সুমন ভট্টাচার্য
পায়ের তলায় সর্ষের আচমকা বরাতে ভ্রমণের মোক্ষম হয়ে গেল, রামরাম ওঝার। প্রমথ বোস লেনকে বরাবরই একটু এড়িয়েই চলেন খানদানি ওঝারা। যেমন আদ্যিকালের হাড্ডি-পাঁজরায় গড়া সব বাড়ি, তার ওপর আবার কটা পুঁয়ে টালির ঘর, ট্যারানে টিনচালা, কয়েকটা মাঠকোঠা। একখানা নতুন পেল্লায় পাঁচতলাও অবিশ্যি হয়েছে, সেখানকার এক বাসিন্দার ডাকেই আসা। নাম শুনেই তো ভয় পেলেন প্রথমটা, ‘আইজ্ঞা ঠাকুরমশাই আমাগো ফেল্যাটে একটু শান্তি করবার লাগে।’
‘কী হয়েচে?’
‘আইজ্ঞা তাইনদের হাওয়া বাতাস ট্যার পাই-’
উঁ, বেশ, আজ হ’ল গে বিষ্যুদবার, তা বেশ এই শনিবারই হবে, শনিবার বেলা সাড়ে তিনটেয় আজবা।’
যাব করে পকেট থেকে একখানা পাঁজি বের করে লোকটা পাতা ঘেঁটে বললে, ‘আইজ্ঞা, শনিবার বারবেলা তো, তখন আর থাকবো না,’ কথাটা খেয়াল ছিল না রামরামের। কিন্তু তা বললে চলবে না। ‘হুঁ, তাতে ভেবড়ে যাবেন না, মশাই, আমি দূরান্বয়ী মন্ত্র যোগে ঠিক বেলা এগারোটা থেকেই প্রেতপ্রপাতন প্রেতাউল প্রেতপ্রপাতিক মন্ত্রে, চারপাশ বেঁধে দেবো। আসলে সেই দিন আমাদের ওঝাতন্ত্রের, গোস্টটেমারোলজির জিলবাস ফ্রেমিং আর পরীক্ষার ডেট নিয়ে একটা মিটিং আছে কিনা, তারপরে গোস্ট ম্যানেজমেন্ট, তা আপনার নামটা বলুন, ঠিকানা –
যেমনটা ভেবেছিলেন, তা হ’ল না। লোকটা বললে ‘হেই গোষ্টাট্যামটেমি লইয়া তো কাম নাই – আমার একখান ওঝা লাগে – পেলেন অ্যান্ড সিমপুল ওঝা’।
‘নাম বলুন –’ একটু থমকানো গলায় বললেন তিনি।
‘আইজ্ঞা ব্রহ্ম দইত্ত, সাইত বাই – ’
‘অ্যাঁ ব্রহ্মদৈত্য –’ দ্রুত ভদ্রলোককে দেখে তাঁর ছায়াটায়া পড়ছে কিনা বুঝবার চেষ্টা করলেন। নাঃ এখম মেঘলা দিন, ছায়া বুঝবারও জো নেই।
‘আইজ্ঞা ব্রহ্ম দৈত্য না, ব্রহ্ম দইত্ত –’
সহসাই ভীতু বুদ্ধিতে আলো খেলল, হুঁঃ! ব্যাটা বাঙাল! আর একটু হলেই হয়েছিল আর কি! ‘আমি রামরাম ওঝা, সাক্ষাৎ কৃত্তিবাস ওঝার প্রত্যক্ষ বংশধর, এই ওঝাতন্ত্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন।’ একটু স্বস্তি পেয়েই বলতে থাকেন রামরাম।
কিন্তু অলক্ষ্যে হাসলেন সরসীবরণ মুখুজ্যে। অবশ্য হাসলেন না, বিরক্তই হলেন। এইসব বাজে গুলগাপ্পা কেন মারিস বাপ। তুই হলি গে চাটুতি গাঞ্চি, হারায়ে মারায়ে কাশ্যপ গোত্র চাটুজ্জে, কোন কৃত্তিবাসের কোন বংশ কেমন করে হবি রে মুখ্যু? আর একবার ফের বলে দ্যাক না কেন, কিরিত্তিবাস! তোর ভবের বাস আমি উদোবো।
রামরাম বলে যাচ্ছিলেন ‘এই এলাকার সমস্ত রকম ভূত-প্রেত-প্রেতিনী-ডাকিনী, আমার প্রেতরশিবাবকে ভয় পায়। শুধু এখানকার কেন, খেরেষ্টান ভূত, পিক্সি-গব্লিন, মুসলমান জ্বিন-মামদো-’
অত্যন্ত বিরক্ত হলেন সরসীবরণ, আবার সেই গুলবাজি! নিজের ঘরের কোনটা ভূত, কোনটা পিশাচ, কোনটা বেতাল চেনে না! আবার খেরেষ্টান নিয়ে টান-টানানি! হুঁ! দুইবার হ’ল। ওয়ার্নিং। তিনবারের বার রেহাই নেই। বলে টলে নিজের মৌরুবি জাজিমে চলে গেলেন সরসীবরণ। ব্রহ্ম দত্ত চলে গেলেন তাঁর ফ্ল্যাটে। রামরাম গেলেন তাঁর সাবেক বাড়ির ভাগের ঘরে। দাঁওটা একটু ভালো করেই মারতে হবে। বেশ ফরফরিয়া ফূর্তি টের পেলেন, অনেকদিন পর।
ভূততাড়ন কর্মকাণ্ড খুবই শ্রমের। আজকাল একজন স্যাঙাৎকে সঙ্গে রাখেন। বলেন অ্যাপ্রেন্টিস্। তাকে দিয়েই ওই খাটুনির কাজ করান আগাগোড়া। শেষ পনেরো মিনিটের নাচনকোঁদন, মন্ত্রবাচন, সর্ষে ছোঁড়ার কাজগুলো তাঁর। এই শেষ পনেরো মিনিটে, লোকজন তখন অতিষ্ট মোটামুটি, ভূতের বদলে, ওঝার বিদায়ই তখন তাদের প্রার্থনা। মাথায় একটা কালো কাপড় ফেট্টি করে বেঁধে উঠে দাঁড়ান রামরাম। প্রচন্ড গালবাদ্য আর ডমরুধ্বনিতে চারদিক কাঁপিয়ে বলেন ‘আদিতে কে এর প্রচলন করবার কথা বললেন, না কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাস কে? না যিনি রামায়ণ বাংলায় লিখলেন। কেন লিখলেন? না তিনিও ছিলেন ওঝা। রামকে আশ্রয় তাঁর অনিবার্য, তাই লিখলেন রামায়ণ। রাম কেমন করে ভূত তাড়ান –
দান্ডাইলা রামচন্দ্র হস্তে লয়ে অসি।
রাবণে বধেছি মুই, যতেক রাক্ষসী।।
কান্দিয়া পড়িল পায়ে বধো না গো মোরে।
কইলাম স্মরণে রাখো ভুলিলে বেঘোরে।।
রাক্ষসীরা কহে রাজা না বধিও তবে।
কহো তুমি কী করিলে সবে রক্ষা পাবে।।
কহিলা গো রঘুপতি রাক্ষসের অধোগতি
তেমতি করিব ভূতপ্রেতে।
মোর বরপুত্র সবে লোকে যারে ওঝা কবে
বিপদে ধরিও আনন্দেতে।
অর্থাৎ ভূতপ্রেতপিশাচপ্রমথবেতালকবন্ধ সর্বৈব অশরীরী দমনের রামমোক্তার থুড়ি আমমোক্তারনামা আমাদের দিয়েছেন শ্রীরামচন্দ্র।
ওং হ্রীং ক্লিং ক্লিং ক্রিং
ওং কর্কট মর্কট ধরকট ছড়কট
ওং ট্রিং খ্রিং খ্রিল্রিট্রিং ম্রিং
ওং ধরফটাফট ছটফটিয়াং মট্’
ব’লে একখানা মালসা ভাঙলেন রামরাম। মালসার উপর নাইলনের অস্থি বুলিয়ে এক পা তুলে
‘যত্ত সত্ত মত্ত মত্ত কত্ত কত্ত বিটলে ভূত
এ বাড়ি ও বাড়ি ও বাড়ি সে বাড়ি
মার ঝাড়ু মারি, ভগ্নদূত-
ভগ্ন-টগ্ন, খগনো-ঠগনো, ঠক-ঠকাঠক নিপাত যা
কলাই, নলাই, জলাই, শলাই দে জ্বালিয়ে দে রে
কসম খা,
আসবি না এই ভিটের ভিতেও
আসবি নে ছাদে বারেন্ডায়
দেয়ালে-দেউলে-দালানে দাখিলা
দালালি দাপুটে দাগানো ভু-র্-র্-র্-র্
নৌকোতে নাকুয়া, নিভোনো নাকি লা
ন্যাংচা, ন্যাদের নাকানি চু-র্-র্-র্-র্-
এইবার, সর্ষে দানা দিয়েন, সর্ষে, সাদা সর্ষে, রাই, কালো সর্ষে, কানাই, দীত সর্ষে, বলাই, লাল সর্ষে, রাঙাই-’
‘আইজ্ঞা বলাই, রাঙাই তো পাই নাই-’
‘তবে তৈল দিয়েন, ঘানিতে নেঙা নিয্যস খাঁটি বুটি তৈল –’
ব্রহ্মবাবুর পুত্রবধূ এক দেশলাইবাক্স মাপের বাটিতে তেল দিলেন। সেই তেলে অনামিকা চুবিয়ে দেয়ালে অদৃশ্য এক ছক কাটতে কাটতে রামরাম বললেন, ‘এইবার বাবা ভূতভাবণ শিবের নাম করুন, আমি শিবের নটরাজ বেশে নটরাজ রূপে অবতীর্ণ হবো, পেল্লায় নাচ নাচলে সকল কাঁপন তুলে হে নটরাজ, নটরাজ চটের আসন ভুললে যখন বাঘের ছালে, এই আমি কৃত্তিবাসের বংশধর, আ-আ-আ-’
তিনবার হয়ে গেল, আর না ব্যাটা চাটুজ্জে বলিস কিনা মুখুটির বংশ!! সরসীবরণ সেই ভ্যাজাল সর্ষের তেলের ফোঁটায় দক্ষিণ পদাস্থিভর রামরামকে অনায়াসে পিছলে দিলেন এমনই মোক্ষমে, যে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টায় রামরাম ভর দিলেন যে টেবিলের কানায়, সাক্ষাৎ চৈতন্যদেবের বিপ্রতীপ সম্পাদ্যে টেবিলের ওপর রাখা বাহারি এক ফুলদানিটি পড়লো গড়িয়ে তাঁর মাথায়, এবং টেবিলের কানা বেয়ে আসা ফুল-কলসির ভারে বা প্রেমে, রামরামের, রামনাম সৎ-এর সদসৎ সমাধা।
সরসীবরণ অতটা চাননি। তবু প্রাচীন মানবিক অভ্যাসে বললেন, ‘সরি।’
রামরামের হুঁশ হল, মাথায়, ঘাড়ে, পিঠে-কোমরে, ঠ্যাঙে সর্বত্রই ব্যথার পরমান্ন মাখামাখি। তাকালেন, একটা কেমন মাঝবয়েসি গেরস্থবাড়ির দালানে তিনি। কোথায়, কী বৃত্তান্ত, কেন, কীভাবে, বুঝতে-বুঝতেই বুঝলেন ওই ব্যাটা বাঙাল ব্রহ্ম দইত্তের সমতলে, তাঁরই ওং ব্রহ্মটি ঘটিত।
নিরাকার হাত পায়ে আড়মোড়া ভেঙে আঙুল মটকে কান চুলকে নাকে একটু আঙুল দিয়েই সতর্ক হলেন, কেউ দেখছে না তো! শুনলেন, ‘আরে দেখলেই বা কি আসে যায় হ্যাঁ! এতো আর আমলা, ধামলা-সদরালার দোকান নয়কো, যে এটিকেট ভাঙচো বলে ধাতানি খাবে! আমরাও অমনতর চোখে পিচুটি, চুলে উকুন লোকজন। আমাদের মধ্যে তুমি নতুন এয়েচো, থাকো। তবে ঘর পাবে না, দোর বরাদ্দ। তোমার বাপু ব্যাড কনডাকট্, জন্মোকালে তুমি ছিলে আমাদের শত্তুরগোত্র! নিয়মমাফিক তোমার ঠাঁই ওই ঠিকানায়, তা আমরা মানতে বাধ্যই। কিন্তু ব্যস্, ঘর আমরা দেবোনা। ইউনিয়নের মানা আচে।’
এতক্ষণে তাঁর মনে এলো, তিনি তো ভূতের ওঝা! তবে এখন মরবার পরে তিনিই কি ভূত হলেন! হুঁ। আইন মোতাবেক অপঘাতে প্রয়াণ – হুঁ প্রেত তো হতেই হবে। আমি রামরাম ওঝা। জিয়ন্তে বরাবর এই ভূতেদের দাবিয়ে রেখেছি, এখন এখানেও বেশ একটা –
‘হুঁ! কিস্যুটি করতে পারবে না হে রামরাম।’
‘কে রে, ভূত হয়ে রামনাম করিস?’
‘সে তো তুমিও করলে! রামনামে যদি সত্যি কিছু হতো, তবে তুমিই কি আর অমন বারফট্টাই করে নিজের নাম বলতে পারতে হে!’
‘তবে?’
‘তবে আবার কী! দিব্যি তো পট্টিবাজি করে টাকা কামিয়েছ! আমরা আর কী বলবো, একে আমাদের লোকগুলো বেজায় আলসে, তায় আজকাল আমার আমাদের তিনটে ইউনিয়নের তিন রকম এজেন্ডায় সকলেই দিশাহারা হয়ে ভোম্…’
‘তবে?’
‘আবার তবে! ঘটে আছে কী? আগে ছিল একদল ভূত পুরো এক বাড়ির দায়িত্ব নেবে – গোলমাল লেগেই থাকতো। ওঝারা আসতো – একটা আপতরফা হতো। দু’মাস নিশ্চিন্তি, তারপর আবার রেকারিং বেনিফিট। আজকাল, মানে তুমি যবে থেকে কারবারে নেমেছ, তার আগে থেকেই কিছুটা, নিয়ম হলো বদলির। মনে করো ক তিনমাস যদি অ-বাড়িতে কাজ করে তো তারপর ই-তে। ই-র যে খ-ভূত সে যাবে ঋ-বাড়িতে। এই বদলির চাপে, কারোরই তেমন কাজে মন নেই। নামকাওয়াস্তে দু-তিন দিন একটু শিফটিং, লিফটিং করলে কি করলে না, দম শেষ! আরে এ-সব যত গোলমাল। এর কটা চ্যাংড়া ভূত চায়, ওই ছুকরিটাইপ মেয়ের ঘাড়ে চাপতে- মানে ফষ্টিনষ্টি করতে। আরে বাবা আমরা সব সিনিয়াররা আছি, আমাদেরও তো…ইয়ে…যাক।’
‘না না, থামলে কেন বলো’
‘হ্যাঁ, বলি, তোমারও তো বয়েস একটু ঝড়তির দিকেই, তার মধ্যে বউকে কাঁদিয়ে এসচো, ক’দিন পরেই এইসব টানটোন টের পাবে। তখন বুজবে, একটা-দুটো ছুকরিকে কবজা করার সোয়াদ! তা আমাদের দেয় যত্ত রাজ্যের আধবুড়ি, বাঁধবুড়ি, আধবুড়ির বরাত-’
‘এই বাঁধবুড়ি আর আধবুড়ি…’
‘হুঁ হুঁ, বুঝবে, ঢের ঢের অমন পাবে বয়েস ঢের, তবু চুলে রঙ, দাঁতে বাঁধাই, চামড়ায় পালিশ, পোশাকে, আশাকে খুকি খুকি আল্লাদ, তবু, যাক আর আধবুড়ি হ’ল আরো ভয়ংকর, বুঝলে কিনা, বয়েস তেমনটি নয়, কিন্তু মনে, চালচলনে একদম বুড়ি, হাবড়ির সিলমোহর লেপটে-’
কথা শেষ হ’ল না, আরো অনেকগুলো গলার হইহই আওয়াজে রামরাম চমকে উঠে তাকান। কোথায় কোথায় কেমন কেমন হাড় হাড় হিম হিম ঝিমঝিম ভাব, শুনলেন ‘এই যে ঘণ্টাবাবু, তুমি ওর সঙ্গে অমন খোশগল্প জুড়েছ? মনে রেখো, এখানে ওর অ্যাকমোডেশন শুধুই আইনের খাতিরে। ইনি জ্যান্তে ছিলেন আমাদের শ্রেণিশত্রু, সমস্ত জীবন আমাদের বিরুদ্ধে, আমাদের উচ্ছেদের অভিপ্রায়ে কাজ করেছেন। আমরাই ছিলাম ওনার প্রফেশনের সোর্স, অথচ কোনো কৃতজ্ঞতা নেই! কাজেই আমাদের সিদ্ধান্ত, আমরা একে বয়কট করলাম। যদি কেউ এই বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে কোনো সম্পক্ক রাখে, তাকেও বয়কট। হ্যাঁ, থাকবার অধিকার আছে, সুতরাং এই ঠিকানায় উনি থাকবেন, কিন্তু নো রুম অ্যালটমেন্ট, নো অ্যাসাইনমেন্ট।’
‘যদি ফ্রিল্যান্স করতে চায়-’
‘করুক কিন্তু কোনো এলাকায় নয়, কোন বাড়িঘরে নয়। ওই রাস্তায় থাকে, ভিক্ষে-টিক্ষে করে, তেমন কিছু জুটিয়ে নিক, কিন্তু নো এনি ফ্যামিলি। প্রেতপক্ষ জিন্দাবাদ। আমাদের দাবি, টানতে হবে। আমাদের কথার ধান ভানতে হবে।’
রামরাম তাঁর নিরাকারে বসে নিরাকার মাথায় নিরাকার হাত বোলান। সত্যিই তো, তিনি বরাবর ভূত তাড়ানোরই কাজ করেছেন, কিন্তু জানতেন না তো কিছুই!
মনের দুঃখে ভাবলেন, যাই একটু গিন্নির সঙ্গে দেখা করে আসি। নিশ্চয়ই কেঁদে ভাসাচ্ছে বেচারা।
পলকেই নিজের ঘরে। লোকজন কিছু বাইরে বসে দিব্যি সোনাছেলে মুখ ক’রে চা-সন্দেশ-রসগোল্লা খাচ্ছে। তাঁর পত্নী মুখে একটি পান ঠুসে বিমার দালাল কিরণকে শুধোচ্ছেন ‘তা ওঁর ওই পলিশি-টলিশি যা আছে, তার টাকাপয়সাগুলো এবার ফেরাও দেখি। আর কাল ব্যাঙ্কে যাবো, ওনার নামেই তো অ্যাকাউন্ট – ওই টাকাগুলোও তুলতে হবে। আর ভালো কথা, যাদের বাড়িতে অমন করে অক্কা পেলো, তাদের কিন্তু ছেড়ো না। একটা বড় খেসারত আদায় করতে হবে। প্লাস আজকের ফীজ।’
আর থাকতে না পেরে রামরাম বললেন, ‘না না, ওদের দোষ ছিল না, তবে হ্যাঁ আজকের মজুরিটা অবশ্যই নেবে। কারণ উপদ্রব আমি মিটিয়েই এসেছি।’
গৃহিণী হাত নেড়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘না-না- আজকের ভিজিট তো নেবোই, তার সঙ্গে ডেথ ইন হারনেস, কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু, অতি অবশ্যই একটা বড় কমপেনসেশন প্লাস ওদের থেকেই আমার পেনশনটাও সিকিওর করবো- আচ্ছা কিরণ, কত টাকা করে পেনশন ক্লেম করি বলো তো?’
‘ওদের এখন এখান থেকে যেতে বলো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
‘কে? কে? ওরে বাবা! ভূত নাকি! রা- ইয়ে আম আম আম আম…’
‘আমের সময় নয় এখন। আনারস কি কদ্বেল বলতে পারো-’
‘এই, কার এত সাহস রে! ওঝার বাড়ি ভূত হয়ে আসিস?’
‘আঃ, নিজের সোয়ামিকে অমন ছোটলোকি চালে তুইতোকারি করো কেন?’
‘এঃ সোয়ামি! কোথাকার শেয়ালকাঁটা – বোয়ালহেঁড়ে সোয়ামি রে! বাবা আমায় ভূতের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল! সম্প্রদান করেছিল একটা ভূতের হাতে! ও কিরণ কিছু বলো না ভাই’ বলতে বলতে দেখলেন, কিরণ পালিয়েছে – ঘর ফাঁকা! ঠিক ফাঁকা নয়, কত্তার শখের চেয়ারটিতে যেন তিনিই বসে, শুধু কেবল যেন ছোটবেলাকার উনুনের ধোঁয়ার মতো। একরাশ ধোঁয়া যেন মুণ্ডু আর কাঁধ নাড়িয়ে চলেছে। বউ অজ্ঞান হয়ে গেলো দেখে পালালেন তিনিও।
পালাবার সময় শুনলেন চারপাশে যেন কার বা কাদের ফিসফিসে হিশ্হিশে কথা বা হাসির শব্দ।
একটু ভেবে গেলেন কলকাতার দূরদক্ষিণে জোকা পেরিয়ে, নগেন ওঝার বাড়ি। সচরাচর ওঝাদের মধ্যে তেমন বন্ধুত্ব হয় না। একে ভূতের উপদ্রবই কম, তায় আবার এলাকার ভাগাভাগি নিয়ে গোলমাল যেন দেওয়ানির মামলা। আগে মেয়েরাই ভোগাতনা বেশি। কোন্নগরের মেয়ে বে হয়ে গড়িয়ায় এলো। কখনো তার ঘাড়ে গড়িয়ার ভূত তুড়ুৎ করে দখল নেয়, কখনো কোন্নগরের পুরোনো ডিম্যান্ড ড্রাফট, তাঁর ছোটোবেলার বন্দীভূত পাকড়ায়। আগে এলাকার ওঝা খুঁজেই কাজ চলতো, কিন্তু সেকশন ফোর নাইনটি এইটের ঝামেলার সময় থেকে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের মতন, ফ্যামিলি না হোক লোকাল ওঝাকেই ডাকছে সবাই! আর তারপর আবার হালে কায়দাবাজির সাইকিয়াট্রিষ্টদের হাঙ্গামা। পষ্ট দেখা – ভূতে ধরেছে। যাও সাইকিয়াট্রিষ্টের চেম্বারে। তাদের আবার ওঝার বাত! ওঝারা যে কাজ না-হোক দু’শো-চারশোয় করে – এনারা প্রথমেই চার অঙ্ক! তারপর হপ্তায় হপ্তায় হাজিরা! আর লোকে আবার তোল্লাই দেয়ও, এই ঠক-বেঠকের হদ্দ হতভাগাদের। এইসব নিয়েই গোলমাল মেটাতে ওঝা ইউনিয়নের শুরু। তা সেখানেই নগেন খাঁড়ার সঙ্গে আলাপ। একে তাঁদের এলাকা অনেক দূরের, সুতরাং মক্কেল ধরা নিয়ে রেষারেষি নেই। তায় মানুষটি ভালো। একবার তো মিটিং-এর পরে আস্ত একটা সিগারেটই ফুঁকিয়ে ছিলেন তাঁকে! কড়া নাড়তে গিয়ে খেয়াল হলো তার দরকার নেই। তবু ভদ্রতাবশত ‘নগেন ও নগেন – বলি নগেন বাড়িতেই তো আছ হে, সাড়া দাও! নগেন –’
লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে বেরোলেন নগেন খাঁড়া ‘কে হে – জানো না একডাকে সাড়া দিতে নেই, নিশি পায় – একী! কে, কে ডাকলে?’
‘আমি হে, আমি রামরাম-’
‘তা কোথায় তুমি? অ্যাঁ! বলি খোকা হলে নাকি! বাড়ি বয়ে এসে লুকোচুরি খেলতে লেগেচ!’
‘কী ছাতার ওঝা বলো তো! টের পাচ্চ না? গতকাল আমার এন্তেকাল হয়েচে।’
‘অ্যাঁঃ! বলি তুমিও কি ভূত নাকি হে! হতচ্ছাড়া বদ বদমাশ বেয়াদপ বেহদ্দ বেহায়া বেলেল্লা বাদামভাজা, না না, কী যেন সব, ও বাঁদর বেল্লিক ভূত- ওঝার বাড়ি আসতে তোর লজ্জা করে না, রাম রাম রাম রাম!’
‘আরে আমিই তো রামরাম, আগে ওঝা ছিলাম, এখন ভূত।’
‘ও সব ভূত-ভবিষ্যৎ জানি না বাপু যদি তদ্ভুত যদ্ভুত সম্ভূত সান্তালন মন্ত্রের বাড়ি খেতে না চাও, জানোই তো সব, তবে বিদেয় হও।’
‘হুঁঃ তদ্ভুত মন্তর, রামনাম, সর্ষে, গুষ্টির পিন্ডি, ওসব কিছুতেই কিছু হয় না রে ভাই! যা বলি আর করি মনে করেছি, তা এক্কেরে বোগাস্। এই তো আমার নামই রামরাম, কই কিছুই তো হচ্ছে না! ওটা একটা বিশুদ্ধ ধোঁকাবাজি! এই সবে ভূত হয়েছি। যদি ভালো চাও তো, মানে যদি নিজের বুঝ বুঝতে চাও তো ভূতদের ব্যাপারস্যাপার তোমায় জানাতে পারি, ব্যাবসা খেলাতে পারবে।’
‘কিন্তু তুমি তো এখন আর ওঝা নও, ভূত।’
‘না আমি ভূতপূর্ব ওঝা।’
বলামাত্রই টের পেলেন চারপাশে আবার সেই ক্যানকেনে ঝ্যানঝেনে ফ্যাঁশফ্যাঁশে ঘ্যাঁষঘ্যাঁষে এক তরঙ্গহিল্লোল ‘দেকেচিস, দেকেচিস কান্ড, বললাম না শ্রেণিশত্রু! এখানে এসে চুকলি কাটছে! হল কি না, আমাদের কসরৎ কায়দা বলে দেবে!’
‘না হে রামরাম, তোমার কথা আমি রাখতে পারছি না। ওঝা হয়ে কিনা শেষপর্যন্ত ভূতের টিপস্ নিয়ে কাজ করবো! নাঃ আমাদের ওঝা সমিতি থেকে তোমার নাম কাটাবো। শোকসভাও করবো না!’
‘করবে না তো করবে না – ভূতেরাই আমার আবির্ভাবে একটা সংবর্ধনাসভা – আনন্দসভা করবে, বুঝলে।’
‘ঘণ্টা করবে, কচু করবে’ সেই খ্যাশখেশে ভ্যাসভেসে স্বর ভেসে এল।
রামরাম বুঝলেন, যে নগেনও শুনতে পেয়েছে। বুঝলেন তার আর্তনাদে ‘বাঁচাও বাঁচাও ওই ব্যাটা রামরাম, মরে ভূত হয়ে, এখন দলবল নিয়ে আমায় অ্যাটাক করতে এসেছে গো!’
নগেন ওঝার গৃহিণীটি প্রায় দৌড়েই এলেন ‘কী হয়েছে, কী? অমন চ্যাঁচাও কেন?’
‘না চ্যাঁচাবো না, গুনগুন করে ঠুংরি গাইবো! ওই যে রামরাম, মনে আছে – তোমার হাতের মাংস খেয়ে গিয়ে খুব খুশি…’
‘য্যাঃ কী যে বলো। আমার হাতের মাংস, রাক্ষস না খোক্কস!’
‘ওঃ, তোমার রান্না করা মাংস – যাক সেই রামরাম ভূত হয়েছে – হয়ে আমার কাছে এসেছে, সঙ্গে একদল ভূত!’
‘অঃ! তা তুমি ওদের ঝেড়ে দাও। তুমি একটা ওঝা মানুষ তোমার ভয় কী?’
একটু থতমত খেলেও, পেশাদার দক্ষতায় সামলালেন, নগেন ওঝা ‘বলি, একটা নিয়মকানুন আছে তো! এতো ফুটবল নয়, ওঝাগিরি একটা ক্রিকেট খেলার মত ব্যাপার। ওয়ান ইজ টু ওয়ান। একজন বল করবে, তারপর ব্যাট। এবার দশজন মিলে একসঙ্গে বল করলে খেলা হবে কেমন করে?’
নগেন্দ্র গৃহিণী একটু ভয় পাওয়া গলায়, ‘তা হ্যাঁগো, শুধুই ভূত, নাকি পেত্নি, শাঁকচুন্নিরাও?’ অত্যন্ত বিরক্ত গলায় নগেন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘ওঃ! একে এই সব প্রেতাত্মার ঠেলায় মরছি নিজের জ্বালায় তার আবার অথচ তাদের জেন্ডার ইয়ে করতে হবে নাকি! না, তারা আমার জ্যান্ত বউয়ের মরা সতীন হতে ছটফটিয়ে বাড়িতে চড়াও হয়নি।’
‘শোনো বেশি বকবে না! মরা সতীন নেই আমার? এর আগেও তো তোমার দু-বার বে হয়েছে… সে সব কথা চেপে গিয়ে, বাবার কাছে দরবার করেছিলে, তা কি বেমালুম ভুলেছ? ভিটকিলিতে ভরপুর বিটলে বদমাশ – দোজবরে একরকম হয়, এ একেবারে তেজবরে!’
‘ওঃ! পঁচিশ বছর হয়ে গেল, এখনো সেই কথা ভুললে না! ওসব হলো গিয়ে ভূতপূর্ব ঘ…’
‘ভূত পূর্ব না ভূত পশ্চিম জানি নে বাপু, আমি তো দেখছি তোমার জন্যে আবাদের এই ঘরে ভূত বর্তমান! তাই শুধোচ্ছিলুম – ভূতের তো অমন এলেম নেই – পেত্নির হতে পারে। কে জানে, তোমার আগের সেই দুই পরিবারই আবার অ্যাদ্দিন বাদে তোমার দখল নিতে এলো, কি না! ওরে বাবা! রাম রাম রাম রাম রাম রাম…’
‘দূর ছাই, রামরামই তো ভূত হয়ে এসেছে – আবার তাকে ডাকতে লাগলে কেন? কী আপদ, বরাতে একখানা রামভূত জুটলো!’
‘একে ভূত, তায় আবার রামনাম মোড়ানো, তায় আবার নিজে ওঝা!’
‘ওঝা আর নয় – আর নয় – ও এখন ভূত – সেরেফ একটা ভূত – তাও আবার ভূতবাসরে প্রভূত হ্যারাস্ড্ ভূত’ আবার সেই ঘ্যাঁসঘেঁসে ধ্যাসধ্যাসে গলা।
নগেন কিছু বলবার আগেই সেই কণ্ঠ শুনলেন নগেন ‘মতলবখানা কী! বলি ভেবেছ তোমার ওই ওঝা, বন্ধুটির নামাবলির খুঁট আঁকড়ে রেহাই পাবে, হুঁ, বোঝ এবার ঠ্যালা – পিঠে একখানা মোক্ষম ধাক্কায় নগেন ঢলে পড়লেন স্ত্রীর ওপর। টাল সামলাতে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। ‘উঃ, আধবুড়ো দামড়ার শখ দেখে বাঁচি না। এ ঘরভত্তি ভূতপেরেত, ও ঘরভত্তি বড় বড় ছেলেমেয়েরা, এখন এসব খোকামি শোভা পায়? আচ্ছা, বলি তোমার বন্ধু যে এসব কচ্ছে – তা তেনার গিন্নি জানে? তাকে একটু বলো না।’
‘হুঁ! সে কি করবে? সে তো আর পত্নী থেকে পেত্নি হয় নি! তবে হ্যাঁ – ওর একটু মেমভূতের বাই ছিল। আসলে জানতো না তো কিছু – বিলিতি সিনেমা দেখে সব কায়দা-কানুন টুকতো।’
‘অ্যাই নগেন কী আবোলতাবোল বকছ, আমি কিছু জানতাম না? অ্যাঁঃ!’
‘জানতে তো নাই, আর তুমিও জানো না কিছু, ফের যদি অমন বারফট্টাই করো তো’ – প্রথমে রামরামের গলা, তারপর সেই ভ্যাসভেসে গলাগুলোর একটায় বেশ প্রতিহিংসার প্রাণপ্রতিষ্ঠা শুনলেন নগেন। কিছু বলবার আগেই আবার আরেক ধাক্কা – কিন্তু এবার ধাক্কা একা নগেন নয়, খেয়েছেন গৃহিণীও। তাঁদের দুজনকে, পর্দার ওপারে থাকা ছেলে – ছেলের বউ – মেয়ে –জামাই এবং আরো দুই ছেলেমেয়ের চোখ দেখলো ড্যাবডেবিয়ে। ‘হুঁ, ভূতের উৎপাতের নাম করে বুড়োর উৎপাত’ বহুকাল বাদে বোধহয় বিয়ের পরে জীবনে প্রথমবার মাথায় একটা থতমত ঘোমটা টানলেন নগেনের স্ত্রী – ‘অ্যাঁ-অ্যাঁ-তু-তুমি কে? কো-কো-কো-কোন শাকচুন্নি!’ নগেনও বলতে পারলেন ওইটুকুই।
ব্যাপার স্যাপার দেখে রামরামও কেমন যেন লজ্জাই পেলেন, আবার হাসিও পেলো। অ্যাই অ্যাই আবার হাসি কীসের হে, তাও আবার যেন শাশুড়ির সামনে নতুন জামাইয়ের মতো হাসি! একটি কন্ঠ থামলে আরেক কণ্ঠ, ‘দাও না, দাও না, ওকে অ্যাকটা পেত্নির সঙ্গে ভিড়িয়ে, ওই তো নগেনেরই তো জানলে, আগের দুই পিস্ বউ শাঁকচুন্নি হয়েই আছে, তাদেরই একটাকে-’
‘না না, নগেনের ভূতপূর্ব স্ত্রী কেন – আমাদের ওঝাদের, খুব শুদ্ধ থাকতে হয়, পরস্ত্রী, তায় আবার বন্ধুপত্নী – তায় আবার মনুষ্যাবতারেই তেমন সুবিধের ছিল না…’
‘আরে সে তখন – পেত্নি, বর্তমান…’
‘অ্যায়ঃ তুমি আবার ওকে বাতাস করো কেন? দেখছ না এখনও ওর ওঝাগিরির ভূত নামেনি।’
‘তা সে ভূত নামাবে কে – তাও তো ওঝারই কাজ – বলি ভূত হয়ে তো আর ভূত নামাতে পারো না – ওটা যে সেমসাইড।’
‘তা তুমিই বা তা করো কেমন করে? তুমিও তো ভূত।’
‘ওই তো বললে – তোমরা আমায় ভূত বলেই তো মানো না – অ্যাসাইনমেন্ট দাও না – তায় আমি ভূতপূর্ব ওঝা।’
‘তোমার একটু চিত্ত-পিত্ত, মৃত্যু ছিত্ব-শুদ্ধি দরকার আর মনে রেখো তুমি – হলে গিয়ে, মনে রাখবে, তুমি, তোমার বর্তমান আর বর্তমান নয়, তুমি হলে ওঝাপূর্ব ভূত – ভূ যুক্ত – ক্ত।’
থ হয়ে রইলেন ভূত রামরাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন