আনোয়ারা আজাদ
সিভিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছিল মেঘনা। চোখ আটকালো একটাতে। দু’বার দেখার পর নিশ্চিত হয়ে চেয়ারের পেছনে মাথা হেলালো। তার ওপরই দায়িত্ব পড়েছে প্রাথমিক বাছাই হওয়া আবেদন পত্রগুলোর ভেতর থেকে দশ জনকে সাক্ষাতকারের জন্য চিঠি দিয়ে জানানোর। নেওয়া হবে তিনজন। স্মৃতি থেকে আবর্জনাগুলো সরিয়ে ফেলতে চাইলেও কেন সরানো যায় না ভেবে সে বিরক্ত হলো খুব। পৃথিবীটাকে সুন্দরভাবে দেখার জন্য যত সাধনাই করুক না কেন, পৃথিবী তা হতে দেয় না। বার বার গালে চড় মেরে ক্ষতবিক্ষত করার জন্য মুখিয়ে থাকে! চেয়ার থেকে মাথা সরিয়ে এনে আবার দেখে মেঘনা, নাহ্, ঐ ঠিকানাই।
সেবার পরীক্ষাটা দিতে না পারলে আজ এখানে বসার চিন্তা বা যোগ্যতা কোনোটাই তার হতো না। কোথায় হারিয়ে যেত স্বপ্ন টপ্ন সব। সেই সময়টায় কোনোভাবেই জোড়াতালি দিয়েও পরীক্ষার ফিস জোগাড় হচ্ছিল না। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট হওয়ায় পড়াশোনার স্বপ্ন বুকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে এগোচ্ছিল তারা। মা বলতো, কষ্টের জীবন নয়, তোরে সুন্দর একটা জীবন দিতে চাই আমি। একেবারে নিরক্ষর মা স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল অন্যের বাড়িতে হাঁড়ি পাতিল মাজার কাজ করতে করতেই এবং তাকেও স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল।
সেই স্বপ্ন বুকে নিয়েই ভর দুপুরে নয়, তার খানিকটা আগেই বাড়িটায় ঢুকেছিল মেঘনা। না গিয়ে উপায় ছিল না। উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষাটা সেবারে না দিলে আর কোনোদিনই সম্ভব হতো না। জানতো সে। সজল বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। বলতো, আর কত পড়বি? মা ঘরে বউ চান। বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। একা একা থাকেন। আসলে সজলরা চেয়েছিল মোটামুটি লিখতে পড়তে জানা একটা গরীব মেয়েকে ঘরে এনে ঠিকা ঝি’টাকে বিদায় করতে।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই তাই ছোট খাটো হলেও চাকরিটা যোগাড় করতে পেয়ে মা মেয়েতে বেঁচে গিয়েছিল। তবে এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চরম মূল্যটা সেই দুপুরেই দিতে হয়েছিল তাকে। শরীর ধুয়ে টুয়ে সাফ করা গেলেও মানসিক ধ্বস নেমেছিল মেঘনার জীবনে। বুড়ো লোকটাই যে তাকে ভুলিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে ভাবতেও পরেনি সে। মা প্রায়ই লাল রংয়ের বাড়িটাতে এটা ওটা কাজ করে দিত বলে বুড়োর জোয়ান ছেলেটার সেই সময়টায় ঘরে না থাকার বিষয়টা জানতো। কিন্তু বুড়ো!
রক্তাত্ত শরীরে হাতে কিছু টাকা নিয়ে টিনের ছাপড়া ঘরটায় যখন সে পৌঁছোয়, মা’ই সব সামলে সুমলে নিয়েছিল। বলেছিল, শোন,গরীব, ধনী সব মাইয়াদেরই এই পৃথিবীতে চরম মূল্য দিয়াই টিইক্যা থাকতি হয়। মন থন ঝাইড়া ফেলা সব। কিচ্ছু হয় নাই তর, কাউরে কিছু জানানোরও দরকার নাই। তবুও ভালোবাসার কারণে সত্য কথাটা জানানোর পর তার প্রেমিক সজল, যে ঘন ঘন তাগাদা দিত বিয়ের জন্য, তাকে এক কথায় বাতিল করে চলে গেল। তাতে কষ্ট পেলেও কেন জানি নির্ভার মনে হয়েছিল মেঘনার আর বুঝে গিয়েছিল যে, পৃথিবীতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো উত্তম কাজ আর নেই!
সামান্য চাকরিটার জন্য সিভিতে যার নাম দেখছে, কে হতে পারে বুড়োটার? বখে যাওয়া ছেলেটাতো নয়। তৃতীয় প্রজন্মে এসেই তাহলে দাম্ভিকতার অবসান হলো! নামের শেষের অংশের মিল দেখে নিশ্চিত হলে চেয়ার ছেড়ে উঠে ছোট্ট নিরিবিলি অফিস রুমের দরজা আটকালো মেঘনা। জানালাও। টেবিল থেকে সিভিটা হাতে উঠিয়ে হা হা করে হাসলো খানিকক্ষণ। এতোদিনেও জমে থাকা কষ্টগুলো, যা তাকে প্রান খুলে হাসা থেকে বিরত করে, মানুষের মাঝে সহজ হতে কুন্ঠিত করে, হাওয়ায় উড়তে থাকলে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলো না মেঘনা। দ্রুত খাম হাতে নিল ঠিকানা লেখার জন্য। ছেলেটির অবয়বে বুড়োর ক্ষতবিক্ষত মুখ দেখতে চায় সে!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন