অদিতি ঘোষদস্তিদার
“ঠামি এখন কেমন রে? আজও ডাক্তারবাবু এসেছিলেন দেখলাম!”
ফ্ল্যাটের ছাদে রিনি দাঁড়িয়েছিল। মিমি এসে দাঁড়াল পাশটিতে।
“ওই একই রকম! শরীর তো মোটামুটি ঠিকই, অসুখ আসলে মনে!”
“দাদু চলে যাবার পর থেকেই এমন, না রে?”
“হ্যাঁরে, সব ব্যাপারে দাদুর ওপর এতো ডিপেন্ডেন্ট ছিলেন, এখন উনি ভাবতেই পারেন না কী করে একা বাঁচবেন!”
“একা কোথায়! তোরা তো আছিস!
“তাতে কী? দাদু তো নেই! জানিস ঠামি কী পরবেন, কী রাঁধবেন, সব দাদু বলে দিতেন। কোথাও ঠামি একা কোনদিন যাননি।”
“সে কী রে? এমন হয়?”
“ঠামির মা হুগলিতে থাকতেন। খুব বাড়াবাড়ি অবস্থার খবর যখন এলো, দাদু কলকাতার বাইরে। ঠামি যাননি জানিস! দাদু দু’দিন পর এসে যখন নিয়ে গেলেন সব শেষ!”
“সত্যি?”
“হ্যাঁরে দাদুর ছায়া যেন!”
“আমার ঠাম্মা তো কতবার বলছেন ওনাদের ওয়াকিং ক্লাবে যেতে, কত কিছু হয় ওখানে।”
মিমির ঠাম্মা মানে শর্মিলা। রিনির ঠামির বন্ধু। মাঝে মাঝে আসেন। খুব অ্যাক্টিভ। স্থানীয় ওয়াকিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। ক্লাবটার শুরু শর্মিলার হাত ধরেই। এলাকার সব মেয়ে বৌদের সদস্য করিয়েছেন প্রায় একার প্রচেষ্টায়।
“তোর ঠাম্মা এই বয়সেও যা দাপিয়ে বেড়ান! এই দুর্দিনে ক্লাব যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াল!
“কমিউনিটি কিচেন থেকে শুরু করে শীতের কম্বল, কি না হল বল! সব বাড়ির মেয়েরা পালা করে সাহায্য করলেন। তোর ঠামিও তো আসতে পারেন। মনটা ভালো হয়।”
“আগেই যাননি, আর এখন? ঠামির এখন একা বাড়ির মধ্যেও হাঁটতেও ভয়!”
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো। রিনি এইসময় রোজ একবার ঠামির ঘরে যায়। ইরাবতী বেশির ভাগ সময়ই চুপচাপ শুয়ে থাকেন। রিনি গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, গান শোনায়। একটু কথাবার্তা বলে। কখনো কখনো একসঙ্গে টিভি দেখে।
নানান চ্যানেল ঘোরাচ্ছিল রিনি যদি কিছু ঠামির পছন্দ হয়। চারদিকে পরিবেশ এখন খুব উত্তপ্ত। সেই খবরই দেখাচ্ছে সব চ্যানেলে।
টিভির পর্দায় এখন বড় করে এক বৃদ্ধা মহিলার মুখ! পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে হল্লা। ইরাবতীর কোন ব্যাপারেই আজকাল তেমন তাপ উত্তাপ নেই। কিন্তু হঠাৎ এখন যেন বেশ উত্তেজিত।
“ও কে দিদিভাই! পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন বুড়ি মানুষটাকে! চশমাটা দে তো, ভালো করে দেখি!”
ঠামি উঠে বসতে যাচ্ছে দেখে পিঠে দুটো বালিশ দিয়ে দিল রিনি।
“ওনাকে চেনো না তুমি? সত্যি?”
শাহানবাগের দাদির গল্প ছোট করে ঠামিকে বললো রিনি। কত রাস্তা হেঁটে, কত কষ্ট সয়েও বার বার প্রতিবাদে সামিল!
টিভির স্ক্রিন জোড়া এখন বিলকিসের মুখ। সংবাদ পাঠিকা বলে যাচ্ছেন, “ঠিক একবছর আগেও দিল্লির হাড় কাঁপানো শীত সহ্য করে এক মাসের ওপর সময় অবস্থান নিয়ে ছিলেন….”
গত বছরও?
গত বছর এই সময় কী করছিলেন ইরাবতী? তার আগের বছর! তার আগের? আরো আগের?
“কিসের জন্যে এমন বার বার ছুটে আসেন উনি? এত ঝামেলা ঘাড়ে নেন!”
“অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ঠামি! আঙুল উঁচিয়ে বলেন কাউকে ভয় পান না!”
“কাউকে নয়? অশান্তিরও নয়?” আপনমনে বিড়বিড় করলেন ইরা।
রিমির কানে পৌঁছোলনা সে কথা। উচ্ছ্বসিত হয়ে সে তখন বলেই চলেছে,
“এক সাধারণ খেটে খাওয়া ঘরের মহিলা হয়েও বিলকিস ঠাঁই করে নিয়েছেন টাইমস এর মত ম্যাগাজিনে, বিশ্বের সেরা একশো প্রভাবশালীর তালিকায়! তাঁর কথায়, জানো ঠামি, হাজার হাজার তোমার বয়েসি মহিলা দূর থেকে হেঁটে এসে জড় হয়েছিলেন অধিকারের দাবিতে।”
“এত পায়ের জোর, একলা চলার শক্তি কোথা থেকে পায় ওরা?”
হঠাৎ মাকে মনে পড়ল ইরাবতীর। শুনেছিলেন শেষসময় পর্যন্ত খালি দরজার দিকে তাকিয়ে “ইরা”, ”ইরা” করছিলেন।
সুভাষ ঘরে ঢুকলেন। রিমির বাবা। অফিস থেকে ফিরে রোজই প্রায় এইসময় মায়ের খোঁজখবর নেন।
“বাহ্! এই তো মা আজকে উঠে বসেছ! বেশ! বেশ! এইভাবে শুয়ে থাকলে কি আমাদের ভালো লাগে বল?”
“জানো বাবা, বিলকিসকে টিভিতে দেখে ঠামি উত্তেজনায় উঠে বসেছে! খুব ইন্সপায়ার্ড!”
“কী? কাকে দেখে?”
কোঁচকানো ভুরু সুভাষের চোখ এখন টিভির পর্দায়। ঘোষিকার পেছনে উত্তাল জনতা।
“এই সব দেখছিস তোরা বসে বসে? ও সব গিমিক মা! খবরদার ওসবে মেতো না! সব রাজনীতির খেলা! বাড়ির বৌ ঝিদের রাস্তায় বের করতেও একটু বাধে না ওদের!”
টিভির রিমোট সুভাষের হাতে।
“অমন করে বলছো কেন বাবা? ঠামি হয়ত ওনাদের দেখে একটু হাঁটার ভরসা পাচ্ছিল! ”
উতলা রিনি।
“আঃ! মনে জোর আনতে এইসব! গীতাপাঠ কর মা, জানো তো তাঁর কৃপায় পঙ্গুং লঙ্ঘতে গিরিম!”
ইরাবতী মনে মনে বললেন,”লঙ্ঘয়তে!”
মুখে ক্ষীণ স্বর।
“কিন্তু সত্যি তো ওনারা মাইলের পর মাইল হেঁটে এই শীতে এসেছেন খোকা!”
“এতেই তুমি মাত হয়ে গেলে! সত্যি মা! এইজন্যেই বাবা…, যাকগে তোমার বৌমা বলল ডাক্তার নাকি বলেছেন তোমার পায়ে কোন সমস্যা নেই। তাহলে চলো মা, তীর্থ করে আসবে। আমি তোমায় নিয়ে যাবো! যত খুশি হাঁটবে! একমাস ছুটি নিয়ে নেব! লোকে বুঝবে আমি কি রকম মাতৃভক্ত!”
হা হা করে হেসে সুভাষ বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
রিনিও বেরিয়ে আসছিল। ইরা হাতটা টেনে আটকালেন।
“শর্মিলার ফোন নম্বরটা একটু খুঁজে দিবি দিদি?”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন