শ্যামলী আচার্য
সোসাইটি প্রত্যেকেরই আছে। একটা সামাজিক বাতাবরণে বেঁচেবর্তে থাকতে গেলে সোসাইটি তো একখানা দরকার। সোসাইটি কী? আরে বাবা সোসাইটি মানে হল চারপাশে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে ঘেঁষে ধাক্কা দিয়ে ঝগড়া করে মুখঝামটা দিয়ে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে গলা জড়িয়ে আহ্লাদ করে থাকা – মোদ্দা কথা হল একসঙ্গে থাকা। পাশাপাশি। গলাগলি না হোক, ঠেলাঠেলিই সই।
ইহলোক অর্থাৎ কিনা মর্ত্যলোকের এখন বহু সোসাইটি। দুর্গাপুজোর আগে চাঁদাপার্টি, দুর্গাপুজোর সময় অঞ্জলি দেওয়ার লাইন এবং ভোগ বিতরণে ব্যস্ত ভলান্টিয়ার, পুজোর পরে বিজয়া সম্মিলনী নিয়ে কালচারাল ক্যাচাল বাধানো পাবলিক, ভাসানের সময় বাজি ফাটানো হল্লা মাচানো দল। মোট কথা ওই এক দুর্গাপুজো ঘিরেই নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান। একটা পাড়ায় কম করে তিনটি দল। কেউ দুর্গাপুজোয় নিবেদিতপ্রাণ। কেউ কালীপুজোয় কঠিন তরল নানাবিধ আগুনে রক্ত গরম করতে চায়। কেউ আবার ছুটকোছাটকা কালচার-ফালচার নিয়ে চারপাশে একটা সমীহ আদায় করার চেষ্টা করে। মোটকথা প্রত্যেকেরই চারপাশে এখন একটা বলয়। ফ্যানবলয়। মাথার পেছনে আলগা জ্যোতি। ক্যালেণ্ডারের ঠাকুরদের পিছনে যেমন থাকে আর কি। দু’বেলা খেতে পাক বা না পাক, হাতে দামি ফোন, আত্মবিশ্বাস মজবুত করার জন্য পাঁচ আঙুলে সতেরোটা আংটি। পরিশ্রম আর কৌতূহলের ঘামতেলে চকচকে মুখ। দেখে মনে হয় সদ্য ফেশিয়াল।
সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে কালচার্ড মানুষজন অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছেন। আগে মহিলারা নাইটি পরেই ভোরবেলা ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর’ গেয়ে কিংবা ঘোর গ্রীষ্মের দুপুরে আবেগঘন গলায় ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ বলে ফেবুতে পোস্ট করে ফেলতেন। ঘামের ফোঁটা না চোখের জল, বোঝে কার সাধ্যি? পুরুষের তখন এত ‘লাইভ’ বাতিক ছিল না। করোনা এসে জেন্ডার বায়াসনেস ঘুচিয়ে দিয়েছে। এখন আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান। বউ গান গাইলে বর দেরাজ ঘেঁটে কবিতার খাতার ধুলো ঝাড়েন। দেবী চার লাইন পদ্য লিখলে দ্যাবা অবধারিত চাট্টি নাটকের ডায়ালগ প্র্যাকটিস করে নেন গলা কাঁপিয়ে। এই লকডাউনে তো শুরু হল সেলফির ধূম। পাড়ার গ্রসারি শপেই এখন মাস্ক আর সেলফি স্টিক পাওয়া যায়। এখনও একটা কিনলে একটা ফ্রিয়ের কনসেপ্ট শুরু হয়নি। হল বলে। জুম, হ্যাংআউট, মীট নিয়ে সংস্কৃতিবান মানুষেরা নিজেদের ক্রমশ আপডেট করছেন। ক্যামেরা জুম করে এতদিন শুধু কুয়াশার আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুঁজতেন, এখন শেষবেলার ছাদে সূর্যের এক্সক্লুসিভ পোজ খোঁজেন। শুধুমাত্র ফেবুর দেওয়ালে লটকানোর জন্যই। বাড়িতে এখন কার্ডবোর্ড বা প্লাস্টিকের ছ্যাতরানো অ্যালবামের বদলে হার্ড ডিস্কের জিবি ভর্তি। উড়ে গেলে জান-মান-প্রাণ সব গেল। হ্যাংআউটে আগে শুধু উইকএণ্ডে ভালমন্দ সাঁটাতে যেতেন। এখন লেটেস্ট কবিতা নিয়ে সেখানে মিটিং চলে। অপছন্দের প্রসঙ্গ এলেই অপ্রিয় কথা এড়িয়ে টুক করে কেটে পড়া যায়। অজুহাত তো মজুত। নেটওয়ার্ক প্রবলেম বা ডেটা ফুরিয়ে গেছে। গুগল মীট তো যেন ডিজিটাল কবিসম্মেলন। ঘরে বসে দলে দলে যোগ দিন। কেউ কেউ নয়, এখন সকলেই কবি। শুধু ‘লাইভ’ ক্যামেরার সামনে বসার সময় বৌয়ের ড্রেসিংটেবিল থেকে চুপি চুপি কনসিলার বা ফাউণ্ডেশন তুলে বাথরুমের আয়নার সামনে চলে যান। আর ছেলের পড়ার টেবিল থেকে টেবল ল্যাম্প। আলো যেন মুখেই পড়ে। আহা, সোসাইটিতে একটা ইমেজ আছে না?
এরা কেউ কাউকে সামনে ঘাঁটায় না। কিন্তু এইসব কালচারাল সোসাইটির লোকেদের হেবি ঘ্যাম। তারা প্রকাশ্যে খোলাখুলি কিছু বলেন না। প্যাণ্ডেলের বাঁশ, সরস্বতীর হাঁস, গণেশের ধুতির কাছা বা বিজয়া সম্মিলনীর ডিজে মাচা নিয়ে এরা একেবারে নিরুত্তাপ। উদাসীন শিল্পী যেন! সারাদিনই ঘাসের পাশে ট্রামলাইন খুঁজছেন… যেন এই মরপৃথিবীর কিছুতেই তাদের কিছু এসে যায় না। হাবভাব এমন, সব লেখা জমিয়ে রাখার জন্য এরা বড়সড় ট্রাংক অর্ডার দিয়েছেন। নিজেরাই সর্বত্র লেখা পাঠান। ছাপা হলে বলেন, আমন্ত্রিত। প্রকাশিত না হলে মনে মনে সম্পাদকের মুণ্ডপাত। প্রকাশ্যে জল মেপে নেওয়া, কেউ কি জানে? টের পেল কেউ? চুপিচুপি সারাদিন খোঁজ… কোন পুরস্কার পেতে গেলে কত পথ পেরোতে হয় যেন! সার্ফে কাচা ঝকঝকে নীল আকাশ দেখে চার লাইন কবিতা লিখেই ফেসবুকে পোস্ট। আনমনা দেখে নেওয়া কত লাইক। এদের লাইকের একক ‘কে’। কত ‘কে’ ভিউ। ‘কে’ তে টান পড়লেই মন মাতাল। বুঝল না, কেউ বুঝল না। না না, লতাজির গানের কথা ভাবলে হবে না, না বোঝা নিয়ে বৌদ্ধযুগের কোনও কবির পালিভাষার কোটেশন পেলে বড় ভাল হত। সোসাইটিতে একটা ইয়ে আছে না! এরা পেছনে বাছা বাছা মন্তব্য করেন। উড়ো খইয়ের মতো হাওয়ায় ভাসানো মন্তব্য মোটেই নয়। রীতিমতো বিঁধে যাওয়া কাঁটা, ফুটে যাওয়া হুল। সেসব মন্তব্যের আবার রেকর্ড থাকে না কোনও। থাকলেই মুশকিল। কে জানে কে কোথায় নিয়ে নেবে স্ক্রিনশট! যদিও মাঝেসাঝে নেগেটিভ পাবলিসিটিও বড় দরকার।
আসলে কালচার ব্যাপারটাই অমন। হিংসের জেনারেটর। যত গরম, তত প্রয়োজন বাড়তির দিকে। তখন গরম কমাতে প্রয়োজন ফ্যান। এ ফ্যান সে ফ্যান নয়। এ হল ভক্ত। ভক্ত সোসাইটি। এক-আধজন নয়, একেবারে দলবদ্ধ বিনীত ভক্তকুল। ধরা যাক, ‘কবির বারান্দা’ ফ্যান ক্লাব। সেখানে নানান নামের ছড়াছড়ি। বনলতা সেন থেকে অপর্ণা সুচিত্রা নামে বহু সেনেদের ভিড়। নিজের নাম, ছদ্মনাম। কেউ বনফুল, কেউ ঝোড়ো কাক, কেউ বুনোঝোপ, কেউ নিশিডাক। কে কী কেন, অত জানতে নেই। মানিকদা যেন কোন শিশুপাঠ্য গল্পে বলেছেন, বেশি জানলে জিঞ্জিরিয়া হয়।
পাড়ায় কেউ কবি বা নাট্যকার অথবা অভিনেতা বা গাইয়ে অথবা নৃত্যশিল্পী থাকলে, আর সেই মানুষটি কোনওক্রমে চারটি ঝাঁ-চকচকে চ্যানেলে কম্প্যাক্ট-রুজ-আইলাইনার শোভিত মুখ দেখালে আর রক্ষে নেই। পুরো পাড়ার গ্ল্যামার চলকে পড়ছে। টিভির রিয়েলিটি শোতে দাদা বা দিদির আতিথেয়তা পেলে তো কথাই নেই। গ্ল্যামার কোশেন্ট হু হু করে বাড়ছে। একদম যেন করোনার ঊর্ধমুখী জ্বর আর ম্যালেরিয়ার কাঁপুনির যুগলবন্দী। কে জানিত এত শিল্পীর সমাহার অলিতেগলিতে! আরে ভাই, চারপাশে বাকি সব মিডিওকার, বুঝলেন না? এই এঁদের চরম আক্ষেপ। মধ্যমেধার দাপটে কেউ খুঁজেই নিতে পারছে না প্রকৃত প্রতিভা। তা না হলে হিং আর গোলমরিচ ফোড়ন দিয়ে দই সরষেবাটায় কষিয়ে জায়ফল জয়িত্রীর গুঁড়ো দিয়ে নামিয়ে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে যে মাংসের প্লেট দেখিয়ে অতনুবৌদি (মানে, অতনুদা’র বউ, তার নাম জানা নেই আসলে) রেড চ্যানেলে রাঁধুনী নাম্বার ওয়ান হয়, তারই কিনা ডাক পড়ে পাড়ার দুর্গাপুজোর উদ্বোধনে ফিতে কাটতে? আর তার পাশের ব্লকের তিনতলার ফ্ল্যাটেই যে সাহিত্যসেবীর বাস, তার ইনস্টাগ্রাম আর ফেসবুক কেউ চেয়েই দেখল না? এই জন্যই বলে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। দীর্ঘশ্বাসে করোনা ভাইরাস মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।
এইসব কালচার্ড লোকেদেরও একটা সোসাইটি আছে। একটা গুপ্ত সমিতি। সেখানে অবিশ্যি কেউ কারও বন্ধু নন। এঁরা কোটেশন দেন, সকলেই এবং প্রত্যেকে একা। তা হোকগে। এদিক সেদিক যেতে গেলে একা যাওয়া যায় নাকি? একা ফেরাও যায় না। পুরস্কারের বেলা আলাদা কথা। তখন আকেলে হাম, আকেলে তুম। দেঁতো হাসি, সুললিত ভাষণ। ছেলেবেলায় বাড়ির পাশের কলোনির ইশকুলের কথা বলতে হয়, আলতো করে এড়িয়ে যেতে হয় সেই ইশকুলে আদৌ পড়েছিলেন কিনা। বলতে হয় কুয়োতলা, টিনের মগ, অ্যালুমিনিয়ামের সুটকেস, জলন্যাকড়া আর শ্লেট-পেনসিলের গপ্পো। বাজারে সবই বিকোয়। যত উচ্চতা, ততই মাটির কাছাকাছি থাকার হাবভাব। ঘাসের গন্ধ শুধু নয়, আরেকটু আবেগ ঢাললে তার স্বাদের খবরও দিয়ে দিতে পারবেন বিস্তারিত। আর সেই শুনে ভক্তজন, আবেগে আপ্লুত হন। সোসাইটি নানাবিধ। কালচারাল সোসাইটির কথাই হচ্ছিল। যাঁরা সর্বঘটে, সর্বভূতে বিরাজমান। এঁদের বাদ দিলে পানসে জীবন। লাইফকে জিঙ্গালালা করে তুলতে কালচার আপনার সঙ্গে রাখুন। আর নাম লেখান কালচার্ড সোসাইটিতে।
ইহলোক অর্থাৎ কিনা মর্ত্যলোকের এখন বহু সোসাইটি। দুর্গাপুজোর আগে চাঁদাপার্টি, দুর্গাপুজোর সময় অঞ্জলি দেওয়ার লাইন এবং ভোগ বিতরণে ব্যস্ত ভলান্টিয়ার, পুজোর পরে বিজয়া সম্মিলনী নিয়ে কালচারাল ক্যাচাল বাধানো পাবলিক, ভাসানের সময় বাজি ফাটানো হল্লা মাচানো দল। মোট কথা ওই এক দুর্গাপুজো ঘিরেই নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান। একটা পাড়ায় কম করে তিনটি দল। কেউ দুর্গাপুজোয় নিবেদিতপ্রাণ। কেউ কালীপুজোয় কঠিন তরল নানাবিধ আগুনে রক্ত গরম করতে চায়। কেউ আবার ছুটকোছাটকা কালচার-ফালচার নিয়ে চারপাশে একটা সমীহ আদায় করার চেষ্টা করে। মোটকথা প্রত্যেকেরই চারপাশে এখন একটা বলয়। ফ্যানবলয়। মাথার পেছনে আলগা জ্যোতি। ক্যালেণ্ডারের ঠাকুরদের পিছনে যেমন থাকে আর কি। দু’বেলা খেতে পাক বা না পাক, হাতে দামি ফোন, আত্মবিশ্বাস মজবুত করার জন্য পাঁচ আঙুলে সতেরোটা আংটি। পরিশ্রম আর কৌতূহলের ঘামতেলে চকচকে মুখ। দেখে মনে হয় সদ্য ফেশিয়াল।
সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে কালচার্ড মানুষজন অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছেন। আগে মহিলারা নাইটি পরেই ভোরবেলা ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর’ গেয়ে কিংবা ঘোর গ্রীষ্মের দুপুরে আবেগঘন গলায় ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ বলে ফেবুতে পোস্ট করে ফেলতেন। ঘামের ফোঁটা না চোখের জল, বোঝে কার সাধ্যি? পুরুষের তখন এত ‘লাইভ’ বাতিক ছিল না। করোনা এসে জেন্ডার বায়াসনেস ঘুচিয়ে দিয়েছে। এখন আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান। বউ গান গাইলে বর দেরাজ ঘেঁটে কবিতার খাতার ধুলো ঝাড়েন। দেবী চার লাইন পদ্য লিখলে দ্যাবা অবধারিত চাট্টি নাটকের ডায়ালগ প্র্যাকটিস করে নেন গলা কাঁপিয়ে। এই লকডাউনে তো শুরু হল সেলফির ধূম। পাড়ার গ্রসারি শপেই এখন মাস্ক আর সেলফি স্টিক পাওয়া যায়। এখনও একটা কিনলে একটা ফ্রিয়ের কনসেপ্ট শুরু হয়নি। হল বলে। জুম, হ্যাংআউট, মীট নিয়ে সংস্কৃতিবান মানুষেরা নিজেদের ক্রমশ আপডেট করছেন। ক্যামেরা জুম করে এতদিন শুধু কুয়াশার আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুঁজতেন, এখন শেষবেলার ছাদে সূর্যের এক্সক্লুসিভ পোজ খোঁজেন। শুধুমাত্র ফেবুর দেওয়ালে লটকানোর জন্যই। বাড়িতে এখন কার্ডবোর্ড বা প্লাস্টিকের ছ্যাতরানো অ্যালবামের বদলে হার্ড ডিস্কের জিবি ভর্তি। উড়ে গেলে জান-মান-প্রাণ সব গেল। হ্যাংআউটে আগে শুধু উইকএণ্ডে ভালমন্দ সাঁটাতে যেতেন। এখন লেটেস্ট কবিতা নিয়ে সেখানে মিটিং চলে। অপছন্দের প্রসঙ্গ এলেই অপ্রিয় কথা এড়িয়ে টুক করে কেটে পড়া যায়। অজুহাত তো মজুত। নেটওয়ার্ক প্রবলেম বা ডেটা ফুরিয়ে গেছে। গুগল মীট তো যেন ডিজিটাল কবিসম্মেলন। ঘরে বসে দলে দলে যোগ দিন। কেউ কেউ নয়, এখন সকলেই কবি। শুধু ‘লাইভ’ ক্যামেরার সামনে বসার সময় বৌয়ের ড্রেসিংটেবিল থেকে চুপি চুপি কনসিলার বা ফাউণ্ডেশন তুলে বাথরুমের আয়নার সামনে চলে যান। আর ছেলের পড়ার টেবিল থেকে টেবল ল্যাম্প। আলো যেন মুখেই পড়ে। আহা, সোসাইটিতে একটা ইমেজ আছে না?
এরা কেউ কাউকে সামনে ঘাঁটায় না। কিন্তু এইসব কালচারাল সোসাইটির লোকেদের হেবি ঘ্যাম। তারা প্রকাশ্যে খোলাখুলি কিছু বলেন না। প্যাণ্ডেলের বাঁশ, সরস্বতীর হাঁস, গণেশের ধুতির কাছা বা বিজয়া সম্মিলনীর ডিজে মাচা নিয়ে এরা একেবারে নিরুত্তাপ। উদাসীন শিল্পী যেন! সারাদিনই ঘাসের পাশে ট্রামলাইন খুঁজছেন… যেন এই মরপৃথিবীর কিছুতেই তাদের কিছু এসে যায় না। হাবভাব এমন, সব লেখা জমিয়ে রাখার জন্য এরা বড়সড় ট্রাংক অর্ডার দিয়েছেন। নিজেরাই সর্বত্র লেখা পাঠান। ছাপা হলে বলেন, আমন্ত্রিত। প্রকাশিত না হলে মনে মনে সম্পাদকের মুণ্ডপাত। প্রকাশ্যে জল মেপে নেওয়া, কেউ কি জানে? টের পেল কেউ? চুপিচুপি সারাদিন খোঁজ… কোন পুরস্কার পেতে গেলে কত পথ পেরোতে হয় যেন! সার্ফে কাচা ঝকঝকে নীল আকাশ দেখে চার লাইন কবিতা লিখেই ফেসবুকে পোস্ট। আনমনা দেখে নেওয়া কত লাইক। এদের লাইকের একক ‘কে’। কত ‘কে’ ভিউ। ‘কে’ তে টান পড়লেই মন মাতাল। বুঝল না, কেউ বুঝল না। না না, লতাজির গানের কথা ভাবলে হবে না, না বোঝা নিয়ে বৌদ্ধযুগের কোনও কবির পালিভাষার কোটেশন পেলে বড় ভাল হত। সোসাইটিতে একটা ইয়ে আছে না! এরা পেছনে বাছা বাছা মন্তব্য করেন। উড়ো খইয়ের মতো হাওয়ায় ভাসানো মন্তব্য মোটেই নয়। রীতিমতো বিঁধে যাওয়া কাঁটা, ফুটে যাওয়া হুল। সেসব মন্তব্যের আবার রেকর্ড থাকে না কোনও। থাকলেই মুশকিল। কে জানে কে কোথায় নিয়ে নেবে স্ক্রিনশট! যদিও মাঝেসাঝে নেগেটিভ পাবলিসিটিও বড় দরকার।
আসলে কালচার ব্যাপারটাই অমন। হিংসের জেনারেটর। যত গরম, তত প্রয়োজন বাড়তির দিকে। তখন গরম কমাতে প্রয়োজন ফ্যান। এ ফ্যান সে ফ্যান নয়। এ হল ভক্ত। ভক্ত সোসাইটি। এক-আধজন নয়, একেবারে দলবদ্ধ বিনীত ভক্তকুল। ধরা যাক, ‘কবির বারান্দা’ ফ্যান ক্লাব। সেখানে নানান নামের ছড়াছড়ি। বনলতা সেন থেকে অপর্ণা সুচিত্রা নামে বহু সেনেদের ভিড়। নিজের নাম, ছদ্মনাম। কেউ বনফুল, কেউ ঝোড়ো কাক, কেউ বুনোঝোপ, কেউ নিশিডাক। কে কী কেন, অত জানতে নেই। মানিকদা যেন কোন শিশুপাঠ্য গল্পে বলেছেন, বেশি জানলে জিঞ্জিরিয়া হয়।
পাড়ায় কেউ কবি বা নাট্যকার অথবা অভিনেতা বা গাইয়ে অথবা নৃত্যশিল্পী থাকলে, আর সেই মানুষটি কোনওক্রমে চারটি ঝাঁ-চকচকে চ্যানেলে কম্প্যাক্ট-রুজ-আইলাইনার শোভিত মুখ দেখালে আর রক্ষে নেই। পুরো পাড়ার গ্ল্যামার চলকে পড়ছে। টিভির রিয়েলিটি শোতে দাদা বা দিদির আতিথেয়তা পেলে তো কথাই নেই। গ্ল্যামার কোশেন্ট হু হু করে বাড়ছে। একদম যেন করোনার ঊর্ধমুখী জ্বর আর ম্যালেরিয়ার কাঁপুনির যুগলবন্দী। কে জানিত এত শিল্পীর সমাহার অলিতেগলিতে! আরে ভাই, চারপাশে বাকি সব মিডিওকার, বুঝলেন না? এই এঁদের চরম আক্ষেপ। মধ্যমেধার দাপটে কেউ খুঁজেই নিতে পারছে না প্রকৃত প্রতিভা। তা না হলে হিং আর গোলমরিচ ফোড়ন দিয়ে দই সরষেবাটায় কষিয়ে জায়ফল জয়িত্রীর গুঁড়ো দিয়ে নামিয়ে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে যে মাংসের প্লেট দেখিয়ে অতনুবৌদি (মানে, অতনুদা’র বউ, তার নাম জানা নেই আসলে) রেড চ্যানেলে রাঁধুনী নাম্বার ওয়ান হয়, তারই কিনা ডাক পড়ে পাড়ার দুর্গাপুজোর উদ্বোধনে ফিতে কাটতে? আর তার পাশের ব্লকের তিনতলার ফ্ল্যাটেই যে সাহিত্যসেবীর বাস, তার ইনস্টাগ্রাম আর ফেসবুক কেউ চেয়েই দেখল না? এই জন্যই বলে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। দীর্ঘশ্বাসে করোনা ভাইরাস মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।
এইসব কালচার্ড লোকেদেরও একটা সোসাইটি আছে। একটা গুপ্ত সমিতি। সেখানে অবিশ্যি কেউ কারও বন্ধু নন। এঁরা কোটেশন দেন, সকলেই এবং প্রত্যেকে একা। তা হোকগে। এদিক সেদিক যেতে গেলে একা যাওয়া যায় নাকি? একা ফেরাও যায় না। পুরস্কারের বেলা আলাদা কথা। তখন আকেলে হাম, আকেলে তুম। দেঁতো হাসি, সুললিত ভাষণ। ছেলেবেলায় বাড়ির পাশের কলোনির ইশকুলের কথা বলতে হয়, আলতো করে এড়িয়ে যেতে হয় সেই ইশকুলে আদৌ পড়েছিলেন কিনা। বলতে হয় কুয়োতলা, টিনের মগ, অ্যালুমিনিয়ামের সুটকেস, জলন্যাকড়া আর শ্লেট-পেনসিলের গপ্পো। বাজারে সবই বিকোয়। যত উচ্চতা, ততই মাটির কাছাকাছি থাকার হাবভাব। ঘাসের গন্ধ শুধু নয়, আরেকটু আবেগ ঢাললে তার স্বাদের খবরও দিয়ে দিতে পারবেন বিস্তারিত। আর সেই শুনে ভক্তজন, আবেগে আপ্লুত হন। সোসাইটি নানাবিধ। কালচারাল সোসাইটির কথাই হচ্ছিল। যাঁরা সর্বঘটে, সর্বভূতে বিরাজমান। এঁদের বাদ দিলে পানসে জীবন। লাইফকে জিঙ্গালালা করে তুলতে কালচার আপনার সঙ্গে রাখুন। আর নাম লেখান কালচার্ড সোসাইটিতে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
দুর্দান্ত, জিনিয়াস তুমি