আলপনা ঘোষ
অতি প্রাচীনকাল থেকে বঙ্গ জীবনের একটি মহা গুরূত্বপূর্ণ দিক তার ভোজনপ্রীতি এবং খাদ্যসংস্কৃতি। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে চিত্রিত হয় সমাজ ও মানব জীবনের ছবি। খাদ্যসংস্কৃতি যেহেতু জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ তাই বাংলা সাহিত্যের সর্ব ধারায় বাঙালির খাদ্যাভাস ও বিলাসিতা, রন্ধনবৈচিত্র, ইতিহাস- এ সব কিছুই সগর্বে সম্পৃক্ত হয়েছে। ভাষাবিদ সুকুমার সেন মহাশয় তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের সংস্কৃতির বিবর্তনধারা অনুধাবন করলে বুঝতে দেরী হয় না যে অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বঙ্গভূমিতে খাদ্যের প্রকারভেদ সর্বাধিক বিচিত্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রায় গোড়া থেকেই বিচিত্র খাদ্য বস্তুর উল্লেখ পাই যা অন্য কোন অঞ্চলের সাহিত্যে মেলে না”।
কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে শুরু করে আধুনিক লেখকদের রচনায় আমরা সর্বকালের বাঙালির খাদ্যরুচির পরিচয় পাই। কৃত্তিবাসের রামায়ণে জনককন্যা সীতার বিবাহ অনুষ্ঠানে জনক রাজা ভোজসভায় কিভাবে অতিথি সৎকারের আয়োজন করেছিলেন, তার বিস্তৃত বর্ণনা পাই। “ঘৃত দুগ্ধে জনক করিলা সরোবর/ স্থানে স্থানে ভাণ্ডার করিল মনোহর।/রাশি রাশি তন্ডুল মিষ্টান্ন কাঁড়ি কাঁড়ি,/স্থানে স্থানে রাখে রাজা লক্ষ লক্ষ হাঁড়ি”। অন্যত্র, ভারে ভারে দধি দুগ্ধ ভারে ভারে কলা,/ ভারে ভারে ক্ষীর ঘৃত শর্করা উজলা।/সন্দেশের ভার লয়ে গেল ভারিগণ,/ অধিবাস করিবারে চলেন ব্রাহ্মণ”।
প্রাকৃত বাঙালির খাদ্য প্রসঙ্গে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থে বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন। তিনি প্রাকৃতপৈঙ্গল গ্রন্থ থেকে সেযুগের বাঙালির একটি চমৎকার খাদ্যতালিকার উল্লেখ করেছেন, যেমন-“ ওগ্গরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুত্তা।/মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা পুনবত্তা”। অর্থাৎ যে নারী কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল, নালিতা বা পাটশাক পরিবেশন করতে পারেন, তাঁর স্বামী যে যথার্থই পুণ্যবান তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ কিন্তু সে যুগের অতি সাধারণ দৈনন্দিন খাওয়া।
‘নৈষধকাব্য’-র লেখক শ্রীহট্ট খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের কবি। মহাভারতের নল ও দময়ন্তীর উপাখ্যান অবলম্বনেই এই কাব্য বিরচিত। এই কাব্যের এক বড় অংশ জুড়ে আছে বিদর্ভ-রাজ ভীমের কন্যা দময়ন্তীর সঙ্গে নিষাদ-রাজ নলের বিবাহ ও সেই উপলক্ষ্যে আয়োজিত ভোজের সরস বর্ণনা। সাধারণ ভাত থেকে শুরু করে নানাবিধ আমিষ, নিরামিষ পদ, চাটনি, দই কিছু বাদ যায়নি। বর্ণনার গুণে সাধারণ ভাতও হয়ে উঠেছে অনন্য। “সেই লোকেরা সাগ্রহে ভাত খেলেন। তাতে ধোঁয়া উঠছিল, তা ভাঙ্গা নয়, গোটা পরস্পর আলাদা, কোমলতাভাব হারায়নি, সুস্বাদু, সাদা, সরু, সুগন্ধযুক্ত”। এই ত্রুটিশূন্য ভাত রন্ধন প্রক্রিয়া কিন্তু মোটেই সহজ নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে এই কর্মসাধন নব্য বাঙালি গৃহিণীর পক্ষে কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। দই-এর বিবরণ দিতে গিয়ে কবি লিখলেন, “অমৃতের হ্রদ থেকে তুলে আনা পাঁকের মতো” ইত্যাদি। বিয়ের ‘ভোজবস্তু’র সম্বন্ধে শ্রীহর্ষ একটি শ্লোক লিখেছিলেন যে ‘নানাপ্রকার মৎস্য, হরিণ, ছাগ ও পক্ষির মাংসের দ্বারা সূক্ষ্ম সুস্বাদু এবং সুগন্ধি এত রকমের ব্যঞ্জন প্রস্তুত করা হইয়াছিল যে, লোকে তাহা খাইয়া শেষ করা তো দূরের কথা, কেহ তাহার সংখ্যা করিতেও সমর্থ হন নাই”। (‘নৈষধীচরিত’, শ্রীহর্ষ, অনুবাদক, ডঃ করুণাসিন্ধু দাস, কলকাতা, ১৯৮২)
কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে শুরু করে আধুনিক লেখকদের রচনায় আমরা সর্বকালের বাঙালির খাদ্যরুচির পরিচয় পাই। কৃত্তিবাসের রামায়ণে জনককন্যা সীতার বিবাহ অনুষ্ঠানে জনক রাজা ভোজসভায় কিভাবে অতিথি সৎকারের আয়োজন করেছিলেন, তার বিস্তৃত বর্ণনা পাই। “ঘৃত দুগ্ধে জনক করিলা সরোবর/ স্থানে স্থানে ভাণ্ডার করিল মনোহর।/রাশি রাশি তন্ডুল মিষ্টান্ন কাঁড়ি কাঁড়ি,/স্থানে স্থানে রাখে রাজা লক্ষ লক্ষ হাঁড়ি”। অন্যত্র, ভারে ভারে দধি দুগ্ধ ভারে ভারে কলা,/ ভারে ভারে ক্ষীর ঘৃত শর্করা উজলা।/সন্দেশের ভার লয়ে গেল ভারিগণ,/ অধিবাস করিবারে চলেন ব্রাহ্মণ”।
প্রাকৃত বাঙালির খাদ্য প্রসঙ্গে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থে বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন। তিনি প্রাকৃতপৈঙ্গল গ্রন্থ থেকে সেযুগের বাঙালির একটি চমৎকার খাদ্যতালিকার উল্লেখ করেছেন, যেমন-“ ওগ্গরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুত্তা।/মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা পুনবত্তা”। অর্থাৎ যে নারী কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল, নালিতা বা পাটশাক পরিবেশন করতে পারেন, তাঁর স্বামী যে যথার্থই পুণ্যবান তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ কিন্তু সে যুগের অতি সাধারণ দৈনন্দিন খাওয়া।
‘নৈষধকাব্য’-র লেখক শ্রীহট্ট খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের কবি। মহাভারতের নল ও দময়ন্তীর উপাখ্যান অবলম্বনেই এই কাব্য বিরচিত। এই কাব্যের এক বড় অংশ জুড়ে আছে বিদর্ভ-রাজ ভীমের কন্যা দময়ন্তীর সঙ্গে নিষাদ-রাজ নলের বিবাহ ও সেই উপলক্ষ্যে আয়োজিত ভোজের সরস বর্ণনা। সাধারণ ভাত থেকে শুরু করে নানাবিধ আমিষ, নিরামিষ পদ, চাটনি, দই কিছু বাদ যায়নি। বর্ণনার গুণে সাধারণ ভাতও হয়ে উঠেছে অনন্য। “সেই লোকেরা সাগ্রহে ভাত খেলেন। তাতে ধোঁয়া উঠছিল, তা ভাঙ্গা নয়, গোটা পরস্পর আলাদা, কোমলতাভাব হারায়নি, সুস্বাদু, সাদা, সরু, সুগন্ধযুক্ত”। এই ত্রুটিশূন্য ভাত রন্ধন প্রক্রিয়া কিন্তু মোটেই সহজ নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে এই কর্মসাধন নব্য বাঙালি গৃহিণীর পক্ষে কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। দই-এর বিবরণ দিতে গিয়ে কবি লিখলেন, “অমৃতের হ্রদ থেকে তুলে আনা পাঁকের মতো” ইত্যাদি। বিয়ের ‘ভোজবস্তু’র সম্বন্ধে শ্রীহর্ষ একটি শ্লোক লিখেছিলেন যে ‘নানাপ্রকার মৎস্য, হরিণ, ছাগ ও পক্ষির মাংসের দ্বারা সূক্ষ্ম সুস্বাদু এবং সুগন্ধি এত রকমের ব্যঞ্জন প্রস্তুত করা হইয়াছিল যে, লোকে তাহা খাইয়া শেষ করা তো দূরের কথা, কেহ তাহার সংখ্যা করিতেও সমর্থ হন নাই”। (‘নৈষধীচরিত’, শ্রীহর্ষ, অনুবাদক, ডঃ করুণাসিন্ধু দাস, কলকাতা, ১৯৮২)
মধ্যযুগের বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে বাঙালির খাওয়াদাওয়া নিয়ে সরস চর্চা। পঞ্চদশ শতকে লেখা মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলকে তো অন্যতম শ্রেষ্ট মঙ্গলকাব্য বলা হয়ে থাকে। চণ্ডীমঙ্গলে’ বাঙালির রান্নাবান্না এবং ভোজনবিলাসের এত বিবরণ মেলে যে ‘মাছ আর বাঙালি’ গ্রন্থের লেখক রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মশাই তো এই মঙ্গল কাব্যকে “তখনকার বাঙালিদের দৈনন্দিন জীবন আর বিশেষ করে খাওয়াদাওয়ার খবরের ভাঁড়ার” আখ্যা দিয়েছেন।
শষ্যশ্যামলা এই বঙ্গভূমিতে সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য ভাতের সঙ্গে শাক খাওয়ার যথেষ্ট চল ছিল সে যুগে। কিভাবে সেই শাক সংগ্রহ করা হত তার বিস্তৃত বিবরণ পাই মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যগ্রন্থেও। “নটে রাঙ্গা তোলে শাক পালঙ্গ নালিতা,/ তিক্ত ফলতার শাক কলতা পলতা।/ সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা,/ হিজলী কলমী শাক জাঙ্গি ডাঁডি পলা।/নটুয়া বেথুয়া তোলে ফিরে ক্ষেতে ক্ষেতে,/ মহুরী শুলকা ধন্যা ক্ষীর পাই বেতে”। খুল্লনার শুক্তো রান্নার পদ্ধতির বিবরণ দিতেও ভোলেননি কবি। “বেগুন কুমড়া কড়া, কাঁচকলা দিয়া শাড়া/ বেসন পিটালী ঘন কাঠি।/ শুক্তা রন্ধন পরিপাটি”।
শ্রীক্ষেত্রে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের বাড়িতে শ্রীচৈতন্যদেব যে নিরামিষ পদ খেয়েছিলেন তার বর্ণনা মেলে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ। যেমন-“ দশবিধ শাক নিম্ব তিক্ত শুক্তার ঝোল,/ মরিচের ঝালে ছেড়াবড়ি বড়া ঘোল।/ দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী নাফরা,/ মোচা ঘন্ট, মোচা ভাজা বিবিধ শাকেরা”।
বাঙালির মৎস্যপ্রীতির কথা প্রসঙ্গে বাংলা প্রবাদ “মাছের নামে গাছও হাঁ করে” বহুল প্রচলিত। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ লিখেছেন, “বাঙালি যখন দুটি পদে খাওয়ার কথা বলে, তখন হয় বলে ডাল-ভাত, না হয় দুধ-ভাত, অথবা মাছ-ভাত”। মাছ-ভাত বলতে কী বোঝে বাঙালি তার বিস্তর নমুনা মেলে বঙ্গ সাহিত্যে। এবিষয়ে উনিশ শতকের খাদ্যরসিক কবি ঈশ্বর গুপ্ত যা লিখে গেছেন তা একেবারে যথার্থ কথা। “ ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল/ ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল”। দ্বিজ বংশীদাস তাঁর ‘মনসামঙ্গল’ গ্রন্থে লিখেছেন- “নিরামিষ রান্ধে সব ঘৃতে সম্ভারিয়া।/ মৎস্যের ব্যঞ্জন রান্ধে তৈল পাক দিয়া।/বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি।/ জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি।।/ কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি।/ চিতলের কোল ভাজে রস বাস মাখি”।
ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর মৎস্যপ্রেমের ঝুড়ি ঝুড়ি নমুনা রেখে গেছেন তাঁর রচিত কবিতাগুলির মধ্যে। তপসে মাছের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখলেন, “কষিত কনককান্তি কমনীয় কায়।/গালভরা গোঁফ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়।/ মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে।/মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে।।/ পাখি নও কিন্তু ধর মনোহর পাখা।/সুমধুর মিষ্ট রস সব অঙ্গে মাখা”। গলদা চিংড়ি নিয়ে গুপ্ত কবি লিখলেন, “জলের ভিতর মাছ কত রস ভরা।/ দাড়ী গোঁপ জটাধারী জামাজোড়া পরা”। “গলদা চিংড়ি মাছ নাম যার মোচা।/ পড়েছে চরণতলে এলাইয়া কোঁচা”।
শুধু কী মাছ? মাংস খাওয়ার বর্ণনাও মেলে চর্যাপদের নানা লেখায়। গরু, খাসি এবং হরিণের মাংস শুধু নয়, নানাবিধ পক্ষী মাংস খাওয়ার চল ছিল সেই মধুযুগের সময় থেকে। স্বাদু হরিণের মাংস প্রসঙ্গে চর্যাপদে পাই, ”আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”। অর্থাৎ হরিণের মাংসের এতই সুখ্যাতি ছিল যে সবাই বনে এসেই হরিণ খুঁজে শিকার করে।
বিজয়গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গলে লিখেছেন, “মাংসতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল,/ ছাইল খসাইয়া রান্ধে বুইড়া খাসীর তেল”। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যেও নানাবিধ মাংস নানা ভাবের রান্নার সরস বর্ণনা পাই। যেমন- “কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝোল ঝোল রসা/ কালিয়া দোল্মা বাঘা সেক্চি সমসা।/ অন্য মাংস শিক ভাজা কাবাব করিয়া / রান্ধিলেন মুড়া আগে মশলা পুরিলা”।
শষ্যশ্যামলা এই বঙ্গভূমিতে সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য ভাতের সঙ্গে শাক খাওয়ার যথেষ্ট চল ছিল সে যুগে। কিভাবে সেই শাক সংগ্রহ করা হত তার বিস্তৃত বিবরণ পাই মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যগ্রন্থেও। “নটে রাঙ্গা তোলে শাক পালঙ্গ নালিতা,/ তিক্ত ফলতার শাক কলতা পলতা।/ সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা,/ হিজলী কলমী শাক জাঙ্গি ডাঁডি পলা।/নটুয়া বেথুয়া তোলে ফিরে ক্ষেতে ক্ষেতে,/ মহুরী শুলকা ধন্যা ক্ষীর পাই বেতে”। খুল্লনার শুক্তো রান্নার পদ্ধতির বিবরণ দিতেও ভোলেননি কবি। “বেগুন কুমড়া কড়া, কাঁচকলা দিয়া শাড়া/ বেসন পিটালী ঘন কাঠি।/ শুক্তা রন্ধন পরিপাটি”।
শ্রীক্ষেত্রে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের বাড়িতে শ্রীচৈতন্যদেব যে নিরামিষ পদ খেয়েছিলেন তার বর্ণনা মেলে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ। যেমন-“ দশবিধ শাক নিম্ব তিক্ত শুক্তার ঝোল,/ মরিচের ঝালে ছেড়াবড়ি বড়া ঘোল।/ দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী নাফরা,/ মোচা ঘন্ট, মোচা ভাজা বিবিধ শাকেরা”।
বাঙালির মৎস্যপ্রীতির কথা প্রসঙ্গে বাংলা প্রবাদ “মাছের নামে গাছও হাঁ করে” বহুল প্রচলিত। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ লিখেছেন, “বাঙালি যখন দুটি পদে খাওয়ার কথা বলে, তখন হয় বলে ডাল-ভাত, না হয় দুধ-ভাত, অথবা মাছ-ভাত”। মাছ-ভাত বলতে কী বোঝে বাঙালি তার বিস্তর নমুনা মেলে বঙ্গ সাহিত্যে। এবিষয়ে উনিশ শতকের খাদ্যরসিক কবি ঈশ্বর গুপ্ত যা লিখে গেছেন তা একেবারে যথার্থ কথা। “ ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল/ ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল”। দ্বিজ বংশীদাস তাঁর ‘মনসামঙ্গল’ গ্রন্থে লিখেছেন- “নিরামিষ রান্ধে সব ঘৃতে সম্ভারিয়া।/ মৎস্যের ব্যঞ্জন রান্ধে তৈল পাক দিয়া।/বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি।/ জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি।।/ কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি।/ চিতলের কোল ভাজে রস বাস মাখি”।
ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর মৎস্যপ্রেমের ঝুড়ি ঝুড়ি নমুনা রেখে গেছেন তাঁর রচিত কবিতাগুলির মধ্যে। তপসে মাছের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখলেন, “কষিত কনককান্তি কমনীয় কায়।/গালভরা গোঁফ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়।/ মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে।/মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে।।/ পাখি নও কিন্তু ধর মনোহর পাখা।/সুমধুর মিষ্ট রস সব অঙ্গে মাখা”। গলদা চিংড়ি নিয়ে গুপ্ত কবি লিখলেন, “জলের ভিতর মাছ কত রস ভরা।/ দাড়ী গোঁপ জটাধারী জামাজোড়া পরা”। “গলদা চিংড়ি মাছ নাম যার মোচা।/ পড়েছে চরণতলে এলাইয়া কোঁচা”।
শুধু কী মাছ? মাংস খাওয়ার বর্ণনাও মেলে চর্যাপদের নানা লেখায়। গরু, খাসি এবং হরিণের মাংস শুধু নয়, নানাবিধ পক্ষী মাংস খাওয়ার চল ছিল সেই মধুযুগের সময় থেকে। স্বাদু হরিণের মাংস প্রসঙ্গে চর্যাপদে পাই, ”আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”। অর্থাৎ হরিণের মাংসের এতই সুখ্যাতি ছিল যে সবাই বনে এসেই হরিণ খুঁজে শিকার করে।
বিজয়গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গলে লিখেছেন, “মাংসতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল,/ ছাইল খসাইয়া রান্ধে বুইড়া খাসীর তেল”। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যেও নানাবিধ মাংস নানা ভাবের রান্নার সরস বর্ণনা পাই। যেমন- “কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝোল ঝোল রসা/ কালিয়া দোল্মা বাঘা সেক্চি সমসা।/ অন্য মাংস শিক ভাজা কাবাব করিয়া / রান্ধিলেন মুড়া আগে মশলা পুরিলা”।
সেই প্রাচীনকালে বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় এইভাবে শুধু যে বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির ছবি পাই তাই নয়, রান্নার নানাবিধ উপকরণ, প্রণালী -তারও বিস্তৃত উল্লেখ পাই। আশ্চর্য লাগে যখন দেখি আজও বাঙালির খাদ্যতালিকা থেকে সেসবের মধ্যে কিছু পদ কিন্তু এখনও বিস্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে যায়নি। এই মূহুর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে আজকের বাঙালির একটি প্রিয় পদ ‘আমশোল’ -এর কথা। মুকুন্দরাম তাঁর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে খুল্লনার মাছরান্নার যে বিবরণ দিয়েছেন তার মধ্যেও কিন্তু এই পদটির উল্লেখ মেলে। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর ‘মাছ আর বাঙালি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ …খুল্লনার মাছ রান্নায় কিছু হেরফের দেখা যায়। যেমন কাঁঠালবিচি দিয়ে চিংড়ি, খরশোলা মাছ ভাজা, আর শোলমাছের কাঁটা বের করে কাঁচা আমের সঙ্গে রান্না”।
একটা সময়ে বাংলার হোটেল রেস্তোরাঁতে যেমন মোগলাই রান্নার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তেমনি প্রভাব পড়েছিল নানাবিধ ইউরোপীয় রন্ধনপ্রক্রিয়ার। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে নদের ফটিক চাঁদের এখন আর মালপো ভোগে তেমন আস্থা নেই। কেবল ফাউল কারি কতখানি স্বাদু হল তাই নিয়ে তার চিন্তার অবধি নেই। কিন্তু তাঁর ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থে খাদ্য প্রসঙ্গে বঙ্কিম আবার এক অন্য চিত্র এঁকেছেন। এখানে আহার্য বস্তুর সঙ্গে লীন হয়ে গেছে পরিবেশনকারিণীর মমতা ও স্নেহরস। নিমি ক্ষুধার্ত জীবানন্দকে কত যত্নে কী পরিবেশন করেছিল সেদিন তার এক অপূর্ব বিবরণ দিয়েছেন লেখক। “নিমি পিঁড়ি পাতিয়া জলছড়া দিয়া জায়গা মুছিয়া মল্লিকাফুলের মত পরিষ্কার অন্ন, কাঁচা কলাইয়ের ডাল, জঙ্গুলে ডুমুরের ডাল্না, পুকুরের রুইমাছের ঝোল এবং দুগ্ধ আনিয়া জীবানন্দকে খাইতে দিল”।
রবীন্দ্রনাথের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাতেও সেই একই ভাবনা। “শোভন হাতের সন্দেশ পানতোয়া/ মাছ-মাংসের পোলাও ইত্যাদিও/ যবে দেখা দেয় সেবামাধুর্যে ছোঁওয়া/ তখন সে হয় কী অনিবর্চনীয়”। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসেও পরিবেশনকারিনী ও পরিবেশিত ভোজ্যের অপরূপ সংযোগের যে বর্ণনা মেলে তা এক কথায় অনবদ্য। বিনোদিনীর পরিবেশনের নিপুণতা বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “মোরাদাবাদি খুঞ্চের উপর থালায় ফল, সন্দেশ এবং রেকাবে বরফ চিনি সংযুক্ত সুগন্ধি দলিত খরমুজ লইয়া বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিল”। এই ভাবে খাদ্য প্রসঙ্গ বারবার উঠে এসেছে তাঁর ছোট গল্প, উপন্যাস এমন কি তাঁর কবিতাতেও। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে ইস্টিমার যাত্রা কালে কমলা রুই মাছ রান্না ক’রে রমেশকে খাওয়ালে চমৎকৃত রমেশ বলে ওঠে, “এ তো স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়- এ যে সত্যই মুড়ো- যাহাকে বলে রোহিত মৎস্য তাহারই উত্তমাঙ্গ”।
ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা জয়শ্রীর সঙ্গে কুলদাপ্রসাদ সেনের বিবাহ উপলক্ষ্যে লেখা কবিতাতে আছে কবির প্রিয় মাছ প্রসঙ্গ। “যদি কোন শুভদিনে ভর্তা না ভর্ৎসে/ বেশি ব্যয় হয়ে পড়ে পাকা রুই মৎস্যে।/ কালিয়ার সৌরভে প্রাণ যবে উতলায়/ ভোজনে দুজনে শুধু বসিবে কি দুতলায়।/ লোভী এ কবির নাম মনে রেখো বৎসে”।
একটা সময়ে বাংলার হোটেল রেস্তোরাঁতে যেমন মোগলাই রান্নার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তেমনি প্রভাব পড়েছিল নানাবিধ ইউরোপীয় রন্ধনপ্রক্রিয়ার। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে নদের ফটিক চাঁদের এখন আর মালপো ভোগে তেমন আস্থা নেই। কেবল ফাউল কারি কতখানি স্বাদু হল তাই নিয়ে তার চিন্তার অবধি নেই। কিন্তু তাঁর ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থে খাদ্য প্রসঙ্গে বঙ্কিম আবার এক অন্য চিত্র এঁকেছেন। এখানে আহার্য বস্তুর সঙ্গে লীন হয়ে গেছে পরিবেশনকারিণীর মমতা ও স্নেহরস। নিমি ক্ষুধার্ত জীবানন্দকে কত যত্নে কী পরিবেশন করেছিল সেদিন তার এক অপূর্ব বিবরণ দিয়েছেন লেখক। “নিমি পিঁড়ি পাতিয়া জলছড়া দিয়া জায়গা মুছিয়া মল্লিকাফুলের মত পরিষ্কার অন্ন, কাঁচা কলাইয়ের ডাল, জঙ্গুলে ডুমুরের ডাল্না, পুকুরের রুইমাছের ঝোল এবং দুগ্ধ আনিয়া জীবানন্দকে খাইতে দিল”।
রবীন্দ্রনাথের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাতেও সেই একই ভাবনা। “শোভন হাতের সন্দেশ পানতোয়া/ মাছ-মাংসের পোলাও ইত্যাদিও/ যবে দেখা দেয় সেবামাধুর্যে ছোঁওয়া/ তখন সে হয় কী অনিবর্চনীয়”। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসেও পরিবেশনকারিনী ও পরিবেশিত ভোজ্যের অপরূপ সংযোগের যে বর্ণনা মেলে তা এক কথায় অনবদ্য। বিনোদিনীর পরিবেশনের নিপুণতা বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “মোরাদাবাদি খুঞ্চের উপর থালায় ফল, সন্দেশ এবং রেকাবে বরফ চিনি সংযুক্ত সুগন্ধি দলিত খরমুজ লইয়া বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিল”। এই ভাবে খাদ্য প্রসঙ্গ বারবার উঠে এসেছে তাঁর ছোট গল্প, উপন্যাস এমন কি তাঁর কবিতাতেও। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে ইস্টিমার যাত্রা কালে কমলা রুই মাছ রান্না ক’রে রমেশকে খাওয়ালে চমৎকৃত রমেশ বলে ওঠে, “এ তো স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়- এ যে সত্যই মুড়ো- যাহাকে বলে রোহিত মৎস্য তাহারই উত্তমাঙ্গ”।
ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা জয়শ্রীর সঙ্গে কুলদাপ্রসাদ সেনের বিবাহ উপলক্ষ্যে লেখা কবিতাতে আছে কবির প্রিয় মাছ প্রসঙ্গ। “যদি কোন শুভদিনে ভর্তা না ভর্ৎসে/ বেশি ব্যয় হয়ে পড়ে পাকা রুই মৎস্যে।/ কালিয়ার সৌরভে প্রাণ যবে উতলায়/ ভোজনে দুজনে শুধু বসিবে কি দুতলায়।/ লোভী এ কবির নাম মনে রেখো বৎসে”।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন রচনাতে বেশ বিস্তৃত ভাবে খাদ্য প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। নিজের খিদে চাগিয়ে রাখার কারণ দর্শাতে তিনি একবার লিখলেন, “প্রথমে ভাতের সঙ্গে প্রচুর ঘি আর আলুভাতে; দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘন ভাজা অড়হরডাল, আলুর বড় তরকারি- প্রচুর তৈলসিক্ত; তৃতীয় পর্যায়ে একবাটি মহিষের দুধ ঘন ক’রে জ্বাল দেওয়া। ঘি আর দুধ একেবারে খাঁটি। দুধটা বাবা সংগ্রহ ক্রবার চেষ্টা এমন মহিষের, যার শেষের দিকের দুধটা শুকিয়ে ঘন হ’য়ে এসেছে”। এই ভোজের জন্য প্রয়োজনে উপোস করে খিদে চাগিয়ে রাখা লেখকের পক্ষে মোটেই কোন সমস্যা ছিলনা।
‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসে পল্লীগ্রামের জীবনের এক বাস্তব চিত্র বিভূতিভূষণ তুলে ধরেছেন। হরিহর-সর্বজয়ার অভাব অনটনের সংসার। ওদের সন্তান অপু, দুর্গার সামান্য খাদ্য বস্তু আস্বাদনে কী নির্মল আনন্দ! এই প্রসঙ্গে অপু, দুর্গা সম্বন্ধে লেখক নিজের উপলব্ধির কথা তুলে ধরেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। “জন্মিয়া পর্যন্ত ইহারা কখনো কোন ভাল জিনিস খাইতে পায় নাই। অথচ পৃথিবীতে ইহারা নূতন আসিয়াছে, জিহ্বা ইহাদের নূতন- তাহা পৃথিবীর নানা রস, বিশেষত মিষ্ট রস আস্বাদ করিবার জন্য লালায়িত। সন্দেশ মিঠাই কিনিয়া সে পরিতৃপ্তি লাভ করিবার সুযোগ ইহাদের ঘটে না- বিশ্বের অনন্ত সম্পদের মধ্যে তুচ্ছ বনগাছ হইতে আহরণরত এই সব লুব্ধ দরিদ্র ঘরের বালকবালিকাদের জন্য তাই করুণাময়ী বনদেবীরা তুচ্ছ ফলমূল মিষ্টি মধুতে ভরাইয়া রাখেন”। দুর্গা তাই বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় পানিফল, কাঁচা আম, নোনা, আঁশ, শেওড়া ফলের সন্ধানে। বাবার সঙ্গে মহাজনের বাড়িতে গিয়ে মোহনভোগ খেয়ে অপু অবাক হয়। প্রচুর কিসমিস মেশানো এই মোহনভোগ রান্না হয়েছে এত ঘি দিয়ে, মুখে দিতেই অপুর আঙ্গুল ঘিতে মাখামাখি হয়ে গেল। এমন স্বাদু মোহনভোগ সে আগে কখনো খায়নি। জলে সেদ্ধ করা সুজিতে গুড় মিশিয়ে পুলটিসের মতো মায়ের তৈরি দ্রব্যটি যা এতদিন সে মোহনভোগ ভেবে খেয়ে যারপরনাই তৃপ্ত হয়েছে, তার সঙ্গে মহাজনের বাড়ির মোহনভোগের স্বাদের আকাশ-পাতাল তফাৎ। তার মনে হল তার মাও বোধ হয় জানে না যে, এরকমের মোহনভোগ হয়। মায়ের প্রতি করুনা ও সহানুভুতিতে অপুর মন ব্যথিত হল। আবছা ভাবে সে বুঝতে পারল, তারা গরীব আর তাই তাদের বাড়িতে ভালো খাওয়াদাওয়া হয় না।
সাহিত্য জগতের তা’বড় তা’বড় লেখক/কবি ইলিশ নিয়ে বিশেষ কিছু না লিখলেও, রসরাজ অমৃতলাল বসু কিন্তু তাঁর কবিতায় ইলিশ খাওয়ার মজা শুধু নয় রন্ধনপ্রণালীর খুঁটিনাটিও পেশ করেছেন অতি সরস ভঙ্গীতে। যেমন- “কাঁচা ইলিশের ঝোল কাঁচা লঙ্কা চিরে।/ ভুলিবে না খেয়েছে যে বসে পদ্মাতীরে।।/ভাজিলে ঝালের ঝোলে ইলিশ অসার।/ কাঁচাতে অরুচি রুচি মাখনের তার”। বা, “সর্ষে-বাটা দিয়ে তাতে মাখাইয়া দধি।/ আ মরি আহার হবে রেঁধে খাও যদি”।
‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসে পল্লীগ্রামের জীবনের এক বাস্তব চিত্র বিভূতিভূষণ তুলে ধরেছেন। হরিহর-সর্বজয়ার অভাব অনটনের সংসার। ওদের সন্তান অপু, দুর্গার সামান্য খাদ্য বস্তু আস্বাদনে কী নির্মল আনন্দ! এই প্রসঙ্গে অপু, দুর্গা সম্বন্ধে লেখক নিজের উপলব্ধির কথা তুলে ধরেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। “জন্মিয়া পর্যন্ত ইহারা কখনো কোন ভাল জিনিস খাইতে পায় নাই। অথচ পৃথিবীতে ইহারা নূতন আসিয়াছে, জিহ্বা ইহাদের নূতন- তাহা পৃথিবীর নানা রস, বিশেষত মিষ্ট রস আস্বাদ করিবার জন্য লালায়িত। সন্দেশ মিঠাই কিনিয়া সে পরিতৃপ্তি লাভ করিবার সুযোগ ইহাদের ঘটে না- বিশ্বের অনন্ত সম্পদের মধ্যে তুচ্ছ বনগাছ হইতে আহরণরত এই সব লুব্ধ দরিদ্র ঘরের বালকবালিকাদের জন্য তাই করুণাময়ী বনদেবীরা তুচ্ছ ফলমূল মিষ্টি মধুতে ভরাইয়া রাখেন”। দুর্গা তাই বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় পানিফল, কাঁচা আম, নোনা, আঁশ, শেওড়া ফলের সন্ধানে। বাবার সঙ্গে মহাজনের বাড়িতে গিয়ে মোহনভোগ খেয়ে অপু অবাক হয়। প্রচুর কিসমিস মেশানো এই মোহনভোগ রান্না হয়েছে এত ঘি দিয়ে, মুখে দিতেই অপুর আঙ্গুল ঘিতে মাখামাখি হয়ে গেল। এমন স্বাদু মোহনভোগ সে আগে কখনো খায়নি। জলে সেদ্ধ করা সুজিতে গুড় মিশিয়ে পুলটিসের মতো মায়ের তৈরি দ্রব্যটি যা এতদিন সে মোহনভোগ ভেবে খেয়ে যারপরনাই তৃপ্ত হয়েছে, তার সঙ্গে মহাজনের বাড়ির মোহনভোগের স্বাদের আকাশ-পাতাল তফাৎ। তার মনে হল তার মাও বোধ হয় জানে না যে, এরকমের মোহনভোগ হয়। মায়ের প্রতি করুনা ও সহানুভুতিতে অপুর মন ব্যথিত হল। আবছা ভাবে সে বুঝতে পারল, তারা গরীব আর তাই তাদের বাড়িতে ভালো খাওয়াদাওয়া হয় না।
সাহিত্য জগতের তা’বড় তা’বড় লেখক/কবি ইলিশ নিয়ে বিশেষ কিছু না লিখলেও, রসরাজ অমৃতলাল বসু কিন্তু তাঁর কবিতায় ইলিশ খাওয়ার মজা শুধু নয় রন্ধনপ্রণালীর খুঁটিনাটিও পেশ করেছেন অতি সরস ভঙ্গীতে। যেমন- “কাঁচা ইলিশের ঝোল কাঁচা লঙ্কা চিরে।/ ভুলিবে না খেয়েছে যে বসে পদ্মাতীরে।।/ভাজিলে ঝালের ঝোলে ইলিশ অসার।/ কাঁচাতে অরুচি রুচি মাখনের তার”। বা, “সর্ষে-বাটা দিয়ে তাতে মাখাইয়া দধি।/ আ মরি আহার হবে রেঁধে খাও যদি”।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘ইলশে গুঁড়ি’ কবিতায় বৃষ্টির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে ইলিশের ডিম ও ইলিশের নাচের কথা লিখেছেন। “ ইল্শে গুঁড়ি! ইল্শে গুঁড়ি!/ ইলিশ মাছের ডিম।/ ইল্শে গুঁড়ি! ইল্শে গুঁড়ি!/ দিনের বেলায় হিম”। বা, “—হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায় /ইল্শে গুঁড়ির নাচ-/ ইল্শে গুঁড়ির নাচন দেখে/ নাচছে ইলিশ মাছ”।
সাহিত্যে ইলিশ প্রসঙ্গে ভোজনবিলাসী কবি-ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসুর নাম উল্লেখ করতেই হয়। তিনি তাঁর ‘গোলাপ কেন কালো’ উপন্যাসে ইলিশের নানা পদের এক ভারি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। “আবার কোনদিন হয়তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইলিশ – ভাজা, সর্ষেতে ভাপানো, কলাপাতায় পোড়া পোড়া পাতুরি, কচি কুমড়োর সঙ্গে কালোজিরের ঝোল, ল্যাজা-মুড়োর সদ্গতি হ’লো কাঁচালঙ্কা-ছিটোনো লেবুর রসের পাৎলা অম্বলে”।
ক্ষীণদেহী বুদ্ধদেব বসু স্বল্পাহারী হলেও বাংলা রান্নার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিলেন। আমিষ, নিরামিষ পদের স্বাদ সম্বন্ধে তাঁর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ তাঁর লেখনীর গুণে পৌঁছে গেছে অন্য মাত্রায়। ‘গোলাপ কেন কালো’ উপন্যাসে, তিনি যেমন বাংলা রান্না প্রসঙ্গে আমিষ রান্নার খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনি তিনি তুলে ধরেছেন বাংলা নিরামিষ রান্নার শৈল্পিক স্বাদু দিক। ‘নিরিমিষ’ রান্নার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখলেন- “…সে আবার অন্য এক জগৎ। সেখানকার বাসিন্দারা ভারি বিনয়ী, ছেঁচকি, ঘন্ট, শাক, শুক্তো এই সব অনুজ্জ্বল নামে বিরাজ করে, কুমড়োবীচি লাউয়ের খোশার মতো অঁচা জিনিসও সেখানে সম্মানিত। কিন্তু ঐ সব বিজ্ঞাপনহীন সৃষ্টি থেকে যা আস্বাদ বেরিয়ে আসে তা প্যারিসের সেরা রাঁধুনির কল্পনাতীত”।
বাঙালির শেষ পাতে মিষ্টি না হলে তার খাওয়া কিন্তু অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মাছের মত মিষ্টি পদও বাঙালির সেকালে শুধু নয় আজও প্রিয়। দ্বিজ বংশীদাস তাঁর মনসামঙ্গল কাব্যে সনকার মিষ্টান্নপাকের এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। “কত যত ব্যঞ্জন যে নাহি লেখা জোখা।/ পরমান্ন পিষ্টক যে রান্ধিছে সনকা।/ ঘৃত পোয়া চন্দ্রকাইট আর দুগ্ধপুলি।/ আইল বড়া ভাজিলেক ঘৃতের মিশালি।/জাতি পুলি ক্ষীর পুলি চিতলোটী আর।/মনোহরা রান্ধিলেক অনেক প্রকার”।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ কবিবর ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে তাঁর সময়ের মিষ্টান্ন পাক নিয়ে কী লিখেছেন পড়ে দেখুন- “অম্বল রাধিয়া রামা আরম্ভিলা পিঠা।/ বড়া হলো আশিকা পিযুষী পুরি পুলি/ চুটি রুটি রাম রোট মুগের শামুলী।/ কলাবড়া ঘিওর পাঁপর ভাজা পুলি/ সুধা রুচি মুচি মুচি লুচি কতগুলি।/ পিঠা হৈল পরে পরমান্ন আরম্ভিল” ইত্যাদি ইত্যাদি।
লোকমুখে শোনা যায় গৌরাঙ্গ প্রভুর নাকি মিষ্টান্নের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ ছিল এবং সেই কারণে তাঁর শিষ্যবৃন্দ তাঁর জন্য যা যা পদ রান্না করতেন তার মধ্যে অবশ্যই থাকত “ঘৃত দধি সর নবনী পিষ্টক/ নানাবিধ শর্করা সন্দেশ কদলক”। এর পাশাপাশি তাঁর মিষ্টান্নের তালিকায় থাকত- “মুদগবড়া মাষবড়া কলাবড়া মিষ্ট।/ ক্ষীরপুলি নারিকেলপুলি আর যত পিষ্ট”। এসবই লেখা আছে পঞ্চদশ শতকে রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ।
সাহিত্যে ইলিশ প্রসঙ্গে ভোজনবিলাসী কবি-ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসুর নাম উল্লেখ করতেই হয়। তিনি তাঁর ‘গোলাপ কেন কালো’ উপন্যাসে ইলিশের নানা পদের এক ভারি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। “আবার কোনদিন হয়তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইলিশ – ভাজা, সর্ষেতে ভাপানো, কলাপাতায় পোড়া পোড়া পাতুরি, কচি কুমড়োর সঙ্গে কালোজিরের ঝোল, ল্যাজা-মুড়োর সদ্গতি হ’লো কাঁচালঙ্কা-ছিটোনো লেবুর রসের পাৎলা অম্বলে”।
ক্ষীণদেহী বুদ্ধদেব বসু স্বল্পাহারী হলেও বাংলা রান্নার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিলেন। আমিষ, নিরামিষ পদের স্বাদ সম্বন্ধে তাঁর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ তাঁর লেখনীর গুণে পৌঁছে গেছে অন্য মাত্রায়। ‘গোলাপ কেন কালো’ উপন্যাসে, তিনি যেমন বাংলা রান্না প্রসঙ্গে আমিষ রান্নার খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনি তিনি তুলে ধরেছেন বাংলা নিরামিষ রান্নার শৈল্পিক স্বাদু দিক। ‘নিরিমিষ’ রান্নার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখলেন- “…সে আবার অন্য এক জগৎ। সেখানকার বাসিন্দারা ভারি বিনয়ী, ছেঁচকি, ঘন্ট, শাক, শুক্তো এই সব অনুজ্জ্বল নামে বিরাজ করে, কুমড়োবীচি লাউয়ের খোশার মতো অঁচা জিনিসও সেখানে সম্মানিত। কিন্তু ঐ সব বিজ্ঞাপনহীন সৃষ্টি থেকে যা আস্বাদ বেরিয়ে আসে তা প্যারিসের সেরা রাঁধুনির কল্পনাতীত”।
বাঙালির শেষ পাতে মিষ্টি না হলে তার খাওয়া কিন্তু অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মাছের মত মিষ্টি পদও বাঙালির সেকালে শুধু নয় আজও প্রিয়। দ্বিজ বংশীদাস তাঁর মনসামঙ্গল কাব্যে সনকার মিষ্টান্নপাকের এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। “কত যত ব্যঞ্জন যে নাহি লেখা জোখা।/ পরমান্ন পিষ্টক যে রান্ধিছে সনকা।/ ঘৃত পোয়া চন্দ্রকাইট আর দুগ্ধপুলি।/ আইল বড়া ভাজিলেক ঘৃতের মিশালি।/জাতি পুলি ক্ষীর পুলি চিতলোটী আর।/মনোহরা রান্ধিলেক অনেক প্রকার”।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ কবিবর ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে তাঁর সময়ের মিষ্টান্ন পাক নিয়ে কী লিখেছেন পড়ে দেখুন- “অম্বল রাধিয়া রামা আরম্ভিলা পিঠা।/ বড়া হলো আশিকা পিযুষী পুরি পুলি/ চুটি রুটি রাম রোট মুগের শামুলী।/ কলাবড়া ঘিওর পাঁপর ভাজা পুলি/ সুধা রুচি মুচি মুচি লুচি কতগুলি।/ পিঠা হৈল পরে পরমান্ন আরম্ভিল” ইত্যাদি ইত্যাদি।
লোকমুখে শোনা যায় গৌরাঙ্গ প্রভুর নাকি মিষ্টান্নের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ ছিল এবং সেই কারণে তাঁর শিষ্যবৃন্দ তাঁর জন্য যা যা পদ রান্না করতেন তার মধ্যে অবশ্যই থাকত “ঘৃত দধি সর নবনী পিষ্টক/ নানাবিধ শর্করা সন্দেশ কদলক”। এর পাশাপাশি তাঁর মিষ্টান্নের তালিকায় থাকত- “মুদগবড়া মাষবড়া কলাবড়া মিষ্ট।/ ক্ষীরপুলি নারিকেলপুলি আর যত পিষ্ট”। এসবই লেখা আছে পঞ্চদশ শতকে রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম হল পৌষপার্বণ। খাদ্য রসিক কবি ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর ‘পৌষ পার্বণে’ কবিতায় পিঠেপুলি উৎসবের এক সরস চিত্র এঁকেছেন। “আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।/ গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার।/ বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা। হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা”।
অথবা “এই মুগের ভাজাপুলি মুগ্ধ করে মুখ।/ বাসি খাও, তাজা খাও,কত তার সুখ”।
বাঙালির অন্যতম প্রধান মিষ্টি সন্দেশের ব্যবহার যথেষ্ট প্রাচীন। কৃত্তিবাস রচিত ‘রামায়ণ’ গ্রন্থে সন্দেশের উল্লেখ মেলে। কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণান্তে শ্রীচৈতন্য তিনদিন প্রেমাকুল অবস্থায় অনাহারে ঘুরে ফিরলেন। শেষে গঙ্গা পার হয়ে শান্তিপুরে অদ্বৈত ভবনে যে আহার গ্রহণ করলেন তাতে নানাবিধ পদের মধ্যে সন্দেশও উপস্থিত। “দুগ্ধ চিড়া, দুগ্ধ লকলকি কুণ্ডি ভরি/ চাঁপাকলা দধি সন্দেশ কহিতে না পারি”। (চৈতন্যচরিতামৃত)
দীনবন্ধু মিত্র ১৮৫২ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ‘জামাই ষষ্ঠী’ নামে যে দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন তাতেও সন্দেশের উল্লেখ আছে। নতুন জামাই শ্যালকবৃন্দের রঙ্গ রসিকতা, গান-বাজনা ও তাস,পাশা খেলার শেষে “মধুরেণ সমাপয়েৎ” করতে সন্দেশ কিনতে টাকা দিয়েছিলেন। “সেতার তবলা বাজে, খেলে দাবা তাস।/ সন্দেশের টাকা দেন হইয়ে উল্লাস”। শুধু সন্দেশ নয়, অন্যান্য মিষ্টির প্রতি দীনবন্ধুর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখাতে। ‘সুরধুনী’ কাব্যে দীনবন্ধু কৃষ্ণনগরের সরভাজা, সরপুরিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন।
১৮৬৯ সালে ডিউক অব এডিনবরা কলকাতাতে এলে, দীনবন্ধু লিখলেন, “বসো হে ডিউক ভাই হিন্দু ভাই-দলে / শ্বেত-শতদলমালা দিই তব গলে/ ক্ষীর সর নবনীত, মতিচুর মনোনীত,মনোহরা, চন্দ্রপুলি, গঠা সুকৌশলে,/ সমাদরে করি দান বদনে তোমার”।
জনশ্রুতি অনুসারে দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ও নাকি ভোজনরসিক ছিলেন। একবার নিরুপায় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে গুরুর নির্দেশে কলকাতার জলখাবার দিয়েই নাকি মা সরস্বতীকে ভোগ দিতে হয়েছিল। সেই উপলক্ষ্যে তিনি যে সংস্কৃত শ্লোকটি আউড়ে ছিলেন, তা হল “লুচী কচুরী মতিচুর শোভিতং/ জিলেপি সন্দেশ গজা বিরাজিতম্।/ যস্যাঃ প্রসাদেন ফলারমাপ্লুমঃ/ সরস্বতী সা জয়তান্নিরন্তরম্”।
রবীন্দ্রনাথও মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন। বাঙালির শেষ পাতে মিষ্টিমুখ ছাড়া ভোজন অসম্পূর্ণ। রবি ঠাকুরের ছেলেবেলায় লেখা এই কবিতার চাইতে স্বাদু ‘মিষ্টিমুখ’ আর কী হতে পারে! “আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,/ তাহাতে কদলি দলি/ সন্দেশ মাখিয়া লও তাতে/ হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ/ পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে”।
অথবা “এই মুগের ভাজাপুলি মুগ্ধ করে মুখ।/ বাসি খাও, তাজা খাও,কত তার সুখ”।
বাঙালির অন্যতম প্রধান মিষ্টি সন্দেশের ব্যবহার যথেষ্ট প্রাচীন। কৃত্তিবাস রচিত ‘রামায়ণ’ গ্রন্থে সন্দেশের উল্লেখ মেলে। কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণান্তে শ্রীচৈতন্য তিনদিন প্রেমাকুল অবস্থায় অনাহারে ঘুরে ফিরলেন। শেষে গঙ্গা পার হয়ে শান্তিপুরে অদ্বৈত ভবনে যে আহার গ্রহণ করলেন তাতে নানাবিধ পদের মধ্যে সন্দেশও উপস্থিত। “দুগ্ধ চিড়া, দুগ্ধ লকলকি কুণ্ডি ভরি/ চাঁপাকলা দধি সন্দেশ কহিতে না পারি”। (চৈতন্যচরিতামৃত)
দীনবন্ধু মিত্র ১৮৫২ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ‘জামাই ষষ্ঠী’ নামে যে দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন তাতেও সন্দেশের উল্লেখ আছে। নতুন জামাই শ্যালকবৃন্দের রঙ্গ রসিকতা, গান-বাজনা ও তাস,পাশা খেলার শেষে “মধুরেণ সমাপয়েৎ” করতে সন্দেশ কিনতে টাকা দিয়েছিলেন। “সেতার তবলা বাজে, খেলে দাবা তাস।/ সন্দেশের টাকা দেন হইয়ে উল্লাস”। শুধু সন্দেশ নয়, অন্যান্য মিষ্টির প্রতি দীনবন্ধুর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখাতে। ‘সুরধুনী’ কাব্যে দীনবন্ধু কৃষ্ণনগরের সরভাজা, সরপুরিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন।
১৮৬৯ সালে ডিউক অব এডিনবরা কলকাতাতে এলে, দীনবন্ধু লিখলেন, “বসো হে ডিউক ভাই হিন্দু ভাই-দলে / শ্বেত-শতদলমালা দিই তব গলে/ ক্ষীর সর নবনীত, মতিচুর মনোনীত,মনোহরা, চন্দ্রপুলি, গঠা সুকৌশলে,/ সমাদরে করি দান বদনে তোমার”।
জনশ্রুতি অনুসারে দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ও নাকি ভোজনরসিক ছিলেন। একবার নিরুপায় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে গুরুর নির্দেশে কলকাতার জলখাবার দিয়েই নাকি মা সরস্বতীকে ভোগ দিতে হয়েছিল। সেই উপলক্ষ্যে তিনি যে সংস্কৃত শ্লোকটি আউড়ে ছিলেন, তা হল “লুচী কচুরী মতিচুর শোভিতং/ জিলেপি সন্দেশ গজা বিরাজিতম্।/ যস্যাঃ প্রসাদেন ফলারমাপ্লুমঃ/ সরস্বতী সা জয়তান্নিরন্তরম্”।
রবীন্দ্রনাথও মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন। বাঙালির শেষ পাতে মিষ্টিমুখ ছাড়া ভোজন অসম্পূর্ণ। রবি ঠাকুরের ছেলেবেলায় লেখা এই কবিতার চাইতে স্বাদু ‘মিষ্টিমুখ’ আর কী হতে পারে! “আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,/ তাহাতে কদলি দলি/ সন্দেশ মাখিয়া লও তাতে/ হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ/ পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে”।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো লাগলো। এত সুন্দর তথ্যবহুল কম্পাইলেশন !
প্রবন্ধ টি তথ্যবহূল ।খুব ভালো লাগলো।আমার গবেষণার জন্য এই প্রবন্ধটি দরকার আমি কি ব্যবহার করতে পারব?যদি অনুমতি দেন খুব উপকারে লাগবে।
আপনার প্রবন্ধটি সরস ও তথ্যসমৃদ্ধ। সুন্দর বাগানের পেছনে লুকোনো পরিশ্রমের পশরাকে অনুমান করতে পারি। আমার একটি লেখায় এই বাগানের কিছু ফুল ব্যবহারের অনুমতি পেতে পারি কি ?