রক্ত
বাসের নিরাপদ ঘেরাটোপ ছেড়ে নামতেই দমকা বাতাস ধাক্কা দেয় আকমলকে। ধূসর বিকেলের গায়ে পোঁচ পোঁচ হাইড্রোকার্বন লেপে দেয় বাসটি। পোড়া ধোঁয়ার কুন্ডলী ইসোফেগাস পেরিয়ে পৌঁছে যায় আকমলের ফুসফুসে। লক্কড়ঝক্কড় বাসটির থেমে থাকা এঞ্জিনের মত ঘড়ঘড় শব্দ ওঠে ওর গলায়। ফুলে ওঠা কণ্ঠনালী যেন সুরাসুরের যুদ্ধক্ষেত্র, তাম্বুলরঞ্জিত শ্মেষ্মায় রক্তবীজের জীবাণু। সভয়ে সরে যায় পথচারীদের কেউ কেউ। বাসটিও ছেড়ে যায় যাত্রীদের নামাওঠা শেষে।
পর্যুদস্ত শরীর চিন্তাভাবনার সুযোগ না দিয়েই আকমলকে তুলে দেয় দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাগুলোর একটার সিটে।
“বাতাস ঠেলন লাইগব। হাঁচ টিয়া দিবেন।”
দ্বিগুণ ভাড়ার দাবী নিমেষেই সজাগ করে আকমলকে। আসন্ন দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে ভাড়া বাড়ানোয় রিকশাওয়ালাকে বেশ খানিকটা বকে দিয়ে রিকশা ছেড়ে নেমে পড়ে রাস্তায়। নিত্যযাত্রী আকমল সাহেবের ক্ষোভ কমাতে পরিচিত চালকদের কেউ কেউ কিছুটা কমে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও ফেরে না আকমল।
হাঁটাপথে খুব একটা দূর নয় আকমল সাহেবের বাসা। মিনিট কুড়ির রাস্তা। পঁচিশ মিনিট কখনোবা – কাজশেষের ক্লান্তিতে কাহিল থাকলে, কিংবা রোদের তাপে, বৃষ্টির ছাঁটে হাঁটার গতি ধীর হলে। হাঁটতে হাঁটতেই দেখা হয়ে যায় প্রতিদিন অন্যদের সাথে। নটা-পাঁচটার সপারিশ্রমিক জোয়াল কাঁধ থেকে নামিয়ে একই সাথে ফেরে এরা। প্রস্তুত হতে থাকে সান্ধ্যকালীন সেকেণ্ড শিফটের জন্য। দুই কাজের মাঝখানের এই অবৈতনিক বিরতিতে চলে দুঃখ-সুখের ভাগাভাগি। অফিসের কূটকচালি, পরিজনের পাঁচালী, বাজারের হাল আর শরীরের বেহাল নিয়ে আলাপে আলাপে আপন আলয়ের দিকে এগোয় সবে। আকমল অধিকাংশ দিনই নীরব শ্রোতা। কেবল মৃদু হেসে জানান দেয় তার উপস্থিতি। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ইতি-নেতি জবাব দেয় প্রশ্নের। অতি উৎসাহী বন্ধুরা বিরক্ত, কখনোবা রুষ্ট হয় আকমলের নিস্পৃহতায়।
সঙ্গীদের কারো দেখা পায় না আজ আকমল। ঝড়-তুফানের আশঙ্কায় হাঁটাপথ নেয়নি কেউ হয়তোবা। একাকীত্বে অরুচি নেই অবশ্য আকমলের। কারো বাচালতায় ইচ্ছাঅনিচ্ছায় সায় দিতে হবে না গন্তব্যে যেতে যেতে ভেবে স্বস্তি হয় বরঞ্চ।
রওয়ানা করার আগে গলাটা বিচ্ছিরি কাশিটা বন্ধ করা দরকার। খাবারের ব্যাগ হাতড়ে পানির বোতলটি খুঁজে পায় না আকমল। মনে মনে রাগ ফরিদার ওপর রাগ করতে গিয়েও পারেনা আকমল। এই সময়ে এমনটা হতেই পারে। অবশেষে বুক ভরে আর্দ্র বাতাস টেনে নেয় আকমল। শ্বাসনালী সিক্ত করে চলতে শুরু করে বাড়ীর দিকে।
রোদ লুকোনো ছায়ায় ক্লান্তি নেমে যায় খানিকটা। মেঘের মল্লারে, মাতাল হাওয়ায়, গতানুগতিকতার বিরক্তি কাটে কিছুটা। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার আগেই পৌঁছে যাওয়া দরকার। দ্রুত পা চালায় আকমল।
“দা-দা,দাদা-” পরিচিত গলা শুনে থমকে দাঁড়ায় আকমল। পেছন ফিরে নিশ্চিত হয় ঠিকই শুনেছে সে। কালীপদ কারিগরকে বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁটা পথ নিতে দেখে বিস্মিত হয় খানিকটা।
আকমলের পারিবারিক বন্ধু কালীপদ। তবে আকমলদের মত সরকারী-সদাগরী অফিসের চাকুরীজীবী নয় সে। শহরের কেন্দ্রে বিশাল বাজেমালের দোকান কালীপদের। রীতিমিত লাইন দিয়ে বাজার করে সে দোকানে লোকজন। পসারের বড় কারণ কালীপদের পরিশ্রম, মেধা, সর্বোপরি সততা। ক্রেতাদের মুখে একই কথা, “খারিগরর দোয়ানত দুই নম্বর ন ফাইবা।”
“কি খবর বদ্দা। অনামিকাদি কি গাড়ীর দখল নিছে আইজকা?” ঠাট্টার ছোঁয়া আকমলের কণ্ঠে। পায়ে হেঁটে বাড়ী ফেরার কথা নয় কালীপদের। মুদী-মনোহারির আয়ে ভেসপা, অটোরিকশার পালা শেষ করে ডাটসানে চলে এসেছে সে এরই মধ্যে।
ডাটসানের ডাঁটের আঁচড়টি বন্ধুর গায়ে লাগতে দেয়নি অবশ্য কালীপদ। কালীপদের স্ত্রী অনামিকা বিদ্যাধর আর আকমলের সহধর্মিণী ফরিদা পারভীন সহকর্মী – এই শহরতলীর একমাত্র বালিকা বিদ্যালয়ে। গিন্নিদের গলায় গলায় বন্ধুত্ব কাছাকাছি এনেছে আকমল আর কালীপদকে, দুই পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও। অনামিকার কাছেই আকমল-ফরিদা শুনেছে কালীপদ-অনামিকার দুর্দান্ত প্রেমকাহিনী। কারিগরদের চৌকষ ছেলেটির প্রেমে পড়ে জাত-কুল ছাড়তে হয়েছিল বিদ্যাধর পরিবারের সুদর্শন সুশিক্ষিত মেয়েটিকে। অনামিকা মেয়েদের স্কুলের এই চাকুরীটি তখন না পেলে ঘরেই ফিরে যেতে হত হয়ত দুজনকে। ভাগ্যদেবী জাত-পাতের ঊর্ধে থাকায় শুধু স্কুলের চাকুরী নয়, ধার-দেনা করে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে শহরের কেন্দ্রে ছোটখাট একটি দোকানও দাঁড় করিয়ে ফেলে কালীপদ। কুলবংশের কারিগরী বিদ্যা কালিপদকে সাহায্য করে দোকানঘরের পরিসর বৃদ্ধিতে। পরিসরের সাথে বাড়ে পসার। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। অনামিকার জাত খোয়ানোর কালিমা মুছে যায় কালিপদের কারিগর স্টোরের সুনামে।
ফরিদার সাথে অনামিকার কেমন করে যেন মিলে যায় স্কুলের অনেক ব্যাপারেই। স্কুলটি আসলে একটি আধাসরকারী সংস্থার নিজস্ব স্কুল। প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মেয়েদের যাতে পড়াশোনার জন্য খুব দূরে যেতে না হয় সেজন্য করা। স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের অনেকেই সংস্থার পদস্থ-অধস্তনদের আত্মীয়-পরিজন। সেদিক দিয়ে ফরিদা-অনামিকা দুজনই বহিরাগত। দুজনে পড়ায়ও একই বিষয়। স্কুলের পড়াশোনা কিংবা পাঠক্রম বহির্ভুত বিষয়ে পক্ষপাতহীন মতামত দিতে গিয়ে প্রায়ই বিরাগভাজন হয় কর্তৃপক্ষের। ছাত্রীদের ভেতর তুমুল জনপ্রিয়তা না থাকলে অনেক আগেই হয়তো চাকুরী হারাতে হত তাঁদের।
দুবান্ধবীর সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টাও করেছিল কেউ কেউ। সফল হয়নি সেসব অপচেষ্টা – হয়তোবা কাজের বাইরেও দুপরিবারের বন্ধুত্বের কারণেই। ফরিদার দেড়গন্ডা ছেলেমেয়ের মধ্যে পিঠেপিঠি দুজন একই ক্লাসে পড়ে অনামিকার দু ছেলেমেয়ের সাথে। অনামিকারা ফরিদাদের মতই স্কুলের কোয়ার্টারে থাকলেও অনামিকার ছেলেমেয়েরা শহরের উচ্চবেতনের মিশনারি স্কুলে যায়। মিতব্যায়ী কালীপদ ডাটসান কিনেছিল বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়া করতেই। বাচ্চারা একই স্কুলে না পড়ায় ওদের পরীক্ষা কিংবা পাঠক্রম বহির্ভুত প্রতি্যোগিতার ফলাফলের তুলনা করে ঈর্ষা-আক্ষেপের সুযোগ নেই দুই পরিবারে। এলাকার সবারই অবশ্য জানা পড়াশোনায় সেরা ফরিদা আপার ছেলেমেয়েরা, আর গান-বাজনায় অনামিকা টিচারের।
নিজেদের উৎসব-পার্বণে অন্যদের অংশীদার করেন দু-পরিবারই। ফরিদা আপার খাসীর রেজালা মুখে না দিয়ে ঈদ শুরু করে না কালীপদ। কালীপদর দোকানের ঘি ছাড়া রান্না হয় না সেই রেজালা। অনামিকা মাসীর নাড়ুর জন্য ছেলেমেয়েদের এমনকি আকমলের আদেখলাপনায় আপত্তি করে না বরাবরের আদাবুন্নেসা ফরিদা। এই সামাজিক-আত্মিক বিনিময়ে ব্যত্যয় যদি কখনোবা ঘটে, তা মূলতঃ অর্থনৈতিক কারণে। ঈদে ফরিদার ছেলেমেয়েদের কালীপদ-অনামিকারা নূতন কাপড় দিলেও পূজা-পার্বণে প্রতিদান দেয়া হয় না আকমলদের; দেয়া হয়ে ওঠে না আকমল-ফরিদার বাধা বেতনে।
“আকমল ভাই, অনে খবর হুইন্নন না?” কালীপদের কণ্ঠস্বরের উদ্বেগ উৎকণ্ঠিত করে আকমলকে। নিজের উপর কিছুটা বিরক্ত হয় আকমল পরিস্থিতি না বুঝে পরিহাস করার জন্য।
হামলা হয় নি তো আবার কালীপদের দোকানে? বন্ধুর অমঙ্গলের আশংকায় শঙ্কিত হলেও সরাসরি প্রশ্নটি করতে পারে না আকমল কালীপদকে। দ্বিধান্বিত হয় – সহমর্মিতায় আবার আহত না হয় বন্ধুর আত্মসম্মান। লজ্জিত বোধ করে সেইসব সমধর্মী লোকেদের জন্য যারা কালীপদের রমরমা ব্যবসা দখলে নেয়ার জন্য বীর্য প্রদর্শন থেকে গণতান্ত্রিক সংখ্যাধিক্যের যুক্তি কোন কিছুরই বাদ রাখে নি। কালীপদ কোনদিনই আকমলের কাছে এসব নিয়ে আক্ষেপ না করলেও অনামিকা প্রায়ই বলে ফরিদাকে। ফরিদার কাছেই আকমল জেনেছে গত ক’সপ্তার কথা। পাশের দেশে উগ্র-হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির মসজিদ ভাঙ্গার ধুয়া তুলে জুম্মার নামাজের মিছিল নিয়ে কালীপদর দোকানে ঢোকার চেষ্টা করেছিল এদের কেউ কেউ। থানার কর্তাকে ভেট দিয়ে দোকানের সামনে আগেই অনেক পুলিশ জড় করে রাখায় সেযাত্রা বেঁচে যায় কালীপদ। তবে যত দিন যাচ্ছে ততই অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
কালিপদের খরিদ্দারদের মধ্যেও কেমন যেন অসহিষ্ণুতা, চাপা একটা ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে ইদানীং। সুযোগ পেলেই দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত দোকান সহকারী সোনা মিয়াকে এদের কেউ কেউ মালু বলে তাচ্ছিল্য করে বলে জানিয়েছে কালীপদ। হুমকিও দেয় সীমান্ত পার করে সোনাকে তার “আসল” দেশে পাঠিয়ে দেবার। কালিপদ-অনামিকার কাছে আকমল অনেকবার শুনেছে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে সোনার আহত হওয়ার কথা, যুদ্ধে যোগ দেয়ার অপরাধে তার বাড়ী-ঘর-স্বজন সব ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। যুদ্ধের ক্ষত আর করুণ স্মৃতি বয়ে বেড়ানো সোনাকেও যদি এদেশ নিজের করে নিতে না পারে তবে কালীপদ আর অনামিকার কি উপায় হবে? পুলিশ-প্রশাসন আইন-আদালতের দ্বারস্থ হয়েও খুব একটা কাজ হচ্ছেনা আর। বরঞ্চ বেসরকারি চাঁদাবাজীর সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারী তোলাবাজি। সরকারী অতিথিশালার অভ্যাগত থেকে জেলা প্রশাসকের পরিজন কারোই নাকি আজকাল আর খাবার মুখে রোচে না কারিগর স্টোরের বিখ্যাত ঘি ছাড়া। কালিপদের স্নেহে কর্তাদের বপু স্ফীত হলেও বিনামূল্যে ঘি সরবরাহ করার খেসারৎ দিতে ঘিয়ের সাথে ডালডা-পাম অয়েলের মিশেল দিতে হবে শেষ পর্যন্ত হয়ত কালিপদকেও।
“- – ভাবী চান গরিবার সমত ফরি গেইয়ন দে। অনামিকা আঁরার গারীত গরি তাঁইরে মেডিকেলত লই গিয়ে। ডাক্তার বর্তি গরি ফালাইয়ে। সিজার লাগিত ফারে।” কালীপদের এক নিশ্বাসে বলা বাক্য কটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয় আকমলের চিন্তার জাল। দমকা বাতাসের ধাক্কায় শিরশিরে ভাব জাগে সারা শরীরে। কাঁধের পেছনটা হালকা লাগে, বুকের মাঝখানটা বেশ ভারী।
কালীপদ কাছে সরে এসে আকমলের পিঠে হাত দেয়, “আঁই অনেরে বিচরাইলাবার লাই বাস স্টপত গেই। রিকশাআলা তারার তে হুনিয়েরে অনের ফিছে ফিছে আইর।”
দুর্বিপাক কালীপদের নয় তার নিজের এখবর পাওয়ার সাথে সাথেই হাত-পা শীতল হয়ে এসেছিল আকমলের। কালীপদের আশ্বাসে ভয় কমে কিছুটা।
ভরসা করার মত বন্ধু পাশেই রয়েছে ভেবে নিজেকে সামলে নেয়। উলটো ঘুরে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোয় কোন কথা না বলে।
পাশাপাশি নিশ্চুপ হাঁটতে থাকে দুবন্ধু। আকমলের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে গত কমাসের ঘটনা।
ফরিদা যখন আকমলকে প্রথম সংবাদটি দেয় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি আকমলের। আর কত? ফরিদার সন্দেহ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়ার পর ফরিদাকে বকাঝকা করেছে এত বয়সে এসেও নিজের শরীরের হিসেব না রাখার জন্য। বাদানুবাদের পালা শেষ করে গাইনীর কাছে গেলে তিনিও যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া ফরিদার সন্তান ধারণে মা-সন্তান দুজনেরই যথেষ্ট ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে, একথা স্পষ্ট জানিয়ে দেন ডাক্তার। উন্নত অনেক দেশে নানান পরীক্ষা করে ঝুঁকির পরিমাণ আগে থেকে জেনে নেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও সেসব ব্যবস্থা নেই ডাক্তার বা তাঁর পরিচিতজনের কাছে। প্রয়োজনে গোড়ার দিকেই গর্ভপাত করিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে তাঁর পরিচিত একজনের ঠিকানা দিয়ে দেন ডাক্তার আপা।
ডাক্তারের পরামর্শে চূড়ান্ত দ্বিধায় পড়েছিল আকমল-ফরিদা। দীর্ঘদিনের পরিচিত কোহিনূর ডাক্তার। ছেলেমেয়েদের সবাই কোহিনূর ডাক্তারের হাত ধরেই এসেছে। ফরিদার প্রজনন স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তাঁর চাইতে ভালো পরামর্শ দেয়ার মত আর কেউ আছে বলে কখনো মনে হয়নি আকমল বা ফরিদার। তবে গর্ভপাতের পরামর্শ মেনে নিতে পারেনা দুজনের কেউই সহজে। প্রচণ্ড আত্মপীড়নে ভোগে আকমল নিজে বেশ কদিন। রাতে ঘুমোতে পারে না। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। শেষমেশ দুজনে মিলে ফরিদার স্কুলের আরবীর শিক্ষক হাবিবুল্লা সাহেবকে বাসায় দাওয়াত করেন পরামর্শের জন্যে।
হাবিবুল্লা পরহেজগার মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। তবে নামাজ রোজা না করার জন্য বকাবকি করেন না অন্যদের। আরবী-ফারসীর পাশাপাশি সংস্কৃত শ্লোকও জানেন বেশ কিছু। মসজিদ দখলের বদলায় লোকজন দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধাতে চাইলে মোল্লা-মাস্তানদের বুঝিয়ে নিরস্ত করেছেন তিনি। স্কুলের ইতিহাস শিক্ষককে সাথে নিয়ে মসজিদে মসজিদে বক্তৃতা করেছেন। ধর্মবিষয়ে গোঁড়ামি নেই তার ভেতর – এমনটাই সবাই জানে। হাবিবুল্লা আকমল আর ফরিদাকে মুমিনুন সূরা থেকে পাঠ করে শোনান,
“ছুম্মা খালাকনান নুতফাতা আলাকাতান ফাখালাকনাল আলাকাতা মুদ্গাতা ইজা-মা”
বাংলায় তর্জমা করে দেন –
“পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি রক্তপিণ্ডে, অতঃপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি মাংসপিণ্ডে…”
তর্জমা শেষ করে শরীরের পবিত্রতা আর রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন হাবিবুল্লা। ইরান-তুরান আরব সাগর পাড়ি দিয়ে যেই পবিত্র রক্ত এই মাটিতে নিয়ে এসেছে বাবর বখতিয়ারের মত বীরেরা সেই পবিত্র রক্তের এক ফোঁটাও নষ্ট করা যাবে না সেকথা সুস্পষ্টভাবে আকমল-ফরিদাকে জানিয়ে দেন হাবিবুল্লা। সবশেষে দুই হাত তুলে দীর্ঘ মোনাজাত করেন খোদার দরবারে আকমলের বংশধরের সুস্বাস্থ্যের জন্য।
ভয়ে ভয়ে হলেও নিজেকে প্রস্তুত করেছে ফরিদা, ঘরের কাজ বাইরের কাজ বাচ্চা কাচ্চাদের আদর আহ্লাদ সব কিছু সামাল দিয়েও মনোযোগ দিয়েছে শরীরের ভেতরের শরীরটার দিকে। আকমলও এগিয়ে এসেছে দায়িত্ব পালনে – ফরিদাকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, অফিস শেষে বাড়ী ফেরার সময় ওর শরীরের বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য এটা ওটা নিয়ে আসা, গার্হস্থ্য কাজে ফরিদাকে টুকটাক সাহায্য করার চেষ্টা এসবই করেছে যতটুকু সম্ভব।
সমস্যা কিছুটা হয়েছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। হঠাৎ করে মায়ের কেন বাড়তি মনোযোগ বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য দরকার এটি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না তারা। বড় ছেলেটিকে গোসলখানার মেঝেটা ছাই দিয়ে ঘষে সাফ করতে বলেছিলেন কদিন আগে আকমল।
“মাকে বল। আমার পড়া আছে” সোজা উত্তর ছেলের।
রাগ করে লাভ নেই জেনে ঘষে মেজে নিজেই সাফ করবেন সপ্তাহান্তে এমনটি ভেবে রেখেছিলেন আকমল সাহে্ট। হয়ে ওঠেনি আর।
বাসষ্ট্যান্ড থেকে স্কুটার নিয়ে মেডিকেলে পৌঁছে যায় কালিপদ আর আকমল দ্রুতই। তিনতলায় প্রসূতি ওয়ার্ডে ঢুকে আবারো ঘাবড়ে যায় আকমল। আই,সি,ইউ-তে ঢোকানো হয়েছে ফরিদাকে। নার্সদের কাছে খোঁজ-খবর পায় সব আকমলেরা। প্রসবের দিন ঘনিয়ে এলেও কিছুটা সময় বাকী ছিল ফরিদার তখনো। বাচ্চার সাড়া পাওয়া যায় নি গত কঘন্টায়। জরায়ু কেটে ওকে করে বের করে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাক্তাররা। এদিকে পড়ে গিয়ে রক্তপাত হয়েছে ফরিদার প্রচুর। ইতঃমধ্যে রক্তাল্পতা দেখা দিয়েছে তার শরীরে। মাঝে মাঝেই জ্ঞান হারাচ্ছে সে। সব কিছু মিলে জটিল অবস্থা।
“দু এক ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন। রক্ত জোগাড় করুন” কালীপদদের দেখে আই, সি, ইউ-র কাচের দরজা ঠেলে বাইরে এসে খবর দেয় অনামিকা। রক্তের প্রয়োজন শুনেই আতংকিত বোধ করে আকমল। ভয়ে পাংশু হয়ে যাওয়া আকমলের চেহারা দেখে মায়া হয় অনামিকার। অভয় দেয় সে –
“ছেলেমেয়েদের আনিয়ে নেন। ওদের রক্ত মিলে যাবার সম্ভাবনা বেশী। আর শুনেন, হাবিবুল্লা সাহেবকে খবর দেন একটু। ভাবী বলছেন ওনাকে দিয়ে একটা মোনাজাত দিতে।”
আকমলকে নিয়ে নীচে নেমে আসে কালিপদ। ড্রাইভারকে খুঁজে পায় মেডিকেল গেটের চায়ের দোকানে। পাঠিয়ে দেয় ওকে আকমলের ছেলেমেয়েদের আর হাবিবুল্লা সাহেবকে নিয়ে আসতে।
চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে থাকে আকমল। ওপরে যেতে ইচ্ছে করে না, সাহস হয় না তার। কাপের পর কাপ চা খেতে থাকে। মোটেও কানে ঢোকেনা কালীপদর অবিরাম অভয়বাণী। মনে করার চেষ্টা করে ফরিদার আগেরবারের ডেলিভারির কথা। অপারেশন করার প্রয়োজন হতে পারে ভেবে রক্তদাতা যোগাড় করে রাখতে বলেছিলেন কোহিনুর ডাক্তার। তখনই জানা হয়েছিল দুষ্প্রাপ্য গ্রুপের রক্ত ফরিদার। বেশ বেগ পেতে হয়েছিল খুঁজে পেতে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রক্ত দিতে হয়নি সেবার ফরিদাকে। যাদু দেখিয়েছিলেন কোহিনূর ডাক্তার।
হাবিবুল্লার সাথে আকমলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফিরে আসে কালীপদের গাড়ী। অফিস ফেরতা ভিড় ততক্ষণে থিতিয়ে যাওয়ায় খুব একটা দেরী হয় নি চালকের। একসাথে প্রসূতি ওয়ার্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় সবাই, কালীপদের ড্রাইভার শুধু বসে থাকে চায়ের দোকানে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকেন হাবিবুল্লা। আকমলের মেয়ের দিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করেন মাথায় ওড়না টেনে দেয়ার। মেয়ের দিকে তাকিয়ে আকমল টের পায় ঘরের জামা কাপড় পরেই চলে এসেছে ছেলে মেয়েরা। বিব্রত বোধ করে কিছুটা আকমল, কালীপদ – হাবিবুল্লার সামনে।
সবাই আই, সি, ইউ-র সামনে পোঁছুতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে অনামিকা। ছেলেমেয়েদের সবাইকে তাড়াহুড়ো করে নিয়ে যেতে চায় ভেতরে। কেবল ছোট মেয়েটিকে অনামিকার দিকে ঠেলে দেয় আকমল। আস্তে করে বলে, “বাকীদের মিলে না। আমারও না।”
অল্প কিছু পরেই আবার বের হয়ে আসে অনামিকা। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নেয় আকমল রক্ত পরীক্ষার ফলাফল।
হাবিবুল্লা আর আকমলদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিলেন এতক্ষণ কালীপদ। প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে পূজো দেয়ার সময়ে অন্য কারো উপস্থিতি পছন্দ করে না অনামিকা পূজোর জায়গাটুকুতে। কালীপদ তাই ভেবেছেন হাবিবুল্লার প্রার্থনার সময়ও তাকে বিরক্ত করাটা হয়ত ঠিক হবে না। অনামিকা ইঙ্গিতে ডেকে নেয় কালীপদকে। হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায় দ্রুত। কালীপদ দ্রুত বুঝে নেয় সঙ্গীর ইচ্ছা। শার্টের হাতা তুলতে থাকে ভেতরে যেতে যেতে।
ক্ষণিকের বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হয় আকমলের মন। ঝটিতি প্রশ্ন আসে মাথায়, “আচ্ছা, হিন্দুদের রক্তের গ্রুপ কি মুসলমানদের সাথে মিলে?” বিভ্রান্তির ত্বরিত অবসান ঘটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বিজ্ঞান। শেষ পর্যন্ত মৎস্য দপ্তরের কলমপেষার চাকুরী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলেও সমুদ্র বিজ্ঞানের পড়াশোনাটা আকমল করেছিল অনেক উৎসাহের সাথে। বিবর্তনের ক্লাসে জেনেছে রক্তের গ্রুপ কি করে একসূত্রে গাঁথে নানা জাতের, নানা বর্ণের মানুষকে, এমনিকে তাদের প্রজাতিগত উত্তরসূরী প্রাণীদের। একই এ,বি,ও জিন থেকে উৎপন্ন রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ এ, বি, এবি বা ও বিশ্লিষ্ট হয়েছে, মিশ্রিত হয়েছে আদিম মানুষ এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে। যেকোন দুজন লোকের রক্তের গ্রুপ মিলবে কি মিলবে না সেটি ধর্মীয় পরিচয়ের উপর নয় বরঞ্চ কিছুটা হলেও নির্ভর করে ভৌগলিক নৈকট্যের উপর। ধর্ম নয় ধরিত্রীর ভরসায়ই বুঝি ত্রাতার ভূমিকায় আজ বন্ধু কালীপদ। কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে আকমলের মন। এই অনাত্মীয় শহরে কালীপদ আর অনামিকার মত বন্ধু না থাকলে ঠিক কি হত ভেবে পায় না সে।
ঘরের অন্যদিকে চোখ পড়তেই শংকিত হয় আকমুল। আয়াতুল কুরসি পড়া বন্ধ রেখে কঠিন চোখে আকমলে দিকে তাকিয়ে হাবিবুল্লা। চাপা কণ্ঠে বলে ওঠে হাবিব – “রক্তের দোষ বড় দোষ আকমল সাহেব। আল্লার গজব পড়বে। সব শেষ হয়ে যাবে।”
বিস্ময়ে হতবাক হয় আকমল। রাগে ক্ষোভে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা করে। আই, সি, ইউ-র কাচের ওপাশে চোখ যায় তার। ফরিদার জ্ঞান আছে এখনও। হাত দুটো মোনাজাতের ভঙ্গীতে ধরে এদিকেই তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছে সে।
চিৎকার দেয়া হয় না আকমলের। হাবিবুল্লার দিকে ফিরে মোনাজাত ধরে সেও।