চুমকি ভট্টাচার্য
ফিমেল ওয়ার্ডের কোলাপসিবল গেটের বাইরে পা রাখতেই সবকিছু নতুন বলে মনে হল নীলার। এতদিন চারিদিকে অসুস্থ মানুষের মাঝে থাকতে থাকতে ক্রমশ কমে আসছিল তার মনোবল। চোদ্দদিন আগে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ভর্তি করানো হয়েছিল এই সরকারী হাসপাতালে। জ্ঞান আসার পর সে জানতে পারে যে সে কোভিড আক্রান্ত। তার করুণ অবস্থা দেখে এক সহৃদয় নার্সদিদি লুকিয়ে নিজের মোবাইল ফোন দিয়েছিল বাড়ীর লোকের সাথে কথা বলতে। সে সৌম্যকে ফোন করেছিল।
এই বছরেরই ফাল্গুনের এক গোধূলিলগ্নে নীলা ও সৌম্যর চারহাত মিলিত হয়েছিল। মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যাওয়া যায় তা নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ছিল তাদের। শেষে ঠিক হয় মে মাসের শুরুতে অফিস থেকে দশদিনের ছুটি নেবে সৌম্য আর তখনই কপোত-কপোতী ডানা মেলে পাড়ি দেবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানের উদ্দেশ্যে। কিন্ত তার আগেই করোনা অতিমারীর কারণে স্তব্ধ হয়ে গেল গোটা বিশ্ব, ব্যাহত হল স্বাভাবিক জীবন। সৌম্য অবশ্য বাড়ী থেকেই অফিসের সব কাজ সামলাতে থাকে। কিন্তু সৌম্যর চাকড়ির স্থিরতা নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির মধ্যেকার চাপা উদ্বেগ দৃষ্টি এড়ায় না নীলার। সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে এই প্রতিকূল পরিবেশে সবাইকে ভাল রাখতে।
নীলার সকাল শুরু হয় খুব ভোরে। সংসারের প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু করার আগে সে ছাদে গিয়ে ফুলগাছদের সাথে কথা বলে, তাদের পরিচর্যা করে। ফেরার সময় নিয়ে আসে একরাশ ফুল – কিছু ফুল রাখে ঠাকুরঘরে আর কিছু ফুল অঞ্জলি ভরে মেলে ধরে শ্বশুরমশাইয়ের সামনে। তিনি একগাল হেসে বলেন,
– নীলা মা আমার সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী!
ঠিক এই মুহূর্তটিই দিনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত বলে মনে হয় নীলার। শ্বশুরমশাইয়ের মধ্যে নিজের বাবাকে খুঁজে পায় নীলা। কতদিন যে বাবা-মাকে দেখেনি সে…
নীলার শাশুড়িমা, অদিতি, মানুষটি বেশ মেজাজি, কঠিন স্বভাবের। দিনেদিনে তার কাঠিন্য বেড়েই চলেছে। একদিন শ্বশুরমশাইকে ফুল দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় নীলার কানে আসে অদিতি চাপা স্বরে বলছেন,
– তোমায় দেখছি দিব্বি বশ করেছে ওই মেয়ে। দিনরাত শুধু মা লক্ষ্মী আর মা লক্ষ্মী! ও এই বাড়ীতে আসার পর থেকেই যত অনাসৃষ্টি কাণ্ড শুরু হয়েছে, আমার বাবুর চাকড়ি নিয়ে টানাটানি!
নীলা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না। তার দুচোখ জ্বালা করে, কিন্তু সে কাঁদে না। নীলা বোঝে অদিতি এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার। তাকে একটু ধৈর্য ধরতেই হবে। সৌম্যর জন্য সে এটুকু করতে পারবে না? সৌম্য যে বড় ভাল, বড্ড ভালবাসে তাকে।
সেদিন শাশুড়িমার জন্মদিন উপলক্ষে অনেক রান্না করেছিল নীলা। এরমধ্যে সবকিছু আনলক হওয়ায় বিকেলে সৌম্যর সাথে বেড়িয়ে একটা খুব সুন্দর শাড়ী কিনে এনে উপহার দিয়েছিল তাঁকে। অদিতি গম্ভীর হয়ে বলেছিল,
– এই দুঃসময়ে এভাবে টাকা না উড়োলেই পারতে।
ঠিক তার দুদিন পরেই নীলার জ্বর আসে, ক্রমশ তা বাড়তেই থাকে, একসময় সে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে।
নীলার দুচোখ এখন শুধুই সৌম্যকে খুঁজে ফিরছে। কিন্তু কোথায় সৌম্য?
– নীলা মা!
অতি পরিচিত স্নেহের সম্বোধনে পিছনে ফিরতেই বাবাকে দেখতে পায় নীলা, পাশে মা। নীলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– তোমরা? তোমরা অতদূর থেকে কেন আসতে গেলে বাবা? বাড়ীতে না গিয়ে এই হাসপাতালে আমায় দেখতে এসে একদম ঠিক কাজ করোনি তোমরা। সৌম্য তোমাদের দুজনকে কেমন বকা দেয় দেখবে! সৌম্যর সাথে দেখা হয়েছে তোমাদের? সে কোথায়?
নীলার বাবা নীরব রইলেন। নীলার মা কাছে এসে বললেন,
– সৌম্য গতকাল রাতে আমাদের ফোন করে জানায় যে তার অফিসের কাজ নিয়ে সে এতই ব্যস্ত যে তার পক্ষে হাসপাতালে আসা সম্ভব নয়। আর এমনিতেই ওর বাবা-মার বয়স হয়েছে, শরীরও অসুস্থ তাই তোর পরিচর্যার দায়িত্ব ওঁদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই তোকে যেন আপাতত আমাদের কাছেই রাখি। নীলার চোখের জল আজ আর বাঁধ মানে না। তার ছাদবাগানের গাছেদের কথা মনে পড়ে,
– ওরা পরিচর্যা পাচ্ছে তো?
এই বছরেরই ফাল্গুনের এক গোধূলিলগ্নে নীলা ও সৌম্যর চারহাত মিলিত হয়েছিল। মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যাওয়া যায় তা নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ছিল তাদের। শেষে ঠিক হয় মে মাসের শুরুতে অফিস থেকে দশদিনের ছুটি নেবে সৌম্য আর তখনই কপোত-কপোতী ডানা মেলে পাড়ি দেবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানের উদ্দেশ্যে। কিন্ত তার আগেই করোনা অতিমারীর কারণে স্তব্ধ হয়ে গেল গোটা বিশ্ব, ব্যাহত হল স্বাভাবিক জীবন। সৌম্য অবশ্য বাড়ী থেকেই অফিসের সব কাজ সামলাতে থাকে। কিন্তু সৌম্যর চাকড়ির স্থিরতা নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির মধ্যেকার চাপা উদ্বেগ দৃষ্টি এড়ায় না নীলার। সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে এই প্রতিকূল পরিবেশে সবাইকে ভাল রাখতে।
নীলার সকাল শুরু হয় খুব ভোরে। সংসারের প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু করার আগে সে ছাদে গিয়ে ফুলগাছদের সাথে কথা বলে, তাদের পরিচর্যা করে। ফেরার সময় নিয়ে আসে একরাশ ফুল – কিছু ফুল রাখে ঠাকুরঘরে আর কিছু ফুল অঞ্জলি ভরে মেলে ধরে শ্বশুরমশাইয়ের সামনে। তিনি একগাল হেসে বলেন,
– নীলা মা আমার সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী!
ঠিক এই মুহূর্তটিই দিনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত বলে মনে হয় নীলার। শ্বশুরমশাইয়ের মধ্যে নিজের বাবাকে খুঁজে পায় নীলা। কতদিন যে বাবা-মাকে দেখেনি সে…
নীলার শাশুড়িমা, অদিতি, মানুষটি বেশ মেজাজি, কঠিন স্বভাবের। দিনেদিনে তার কাঠিন্য বেড়েই চলেছে। একদিন শ্বশুরমশাইকে ফুল দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় নীলার কানে আসে অদিতি চাপা স্বরে বলছেন,
– তোমায় দেখছি দিব্বি বশ করেছে ওই মেয়ে। দিনরাত শুধু মা লক্ষ্মী আর মা লক্ষ্মী! ও এই বাড়ীতে আসার পর থেকেই যত অনাসৃষ্টি কাণ্ড শুরু হয়েছে, আমার বাবুর চাকড়ি নিয়ে টানাটানি!
নীলা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না। তার দুচোখ জ্বালা করে, কিন্তু সে কাঁদে না। নীলা বোঝে অদিতি এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার। তাকে একটু ধৈর্য ধরতেই হবে। সৌম্যর জন্য সে এটুকু করতে পারবে না? সৌম্য যে বড় ভাল, বড্ড ভালবাসে তাকে।
সেদিন শাশুড়িমার জন্মদিন উপলক্ষে অনেক রান্না করেছিল নীলা। এরমধ্যে সবকিছু আনলক হওয়ায় বিকেলে সৌম্যর সাথে বেড়িয়ে একটা খুব সুন্দর শাড়ী কিনে এনে উপহার দিয়েছিল তাঁকে। অদিতি গম্ভীর হয়ে বলেছিল,
– এই দুঃসময়ে এভাবে টাকা না উড়োলেই পারতে।
ঠিক তার দুদিন পরেই নীলার জ্বর আসে, ক্রমশ তা বাড়তেই থাকে, একসময় সে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে।
নীলার দুচোখ এখন শুধুই সৌম্যকে খুঁজে ফিরছে। কিন্তু কোথায় সৌম্য?
– নীলা মা!
অতি পরিচিত স্নেহের সম্বোধনে পিছনে ফিরতেই বাবাকে দেখতে পায় নীলা, পাশে মা। নীলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– তোমরা? তোমরা অতদূর থেকে কেন আসতে গেলে বাবা? বাড়ীতে না গিয়ে এই হাসপাতালে আমায় দেখতে এসে একদম ঠিক কাজ করোনি তোমরা। সৌম্য তোমাদের দুজনকে কেমন বকা দেয় দেখবে! সৌম্যর সাথে দেখা হয়েছে তোমাদের? সে কোথায়?
নীলার বাবা নীরব রইলেন। নীলার মা কাছে এসে বললেন,
– সৌম্য গতকাল রাতে আমাদের ফোন করে জানায় যে তার অফিসের কাজ নিয়ে সে এতই ব্যস্ত যে তার পক্ষে হাসপাতালে আসা সম্ভব নয়। আর এমনিতেই ওর বাবা-মার বয়স হয়েছে, শরীরও অসুস্থ তাই তোর পরিচর্যার দায়িত্ব ওঁদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই তোকে যেন আপাতত আমাদের কাছেই রাখি। নীলার চোখের জল আজ আর বাঁধ মানে না। তার ছাদবাগানের গাছেদের কথা মনে পড়ে,
– ওরা পরিচর্যা পাচ্ছে তো?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
Darunnnnnn ❤️❤️❤️❤️
চুমকি, তোমার অণুগল্প মন দিয়ে পড়লাম। এমন দরদী ভাষায় লিখেছ যে, শেষ করে বিষণ্নতা মনকে ভারাক্রান্ত করলেও তুমি কঠিন বাস্তবের সঠিক চিত্র ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারে সফল হয়েছ। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
খুব ভালো হয়েছে
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আমি আপ্লুত, অসংখ্য ধন্যবাদ 🙏
টুম্পা খুব সময় উপযোগী লেখা হয়েছে , মন ছুঁয়ে গেল .এগিয়ে চল অনেক দূরে
খুব ভালো লাগল বন্ধু