চিরসখা হে

চিরসখা হে
মহুয়া ব্যানার্জী
চিলেকোঠার ঘরে প্রিয় তোরঙ্গটার ডালা খুলে আজ অনেকদিন পর জিনিস গুলো দেখছে সেমন্তী। রায় বাড়ির মেজবঊ। সেই কবে এবাড়িতে ঘোমটা মাথায় দিয়ে ঢুকেছিল। কত শীত বর্ষা বসন্ত চলে গেল। কত কালবৈশাখীর ঝড় মাথার ওপর দিয়ে পেরিয়ে গেল। তবুও সেই ঘোমটা মুহুরতের জন্যেও শিথিল হয় নি। দু কাঁধে বেনী ঝোলান ছটফটে কিশোরী সেমন্তীর আসল পরিচয় রায় বাড়ির মেজবউয়ের কর্তব্যের আড়ালে হারিয়ে গেছে। শুধু এই একটা জায়গায় এলেই সে নিজেকে খুঁজে পায়। তার বর অনিল মাঝে মঝেই ঠাট্টা করে বলে,’ এই তোরঙ্গে নিশ্চয়ই তোমার কোন গোপন স্মৃতি আছে।‘ মুহূর্তে কেঁপে ওঠে সেমন্তী। আছে তো। সংসার, সন্তানপালনের হাজার দায়িত্বের মাঝেও এই স্মৃতিটুকুই তো তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পাছে ধরা পড়ে তাই সেও কাঠিন্যের সাথে বলে ওঠে, ’এই কারুকাজ করা ছোট আয়না, ঝিনুকের দুল, বাতিল ওড়না এসব আসলে আমার বেড়ে ওঠার স্মৃতি।‘ এই বলে তাড়াতাড়ি আবার কর্তব্যের মুখোশে নিজেকে মুড়ে ফেলে। এইভাবেই কেটেছে এতকাল। কিন্তু আজকের দিনটা একেবারে অন্য রকম। আজ আর কারো থেকেই কিছু লুকোনোর নেই। সব লুকোচুরি আজ শেষ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেমন্তী তোরঙ্গ থেকে একগোছা শুকনো মাধবীলতার ফুল তুলে বুকে চেপে ধরে। সেই ফুলগুলো সেমন্তীর সব যন্ত্রণা নিয়ে ঝুরঝুর করে খসে পড়ে। শান্ত ভাবে নিচে নেমে আসে সেমন্তী।
অনিল এতোদিনেও তার স্ত্রীর মনের তল পায় নি। কেন যে সেমন্তী ইচ্ছাকৃত ভাবেই এতো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে কে জানে! অনেক বার সেমন্তীকে ভালোবেসে কাছে টেনেছে, ভরিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু কিছুতেই আজ এতো বছরেও সে তার স্ত্রীকে মনের মানুষ হিসেবে কাছে পায় নি। তার দিক থেকে একতরফা ভালবাসার কারনেই এই যন্ত্রবৎ সহবাস আর দাম্পত্য বয়ে নিয়ে চলেছে সে। অথচ তাদের বিয়ে পরস্পরের পরিবারের সম্মতিতেই হয়েছে। তবুও কেন সেমন্তীর মনের হদিস সে পায় না? কার কাছে মন দিয়ে বসে আছে তার বিবাহিতা স্ত্রী? উত্তর জানা নেই। কেবল একটা সন্দেহ মাঝে মাঝেই মনের গহীনে উঁকি দেয়। পরক্ষণেই মনকে শাসন করে। ‘ছি ছি, এসব কি ভাবছে? ঘোমটার আড়াল কখনো সরায়নি সেমন্তী। আর সেই মানুষটিও তো স্বভাব গাম্ভীর্য বজায় রেখে দূরত্ব মেনে চলেছেন। কোথাও চোখে পড়ার মত স্খলন তো ছিল না। তবে?’ তবুও সারাদিনের মাঝে কেবল দুবেলা সেই মানুষটিকে খেতে দেওয়ার সময় টুকু কেমন যেন বাড়তি যত্ন করে সেমন্তী, একটু বুঝি আড়াল সরে। উজ্জ্বল হয় কাজল চোখের চাউনি। আর তিনিও বড় পরিতৃপ্ত মুখে সবটুকু আলো শুষে নেন কাঙ্গালের মত। এ সবই কি কেবল অনিলের চোখের ভুল? কে জানে।
তোমায় যখন আমার বৌ করে নিয়ে যাবো, তখন রোজ মাধবীলতার ফুল খোঁপায় লাগিয়ে দেবো। বলেছিল সে। সেমন্তীর কানে কানে। বাংলা অনার্সের সেমন্তীকে টিউশন পড়াতে পড়াতে কবিতা লিখত সে। কখন যে দুজনের মন একতারে বাঁধা পড়ল তা কেবল জানে বাংলা অনার্সের বইগুলো আর সেমন্তীকে উদ্দেশ্য করে লেখা তার কবিতাগুলো। আর জানে সেমন্তীর প্রিয় ফুল মাধবীলতা।
সেমন্তীর বাবার টিউশন পড়ানো ছেলের থেকে সরকারী চাকুরী বেশী পছন্দ হওয়ায় সে আজ রায়বাড়ির বড় বউয়ের বদলে ঐ বাড়ীর মেজো বউ। নিজের অজান্তেই তার ভাগ্য বদল হয়ে গেছিল। তারপর থেকে ঘোমটা একদিনের জন্যেও সরে নি।
আজ আর সে দায় নেই। মাথার ঘোমটা সরিয়ে শেষ বারের মত প্রানভরে দেখে নিল। তারপর চিরনিদ্রায় শায়িত বড় ভাসুর, তার বাংলা মাস্টারমশাইয়ের পায়ের কাছে একগোছা মাধবীলতা নামিয়ে রাখে রায় বাড়ীর মেজ বৌ।

42 thoughts on “চিরসখা হে

  1. মহুয়া, আপনার এই অণুগল্প মন দিয়ে পড়লাম। সাসপেন্স বজায় রেখে সুন্দর শেষ করেছেন। স্বল্প পরিসরেও উপস্থাপন -গুণে মনছুঁয়ে গেল!
    কিছু বানান ঠিকঠাক হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। নবীন প্রজন্ম বানান-বিধি মানছে, দেখতে পাই। “কারণ” না লিখে “কারন” লেখা যায় না। আমি নিজেও অবাক হতাম— এবিপি-র পত্র-পত্রিকায় “ঠান্ডা” লেখা হত দেখে। কিন্তু অ্যাকাডেমির অভিধান দেখে জানলাম যে, ওটাই সঠিক। ঠান্ডা। শব্দটা যেহেতু এসেছে উর্দু “ঠন্ডা” থেকে। কিন্তু, “প্রচণ্ড” সঠিক। এত কথা লিখলাম “অপার বাংলা”-কে নিখুঁত করার জন্যে। আপনি কিন্তু কিছু মনে করবেন না মহুয়া।

    1. আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

  2. মহুয়া, আপনার এই অণুগল্প মন দিয়ে পড়লাম। সাসপেন্স বজায় রেখে সুন্দর শেষ করেছেন। স্বল্প পরিসরেও উপস্থাপন -গুণে মনছুঁয়ে গেল!
    কিছু বানান ঠিকঠাক হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। নবীন প্রজন্ম বানান-বিধি মানছে, দেখতে পাই। “কারণ” না লিখে “কারন” লেখা যায় না। আমি নিজেও অবাক হতাম— এবিপি-র পত্র-পত্রিকায় “ঠান্ডা” লেখা হত দেখে। কিন্তু অ্যাকাডেমির অভিধান দেখে জানলাম যে, ওটাই সঠিক। ঠান্ডা। শব্দটা যেহেতু এসেছে উর্দু “ঠন্ডা” থেকে। কিন্তু, “প্রচণ্ড” সঠিক। এত কথা লিখলাম “অপার বাংলা”-কে নিখুঁত করার জন্যে। আপনি কিন্তু কিছু মনে করবেন না মহুয়া।

    1. খুব ভালো লাগল। মেজো বউ এর
      বেদনা মনকে স্পর্শ করল!!
      আরও লেখার অপেক্ষা তে থাকলাম।🌹

    2. লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে , মেজ বউ এর চরিত্র টা খুব সুন্দর ভাবে লেখিকা তুলে ধরেছেন।আরও লেখার অপেক্ষাতে থাকলাম🌹…

  3. গল্প হলেও সত্যি ।।।অতি বাস্তব থেকে লেখা।।খুব মর্মস্পর্শী ।।

  4. এটা আমার জীবনকাহিনি নয়! তবে গল্পটি স্বল্প পরিসরে দারুণ হয়েছে। বাড়ির মেজো বউ সেমন্তীর বেদনা মনকে স্পর্শ করল!

  5. অসাধারণ লাগলো। অনুগল্প অনেক পড়েছি। কিন্তু এত চমৎকার ভাবে উৎসাহ বজায় রেখে শেষ করাটা সত্যিই প্রসংশনীয়

  6. Khub sabolil ebong jhorjhore lekha ..porte suru korei jhop kore sesh hoye gelo kintu mone holona osumpurna ..besh halka romance ar byatha ..opubo. Keep it up

  7. ছোট গল্প। মিষ্টি গল্প। শ্রদ্ধা মিশ্রিত প্রেমের গল্প। বেশ অনেক টাই অন্যরকম।

  8. মনের হদিশ পাওয়া তো সহজ নয়।এ এক বিমূর্ত শিল্প। লেখা টি মন ছুঁয়ে গেল।মহুয়ার লেখায় নিজস্বতার বার্তা দিয়ে গেল।

  9. খুব ভালো লাগলো,,আরো ভালো লেখার অপেক্ষায় রইলাম

  10. লেখাটা খুব ভালো লাগল,মেজ বউ চরিত্র টা খুব ভালো হয়েছে, আরও লেখার অপেক্ষা তে রইলাম🌹

  11. খুব সুন্দর মর্মস্পর্শী কাহিনী। নিখুঁত অণু গল্প ।

  12. গল্প হলেও সত্যি ।।বাস্তবের সঙ্গে খুব মিল ।।খুব ভাল লাগল।।

  13. গল্প হলেও সত্যি ।।বাস্তবের সঙ্গে খুব মেলে।।খুব ভালো লাগল।।

  14. খুব ভালো লাগলো,,আরো ভালো র অপেক্ষায় রইলাম

  15. একটু অন্যরকম গল্প৷
    ভালো লাগল৷

  16. খুব ভালো লাগলো ম্যাম। সত্যি কত শত কথা, স্বপ্ন, স্মৃতি যে কত কত মন তোরঙ্গের ভিতর গুমরে কাঁদে, তার হদিশ পাওয়া যায় না। শুকনো মাধবীলতাগুলোর মত এক সময় ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে, ধুলোয় মিশে যায়। কেউ তার খবর রাখে না।

  17. খুব ভালো লাগল। এরকম কত মেয়ে যে মেনে আর মানিয়ে নিতে নিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, তার হিসেব কে রাখে!

  18. Darun..!!!!!..sesh line ei maat… abrupt finishing…prakrita chotogalpa…hatachakita…aro parar apekkhai roilum..parar boier talai lukie galper boi para ai pathaker ba amar Mato aro anek pathaker samay ba dhoirjer abhabe hoito akhon chotogalpa…chhoito cinemai sambal..aro anek arokam
    Sundar lekha likhun..ai suvechha roilo..🙏🙏

  19. গল্পটি অবশ্যই মুগ্ধকর। আনন্দ পেলাম ।
    তবে নামকরণ সাধারণ এবং বহুল প্রচারিত ।
    আমি হলে ‘ঘোমটা হে’ রাখতাম।

    1. আপনার এই উপদেশ মনে রাখবো।

  20. যারা আমার এই অণুগল্পটি পড়েছেন বা পড়বেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ। আপনাদের ভালোলাগলে আমার লেখা সার্থক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *