অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী
—কে তুই?
—আমি আলোভূত!
—আলোভূত! ভূতেদের অমন নাম আমি জন্মচৈতন্যে শুনিনি।
—কেন শোনেন নি? আপনি কবি না? কবিদের অজস্র শব্দরাশি থাকে।
—বলত পারছি না। তবে ঐ লিখিটিখি দু’য়েকটা…
–সভা সমিতিতে যান না?
—যাই, তো কি হয়েছে? আর অমন একটু-আধটু লিখলে দু’চারটে সভা-সমিতিতে এ্যাটেন্ড করতেই হয়।
—তার মানে আপনি একটু বাবুগোছের লোক…
–নিজের কথা নিজে কি করে বলি? লোকে বলে…
—আমিও তো আপনার দাসস্য দাস। আপনাকে বাবুই বলি।
—তাই বলে একটা ভূতের কাছ থেকে বাবু ডাক শুনবো?
—তাহলে আপনাকে খচ্চর বলে ডাকি…
—অসভ্য, বেল্লিক। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ…ভূতের বাচ্চা ভূত…এ্যাঁ…কি নাম ‘আলোভূত’। ফের যদি আমার সামনে আসবি তো, তোর ঘাড় আমি মটকে ছাড়বো। আমাকে বলে কি না খচ্চর…আঁ…আঁ….মি….খ….চ….
—আ… মর…মর… ভর সন্ধেয় অমন খচ্চর খচ্চর করে চেঁচাচ্ছ কেন?
অদিতির রাঁধুনে তেল পাঁকানো হাতের রামধাক্কা খেয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসেন অনির্বাণবাবু। ভূতে পাওয়া মানুষের মত অনির্বাণবাবু বিবর্ণ আলো-আঁধারিতে এদিক ওদিক ভেলভেলেটার মত তাকাতে থাকেন। তারপর অতি ফ্যাঁসফেসে গলায় অদিতিকে জিজ্ঞেস করেন—আচ্ছা ঘরের আলোটা অফ করলো কে বল তো?
অদিতি যেন আকাশ থেকে পড়ল—মরণ! বলে কি লোকটা? এই বয়সেই ভীমরতিতে ধরল নাকি। মিমি আর ঝুমু তো ও ঘরে বসে পড়ছে। আর আমি তো সন্ধের থেকে ও ঘরেই রান্না করতে ব্যাস্ত। বিনুটা ক্লাব থেকে কখন বাড়ি ফিরবে জানি না। অপু এখনও ফেরেনি। তা তুমি নিজেই লাইটটা নিভিয়ে ভর সন্ধেয় অমন বিছানার উপরে নেতিয়ে পড়েছ কেন শুনি?
–আমি? নেতিয়ে পড়েছি? খুব অফেন্সিভ কথাবার্তা…হট ডু ইউ মিন ‘নেতিয়ে পড়া’?
–ঘুমের ঘোরে খচ্চর খচ্চর বলে চেঁচাওনি?
—হ্যাঁ চেঁচিয়েছি…কিন্তু তা তো ওই আলোভূতটার জন্যেই …
এবার অদিতির চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া–সন্ধের সময় ঘুম যা হোক মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এর মধ্যে ভূত এলো কোত্থেকে?
—বুঝেছি বুঝেছি অমন চোখ গোলগোল করে তাকাতে হবে না। ওই ভূতের ব্যাটা ভূতই আমার ঘরের আলো নিভিয়েছে। অনির্বাণবাবু যেন প্রশ্নপত্রের একটা যুতসই উত্তর খুঁজে ফেলতে পারলেন।
অদিতি কী বুঝলো কে জানে? সে এবার বেশ একটু অন্য মেজাজেই বলল—শোন ভর সন্ধেবেলায় তেনাদের নাম করতে নেই। আমার এখনও রুটি করা বাকি। তুমি যাও না কেন… একটু বোসদার বাড়ি থেকেও তো ঘুরে আসতে পারো। এই বাষট্টিতেই কেমন যেন হয়ে গেছ। বোসদাকে দেখে শেখো। এখনও কত ইয়াং। বাড়ি বসে কি সব ভূতটুতের স্বপ্ন দেখো…অপু ন’টার ট্রেনে বাড়ি ফিরে এলে তোমাকে ডেকে নিয়ে আসবে’খন। মনটাকে চাঙ্গা রাখতে শেখো বুঝলে?
অনির্বাণ অদিতির মুখের দিকে ফ্যাকাসে ভাবে তাকান। সত্যিই কি সে আজকাল আবোলতাবোল দেখছেন নাকি? লোকে সেভেন্টিটুতে বাহাত্তুরে হয়…আর তার বাষট্টিতেই কি ভূতে ধরা জীবন তৈরী হলো নাকি? নাকি অনেক আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে তৈরী হয়েছে। বুঝতেই পারেননি। হয় তো বোঝার খামতিও ছিল খানিকটা। ভাবতে ভাবতেই হালকা ঘিয়ে পাঞ্জাবীটার ভেতর মাথাটা ভরে দেন অনির্বাণবাবু।
২
—কি খচ্চরবাবু? বোসবাড়িতে যাচ্ছেন নাকি?
—কে, কে ডাকল? এই ক্লাবের এদিকটাতে অঞ্চল থেকে লাইটটাও দেয় না। স্বগতোক্তিতে মন ভরিয়ে তোলেন একাএকাই অনির্বাণবাবু।
—লাইট থাকলেও আপনার আলো আমি যখন তখন নিয়ে নিতে পারি। তখন চাদ্দিকে অন্ধকার হি অন্ধকার…
—কে কেহে তুমি? আমার আলো কেড়ে নিতে পারো মানে?
—আপনার চোখের আলো হুট করে কেড়ে নিতে পারি। কারণ আমার নাম আলোভূত।
—ঠিক আছে আলোসাহেব, না না আলোভূত সাহেব, তা পৃথিবীর এত লোক থাকতে আমার চোখের আলোটাই তোমার কেড়ে নেওয়ার ইচ্ছে হলো কেন?
—হাঁ হাঁ শুধু আপনার হবে কেন, এই গা বাঁচানো পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের চোখের আলো মাঝেমধ্যে একটুখানি চুষে নিই আমরা…
—কেন?
—বা রে আমাদের বুঝি খিদে লাগে না?
—কেন আপনি খানটা কি?
—ঐ যে বললাম চোখের আলো। ভদ্র সভ্য মানুষের একছটাক চোখের আলো আমাকে বহুদিন পর্যন্ত উজ্জীবিত রাখে। যেমন ধরুন, এখন আপনার চোখের আলো খেতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।
—কি সংঘাতিক! আপনি তো আজব ভূত মশাই। এই, এই আমি চোখে দেখছি না কেন? আলোভূত… আলোভূত কোথায় আপনি? আমি সব অন্ধকার দেখছি কেন? আমার চোখের আলো ফিরিয়ে দিন…প্লিজ…
৩
সত্য বোস ঝুঁকে আছে অনির্বাণবাবুর মুখের দিকে। অনির্বাণবাবু দেখছেন মৃদু আলোয় ঘর ভরে আছে। শোয়া অবস্থা। উঠে বসতে চেষ্টা করেন একটু।
—আহা হা… খারাপ লাগলে উঠিস না। সত্য বোসের গলায় উদ্বেগ।
—কেন আমার কি হয়েছে?
—তুই তো ক্লাবের ওখানেই অজ্ঞান হয়ে চিৎ পটাং… আবার দেখ, সেই টাইমেই মন্টুমুদির দুই হাজার টাকা ছিনতাই হয়েছে ওখান থেকেই। মন্টু নাকি অনেকবার তোকে ডেকেওছিলো সাহায্যের জন্যে। তুই শুনিসইনি। যাইহোক, অজ্ঞান হলে আর শুনবি কি করে? আচ্ছা তুই অজ্ঞান হলি কেন বলতো? বিভাস দেখে রিক্সায় তুলে এখানে নিয়ে এসেছে।
অনির্বাণবাবু জড়ানো গলায় বললেন—আসলে আলোভূত হঠাৎই আমার চোখের আলোটা কেড়ে নিলো। আমি এতো বারণ করলাম তাকে… আমি তোদের বাড়িতেই আসছিলাম…কবিতা নিয়ে কিছু আলোচনা করবো বলে, অথচ…।
আলোভূতের কথা শুনে সত্য বোস কিছুটা বোমকে গেলেন…তুই কি যা-তা বকছিস? তোর মাথাটাতা ঠিকঠাক আছে তো?
—মাথা ঠিক থাকবে না কেন? আমার হয়েছেটা কি? হঠাৎ একটু অন্ধকার দেখলাম তাই…
—না মানে কি সব ভূতেটুতে পেয়েছে বলছিস…আর যখন তখন ব্ল্যাকআউট হওয়াটা তো ভালো কথা নয়…ডাক্তার দেখা।
—ওসব কথা থাক। কাল আসবো বুঝলি? আজ উঠি…
—বিভাসকে বলবো নাকি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসবে?
—আরে না রে…আমার কিছুই হয় নি। একাই পারবো।
৪
—কি খচ্চরবাবু? এবার বিশ্বাস হয়েছে, যে আমি আলো কেড়ে নিতে পারি?
—আবার ভূতুড়ে নচ্ছার, তুই এসেছিস?
আমি আসিনি তো ! আমি তো আপনার ভেতরেই থাকি। আপনার দ্বিতীয় সত্ত্বা। আমাদের ছেলেপিলে গন্ডা-গুষ্টি সবাই একেকটা মানুষকে আশ্রয় করে বসবাস করে।
—সবার নামই কি আলোভূত?
—হ্যাঁ সবারই নাম আলোভূত। আমরা আলোভূতের গুষ্টি।
—সবাই চোখের আলো খায়?
—অবশ্যই খায়। তবে তার নির্দিষ্ট সময় আছে।
—কেমন?
—ধরুন আপনি চাইলেন কোন বিষয় আপনি দেখবেন না। অথবা দেখতে চাইবেন না। ঠিক তখনই আপনার চোখের আলো আমরা টপ করে খেয়ে নেব।
—বাহ! ভেরি ইন্টারেষ্টিং তো…
—তবে এই যে চেখের আলো আমরা খাই, তা কখনো কখনো সে ব্যক্তি নিজেও বুঝতে পারেন না। অথবা বুঝতে চান না…
—কেমন কেমন ?
—সেটা আর আপনাকে বলে বোঝাতে হবে না। ওটা আপনাআপনি বুঝে যাবেন একদিন।
মোড় ঘুরতেই অপুর সাথে দেখা।
—বাবা তুমি কার সাথে কথা বলতে বলতে আসছিলে ?
চমকে ওঠেন অনির্বাণবাবু। সামনে অপু খানিকটা হতবাক দাড়িয়ে। কখন যেন তিনটে এঁদো রাস্তা ঘুরে নিজের বাড়ির কাছেই চলে এসেছেন তিনি।
—না মানে আলোভূতের সাথে কথা বলছিলাম। দারুণ একটা ইন্টারেস্টিং চরিত্র জানিস।
—হাউ স্ট্রেঞ্জ! ভূত? আই মিন ঘোষ্ট?
—ইয়েস ইয়েস, ভূত! তা সেই ভূতটা না শুধু চোখের আলো খেয়েই বেঁচে থাকে।
—কি যা-তা বলছ বাবা, আর ইউ ম্যাড?
অনির্বাণবাবু কোনও উত্তর দেন না। সত্যিই কি সে পাগল হয়ে যাচ্ছে?
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়েন অনির্বাণবাবু। বেশি রাত জাগাটা ঠিক হবে না। জাগরণী ক্লাবের স্যুভেনিরে একটা কবিতা চেয়েছিলো। সেটাও লেখা হলো না। যাগ্গে, কাল লিখতেই হবে…।
৫
সকালে বাড়ির সামনে সামান্য জটলা দেখা দেওয়ায় বিনু এগিয়ে যায়—এই যে মনোতোষ কাকু, কি হয়েছে, আমাদের গেটের সামনে হাঙ্গামা কিসের?
ঝুমু ব্রাশ করছিলো—কি হয়েছে রে ছোটদা? সেও এগিয়ে যায়।
মনোতোষবাবু সামনে এগিয়ে আসেন—শোন বিনু, বিষয়টা তোমার বাবাকে বললেই ভালো হত। কাল রাত নটার সময়ে জগা প্রধানের ছেলে বিলে আমার ছেলেকে অকারণে বুড়োবটতলার মোড়ে চড় চাপড় দিয়েছে। যাচ্ছেতাই বলে গালিগালাজও করেছে। ও তখন দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিল। এইভাবে একজন ভদ্রলোকের ছেলেকে মান অপমান করা…আচ্ছা বাবা বলত আমরা কোন সমাজে আছি?
—সে না হয় বুঝলাম, তা আমার বাবা কি করতে পারেন এতে?
—কিছু মনে করো না বিনু, তোমার বাবা তখন সেই সময়ে ওই রাস্তা দিয়েই আসছিলেন। আমার ছেলে তোমার বাবাকে দেখে তখন অনেকবার ডেকেওছিল। কিন্তু তোমার বাবা দেখেও না দেখার ভান করে সেখান থেকে চলে আসেন। এতদিন তো তোমার বাবাকে সমাজের একজন সজ্জন ভদ্র ব্যক্তি বলেই জানতাম। আবার একটু লেখালেখিও করেন শুনেছি। অথচ একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ পর্যন্ত করলেন না?
—না মানে ও ভাবে নেবেন না কাকু। বিষয়টা আমি বাবার কাছে জেনে দেখছি।
—থাক থাক, আর জানতে হবে না। সব মুখোশধারী ভদ্র মানুষ অন্ধ হয়ে থাকে। এটা আমার জানা ছিল না…
৬
বিষয়টা যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। তবুও অনির্বাণবাবু কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছেন আজকাল। তিনি কি সত্যি সত্যি মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছেন না। নাহ্ ডাক্তার দেখাতেই হবে। রানাঘাটের নেত্রজ্যোতিতে চোখের ডাক্তার বসে সপ্তাহে একদিন।
ডাক্তার সৌরভ মুখার্জী ঘটনা শুনেই খানিক ফিকফিক করে হাসলেন। তারপর বললেন—আসলে আলোভূতটুত বলে কিছুই নেই। সবই আপনার মনগড়া চরিত্র। চিন্তার বিষয় হলো যেটা , আপনি যা যা বলছেন, তা গ্লুকোমার প্রথম লক্ষণ বলেই মনে হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ ব্ল্যাকআউট হয়ে যাওয়া ভালো কথা নয়।
—ব্ল্যাকআউট মানে ডাক্তারবাবু? অনির্বাণবাবু খানিক বিস্মিত হন।
—এই যে মাঝে মাঝেই চোখে অন্ধকার নেমে আসে। কিচ্ছু দেখতে পান না। এটাই ব্ল্যাকআউট। আসলে আমাদের দৃষ্টির চারিপাশ যখন ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসে তখনই ধরে নিতে হবে ওটা গ্লুকোমার লক্ষণ।
—যেমন…
—যেমন ধরুন টর্চের আলো ফেললে কি হয়? শুধু গোল বৃত্ত হয়ে সামনের জায়গাটা আলোকিত হয়। অথচ তার চারিপাশেই কেমন ঘোলাটে অন্ধকার থাকে। পাশের কিচ্ছুটি দেখা যায় না। তেমনই ক্রমে আপনার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসবে। এতে চোখের অপটিক নার্ভ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
—এটা কেন হয়?
—এট মূলত প্রেশার থেকেই হয়। আমরা মনে করি শুধু রক্তেরই প্রেশার থাকে। তা নয়। চোখেরও প্রেশার আছে…
—আচ্ছা অন্ধত্বের সাথে সাথে সে ব্যক্তি কি কানেও শুনবে না।
—তা কেন হবে?
অনির্বাণবাবু মনে মনে ভাবতে থাকেন, কিন্তু তিনি যে ইদানিং বিপদগ্রস্ত মানুষের ডাকও শুনতে পান না, তার কি হবে?
এমন সময়ে চেম্বারের বাইরে বেশ একটা গন্ডগোল শোনা যায়। ডাক্তার বাবু তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসেন। দেখেন মলিন কাপড় চোপড়ে রক্তমাখা এক লোক চোখে হাত চাপা দিয়ে বসে আছে। সেখান থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। আরেকজন লোক পাশ থেকে এগিয়ে এসে করজোড়ে অনুরোধ করে—ডাক্তারবাবু, আমার ভাইটাকে বাঁচান, গরুতে মেরে ওর চোখটাকে সব্বোনাশ করে দিয়েছে।
—ঠিক আছে, ঠিক আছে। কই রে ন্যাপলা, ওর চোখটা পরিস্কার করে একটু ব্যান্ডেজ করে দে। আরেকটা ইঞ্জেকশান দিচ্ছি। ব্যথা কমবে। তবে অপারেশানের দরকার হতে পারে। আপনি বরং গাড়ি ভাড়া করে ব্যারাকপুর দিশায় চলে যান। আমার এখানে তো তেমন ব্যবস্থা নেই।
—আমরা খুব গরীবমানুষ ডাক্তারবাবু, আপনার এখানেই যদি কোনও ব্যাবস্থা করেন।
—আহা বললাম তো, আমার এখানে তেমন ব্যবস্থা নেই। বিরক্ত মুখে আবার চেম্বারের ভেতরে ঢুকলেন ডাক্তার মুখার্জী। অনির্বাণবাবুর সাথে দু’চারটে বাক্যালাপ সেরে ওষুধ লিখলেন খসখস করে গোটাকয়েক।
অনির্বাণবাবুর বিষয়টা খুব খারাপ লাগলো—ডাক্তারবাবু লোকটার চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। আপনি আরেকটু ভালভাবে দেখতে পারতেন।
ডাঃ মুখার্জী হাসলেন—পেছনে লাইন দেখেছেন? ওকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে আপনাদের দেখবো কখন?
অনির্বাণবাবু জানেন আসলে এটা কোনও কথার কথা নয়। লোকটা গরীব। ডাক্তারবাবুর পকেট ভরাতে পারবেন না বলেই দেখলেন না। কোনও কথা না বলেই বেরিয়ে আসেন অনির্বাণবাবু।
৭
—কি বলেছিলাম না। অনেকেই দেখতে পান না।
—কে?
—আরে আমি গো। আলোভূত।
—আ মরণ! একটু শুতেও কি পারবো না তোর যন্ত্রণায়?
—শোবেন শোবেন। একটা বিষয় ধরিয়ে দিতে এলাম।
—কোন বিষয়টা?
—কেন ওই যে বলেছিলাম। চোখের আলো খেয়ে ফেললে সে কিছুই দেখতে পায় না। অথবা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। যেমন ডাক্তারবাবু। ওই যে রুগিটাকে দেখলেন না। ওই সময়ে একটা আলোভূত টপ করে ডাক্তারবাবুর চোখের আলোটুকু খেয়ে নিয়েছিলো। তাই তো উনি গরীব রুগিটাকে আর দেখতে পেলেন না।
—আশ্চর্য। অতীব আশ্চর্য ব্যাপার। তাহলে ডাক্তারবাবুকেও একটা আলোভূতে ধরেছে?
—ধরেছে বৈ কি? শুধু ডাক্তারবাবুই টের পান নি। এমন অনেককেই ধরে…
—ঠিক আছে। ভূতেধরা ডাক্তারের ওষুধ আমি আর খাব না। আর….খাব…না….
আচমকা একটা ধাক্কায় উঠে বসেন অনির্বানবাবু। সামনে বিনু দাড়িয়ে। বিমর্ষ হয়ে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে—ওঠো, তোমার সন্ধেয় একটা ওষুধ খাওয়ার আছে। উঠছ না দেখে ডাকতে এলাম। আর বিড়বিড় করে ওষুধ খাব না….ওষুধ খাব না বলছ কেন?
—না মানে ডাক্তারবাবুকেও জানিস আলোভূতে ধরেছে। তা ভূতেধরা ডাক্তারের ওষুধ খাওয়াটা কি ঠিক হবে?
—কি যা-তা বলছ ? তোমার মাথাটা গেছে। দেখ বাবা তুমি অত চাপ নিচ্ছ কেন?
—না রে চাপ না। লোকের কাছে আমি কত ছোট হয়ে যাচ্ছি বলতো? রাস্তায় কোন সমস্যা ঘটলে আমি দেখতে পাচ্ছি না। জটলা দেখলে এড়িয়ে যাই। বিপদ বুঝে সরে আসি। দেখেও না দেখার ভান করি। শুনেও না শোনার ভান করি। এগুলো আমি কিন্তু ইচ্ছাকৃত করছি না, বুঝলি? সবই ওই আলোভূতটার জন্যে।
—এগুলো ভালো তো বাবা। এগুলো ভালো। সব সমস্যা তুমি দেখতে যাবেই বা কেন। সব বিপদের মধ্যে তুমি নাক গলাবেই বা কেন ? তুমিই তো আমাদের ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছ, কোনও ফালতু হাঙ্গামার মধ্যে না জড়িয়ে পড়তে।
—কি হল রে বিনু, বাড়িতে ঢুকেই শুনি শোরগোল করছিস। কি হয়েছে? অপু এসে দাড়ায় দরজায়। অফিসের ব্যাগ তখনও তার হাতে। মানে এখনও ঘরে ঢোকেনি সে।
অনির্বাণবাবু ব্যগ্র হয়ে উঠলেন—দেখ না অপু, আজকাল আমি রাস্তাঘাটে কোনো ঘটনা ঘটলে দেখতে পাই না। বিনু বলে ওটাই নাকি ভালো। বিশেষ করে বেছে বেছে কারো বিপদে পড়ার ঘটনা তো আমি দেখতেই পাই না। খুব লজ্জার বিষয় হলো বল তো দেখি। মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।
—তুমি শুধু শুধুই চিন্তা করছ বাবা। ওটা একটা কোইন্সিডেন্ট। আর অত সমস্যা-টমস্যা চোখে না দেখাটাই ভালো। এই তো আজকে ট্রেনের মধ্যে এক ভিখারি ভিক্ষে করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। কামরায় একেবারে হৈহৈ ব্যাপার। সকলে চাঁদা তুলে তাকে ডাক্তারের কাছে নেবে ঠিক হলো। অত হ্যাপা বাবা পোশায় না। আমি দশটাকার একটা নোট দিয়ে নেমে এলাম।
—সেটাই দাদা। কাল ক্লাবে ব্লাড ডোনেশানের ক্যাম্পে একটা ছেলে নাকি রক্ত দিতে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে কল্যাণীতে রেফার করেছে। আজকে ক্লাবে সে বিষয়ে মিটিং ছিল। যাইনি তো, বাড়িতেই রয়েছি। অত হ্যাপায় জড়িয়ে লাভ কি? বিনু হেসে বলে।
—তা হলে তোরা বলছিস আমি ঐ সব বিপদ টিপদ না দেখে ভালোই করেছি, কি বলিস?
অপু ব্যাগ নাচিয়ে বলে—আলবাৎ তুমি ভালো করেছ বাবা। যাই হোক, তুমি ওষুধটা খেয়ে নাও। বিনু, বাবার ঠিকমত যত্ন নিস। যাই, আমি একটু ফ্রেশ হই। রোজ যা ধকল যায় জার্নিতে…
৮
দিনদুই ধরে আলোভূত আর আসেনি। ব্ল্যাকআউট বিষয়টাও প্রায় ভুলে ছিলেন অনির্বাণবাবু। জাগরণী ক্লাবের স্যুভেনির আজ প্রকাশিত হল। অনির্বানবাবুর নিমন্ত্রণ ছিল সেখানে। ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছে। তবুও ন’টা… এ আর এমন কি সময়। ক্লাব থেকে একটা মিষ্টির প্যাকেটও ধরিয়ে দিয়েছে তাকে। রজনীগন্ধার একটা তোড়াও। ম’ম’ গন্ধ সাথে করে নিয়ে ফিরছিলেন বাড়িতে। হঠাৎ খেয়াল হলো মিষ্টির প্যাকেটের মিষ্টি কটা বাড়ির সবার ভাগে হবে না। ‘চৈতন্য মিষ্টি ভাণ্ডার’ থেকে আরো কিছু মিষ্টি কিনে সোজা হাঁটা লাগালেন বাড়ি। এদিকটাতে বাজার শেষ। গলির শুরু। বড়বড় বিল্ডিং উঠছে আজকাল। অন্ধকার তাই ঝুপসির মত নেতিয়ে পড়েছে এদিকওদিক। রাস্তার লাইটগুলোও কম। হঠাৎ কানাগলির ভেতর থেকে ঝটপটানির আওয়াজ শোনা গেল…কেউ কি ডাকছে?
—কি কবিবাবু, মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন নাকি?
—কে ? ফিসফিসিয়ে কথা বলল কে?
—আরে কে আবার, আমি আলোভূত গো…
—তুই? আবার?
—কি আর করি বলেন, একটা বিষয়ে কথা বলার ছিলো…
—কি কথা?
—আপনার ছেলেরা অপু বিনু দেখলেন, কেমন আমাদের পাল্লায় পড়েছে?
—কই, কখন, বুঝলাম না তো? সব্বোনাশ ওদের চোখেও কি গ্লুকোমার লক্ষন দেখা দিলো নাকি?
—আরে না না। আমাদের পাল্লায় পড়েছে। গ্লুকোমা হবে কেন? শুনলেন না, কাল আপনাকে বলল একজন ভিখারির কষ্টকে দেখেও দেখতে পারছে না। আরেকজন ব্লাড ডোনারের সমস্যা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে।
—আরে ও তো আমিই ছোটবেলা থেকে ওদের শিখিয়েছি বিপদ এড়িয়ে চলতে। আজকাল যা দিন পড়েছে, পরের সমস্যা অত না দেখাই ভালো।
—ওই তো একই কথা আপনি বুঝলেন, না দেখা। আমরা বুঝি, চোখের আলোখাওয়া।
—তুমি কি বলতে চাও হে গান্ডুষ মার্কা ভূত? তা হলে তো তামাম পৃথিবীর আশিভাগ মানুষের ঘাড়ে তোমরা চেপে বসে আছ।
—তা একপ্রকার বলতে পারেন। তবে কিছু ঘাড় ত্যাড়া মানুষ আছেই তাদের চোখের আলো যা খেতে পারি না। আফসোস। তারা পৃথিবীর সব বিষয়ই একটু বেশিবেশি দেখে আর বেশিবেশি শোনে। তবে যেহেতু আশিভাগ লোকের চোখের আলো খেতে পারি তাই আর আমাদের খাবারের অভাব হয় না…।
বিড়বিড় করতে করতে অনির্বাণবাবু কখন যেন চলে এসেছেন নিজের বাড়ির গেটে। বুঝতেই পারেন নি।
বাড়িতে ঢুকেই বুঝলেন থমথমে পরিবেশ। কিছু একটা হয়েছে।
অদিতির চোখেমুখে ভয়ের আবহ—ও গো তুমি তো রাস্তা দিয়ে এলে। মিমিকে কি দেখেছ ? প্রাইভেট পড়ে সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফেরার কথা। মেয়ে তো এখনও ফেরেনি। অপু আর বিনু বেরিয়েছে খোঁজ করতে।
আমতা আমতা করে অনির্বাণবাবু জবাব দিলেন—কই না তো। আমার সাথে তো মিমির দেখা হয় নি।
এমন সময় একটা ভ্যান রিক্সা এসে থামলো গেটে। মিমিকে ধরাধরি করে বিনু আর অপু দুজনে মিলে নিয়ে আসলো বাড়ির ভেতরে।
বিছানায় শুয়ে বিধ্বস্ত মিমি কান্নায় ভেঙে পড়ল—মা ওরা তিনজনে ছিল। ওদের সঙ্গে আমি পেরে উঠতে পারিনি। অন্ধকার গলিতে যখন টানছিল ওরা তখন দেখি বাবা ফুলের তোড়া আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরছে। আমি চিৎকার করে এত ডাকলাম। বাবা শুনলোই না। ওরা তখন ওড়না দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিল। আমার আর কিছু করার ছিলো না মা… ওরা আমাকে শেষ করে ফেলেছে… কাঁদতে কাঁদতে বিছানার সাথে মিশে যেতে থাকে মিমি।
অনির্বাণবাবু সবকিছু শুনে মাথায় করাঘাত করে বসে পড়লেন খাটে।
অদিতি মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদলো। একটাই অনুযোগ তার—তুমি বাবা নামের কলঙ্ক।
অপু আর বিনুরও কথা তাই–তুমি কি এতটাই অন্ধ হয়ে গেছ বাবা, যে মেয়ের চিৎকারও কানে যায়নি?
সবার অভিযোগ-অনুযোগ-ধিক্কার-ঘৃণা মাথা পেতে নিলেন অনির্বাণবাবু। একটি কথাও মুখ দিয়ে বললেন না। তিনি কাকে বোঝাবেন, তখন তিনি আলোভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন। যে চোখের আলোয় দেখা যায় চোখের বাহিরে সেই চোখের আলো একটু একটু করে খেয়ে নিচ্ছিলো তখন আলোভূত। সেই আলোভূতের পাল্লায় পড়লে পৃথিবীর সমস্ত অনির্বাণরাই অন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য।
কারোর সাথে আর কোনো কথা না বলে একা একা ছাদে উঠে যান অনির্বাণবাবু।
ছাদে একা বসে খুব কাঁদেন… মিমির জন্যে কাঁদেন…বড় আদরের মিমি। নিজের জন্যে কাঁদেন….তারপর মথা উঁচু করে লক্ষ লক্ষ উজ্জ্বল তারার দিকে তাকিয়ে অষ্ফুটকন্ঠে প্রার্থনা করে ওঠেন—হে ঈশ্বর তুমি আমার চোখের আলো ফিরিয়ে দাও… আলোভূতের কেড়ে নেওয়া আমার চোখের আলো ফেরত চাই। আমায় অন্ধ করে দিও না হে ইশ্বর।
—আমি আলোভূত!
—আলোভূত! ভূতেদের অমন নাম আমি জন্মচৈতন্যে শুনিনি।
—কেন শোনেন নি? আপনি কবি না? কবিদের অজস্র শব্দরাশি থাকে।
—বলত পারছি না। তবে ঐ লিখিটিখি দু’য়েকটা…
–সভা সমিতিতে যান না?
—যাই, তো কি হয়েছে? আর অমন একটু-আধটু লিখলে দু’চারটে সভা-সমিতিতে এ্যাটেন্ড করতেই হয়।
—তার মানে আপনি একটু বাবুগোছের লোক…
–নিজের কথা নিজে কি করে বলি? লোকে বলে…
—আমিও তো আপনার দাসস্য দাস। আপনাকে বাবুই বলি।
—তাই বলে একটা ভূতের কাছ থেকে বাবু ডাক শুনবো?
—তাহলে আপনাকে খচ্চর বলে ডাকি…
—অসভ্য, বেল্লিক। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ…ভূতের বাচ্চা ভূত…এ্যাঁ…কি নাম ‘আলোভূত’। ফের যদি আমার সামনে আসবি তো, তোর ঘাড় আমি মটকে ছাড়বো। আমাকে বলে কি না খচ্চর…আঁ…আঁ….মি….খ….চ….
—আ… মর…মর… ভর সন্ধেয় অমন খচ্চর খচ্চর করে চেঁচাচ্ছ কেন?
অদিতির রাঁধুনে তেল পাঁকানো হাতের রামধাক্কা খেয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসেন অনির্বাণবাবু। ভূতে পাওয়া মানুষের মত অনির্বাণবাবু বিবর্ণ আলো-আঁধারিতে এদিক ওদিক ভেলভেলেটার মত তাকাতে থাকেন। তারপর অতি ফ্যাঁসফেসে গলায় অদিতিকে জিজ্ঞেস করেন—আচ্ছা ঘরের আলোটা অফ করলো কে বল তো?
অদিতি যেন আকাশ থেকে পড়ল—মরণ! বলে কি লোকটা? এই বয়সেই ভীমরতিতে ধরল নাকি। মিমি আর ঝুমু তো ও ঘরে বসে পড়ছে। আর আমি তো সন্ধের থেকে ও ঘরেই রান্না করতে ব্যাস্ত। বিনুটা ক্লাব থেকে কখন বাড়ি ফিরবে জানি না। অপু এখনও ফেরেনি। তা তুমি নিজেই লাইটটা নিভিয়ে ভর সন্ধেয় অমন বিছানার উপরে নেতিয়ে পড়েছ কেন শুনি?
–আমি? নেতিয়ে পড়েছি? খুব অফেন্সিভ কথাবার্তা…হট ডু ইউ মিন ‘নেতিয়ে পড়া’?
–ঘুমের ঘোরে খচ্চর খচ্চর বলে চেঁচাওনি?
—হ্যাঁ চেঁচিয়েছি…কিন্তু তা তো ওই আলোভূতটার জন্যেই …
এবার অদিতির চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া–সন্ধের সময় ঘুম যা হোক মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এর মধ্যে ভূত এলো কোত্থেকে?
—বুঝেছি বুঝেছি অমন চোখ গোলগোল করে তাকাতে হবে না। ওই ভূতের ব্যাটা ভূতই আমার ঘরের আলো নিভিয়েছে। অনির্বাণবাবু যেন প্রশ্নপত্রের একটা যুতসই উত্তর খুঁজে ফেলতে পারলেন।
অদিতি কী বুঝলো কে জানে? সে এবার বেশ একটু অন্য মেজাজেই বলল—শোন ভর সন্ধেবেলায় তেনাদের নাম করতে নেই। আমার এখনও রুটি করা বাকি। তুমি যাও না কেন… একটু বোসদার বাড়ি থেকেও তো ঘুরে আসতে পারো। এই বাষট্টিতেই কেমন যেন হয়ে গেছ। বোসদাকে দেখে শেখো। এখনও কত ইয়াং। বাড়ি বসে কি সব ভূতটুতের স্বপ্ন দেখো…অপু ন’টার ট্রেনে বাড়ি ফিরে এলে তোমাকে ডেকে নিয়ে আসবে’খন। মনটাকে চাঙ্গা রাখতে শেখো বুঝলে?
অনির্বাণ অদিতির মুখের দিকে ফ্যাকাসে ভাবে তাকান। সত্যিই কি সে আজকাল আবোলতাবোল দেখছেন নাকি? লোকে সেভেন্টিটুতে বাহাত্তুরে হয়…আর তার বাষট্টিতেই কি ভূতে ধরা জীবন তৈরী হলো নাকি? নাকি অনেক আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে তৈরী হয়েছে। বুঝতেই পারেননি। হয় তো বোঝার খামতিও ছিল খানিকটা। ভাবতে ভাবতেই হালকা ঘিয়ে পাঞ্জাবীটার ভেতর মাথাটা ভরে দেন অনির্বাণবাবু।
—কি খচ্চরবাবু? বোসবাড়িতে যাচ্ছেন নাকি?
—কে, কে ডাকল? এই ক্লাবের এদিকটাতে অঞ্চল থেকে লাইটটাও দেয় না। স্বগতোক্তিতে মন ভরিয়ে তোলেন একাএকাই অনির্বাণবাবু।
—লাইট থাকলেও আপনার আলো আমি যখন তখন নিয়ে নিতে পারি। তখন চাদ্দিকে অন্ধকার হি অন্ধকার…
—কে কেহে তুমি? আমার আলো কেড়ে নিতে পারো মানে?
—আপনার চোখের আলো হুট করে কেড়ে নিতে পারি। কারণ আমার নাম আলোভূত।
—ঠিক আছে আলোসাহেব, না না আলোভূত সাহেব, তা পৃথিবীর এত লোক থাকতে আমার চোখের আলোটাই তোমার কেড়ে নেওয়ার ইচ্ছে হলো কেন?
—হাঁ হাঁ শুধু আপনার হবে কেন, এই গা বাঁচানো পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের চোখের আলো মাঝেমধ্যে একটুখানি চুষে নিই আমরা…
—কেন?
—বা রে আমাদের বুঝি খিদে লাগে না?
—কেন আপনি খানটা কি?
—ঐ যে বললাম চোখের আলো। ভদ্র সভ্য মানুষের একছটাক চোখের আলো আমাকে বহুদিন পর্যন্ত উজ্জীবিত রাখে। যেমন ধরুন, এখন আপনার চোখের আলো খেতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।
—কি সংঘাতিক! আপনি তো আজব ভূত মশাই। এই, এই আমি চোখে দেখছি না কেন? আলোভূত… আলোভূত কোথায় আপনি? আমি সব অন্ধকার দেখছি কেন? আমার চোখের আলো ফিরিয়ে দিন…প্লিজ…
সত্য বোস ঝুঁকে আছে অনির্বাণবাবুর মুখের দিকে। অনির্বাণবাবু দেখছেন মৃদু আলোয় ঘর ভরে আছে। শোয়া অবস্থা। উঠে বসতে চেষ্টা করেন একটু।
—আহা হা… খারাপ লাগলে উঠিস না। সত্য বোসের গলায় উদ্বেগ।
—কেন আমার কি হয়েছে?
—তুই তো ক্লাবের ওখানেই অজ্ঞান হয়ে চিৎ পটাং… আবার দেখ, সেই টাইমেই মন্টুমুদির দুই হাজার টাকা ছিনতাই হয়েছে ওখান থেকেই। মন্টু নাকি অনেকবার তোকে ডেকেওছিলো সাহায্যের জন্যে। তুই শুনিসইনি। যাইহোক, অজ্ঞান হলে আর শুনবি কি করে? আচ্ছা তুই অজ্ঞান হলি কেন বলতো? বিভাস দেখে রিক্সায় তুলে এখানে নিয়ে এসেছে।
অনির্বাণবাবু জড়ানো গলায় বললেন—আসলে আলোভূত হঠাৎই আমার চোখের আলোটা কেড়ে নিলো। আমি এতো বারণ করলাম তাকে… আমি তোদের বাড়িতেই আসছিলাম…কবিতা নিয়ে কিছু আলোচনা করবো বলে, অথচ…।
আলোভূতের কথা শুনে সত্য বোস কিছুটা বোমকে গেলেন…তুই কি যা-তা বকছিস? তোর মাথাটাতা ঠিকঠাক আছে তো?
—মাথা ঠিক থাকবে না কেন? আমার হয়েছেটা কি? হঠাৎ একটু অন্ধকার দেখলাম তাই…
—না মানে কি সব ভূতেটুতে পেয়েছে বলছিস…আর যখন তখন ব্ল্যাকআউট হওয়াটা তো ভালো কথা নয়…ডাক্তার দেখা।
—ওসব কথা থাক। কাল আসবো বুঝলি? আজ উঠি…
—বিভাসকে বলবো নাকি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসবে?
—আরে না রে…আমার কিছুই হয় নি। একাই পারবো।
—কি খচ্চরবাবু? এবার বিশ্বাস হয়েছে, যে আমি আলো কেড়ে নিতে পারি?
—আবার ভূতুড়ে নচ্ছার, তুই এসেছিস?
আমি আসিনি তো ! আমি তো আপনার ভেতরেই থাকি। আপনার দ্বিতীয় সত্ত্বা। আমাদের ছেলেপিলে গন্ডা-গুষ্টি সবাই একেকটা মানুষকে আশ্রয় করে বসবাস করে।
—সবার নামই কি আলোভূত?
—হ্যাঁ সবারই নাম আলোভূত। আমরা আলোভূতের গুষ্টি।
—সবাই চোখের আলো খায়?
—অবশ্যই খায়। তবে তার নির্দিষ্ট সময় আছে।
—কেমন?
—ধরুন আপনি চাইলেন কোন বিষয় আপনি দেখবেন না। অথবা দেখতে চাইবেন না। ঠিক তখনই আপনার চোখের আলো আমরা টপ করে খেয়ে নেব।
—বাহ! ভেরি ইন্টারেষ্টিং তো…
—তবে এই যে চেখের আলো আমরা খাই, তা কখনো কখনো সে ব্যক্তি নিজেও বুঝতে পারেন না। অথবা বুঝতে চান না…
—কেমন কেমন ?
—সেটা আর আপনাকে বলে বোঝাতে হবে না। ওটা আপনাআপনি বুঝে যাবেন একদিন।
মোড় ঘুরতেই অপুর সাথে দেখা।
—বাবা তুমি কার সাথে কথা বলতে বলতে আসছিলে ?
চমকে ওঠেন অনির্বাণবাবু। সামনে অপু খানিকটা হতবাক দাড়িয়ে। কখন যেন তিনটে এঁদো রাস্তা ঘুরে নিজের বাড়ির কাছেই চলে এসেছেন তিনি।
—না মানে আলোভূতের সাথে কথা বলছিলাম। দারুণ একটা ইন্টারেস্টিং চরিত্র জানিস।
—হাউ স্ট্রেঞ্জ! ভূত? আই মিন ঘোষ্ট?
—ইয়েস ইয়েস, ভূত! তা সেই ভূতটা না শুধু চোখের আলো খেয়েই বেঁচে থাকে।
—কি যা-তা বলছ বাবা, আর ইউ ম্যাড?
অনির্বাণবাবু কোনও উত্তর দেন না। সত্যিই কি সে পাগল হয়ে যাচ্ছে?
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়েন অনির্বাণবাবু। বেশি রাত জাগাটা ঠিক হবে না। জাগরণী ক্লাবের স্যুভেনিরে একটা কবিতা চেয়েছিলো। সেটাও লেখা হলো না। যাগ্গে, কাল লিখতেই হবে…।
সকালে বাড়ির সামনে সামান্য জটলা দেখা দেওয়ায় বিনু এগিয়ে যায়—এই যে মনোতোষ কাকু, কি হয়েছে, আমাদের গেটের সামনে হাঙ্গামা কিসের?
ঝুমু ব্রাশ করছিলো—কি হয়েছে রে ছোটদা? সেও এগিয়ে যায়।
মনোতোষবাবু সামনে এগিয়ে আসেন—শোন বিনু, বিষয়টা তোমার বাবাকে বললেই ভালো হত। কাল রাত নটার সময়ে জগা প্রধানের ছেলে বিলে আমার ছেলেকে অকারণে বুড়োবটতলার মোড়ে চড় চাপড় দিয়েছে। যাচ্ছেতাই বলে গালিগালাজও করেছে। ও তখন দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিল। এইভাবে একজন ভদ্রলোকের ছেলেকে মান অপমান করা…আচ্ছা বাবা বলত আমরা কোন সমাজে আছি?
—সে না হয় বুঝলাম, তা আমার বাবা কি করতে পারেন এতে?
—কিছু মনে করো না বিনু, তোমার বাবা তখন সেই সময়ে ওই রাস্তা দিয়েই আসছিলেন। আমার ছেলে তোমার বাবাকে দেখে তখন অনেকবার ডেকেওছিল। কিন্তু তোমার বাবা দেখেও না দেখার ভান করে সেখান থেকে চলে আসেন। এতদিন তো তোমার বাবাকে সমাজের একজন সজ্জন ভদ্র ব্যক্তি বলেই জানতাম। আবার একটু লেখালেখিও করেন শুনেছি। অথচ একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ পর্যন্ত করলেন না?
—না মানে ও ভাবে নেবেন না কাকু। বিষয়টা আমি বাবার কাছে জেনে দেখছি।
—থাক থাক, আর জানতে হবে না। সব মুখোশধারী ভদ্র মানুষ অন্ধ হয়ে থাকে। এটা আমার জানা ছিল না…
বিষয়টা যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। তবুও অনির্বাণবাবু কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছেন আজকাল। তিনি কি সত্যি সত্যি মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছেন না। নাহ্ ডাক্তার দেখাতেই হবে। রানাঘাটের নেত্রজ্যোতিতে চোখের ডাক্তার বসে সপ্তাহে একদিন।
ডাক্তার সৌরভ মুখার্জী ঘটনা শুনেই খানিক ফিকফিক করে হাসলেন। তারপর বললেন—আসলে আলোভূতটুত বলে কিছুই নেই। সবই আপনার মনগড়া চরিত্র। চিন্তার বিষয় হলো যেটা , আপনি যা যা বলছেন, তা গ্লুকোমার প্রথম লক্ষণ বলেই মনে হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ ব্ল্যাকআউট হয়ে যাওয়া ভালো কথা নয়।
—ব্ল্যাকআউট মানে ডাক্তারবাবু? অনির্বাণবাবু খানিক বিস্মিত হন।
—এই যে মাঝে মাঝেই চোখে অন্ধকার নেমে আসে। কিচ্ছু দেখতে পান না। এটাই ব্ল্যাকআউট। আসলে আমাদের দৃষ্টির চারিপাশ যখন ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসে তখনই ধরে নিতে হবে ওটা গ্লুকোমার লক্ষণ।
—যেমন…
—যেমন ধরুন টর্চের আলো ফেললে কি হয়? শুধু গোল বৃত্ত হয়ে সামনের জায়গাটা আলোকিত হয়। অথচ তার চারিপাশেই কেমন ঘোলাটে অন্ধকার থাকে। পাশের কিচ্ছুটি দেখা যায় না। তেমনই ক্রমে আপনার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসবে। এতে চোখের অপটিক নার্ভ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
—এটা কেন হয়?
—এট মূলত প্রেশার থেকেই হয়। আমরা মনে করি শুধু রক্তেরই প্রেশার থাকে। তা নয়। চোখেরও প্রেশার আছে…
—আচ্ছা অন্ধত্বের সাথে সাথে সে ব্যক্তি কি কানেও শুনবে না।
—তা কেন হবে?
অনির্বাণবাবু মনে মনে ভাবতে থাকেন, কিন্তু তিনি যে ইদানিং বিপদগ্রস্ত মানুষের ডাকও শুনতে পান না, তার কি হবে?
এমন সময়ে চেম্বারের বাইরে বেশ একটা গন্ডগোল শোনা যায়। ডাক্তার বাবু তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসেন। দেখেন মলিন কাপড় চোপড়ে রক্তমাখা এক লোক চোখে হাত চাপা দিয়ে বসে আছে। সেখান থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। আরেকজন লোক পাশ থেকে এগিয়ে এসে করজোড়ে অনুরোধ করে—ডাক্তারবাবু, আমার ভাইটাকে বাঁচান, গরুতে মেরে ওর চোখটাকে সব্বোনাশ করে দিয়েছে।
—ঠিক আছে, ঠিক আছে। কই রে ন্যাপলা, ওর চোখটা পরিস্কার করে একটু ব্যান্ডেজ করে দে। আরেকটা ইঞ্জেকশান দিচ্ছি। ব্যথা কমবে। তবে অপারেশানের দরকার হতে পারে। আপনি বরং গাড়ি ভাড়া করে ব্যারাকপুর দিশায় চলে যান। আমার এখানে তো তেমন ব্যবস্থা নেই।
—আমরা খুব গরীবমানুষ ডাক্তারবাবু, আপনার এখানেই যদি কোনও ব্যাবস্থা করেন।
—আহা বললাম তো, আমার এখানে তেমন ব্যবস্থা নেই। বিরক্ত মুখে আবার চেম্বারের ভেতরে ঢুকলেন ডাক্তার মুখার্জী। অনির্বাণবাবুর সাথে দু’চারটে বাক্যালাপ সেরে ওষুধ লিখলেন খসখস করে গোটাকয়েক।
অনির্বাণবাবুর বিষয়টা খুব খারাপ লাগলো—ডাক্তারবাবু লোকটার চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। আপনি আরেকটু ভালভাবে দেখতে পারতেন।
ডাঃ মুখার্জী হাসলেন—পেছনে লাইন দেখেছেন? ওকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে আপনাদের দেখবো কখন?
অনির্বাণবাবু জানেন আসলে এটা কোনও কথার কথা নয়। লোকটা গরীব। ডাক্তারবাবুর পকেট ভরাতে পারবেন না বলেই দেখলেন না। কোনও কথা না বলেই বেরিয়ে আসেন অনির্বাণবাবু।
—কি বলেছিলাম না। অনেকেই দেখতে পান না।
—কে?
—আরে আমি গো। আলোভূত।
—আ মরণ! একটু শুতেও কি পারবো না তোর যন্ত্রণায়?
—শোবেন শোবেন। একটা বিষয় ধরিয়ে দিতে এলাম।
—কোন বিষয়টা?
—কেন ওই যে বলেছিলাম। চোখের আলো খেয়ে ফেললে সে কিছুই দেখতে পায় না। অথবা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। যেমন ডাক্তারবাবু। ওই যে রুগিটাকে দেখলেন না। ওই সময়ে একটা আলোভূত টপ করে ডাক্তারবাবুর চোখের আলোটুকু খেয়ে নিয়েছিলো। তাই তো উনি গরীব রুগিটাকে আর দেখতে পেলেন না।
—আশ্চর্য। অতীব আশ্চর্য ব্যাপার। তাহলে ডাক্তারবাবুকেও একটা আলোভূতে ধরেছে?
—ধরেছে বৈ কি? শুধু ডাক্তারবাবুই টের পান নি। এমন অনেককেই ধরে…
—ঠিক আছে। ভূতেধরা ডাক্তারের ওষুধ আমি আর খাব না। আর….খাব…না….
আচমকা একটা ধাক্কায় উঠে বসেন অনির্বানবাবু। সামনে বিনু দাড়িয়ে। বিমর্ষ হয়ে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে—ওঠো, তোমার সন্ধেয় একটা ওষুধ খাওয়ার আছে। উঠছ না দেখে ডাকতে এলাম। আর বিড়বিড় করে ওষুধ খাব না….ওষুধ খাব না বলছ কেন?
—না মানে ডাক্তারবাবুকেও জানিস আলোভূতে ধরেছে। তা ভূতেধরা ডাক্তারের ওষুধ খাওয়াটা কি ঠিক হবে?
—কি যা-তা বলছ ? তোমার মাথাটা গেছে। দেখ বাবা তুমি অত চাপ নিচ্ছ কেন?
—না রে চাপ না। লোকের কাছে আমি কত ছোট হয়ে যাচ্ছি বলতো? রাস্তায় কোন সমস্যা ঘটলে আমি দেখতে পাচ্ছি না। জটলা দেখলে এড়িয়ে যাই। বিপদ বুঝে সরে আসি। দেখেও না দেখার ভান করি। শুনেও না শোনার ভান করি। এগুলো আমি কিন্তু ইচ্ছাকৃত করছি না, বুঝলি? সবই ওই আলোভূতটার জন্যে।
—এগুলো ভালো তো বাবা। এগুলো ভালো। সব সমস্যা তুমি দেখতে যাবেই বা কেন। সব বিপদের মধ্যে তুমি নাক গলাবেই বা কেন ? তুমিই তো আমাদের ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছ, কোনও ফালতু হাঙ্গামার মধ্যে না জড়িয়ে পড়তে।
—কি হল রে বিনু, বাড়িতে ঢুকেই শুনি শোরগোল করছিস। কি হয়েছে? অপু এসে দাড়ায় দরজায়। অফিসের ব্যাগ তখনও তার হাতে। মানে এখনও ঘরে ঢোকেনি সে।
অনির্বাণবাবু ব্যগ্র হয়ে উঠলেন—দেখ না অপু, আজকাল আমি রাস্তাঘাটে কোনো ঘটনা ঘটলে দেখতে পাই না। বিনু বলে ওটাই নাকি ভালো। বিশেষ করে বেছে বেছে কারো বিপদে পড়ার ঘটনা তো আমি দেখতেই পাই না। খুব লজ্জার বিষয় হলো বল তো দেখি। মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।
—তুমি শুধু শুধুই চিন্তা করছ বাবা। ওটা একটা কোইন্সিডেন্ট। আর অত সমস্যা-টমস্যা চোখে না দেখাটাই ভালো। এই তো আজকে ট্রেনের মধ্যে এক ভিখারি ভিক্ষে করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। কামরায় একেবারে হৈহৈ ব্যাপার। সকলে চাঁদা তুলে তাকে ডাক্তারের কাছে নেবে ঠিক হলো। অত হ্যাপা বাবা পোশায় না। আমি দশটাকার একটা নোট দিয়ে নেমে এলাম।
—সেটাই দাদা। কাল ক্লাবে ব্লাড ডোনেশানের ক্যাম্পে একটা ছেলে নাকি রক্ত দিতে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে কল্যাণীতে রেফার করেছে। আজকে ক্লাবে সে বিষয়ে মিটিং ছিল। যাইনি তো, বাড়িতেই রয়েছি। অত হ্যাপায় জড়িয়ে লাভ কি? বিনু হেসে বলে।
—তা হলে তোরা বলছিস আমি ঐ সব বিপদ টিপদ না দেখে ভালোই করেছি, কি বলিস?
অপু ব্যাগ নাচিয়ে বলে—আলবাৎ তুমি ভালো করেছ বাবা। যাই হোক, তুমি ওষুধটা খেয়ে নাও। বিনু, বাবার ঠিকমত যত্ন নিস। যাই, আমি একটু ফ্রেশ হই। রোজ যা ধকল যায় জার্নিতে…
দিনদুই ধরে আলোভূত আর আসেনি। ব্ল্যাকআউট বিষয়টাও প্রায় ভুলে ছিলেন অনির্বাণবাবু। জাগরণী ক্লাবের স্যুভেনির আজ প্রকাশিত হল। অনির্বানবাবুর নিমন্ত্রণ ছিল সেখানে। ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছে। তবুও ন’টা… এ আর এমন কি সময়। ক্লাব থেকে একটা মিষ্টির প্যাকেটও ধরিয়ে দিয়েছে তাকে। রজনীগন্ধার একটা তোড়াও। ম’ম’ গন্ধ সাথে করে নিয়ে ফিরছিলেন বাড়িতে। হঠাৎ খেয়াল হলো মিষ্টির প্যাকেটের মিষ্টি কটা বাড়ির সবার ভাগে হবে না। ‘চৈতন্য মিষ্টি ভাণ্ডার’ থেকে আরো কিছু মিষ্টি কিনে সোজা হাঁটা লাগালেন বাড়ি। এদিকটাতে বাজার শেষ। গলির শুরু। বড়বড় বিল্ডিং উঠছে আজকাল। অন্ধকার তাই ঝুপসির মত নেতিয়ে পড়েছে এদিকওদিক। রাস্তার লাইটগুলোও কম। হঠাৎ কানাগলির ভেতর থেকে ঝটপটানির আওয়াজ শোনা গেল…কেউ কি ডাকছে?
—কি কবিবাবু, মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন নাকি?
—কে ? ফিসফিসিয়ে কথা বলল কে?
—আরে কে আবার, আমি আলোভূত গো…
—তুই? আবার?
—কি আর করি বলেন, একটা বিষয়ে কথা বলার ছিলো…
—কি কথা?
—আপনার ছেলেরা অপু বিনু দেখলেন, কেমন আমাদের পাল্লায় পড়েছে?
—কই, কখন, বুঝলাম না তো? সব্বোনাশ ওদের চোখেও কি গ্লুকোমার লক্ষন দেখা দিলো নাকি?
—আরে না না। আমাদের পাল্লায় পড়েছে। গ্লুকোমা হবে কেন? শুনলেন না, কাল আপনাকে বলল একজন ভিখারির কষ্টকে দেখেও দেখতে পারছে না। আরেকজন ব্লাড ডোনারের সমস্যা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে।
—আরে ও তো আমিই ছোটবেলা থেকে ওদের শিখিয়েছি বিপদ এড়িয়ে চলতে। আজকাল যা দিন পড়েছে, পরের সমস্যা অত না দেখাই ভালো।
—ওই তো একই কথা আপনি বুঝলেন, না দেখা। আমরা বুঝি, চোখের আলোখাওয়া।
—তুমি কি বলতে চাও হে গান্ডুষ মার্কা ভূত? তা হলে তো তামাম পৃথিবীর আশিভাগ মানুষের ঘাড়ে তোমরা চেপে বসে আছ।
—তা একপ্রকার বলতে পারেন। তবে কিছু ঘাড় ত্যাড়া মানুষ আছেই তাদের চোখের আলো যা খেতে পারি না। আফসোস। তারা পৃথিবীর সব বিষয়ই একটু বেশিবেশি দেখে আর বেশিবেশি শোনে। তবে যেহেতু আশিভাগ লোকের চোখের আলো খেতে পারি তাই আর আমাদের খাবারের অভাব হয় না…।
বিড়বিড় করতে করতে অনির্বাণবাবু কখন যেন চলে এসেছেন নিজের বাড়ির গেটে। বুঝতেই পারেন নি।
বাড়িতে ঢুকেই বুঝলেন থমথমে পরিবেশ। কিছু একটা হয়েছে।
অদিতির চোখেমুখে ভয়ের আবহ—ও গো তুমি তো রাস্তা দিয়ে এলে। মিমিকে কি দেখেছ ? প্রাইভেট পড়ে সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফেরার কথা। মেয়ে তো এখনও ফেরেনি। অপু আর বিনু বেরিয়েছে খোঁজ করতে।
আমতা আমতা করে অনির্বাণবাবু জবাব দিলেন—কই না তো। আমার সাথে তো মিমির দেখা হয় নি।
এমন সময় একটা ভ্যান রিক্সা এসে থামলো গেটে। মিমিকে ধরাধরি করে বিনু আর অপু দুজনে মিলে নিয়ে আসলো বাড়ির ভেতরে।
বিছানায় শুয়ে বিধ্বস্ত মিমি কান্নায় ভেঙে পড়ল—মা ওরা তিনজনে ছিল। ওদের সঙ্গে আমি পেরে উঠতে পারিনি। অন্ধকার গলিতে যখন টানছিল ওরা তখন দেখি বাবা ফুলের তোড়া আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরছে। আমি চিৎকার করে এত ডাকলাম। বাবা শুনলোই না। ওরা তখন ওড়না দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিল। আমার আর কিছু করার ছিলো না মা… ওরা আমাকে শেষ করে ফেলেছে… কাঁদতে কাঁদতে বিছানার সাথে মিশে যেতে থাকে মিমি।
অনির্বাণবাবু সবকিছু শুনে মাথায় করাঘাত করে বসে পড়লেন খাটে।
অদিতি মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদলো। একটাই অনুযোগ তার—তুমি বাবা নামের কলঙ্ক।
অপু আর বিনুরও কথা তাই–তুমি কি এতটাই অন্ধ হয়ে গেছ বাবা, যে মেয়ের চিৎকারও কানে যায়নি?
সবার অভিযোগ-অনুযোগ-ধিক্কার-ঘৃণা মাথা পেতে নিলেন অনির্বাণবাবু। একটি কথাও মুখ দিয়ে বললেন না। তিনি কাকে বোঝাবেন, তখন তিনি আলোভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন। যে চোখের আলোয় দেখা যায় চোখের বাহিরে সেই চোখের আলো একটু একটু করে খেয়ে নিচ্ছিলো তখন আলোভূত। সেই আলোভূতের পাল্লায় পড়লে পৃথিবীর সমস্ত অনির্বাণরাই অন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য।
কারোর সাথে আর কোনো কথা না বলে একা একা ছাদে উঠে যান অনির্বাণবাবু।
ছাদে একা বসে খুব কাঁদেন… মিমির জন্যে কাঁদেন…বড় আদরের মিমি। নিজের জন্যে কাঁদেন….তারপর মথা উঁচু করে লক্ষ লক্ষ উজ্জ্বল তারার দিকে তাকিয়ে অষ্ফুটকন্ঠে প্রার্থনা করে ওঠেন—হে ঈশ্বর তুমি আমার চোখের আলো ফিরিয়ে দাও… আলোভূতের কেড়ে নেওয়া আমার চোখের আলো ফেরত চাই। আমায় অন্ধ করে দিও না হে ইশ্বর।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন