অপর্ণা গাঙ্গুলী
তিস্তা-তোর্সা এরা দুজনেই আমাকে ভয়ঙ্কর আকর্ষণ করে। তিস্তার রিকিঝিকি চুলে মধ্যগামী সূর্য্যের কচি কিরণমালা খেলে এক মায়া বালুচরী বিছিয়ে যায় আর তোর্সার কলোচ্ছাসে নবযৌবনা কলেজ বালিকার কলকাকলি। এইসব এলোমেলো ভালোলাগাগুলোই আমাকে আমার থেকে টেনে নিয়ে বের করে আনে প্রতিবার। তাই ওদের টানে, ওদের ডাকে ছুটে যাই।
প্রকৃতির মতো বন্ধু হয় না। যখনই কাছে যাই, তার শ্যামঞ্চল বিছানো থাকে আমার চৌদিকে। প্রচন্ড শীতে আমি সেই আঁচল বুকে পিঠে জড়িয়ে নিই। প্রকৃতির ওমে নিজেকে নিজে আরও বেশি করে চিনতে পারি। আত্মদর্শন হয়। তবু এবারে যেন অন্যরকম, এবারে যেন নতুনের ডাক। মরা নদীর বুকের ওপর দিয়ে আমরা জীপ্ হাঁকিয়ে এগিয়ে চলি। জয়ন্তী নদী। জয়ন্তী পাহাড়। বক্সা অরণ্যের গা ঘেঁষে বেয়ে চলা এক খরতোয়া ওই জয়ন্তী। বর্ষায় আশ্লেষে, আদরে, যার গা ভরে এসেছিলো যৌবনের প্লাবন, প্রবল শীতে সে এখন ন্যুব্জ বৃদ্ধা, শীর্ণা, দীর্না। শাদা খয়েরি ধূসর পাথর সমস্ত নদীবক্ষে অবিন্যস্ত ছড়ানো। রিক্তা, নিঃসঙ্গ মা তাঁর সন্তানদের বুকে করে রেখেছেন। যতদূর চোখ যায় অনাবিল চড়া। কখনো সূর্য্যের আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠেছে তার পাথর, আবার কখনো রাতগভীরে ক্লান্ত রিক্তা পাগলিনীর মতো ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে সব হারিয়ে। ভাবতে অবাক লাগে ওই পাথরের তলায়, কোন গভীরে রয়েছে নদীজল। সেই কোন জন্মের কোনকালের চরেইবেতি অঙ্গীকার নিয়ে।
আমি একা বসে ভাবি। নারী আর নদী আমার মাঝে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। সর্বংসহা ওই একদা চঞ্চলা এখন বিগতযৌবনা। আমি সকাল বিকেল জয়ন্তীর কাছে যাই। শনশন ঠান্ডায় দূরের শাল শেগুণের পাতায় পাতায় শীতের নাচন জেগে ওঠে। আর জয়ন্তী তার জীবনের গল্প বলে চলে। তাঁর পূর্ণময়তার গপ্পো, তার বয়ে যাওয়ার গপ্পো, তার ভাঙা গড়ার গপ্পো, তার রিক্ততার গপ্পো – তার সব বিলিয়ে দিয়ে দিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে চলার গপ্পো। কি বলবো, আমি জয়ন্তীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। আমি জয়ন্তীর গলা জড়িয়ে ধরে সই পাতাই। ফিরে আসার দিনে বলে আসি, আবার ফিরবো। জয়ন্তীর চোখে জল শুকিয়ে গেছে। শুধু দুটি পাথর এদিক ওদিক গড়িয়ে পড়ে। আত্মানম বিধি।
শুধু, আমি নিজেকে জয়ন্তীর মধ্যে দেখে ফেলি।
শুধু, আমি নিজেকে জয়ন্তীর মধ্যে দেখে ফেলি।
জয়ন্তী পাহাড় আর জয়ন্তী নদীর গা ঘেঁষে যে সব জঙ্গল, সেখানে ডেরা বুনো হাতি, বাইসন, এক শৃঙ্গ গন্ডার, বিভিন্ন পরিযায়ী পাখি, বন্য শূকর, পাইথন সাপ, আরো কতও কী কী বন্য প্রাণীদের। বন্যদের বনে দেখে যে সুখ, শহরের চিড়িয়াখানার ঘেরাটোপে তা নেই। তাই, একপাল হাতি ও হাতির বাচ্চারা যখন চাপড়ামারি, গরুমারা বা চিলাপাথার শুঁড়িপথে যাতায়াত করে, সে চোখে দেখা বড়ো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির নীল সবুজে ওদের ভারী অন্যরকম মায়াময় দেখায়, তা সত্যি। আমরা নাকভরে বনের গন্ধ নিই। কখনো তা গাঁদালপাতার ঝাঁঝালো গন্ধ তো কখনো কোনো স্বর্গীয় পরিমল ভেসে আসে। বনপাহাড় ভালোবাসা মানুষজনকে প্রকৃতি এইসব হঠাৎ-উপহার দিয়েই থাকে। আমি বুক ভরে নিয়ে রাখি ওই সুবাস। আমার অন্তরাত্মায় জারিয়ে থাকে সে বনগন্ধ। হাতিরা দূর থেকে কাছের থেকে মানুষ দেখে অভ্যস্ত। ওরা আমাদের খুব পাত্তা দেয় না। দূরে চলে যায়, অনেক দূরে, বনের কন্দরে। পেছনে পেছনে যায় বাচ্চা হাতিরা মায়ের লেজ ধরে। জীপের ধুলো ওড়ানো ওই আদেখলে অসভ্য দুপেয়েদের ওরা ক্ষমাঘেন্না করে দেয় বই কি।
ওদের রাজসিক হাঁটাচলার দিকে আমরা অবাক তাকিয়ে থাকি। ওদের প্রিভেসিতে বাধ সাধার জন্য মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিই।
ওদের রাজসিক হাঁটাচলার দিকে আমরা অবাক তাকিয়ে থাকি। ওদের প্রিভেসিতে বাধ সাধার জন্য মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিই।
তিরতিরে এক নাম-না-জানা নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বেশ নদী। ছোট্ট এইটুকু এক হাসিখুশি ষোড়শী। বয়ে চলেছে, বয়েই চলেছে। আর তার শব্দ যেন প্রথম জাগা পাখির ডাক। ছবিতে সে সব স্বর্গীয় ছবি ধরা যায় না। সে সব দেখতে হলে, জানতে হলে, অনুভব করতে হলে প্রকৃতির কোলের কাছে যেতে হয়। আমি কানে ভরে নিয়ে এসেছি সেই নদীশব্দ। যেন বিটোফেনের মুনলাইট সোনাটা। আমার মনে হয়, তার থেকেও সুন্দর কিছু। ছুপ ছুপ, ছিপ ছিপ, সেই অনর্গল ছন্দ আমার মনেমনে বয়ে চলেছে। দূরের সেই একরত্তি নদীটি আমাকে ডাকছে অহরহ।
সে ডাকে জ্বর আসে।
সে ডাকে জল আসে চোখ ভরে।
সে ডাকে ঘর ভোলা যায়।
সে ডাকে জ্বর আসে।
সে ডাকে জল আসে চোখ ভরে।
সে ডাকে ঘর ভোলা যায়।
ডিসেম্বরের ডুয়ার্সের বাঘ-কাঁপানো শীতে চিলাপাতার জীপ্ সাফারী। এমন অমৃতযোগ জীবনে কমই আসে, তাই লোকজনের অহেতুক হিহি শীতাতঙ্ক, পাহাড়ি কোনো মারণ ভাইরাসের (করোনা নয়) সাবধানবাণীকে অগ্রাহ্য করে হুড খোলা জীপে উঠে বসেছি। বসেছি তো বসেছি, যেন গরম জামাকাপড়ে মোড়া ‘জুবজু’। সঙ্গিনীরা চোখ ঠেরে হেসেছে। যেন আমরা সাইবেরিয়া আগত পক্ষী। সে যাক, বুকের মধ্যে এখন হাল্লা রাজার যুদ্ধ যাত্রার রণদামামা বেজে উঠেছে। আমরা প্রস্তুত। হুড খোলা জীপের পেছনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে আমাদের গাইড। সে দাঁড়িয়ে থাকবে সারাটা পথ। বন্য জন্তুর দেখা পেলে গাড়ি থামাতে বলবে তখনই। বুকের মধ্যে বুম্বুটি-বুম্বুটি-ব্যাঙ-ব্যাঙ-ব্যাঙ। সফর শুরু আর অল্পক্ষণের মধ্যেই জীপ্ ঢুকে পড়েছে চিলাপাতার সেই ঐতিহাসিক অরণ্যে। চিলাপাতা অরণ্য জলদাপাড়া ও বক্সা অরণ্যের মাঝামাঝি এক সুগভীর মহারণ্য। শোনা যায়, চিলাপাতার শুঁড়িপথ বেয়ে হাতির দল জলদাপাড়া থেকে বক্সা যাতায়াত করে। গুপ্তরাজাদের সময়ের এক কেল্লার ধ্বংসাবশেষ এখানে রয়েছে। সে যাই হোক, জঙ্গলে ঢুকতে ঢুকতেই চারিদিক আঁধার করে আসে। জীপ্ চলেছে তার গতিতে কিন্তু সূর্য্যের আলো ম্লান থেকে ম্লানতরো হয়ে আসছে যত গাছের ভিড় বাড়ছে আমাদের ঘিরে।
হুড খোলা জীপ্, তাই বসে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়েছি প্রায় সবাই। চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিতে হবে। এমনভাবে প্রকৃতির রূপ রস মধুগন্ধ বুঝি আর পাবো না। জীপের তৈরী পথ ছাড়া সবটাই গভীর অরণ্য। গাছেরা খুব কাছাকাছি জোটবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকে ওরা, হাতে হাত, শিকড়ে শিকড়। আসলে গাছেদের থাকে অনেক কিছু শেখার আছে। পৃথিবীর শুরু থেকে ওরা যেন মেসিয়ার ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে। যতই এগোই চিলাপাতার ভেতরঞ্চলে ঠাকুরদাদার মতো, পূর্বপুরুষদের মতো স্নেহপ্রদানকারী গাছেরা আমাদের জড়িয়ে ধরে। কখনো আহ্লাদে আবদারে ফেলে দিয়ে যায় ফুল পাতা গাছের ডাল। আমরা মাথা নিচু করতে করতে এগোই, গাছেরা নুইয়ে আসে আমাদের দিকে। প্রতিনমষ্কারে আমাদেরও মাথা নুইয়ে আসে।
সমস্ত জীবন ওই সংগ্রামী গাছ যুদ্ধ করে বেঁচে উঠেছে গাছ হয়ে ওঠবার জন্যেই তো। ওদের গাছ জীবন সার্থক। ওই গাছেদের গায়ে পিঠে রকমারি অর্চিড জড়িয়ে আছে পরভৃতের মতো। ঠাকুরদাদা গাছ ওদের আশ্রয় দিয়েছে দেখি। গাইড নাম বলে চলে – শাল, সেগুন, গর্জন, জারুল, শিশু আরো কত কত কী কী। দেখতে পাই, কোনো দুটি গাছ একরকম নয়। একে ওপরের থেকে আলাদা। ওদের দাঁড়াবার ভঙ্গিমায়, ওদের ঠমকে, গমকে, আলাপে, বিস্তারে, রঙে, ঢঙে, আহ্লাদে কৌতুকে ওরা প্রত্যেকে এক একটি কবিতা। ওদের গা বেয়ে অজস্র প্রজাপতি খেলে বেড়ায়। আলো আঁধারিতে ওদের মন পড়া যায়। ওই বিশাল বনস্পতিদের কাছে সৌখীন অর্কিডদের দেখে মনে হয় দয়িতের চরণচুম্বনরতা আয়তনয়না নম্রসহচরী। গাছেরা মানুষ দেখে খুশি হয়। মাথা দুলিয়ে ওরা কেমন অভিবাদন করে আমাদের। আর আমার খালি মনে হয় কোন এক অন্য পৃথিবীর, অন্য জন্মে, অন্য কালে, অন্য সময়ে পৌঁছে গেছি বুঝি বা। এ অনন্ত যাত্রা যেন পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটে চলেছে।
এসব বিচিত্র চিন্তাভাবনার জাল বোনা শুরু হয়েছে মাথার মধ্যে আর চোখ ভরে নিয়ে চলেছি সবুজে সবুজ, নীল, বেগুনে, গাঢ় হালকা হলুদ সবুজ, বেগুনি, গোলাপী, লাল আরো কত শত রঙের প্যালেট। এমনি করে বনপথে ভেসে চলেছি, হঠাৎ জীপ্ থামলো। গাইড আর চালকে খুব সম্ভবতঃ রাভা উপজাতিদের ভাষায় কথা হলো। ওরা দেখতে পেয়েছে বক। আর তার মানে কাছাকাছি বাইসন রয়েছে। বকেরা ওদের পিঠের পোকামাকড় খেয়ে সাফ করে। আরামে চক্ষু বুজে ওরা পাতা খায় তখন, বকদের কিচ্ছুটি বলেও না। বাইসনরা যখন অবলীলাক্রমে লেজ দিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে খচমচ করে পাতা খেতে লেগেছে তখন সবুজের প্রেক্ষাপটে ওদের দেখে মনে লেগেছে হচ্ছে আলতামিরা গুহাচিত্রের সেই বাইসন দম্পতি।
ঠিক তাই। কিছু দূরেই সেই বন্য মহিষের সাদা শিং প্রকট হলো। ইয়া ষণ্ডা কালো দেহ তার চারিদিকের সবুজের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাইসন দম্পতি মধ্যাহ্ন ভোজন সারছেন। মানুষকে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই। ক্যামেরাবাগেরা খচাখচ ফোটো তুলতে লাগলেন। আর আমি মন-ক্যামেরায় নথিবদ্ধ করে ফেললাম সে দৃশ্য। এখনো খিচিক করে মনের অ্যালবাম খুলে ফেললেই দেখতে পাই, সেই অদ্ভুত ছবি। বাইসনরা হাতির মতো লাজুক প্রাণী যে নয়, বোঝা গেলো। বেশ দাঁড়িয়ে রইলো ছবি তোলানোর আশায় আর এতশত কাণ্ডের পর গাড়ি আবার এগোতে লাগলো আরো আরো ঘন জঙ্গলের দিকে।
একটু এগিয়েছি হঠাৎ চোখে পড়লো এক বিশাল পাখি রামধনু পেখম মেলে উড়ে গেলো গাছের থেকে গাছে। বনময়ূর। এতো দ্রুত সে উড়ান যে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই রংমশাল জ্বালিয়ে দিয়ে উধাও হলো সে পাখি। শুধু সব গাছগুলোর গায়ে যেন ময়ূরপঙ্খী রং ধরিয়ে দিয়ে গেলো সে। সমস্ত বনান্তরে সে আলো খেলে গেলো মুহূর্তে … এগোচ্ছি আরও গভীর বনের মধ্যে, চোখে জেগে রয়েছে সতর্ক পাহারা, এই বুঝি গাছ পাতা নড়লো সরলো আর আমরা সেই প্রার্থিতজনেদের দেখা পেয়ে গেলাম। এ সব সময়কাল প্রগাঢ় সাধনার, ঈশ্বরদর্শনের সাধনার থেকে এ কম নয়। দিনের আলো যত কমে আসছে, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত মায়া, সমস্ত বনান্তর জুড়ে। এক তীব্র বুনো গন্ধ আমাদের সমস্ত চেতনায় ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। সে সমস্ত বন-বনস্পতির চোরা মায়া এক অনাস্বাদিত বিষাদের রূপ ধরে আমাদের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে। মোহগ্রস্তের মতো আমরা এগিয়ে চলেছি তো চলেছি, আরও গভীর থেকে গহনে।
কি মনে হচ্ছে সে সময় … মনে হচ্ছে এখান থেকে ফেরবার রাস্তা নেই। ফিরতেও চাই না কেউ আমরা। এই মায়া বুকে নিয়ে আমরা চিরতরে প্রকৃতির বুকে মিশে যেতে চাই …
এসব বিচিত্র চিন্তাভাবনার জাল বোনা শুরু হয়েছে মাথার মধ্যে আর চোখ ভরে নিয়ে চলেছি সবুজে সবুজ, নীল, বেগুনে, গাঢ় হালকা হলুদ সবুজ, বেগুনি, গোলাপী, লাল আরো কত শত রঙের প্যালেট। এমনি করে বনপথে ভেসে চলেছি, হঠাৎ জীপ্ থামলো। গাইড আর চালকে খুব সম্ভবতঃ রাভা উপজাতিদের ভাষায় কথা হলো। ওরা দেখতে পেয়েছে বক। আর তার মানে কাছাকাছি বাইসন রয়েছে। বকেরা ওদের পিঠের পোকামাকড় খেয়ে সাফ করে। আরামে চক্ষু বুজে ওরা পাতা খায় তখন, বকদের কিচ্ছুটি বলেও না। বাইসনরা যখন অবলীলাক্রমে লেজ দিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে খচমচ করে পাতা খেতে লেগেছে তখন সবুজের প্রেক্ষাপটে ওদের দেখে মনে লেগেছে হচ্ছে আলতামিরা গুহাচিত্রের সেই বাইসন দম্পতি।
ঠিক তাই। কিছু দূরেই সেই বন্য মহিষের সাদা শিং প্রকট হলো। ইয়া ষণ্ডা কালো দেহ তার চারিদিকের সবুজের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাইসন দম্পতি মধ্যাহ্ন ভোজন সারছেন। মানুষকে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই। ক্যামেরাবাগেরা খচাখচ ফোটো তুলতে লাগলেন। আর আমি মন-ক্যামেরায় নথিবদ্ধ করে ফেললাম সে দৃশ্য। এখনো খিচিক করে মনের অ্যালবাম খুলে ফেললেই দেখতে পাই, সেই অদ্ভুত ছবি। বাইসনরা হাতির মতো লাজুক প্রাণী যে নয়, বোঝা গেলো। বেশ দাঁড়িয়ে রইলো ছবি তোলানোর আশায় আর এতশত কাণ্ডের পর গাড়ি আবার এগোতে লাগলো আরো আরো ঘন জঙ্গলের দিকে।
একটু এগিয়েছি হঠাৎ চোখে পড়লো এক বিশাল পাখি রামধনু পেখম মেলে উড়ে গেলো গাছের থেকে গাছে। বনময়ূর। এতো দ্রুত সে উড়ান যে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই রংমশাল জ্বালিয়ে দিয়ে উধাও হলো সে পাখি। শুধু সব গাছগুলোর গায়ে যেন ময়ূরপঙ্খী রং ধরিয়ে দিয়ে গেলো সে। সমস্ত বনান্তরে সে আলো খেলে গেলো মুহূর্তে … এগোচ্ছি আরও গভীর বনের মধ্যে, চোখে জেগে রয়েছে সতর্ক পাহারা, এই বুঝি গাছ পাতা নড়লো সরলো আর আমরা সেই প্রার্থিতজনেদের দেখা পেয়ে গেলাম। এ সব সময়কাল প্রগাঢ় সাধনার, ঈশ্বরদর্শনের সাধনার থেকে এ কম নয়। দিনের আলো যত কমে আসছে, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত মায়া, সমস্ত বনান্তর জুড়ে। এক তীব্র বুনো গন্ধ আমাদের সমস্ত চেতনায় ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। সে সমস্ত বন-বনস্পতির চোরা মায়া এক অনাস্বাদিত বিষাদের রূপ ধরে আমাদের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে। মোহগ্রস্তের মতো আমরা এগিয়ে চলেছি তো চলেছি, আরও গভীর থেকে গহনে।
কি মনে হচ্ছে সে সময় … মনে হচ্ছে এখান থেকে ফেরবার রাস্তা নেই। ফিরতেও চাই না কেউ আমরা। এই মায়া বুকে নিয়ে আমরা চিরতরে প্রকৃতির বুকে মিশে যেতে চাই …
ডুয়ার্স থেকে ফেরার পর কি যে হয়েছে বুঝি না। সবুজ। সবুজ। সবুজ। সবুজ আমার তৃতীয় নেত্রে আটকে আছে । আর মস্তিষ্কের জঙ্গলের মধ্যে চারিয়ে রয়েছে জঙ্গলের গপ্পো, পাহাড়ের গপ্পো, নদীর গপ্পো। এইসব এতো কথা মনের মধ্যে চেপে না রেখে তাই কিছুমিছু লিখে ফেলছি আর কি। ওই তো দেখো না, এক একটা বনজ দৃশ্য, পপকর্নের মতো শব্দ সমভিব্যাহারে ফুটে উঠছে টুপ্ টাপ করে কেমন। এই যেমন জঙ্গলে, আরো জঙ্গলে, আরো গভীর জঙ্গলে যখন ঢুকছি তখন রক্তে যে দোলা লেগেছিলো তার অপর নামই বোধহয় থ্রিল। সে যে কি এক দুর্ভেদ্য, স্যাঁতস্যাঁতে, হীমশীতলতা আমাদের সমস্ত অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে গিয়েছিলো ভাষায় বোঝানো দুঃসাধ্য। তাই চেষ্টাও করবো না বোঝাতে, শুধু নজর রাখতে বলবো ওই সরু জীপ্ চলা রাস্তার দুটি পাশে যেখানে গাছগাছড়ার অগম অন্ধকারে একটি বুনো শুকরের পশ্চাৎদর্শনে মাত্র আমরা প্রবলতর উল্লাসেও টুঁ শব্দটিও করতে পারিনি – পাছে পালায়। শুধু বোঝা গেছে, ওদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি মানুষের থেকে অনেক বেশি কর্মক্ষম। দাঁতাল কিনা তাও দেখা সম্ভব হয়নি। অনতিদূরে একটি ছোট ওয়াচ টাওয়ার কিন্তু আমরা বুঝেছি, ওতে চড়েও লাভ নেই। হাতি বা গন্ডার দর্শনের অভীপ্সা আপাতত মাচায় তুলে রেখে এগোনো যাক আরো ভেতরে। পাখির দেখা মিলেছে এদিক ওদিক। প্রকৃত বার্ডওয়াচার না হলে সে সব পাখি কে চেনে। দেখতে বেশ কিন্তু শাটার টেপার আগেই ওরা উড়ে যায়, তাই মনের আয়নায় ওদের সাজিয়ে রাখি, বাঁধিয়ে রাখি। বান্ধবীরা কেউ কেউ ইয়া বোম্বা ক্যামেরা বাগিয়ে চমৎকার সব ছবি তুলে এনেছেন, সেই সব দেখতে থাকি আর মনটা কেবল ডুয়ার্স ডুয়ার্স করে ওঠে। সত্যি বলতে কি, প্রকৃতির যে সম্মোহনী শক্তি রয়েছে সে কথা আগেই জানি। তবু ভাবতে ইচ্ছে হয়, এই বনপথ, চাঁদিম জোছনায় কী কী না কুহক সৃষ্টি করে থাকে। একবার, শুধু একবার ঝুম জোছনায় চিলাপাতার জঙ্গলমহলে ওই অর্কিড ঢাকা জারুল গাছটাকে দুহাতের ফেরে জড়িয়ে দেখতে চাই, কেমন লাগে। ব্যাস, তারপর নাভিমূল থেকে পদ্ম একেবারে সহস্রারে – পুনর্জন্ম।
জীপের শব্দে জন্তু জানোয়ার হয়তো সজাগ হয়ে পড়ে। তবে জীপের ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ ছাড়াও রয়েছে, ময়ূরের ডাক, অন্যান্য পাখির ডাক, পাতা পড়ার শব্দ, একটানা ঝিল্লিরব। এইসব ছাপিয়ে ছিল আমাদের লাবডুব স্বাসের শব্দ। বিদেহী পূর্বজদের ফিসফাস শোনা যায় বুঝি হাওয়া বাতাসে, আনাচে, কানাচে। এ কোন অমরায় পৌঁছেছি আমরা জানি না। শুধু সব মিলিয়ে এক অনন্য নেশা লেগে গেছে আমাদের মনে। শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ, দর্শন মিলে মিশে যে নিরন্তর প্রকৃতির ইন্দ্রজালের মোহে পড়ে এগিয়ে চলেছি আমরা… সে যে এক অসাধারণ ইউটোপিয়া সে বিষয়ে সন্দেহ কি।
জঙ্গলের মধ্যে নিবিড় আঁধার। শুধু মাঝে মধ্যে সুয্যিদেব অতি সম্ভ্রমে, সন্তর্পনে ঢুকে পড়ছেন। তখন নবীন কিশোরী চিলাপাতার মায়ামুখে আলো পড়ে রঙধনু খেলে যায়। আমরাও সেই দুপুরে-আলোয় রেঙে উঠি। বলতে না বলতেই ভোজবাজির মতো সরে যায় জঙ্গল আর আমরা হাইওয়েতে উঠে পড়ি।
বিকেল নেমে পড়েছে ঝুপ করে। পাহাড়ে যেমন বিনা নোটিসে সন্ধ্যে নামে। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পাই। চিলাপাতার বনপথ মিলিয়ে যেতে থাকে দূরের থেকে দূরে। শুধু ‘প্রেতের চাদরের মতো’ মিহি হিমেল কুয়াশা ভর করে আছে সমস্ত হাইওয়ে জুড়ে। আর নিষ্প্রভ মনখারাপি আলো জ্বলে উঠেছে ওই সদ্য বিকেলেই। এই প্রথম বুকে ব্যথা বাজে। বিরহবিধুর আমি, অন্তরের নরম দীপশিখাটিতে নিজেকে দেখি।
মনে মনে বলি, ওই শিকড়ের কাছে ফিরবো, ফিরবোই। অঙ্গীকার রেখে যাই।
বিকেল নেমে পড়েছে ঝুপ করে। পাহাড়ে যেমন বিনা নোটিসে সন্ধ্যে নামে। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পাই। চিলাপাতার বনপথ মিলিয়ে যেতে থাকে দূরের থেকে দূরে। শুধু ‘প্রেতের চাদরের মতো’ মিহি হিমেল কুয়াশা ভর করে আছে সমস্ত হাইওয়ে জুড়ে। আর নিষ্প্রভ মনখারাপি আলো জ্বলে উঠেছে ওই সদ্য বিকেলেই। এই প্রথম বুকে ব্যথা বাজে। বিরহবিধুর আমি, অন্তরের নরম দীপশিখাটিতে নিজেকে দেখি।
মনে মনে বলি, ওই শিকড়ের কাছে ফিরবো, ফিরবোই। অঙ্গীকার রেখে যাই।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন