বিভাবসু দে
আমি একটা পাথর কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আর সেই সঙ্গে একটা স্বপ্ন— মনুষ্যজীবনের সুন্দরতম এক স্বপ্ন। তিল তিল করে সেটাকেই ফুটিয়ে তুলেছিলাম ওই পাথরের ওপর। এক পুরুষ আর এক নারী— গভীর আশ্লেষে মিশে গেছে পরস্পরের সত্তায়। ওই পাথরে মনুষ্যত্বের জন্ম দিয়েছিলাম আমি— লিঙ্গ, যোনি, স্তন, নিতম্ব আর কামনা-বাসনায় সিক্ত দুটো পরিপূর্ণ মানবমূর্তি যারা মানবীয় ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরেছে একে অপরকে। আমার স্বপ্ন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল ওদের শরীর হয়ে। ওরা মানুষ— ওদের সুখ ছিল, দুঃখ ছিল, ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল, ছিল চোখের জল আর মুখের হাসি। ওদের শরীর জাগত প্রকৃতির নিয়ম মেনে, ওরা গরমভাতে স্বপ্ন দেখত আগামীদিনের— চোখ ঝাপসা হয়ে আসত আকাশের তারা গুনতে গুনতে।
আমার কাজ ফুরিয়েছিল— সৃষ্টি জীবন পেলে স্রষ্টার কাজ ফুরোয়। তাই সেই মিথুন মূর্তিকে সেখানেই রেখে আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম এক দীর্ঘ যাত্রায়— অন্যকোনও স্বপ্ন আর অন্যকোনও পাথরের খোঁজে।
কতটা সময় পেরিয়ে গেছিল, জানি না; হয়তো তিনযুগ। কিংবা আরও বেশি। পৃথিবীটা তো গোল, তাই একদিন আবার নিজের ফেলে যাওয়া স্বপ্নের কাছে ফিরে এলাম— দেখতে এলাম আমার গড়া ওই যুগলমূর্তি আজও কি সেই একই সাবলীলতায় ভালোবাসে একে অপরকে? আজও কি তাদের পাথুরে অবয়বে জেগে ওঠে আদিম অনুভূতি, জৈবচেতনার জাগ্রততম অভিব্যক্তি হয়ে? ফিরে এলাম নিজের কাছে।
আর চমকে উঠলাম। একই পাথরের বুকে চিরন্তন মানবীয় প্রেমের প্রতীকরূপে যাদের গড়েছিলাম, কারা যেন তাদের কেটে আলাদা করে দিয়েছে! এখন নারী আর পুরুষ মূর্তিদ্বয় মৈথুনচ্যুত— পরস্পরের থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। পুরুষের জাগ্রত লিঙ্গ, কামনাসিক্ত নগ্ন শরীর ঢেকে গেছে ভব্য বস্ত্র আর ফুলের মালায়। নারীর উদ্ভিন্ন স্তনবৃন্ত, কমনীয় দেহবল্লরী এখন সোনার কারুকাজ করা রাজকীয় বস্ত্রের ভারে অদৃশ্য, তার রতিসুখার্দ্র দৃষ্টি কারা যেন ঢেকে দিয়েছে অবগুণ্ঠনে। ফুলের স্তূপে ডুবে গেছে ওদের ললিত পদভঙ্গিমা।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কারা?”
জবাব এল, “আমরা দেব-দেবী।”
“কিন্তু আমি তো মানুষ গড়েছিলাম।”
“ওরা মরে গেছে। মনুষ্যত্ব না মরলে যে দেবতার জন্ম হয় না।”
“কে মারল আমার সৃষ্টিকে?”
কিন্তু এবার আর কোনও উত্তর পেলাম না— তার আগেই পেছন থেকে কারা যেন আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিল দেবতার পায়ে; গর্জে উঠল, “প্রণাম করছ না যে বড়?”
আমি সভয়ে প্রণত হলাম আমারই সৃষ্ট মনুষ্যত্বের শবাধারে।
আমার কাজ ফুরিয়েছিল— সৃষ্টি জীবন পেলে স্রষ্টার কাজ ফুরোয়। তাই সেই মিথুন মূর্তিকে সেখানেই রেখে আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম এক দীর্ঘ যাত্রায়— অন্যকোনও স্বপ্ন আর অন্যকোনও পাথরের খোঁজে।
কতটা সময় পেরিয়ে গেছিল, জানি না; হয়তো তিনযুগ। কিংবা আরও বেশি। পৃথিবীটা তো গোল, তাই একদিন আবার নিজের ফেলে যাওয়া স্বপ্নের কাছে ফিরে এলাম— দেখতে এলাম আমার গড়া ওই যুগলমূর্তি আজও কি সেই একই সাবলীলতায় ভালোবাসে একে অপরকে? আজও কি তাদের পাথুরে অবয়বে জেগে ওঠে আদিম অনুভূতি, জৈবচেতনার জাগ্রততম অভিব্যক্তি হয়ে? ফিরে এলাম নিজের কাছে।
আর চমকে উঠলাম। একই পাথরের বুকে চিরন্তন মানবীয় প্রেমের প্রতীকরূপে যাদের গড়েছিলাম, কারা যেন তাদের কেটে আলাদা করে দিয়েছে! এখন নারী আর পুরুষ মূর্তিদ্বয় মৈথুনচ্যুত— পরস্পরের থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। পুরুষের জাগ্রত লিঙ্গ, কামনাসিক্ত নগ্ন শরীর ঢেকে গেছে ভব্য বস্ত্র আর ফুলের মালায়। নারীর উদ্ভিন্ন স্তনবৃন্ত, কমনীয় দেহবল্লরী এখন সোনার কারুকাজ করা রাজকীয় বস্ত্রের ভারে অদৃশ্য, তার রতিসুখার্দ্র দৃষ্টি কারা যেন ঢেকে দিয়েছে অবগুণ্ঠনে। ফুলের স্তূপে ডুবে গেছে ওদের ললিত পদভঙ্গিমা।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কারা?”
জবাব এল, “আমরা দেব-দেবী।”
“কিন্তু আমি তো মানুষ গড়েছিলাম।”
“ওরা মরে গেছে। মনুষ্যত্ব না মরলে যে দেবতার জন্ম হয় না।”
“কে মারল আমার সৃষ্টিকে?”
কিন্তু এবার আর কোনও উত্তর পেলাম না— তার আগেই পেছন থেকে কারা যেন আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিল দেবতার পায়ে; গর্জে উঠল, “প্রণাম করছ না যে বড়?”
আমি সভয়ে প্রণত হলাম আমারই সৃষ্ট মনুষ্যত্বের শবাধারে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অর্থবহ বার্তা! সমাজ যখন ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে, যখন মুষ্টিমেয় নির্বোধের হাতের রাজদন্ড নেমে আসছে আপামর মানুষের অস্ত্র হয়ে…এই যুগসন্ধিক্ষণে এই গল্প তাৎপর্যময়! অথচ কি সাবলীল ভঙ্গী! ভালোলাগল।
বিভাবসু, তুমি তো সূর্য! তোমার লেখাও বিভাবসুর আলোতে উদ্ভাসিত ! খুবই উঁচু মানের অণুগল্প! অভিনব ভাবনা তো বটেই, স্বল্প কথায় অনেক কিছু বলেছ। অনুভবে বুঝতে হবে। অনেক অনেক ভাবনার সঞ্চার করতে পেরেছ তুমি পাঠক-মনে । আমার তো মনে হয়, শেষ কথা হল — মনুষ্যত্বের উপরে আর কিছু নেই। পুরোনো লাইনটা লিখি — সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই!