্বজাকাকা সরে যাও’ বলে হেঁকে রাস্তা চাওয়ার মধ্যেও দোষের কিছু খুঁজে পায়নি মিলন। ওরা সত্যিই জানে ওর নাম ধ্বজাধারী বা ওইরকম কিছু, সংক্ষেপে ‘ধ্বজাদা’ বা ‘ধ্বজাকাকা’।
এসব শুনে এখন আর রাগ করে না মিলন, মাথাও ঘামায় না।বরং পড়াশোনা, কাজের মধ্যে নিজেকে আরো ডুবিয়ে দিয়েছে। দোতলা বাড়ির নিচের তলায় নিজেই একটা ছোটখাটো ল্যাবরেটরী বানিয়ে নিয়েছে, অফিস থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে ওখানেই ঢুকে যায়, মধ্যরাতের আগে আর বেরয় না।

।। ৩।।


রাতটা বেশ গরমের,ভ্যাপসা গরম। চারপাশটা দম ধরে আছে, হাওয়া নেই একটুও, একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। এমন রাতে ফ্যানের হাওয়াও গায়ে লাগে না, মনে হয় সারাদিন ধরে তেতে থাকা ছাদ থেকে গরম হাওয়া নামছে। এই পচা ভাদুরে গরমে একমাত্র এসি থাকলেই আরামে ঘুমানো যায়, কিন্তু জয়াদের বাড়িতে সেটা নেই।জয়ার ঘুম আসছিল না গরমে, শুলেই যত ঘাম গলায় গিয়ে জমছিল। ডেঙ্গু আর ম্যালেরিয়ার ভয়ও আছে, তাই মশারি না টাঙিয়ে উপায় নেই, অথচ মশারি টাঙালে ভেতরে হাওয়াই ঢোকে না।
রাত তখন প্রায় দুটো, বিরক্ত হয়ে জয়া ছাদে গেল, খোলা জায়গায় যদি হাওয়ায় ঘামটা একটু শুকায়!
ছাদের আলসের ধারে দাঁড়িয়ে দূরের রাস্তা দেখছিল জয়া। দিনেরবেলায় লোকজনের ভীড়ভাট্টা ,গাড়িঘোড়া, হৈচৈতে জমজমাট জায়গাটাকে রাতের বেলা একদম আলাদারকম দেখাচ্ছে, কেমন যেন গা ছমছমে ভুতুড়ে।
আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে ঘুমের ঢুলুনি আসছিল জয়ার, গরমের জ্বালা ধরানো ভাবটাও কমে এসেছিল ততক্ষণে।সেই ঘুম জড়ানো চোখেই ও দেখল,কেউ একজন পাশের গলিটা থেকে বেরিয়ে উল্টোদিকের গলিটাতে ঢুকল আর তার পিছু নিল একটা কুকুর।
জয়ার চটকাটা ভেঙে গেল। চোখ কচলে ভালো করে তাকিয়ে আর কিছু দেখতে পেল না, ততক্ষণে পুরো দৃশ্যটাই বড় একটা বাড়ির আড়ালে অদৃশ্য।লোকটার সঙ্গে একটা ব্যাগও ছিল বলে মনে হল ওর।
জয়ার মনে হল কিছু একটা হতে চলেছে,যা জানাটা ওর জন্য অত্যন্ত জরুরী। নাহলে কেনই বা এত রাতে ও এসে এখানে দাঁড়াবে আর কেনই বা লোকটা ওর চোখে পড়ে যাবে! পুরো ব্যাপারটা ওকে চুম্বকের মত টানতে লাগল,অগ্রপশ্চাৎ কিছু না ভেবে, চুপচাপ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল জয়া আর সামনে গলিটাতে ঢুকে পড়ল যেটাতে লোকটাকে ঢুকতে দেখেছিল।
জোর পায়ে একটু এগোতেই ওদের দেখতে পেল জয়া,সেই লোকটা আর তাকে অনুসরণকারী কুকুর। পোষাকুকুর ছাড়া এমন নিঃশব্দে কোনো কুকুরকে কারো সঙ্গে যেতে দেখেনি জয়া, অথচ এটা নিতান্তই রাস্তার একটা নেড়ি।ধর্মরাজ আর তার পিছু নেওয়া কুকুরের গল্প মনে পড়ে গেল ওর, এদেরও কি তবে গন্তব্য স্বর্গ নাকি! ব্যাপারটা জানার জন্য একটু দূরত্ব রেখে জয়াও এগোতে লাগল।

দু-এক পা এগিয়ে জয়ার মনে হল, কি বোকামির কাজটাই না ও করেছে! একটা ঘোরের মধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে এত রাতে!
কারও যদি কুকুর পোষ্য থাকে আর সেই কুকুরকে যদি বাড়ির এক কোনে চেন দিয়ে বেঁধে না রেখে কোলেপিঠে করার অভ্যাস থাকে, তবে যতই সাবান মেখে স্নান করো আর পারফিউম মাখো না কেন, একটা ‘কুকুর-কুকুর’ গন্ধ থাকবেই। সেই গন্ধটা অবশ্য মানুষেরা পাবেনা, তবে অন্য কুকুরেরা পাবে আর বুঝে যাবে, এ ব্যাটা কুকুরপ্রেমী! সে কারো পোষাই হোক বা রাস্তার নেড়ি, তারা তখন অকুতোভয়ে সেই মানুষটার সঙ্গে গা ঘষাঘষি করবে। হতে পারে এই নেড়িটা সেজন্যই লোকটার সঙ্গে চলছে, হয়ত লোকটা রোজরাতেই এইপথে ফেরে, আর নেড়িটা ওর সঙ্গে যায়!
এসব ভেবে ও ফিরে যাবে বলে দাঁড়াল, আর তখনই দেখতে পেল।
লোকটা পকেট থেকে রুমাল বার করল আর ব্যাগ থেকে বোতল বার করে রুমালে কিছু ঢেলে কুকুরটার দিকে ছুঁড়ল, কুকুরটা রুমালটা কামড়ে ধরল আর পরক্ষনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
ততক্ষণে ওরা একটা মাঠের পাশে চলে এসেছিল। জয়ার দিকে পেছন ফিরে লোকটা এবার কুকুরটার পাশে গিয়ে বসল। লোকটা কে সেটা বুঝতে না পারলেও জয়ার এটা বুঝতে কোনো অসুবিধাই হল না, কুকুরটাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে লোকটা কি করতে চলেছে! ও আর আড়ালে থাকতে পারল না।

লোকটা ততক্ষণে ব্যাগ থেকে বার করে ফেলেছিল একটা সার্জারি করার ছুরি, যদিও জয়া ভেবেছিল লোকটার হাতে দেখবে একটা সরু তার।
“কি করছিস কি তুই জানোয়ার!” জয়া ওর ছুরি ধরা হাতে আচমকা একটা লাথি মারল।
ছুরিটা ছিটকে পড়ল দূরে, লোকটাও চমকে গিয়ে মুখ তুলে তাকাল।
“একি! তুমি!! ছিঃ”
ধরা পড়ে যাওয়ায় লোকটি দুহাতে মুখ ঢাকল।
“তুমি এখন বাড়ি চলে যাও! এতরাতে রাস্তায় বসে নাটক করা বা দেখা কোনোটারই মানে হয় না। কাল সকালে তোমার বাড়িতে গিয়ে সব কথা শুনব।আশাকরি আবার কোনোরকম নতুন নাটক ফাঁদবে না রাতের মধ্যে। তাহলে আমি সবাইকে সবকিছু বলে দিতে বাধ্য হব “
জয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিল।



পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে যথেষ্ট দেরি হল জয়ার, কারন আগের দিন ঘুম আসতে আসতে প্রায় ভোর হয়ে গেছিল। বিছানায় উঠে বসতেই ছোটোবোন নেহা এসে একটা খাম ধরালো, মুখবন্ধ।
” মিলনদা সকালে এসেছিল, এটা তোকে দিতে বলে গেছে। বলেছে তুই জানিস এটা কাকে দেবার কথা। তোর নাকি এই খামটা আনার জন্য ওদের বাড়িতে যাবার কথা ছিল,মিলনদা অফিসে বেরিয়ে যাচ্ছে তাই নিজেই দিয়ে গেল!”
জয়া বুঝল এত বড় কুকীর্তি ধরা পড়ে যাবার পর মিলনদা আর জয়ার সামনে আসতে চায় না,তাই এই ব্যবস্থা।
খামটা খুলল জয়া, একটা কাগজ বেরলো, মাত্র কয়েকটা লাইন লেখা তাতে।
“আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম, একটা ওষুধ তৈরির চেষ্টা। পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে এসিটিএইচ বলে একটা হরমোন বার হয়, যেটা মেল কুকুরদের টেস্টিসকে উদ্দীপিত করে।টেস্টিসের মধ্যে থাকা কোষগুলো তখন টেস্টোস্টেরন তৈরি করে,যেটা ওদের মেটিং এর জন্য জরুরি। এইসময়টা কুকুরদের মেটিং সিজন, ফলে হরমোন খুব অ্যাকটিভ থাকবে এখন।
কুকুরের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে এসিটিএইচ কালেক্ট করার জন্য আমাকে কয়েকটা কুকুরকে মারতে হয়েছিল, তবে তাতে কাজ হয়নি।এখন আমার জীবন্ত কুকুর দরকার, কাল সেটাই কালেক্ট করতে গেছিলাম। কুকুর আর মানুষের অ্যানাটমি ফিজিওলজি অনেকটা এক, তাই আমার বিশ্বাস এটা তৈরি করতে পারলে আমার মত আরো অনেক মানুষের কাজে আসত। মানুষের গবেষণার প্রয়োজনে বরাবরই অনেক প্রাণীর প্রাণ গেছে, এটাও তেমনই মনে করে ক্ষমা করে দিস। তুই সায়েন্স পড়েছিস, আশাকরি আমার প্রয়োজনটা বুঝবি। ”

কাগজটা হাতে করে হতভম্ব হয়ে বসে থাকে জয়া।চোখটা ভিজে ওঠে ওর, সেটা অবোলা জীবেদের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে নাকি মিলনের অসহায়তা এবং তা থেকে জন্ম নেওয়া অপ্রকৃতিস্থতার কথা ভেবে সেটা জানা যায়না।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

8 thoughts on “ভাদ্রের কুকুরেরা

  1. ভালো লাগলো৷সুন্দর বুনোট ৷প্লটেও নতুনত্ব৷শক্তিশালী কলম৷

  2. ভীষণ ভালো লাগলো। গল্প টি খুবই নতুনত্ব। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনবদ্য। বলিষ্ঠ লেখনী। এরকম
    আরও আশায় রইলাম। ধন্যবাদ।

  3. বিষয়বস্তুর নতুনত্ব বেশ মনোগ্রাহী | পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ভাবালো |সার্থক ছোট গল্প |

  4. খুবই ভালো লেখা,একটা নতুন বিষয় নিয়ে ভিন্ন ধর্মী লেখা,আশা রইল আরো এরকম লেখা পরার

  5. অদ্ভূত লেখা এরকম একটা বিষয় নিয়ে… নামকরণ টাও যথার্থ… নতুন লেখার অপেক্ষায় রইলাম…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *