তমসো মা…

তমসো মা…
শাম্ব চ্যাটার্জী

সকাল থেকেই দিনটার হাবভাব ভাল ঠেকছিল না। হঠাৎ করে কে যেন অকাল কার্ফু জারি করেছে! ব্যস্ত শহর আজ বড্ড চুপচাপ! কাল পর্যন্ত এমনধারা মেজাজ অন্তত ছিল না। গোটা শহরটাই কোনও এক অজানা জাদুকরের জাদুর ছোঁয়ায় নিঝুম পুরীর চেহারা নিয়েছে। পাড়ার মানুষগুলো সব ঘরের ভিতরে সেধিয়েছে। মধ্যবিত্ত পাড়া। এখনও শপিংমলের আধুনিকতার ছোঁয়াচ লাগেনি। মেনরোডের গা ঘেঁষে ছোট্ট রাস্তা গিয়ে মিশেছে পাড়ায়। ঢোকার পথে অগুন্তি দোকানের সারি, তাতে মুদির দোকান থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের পসরা সাজানো—মায় মাছ-মাংসের বাজারও রয়েছে। অফিসফেরতা লোকজন বাসস্টপে নেমে তার যথার্থ সদ্ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া সন্ধ্যের মুখে বাজার সেরে ঘরে ঢোকার চিরন্তন তাড়ার মাঝে মোড়ের মাথার চায়ের দোকানটাতে ভিড় জমায় সব। মিনুদার এই চায়ের দোকানটা বেশ পুরনো। বাপঠাকুরদার আমলের ব্যাবসা। পাড়ার পত্তনকাল থেকে স্বমহিমায় বর্তমান। শুধু চায়ের টানে নয়, জিভে জল আনা আরও হরেক রকম খাবারের হদিশ মিলবে এখানে। বলতে লজ্জা নেই আমিও সেগুলোর গুণমুগ্ধ ভক্ত। প্রায়শই আমার দেখা মিলবে সেখানে। আমার মাথা গোঁজার ঠাই জায়গাটা থেকে খুব বেশী দূরে নয়। ছোট্ট আস্তানা, একজনের পক্ষে যথেষ্ট। ভবঘুরে মনের মালিক আমি। কখনো সখনো পাড়া থেকে বেশ কিছুদিন বেপাত্তা হয়ে যাই। তখন শত খুঁজলেও টিকি মেলে না আমার। পরিচিতেরা জানেন আমার এই অদ্ভুত স্বভাবের কথা। পাড়ায় থাকলে সকাল-বিকেল কাজের ফাঁকে মিনুদার দোকানে চায়ের আড্ডায় হানা দেওয়া নিত্য রুটিনের মধ্যে পড়ে। রাজনীতি থেকে পরনিন্দা-পরচর্চা, গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে দেয় বক্তারা। মাঝেমধ্যে অস্তিত্বের জানান দিলেও ওঁদের কথার তোড়ে আমার হাঁকডাক চাঁপা পড়ে যায়। মুগ্ধ শ্রোতা না হলেও, শ্রোতার ভান করে থাকি। এতে অবিশ্যি লাভ আছে বেশ। নাহ, চায়ের নেশারু আমি নই। আমার বিনীত সমর্থনসূচক চোখের ভাষা পড়ে ওনাদের মধ্যে অনেকেই যারপরনাই খুশি হয়ে ‘টা’-এর অফার করে থাকেন মাঝেসাঝে। অমন সেধে আসা ঘরের লক্ষ্মীকে আমি ফিরিয়ে দিই না। আমার তরফ থেকে সমর্থনটুকু ছাড়া ওঁরা বোধকরি আর বিশেষ কিছু প্রত্যাশা করেন না।

গোল বেঁধেছে আজ সকাল থেকে। এই শুনশান আবহে আমার মেজাজ ঠিক খাপ খায় না। বার দুই গলা খাকারি দিয়েও ঠিক জুত হল না। চেনা মানুষগুলো হঠাৎ কেমন অচেনা হয়ে গিয়েছে! পরিচিতজনেরা সকলেই রোজকার আড্ডায় অনুপস্থিত। তাঁদের বাড়ীর সামনে দিয়ে কয়েকদফা পায়চারী করেও… সব বেমালুম হাওয়া। দূর থেকে বাঁশির আওয়াজ কানে এলো, সঙ্গে হুঁশিয়ার বাণী। চট করে মিত্তিরদের রোয়াকের পাশে সরু গলিতে ঢুকে পড়লুম। টহলদারি জিপখানা হুস করে বেরিয়ে যেতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। বেরিয়ে এসে ফের এগোলুম মিনুদার দোকানের দিকে। জমজমাট দোকান আজ খাঁখাঁ করছে। শাটার অর্ধেক নামানো। ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়াতে অ্যাদ্দিনের চেনা মানুষটা খেঁকিয়ে উঠল। এমনধারা মেজাজে কথা বলতে জীবদ্দশায় কখনও দেখিনি! বুঝলাম আজ আড্ডাও বন্ধ, আর… হতচ্ছাড়া পেটটাও হয়েছে আচ্ছা শত্তুর। খাকি উর্দির নজর এড়িয়ে ইতিউতি খানিক ঘোরাঘুরি করে, কখন যে বেলা বয়ে গেল টেরও পেলুম না। সন্ধ্যে হতে না হতেই আশেপাশের চেহারা দেখে মনে হল মাঝরাত্তির নেমেছে। এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়ল দত্তদের বাড়ীর দিকে। বাড়ীতে বুড়িমা ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলে কর্মসূত্রে সাত সাগর পাড়ি দিয়েছে। দোতলার জলের পাইপ বেয়ে…

“আহা রে, বড্ড ভালো ছিল… খাওয়াদাওয়ার জন্য শুধু…”—মিনুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে আউড়াল কথাটা। নিথর নিস্পন্দ চারপেয়ে দেহের পাশে কৃতজ্ঞতার স্রোতের ধারা শুকিয়ে তখন কালচে রঙে পরিণত। এক শুভ্রবসনা বৃদ্ধা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সাদা চাদরে মুড়িয়ে দিলেন সময় অসময়ের সঙ্গীকে—ওঁর গাল বেয়ে নেমে আসা অকাল শ্রাবণধারা মুখের মাস্ক শুষে নিয়েছে। শুনশান রাস্তায় কালান্তক ভাইরাস তখন মানুষের শরীর ছেড়ে মনের দখল নিতে ব্যস্ত।

(সব চরিত্র ও প্রেক্ষাপট কাল্পনিক)
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *