short-story-muktiyoddhar-chithi

মুক্তিযোদ্ধার চিঠি
হুমায়ূন কবীর ঢালী


এক


কাজি বাড়ির সামনে গ-গোল।
কিসের গ-গোল? স্ত্রী লতার কাছে জানতে চায় আবুল কাশেম।
বাতেন তো কইল সাইকেল লইয়া।
সাইকেল! কিসের সাইকেল! কার সাইকেল! সাইকেল আইল কইথন? আমাগো গেরামে ত কারো সাইকেল নাই।
আমি ক্যামনে কমু। তয় বাতেন সাইকেলের কথাই কইল।
বাতেন কই গেছে? অরে ডাহ ত।
অরে ডাহুম কইথন। অয় গ-গোল দ্যাখতে গেছে।
কও কী! গ-গোল দেখতে গেছে! তোমারে না কইছি, অরে কোনো গ-গোলে যাইতে দিবা না। যাইতে দিলা ক্যান?
জুয়ান মানুষ বাইন্ধা রাহন যায়? এইডা ছাড়া আপনের ভাইয়ে কি কোনো কথা হুনে? হের যা ইচ্ছা অয়, তাই করে।
পিটাইলে সব ঠিক অইয়া যাইব। কথা হুনব না আবার। একদিন বাইন্ধা এমুন পিটান পিটামু, যাতে কইরা জীবনে আর তোমার কথা অমান্য না করে।
আপনের ভাইরে আপনে বাইন্ধা পিটান, আর ছাইড়া পিটান, ওইডা আপনের ব্যাপার। এইডা নিয়া আমার লগে গ্যানর গ্যানর কইরেন না ত।
তুমি এইডারে গ্যানর গ্যানর কইতাছ? আরে, দেশের অবস্থাডা বুঝতে অইব না? দেশের কথা বাদই দিলাম। গেরামে কী আমাগো শত্রুর অভাব আছে? ইউনুস মিয়া এ্যামনেই আমাগো দুইভাইরে দোষি করে। হেয় সবার লগে কইয়া বেড়াইতাছে, আমরা দুই ভাইয়ের নাকি মুক্তিযোদ্ধাগ লগে যোগাযোগ আছে। আমরা নাকি মুক্তিযোদ্ধাগ কাছে এই গেরামের রাজাকারগ লিস্টি পাঠাইছি। এইডা কোনো কথা অইল। লিস্টি পাডান লাগে? কার গেরামে কে মুক্তিযোদ্ধা, আর কে রাজাকার তা কে না জানে।
মাইষ্যে জানে জানুক, আপনের এইডা নিয়া মাথা ঘামান লাগবো না। ইউনুস মিয়া মানুষ ভালা না। হের লগে পাল্লা দিলে যে কোনো সময় ক্ষতি করতে পারে।
ও… দেশের ক্ষতি করতাছে হেয়, আর খেসারত দিমু আমি? দেহ না, হেরই দৌড়ের উপর থায়ন লাগব। হের ভাতিজা মোহনরে ত আমি কইছি, তোরা চাচা-ভাতিজা সাবধান অইয়া যা। মুক্তিযুদ্ধ মাইনা নে। শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দে।
আর মানুষ পাইলেন না। ভাতিজাও ত চাচার মতো রাজাকার। শান্তি কমিটির মেম্বর। হেয় ক্যামনে শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দিবো! আপনের এই এক দোষ। সবসময় ভুল জায়গায় ঢিল মারেন। ভুল জায়গায় ঢিল মারলে বিপদেই পড়তে অয়।
কী করমু কও। হেরা চাচা-ভাতিজা যা শুরু করছে, মাঝেমধ্যে মনে কয়, উচিত শিক্ষা দিয়া দেই।
দরকার নাই। এইসব বাদ দেন। এহন কই যাইবেন যান। যদি পারেন, কাজি বাড়ির সামনের থন বাতেনরে নিয়া আসেন। আপনের ভাই যেই গাউড়া, আবার কোন গ-গোল লাগায় কে জানে!
ঠিক আছে, যাইতাছি।
হ যান। জলদি যান।

দুই


ঠাকুরচর থেকে ষাটনল লঞ্চঘাট যেতে হলে নবাবনগর হয়ে যেতে হয়। কিন্তু বদু এলো পুরো উল্টো রাস্তা সিকিরচর হয়ে। কারণ বদুর বাবা বলেছে সিকির চর হয়ে ষাটনল যেতে।
কাজি বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেই পথরোধ করল মোহন।
এই মিয়া সাইকেল থামাও।
বদু সাইকেল থামায়।
মোহন এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমার বাড়ি কই?
ঠাকুরচর।
কোন বাড়ি?
সরকার বাড়ি। বদু ইচ্ছা করে মিথ্যা কথা বলে। আসলে তাদের মিয়া বাড়ি।
নাম কি?
বদিউল ওরফে বদু।
ওই মিয়া তুমি মুসলমান না? নামের আগে মুহাম্মদ লাগাও। বলো মুহাম্মদ বদিউল অথবা মুহাম্মদ বদু।
এইডা আমার ব্যাপার। মুহাম্মদ অন্তরে রাহুম না সাইনবোর্ডে ঝুলাইয়া রাহুম এইডা আমি বুঝমু। আপনে কওনের কে?
এই ব্যাটা, চামারের মতো কথা কস ক্যান? তুই জানস আমি কে? আমার চাচার নাম জানস? মোহনের গলা কর্কস হয়ে যায়।
আপনেরে চিননের দরকার নাই। আমার পথ ছাড়েন। দেরি অইয়া যাইতাছে। তাড়াতাড়ি যাইতে অইব।
তা যাইও। তোমার বাবার নাম কি? মোহন গলার সুর নামিয়ে বলল।
আবদুল রউফ সরকার। বদু মিথ্যা বলে।
আরে আবাবও মুহাম্মদ ছাড়া নাম? মুহাম্মদ লাগাইয়া কও বাপের নাম কি?
আবদুল থাকলে মুহাম্মদ না কইলেও চলে।
চলবো না। বল মুহাম্মদ আবদুল রউফ সরকার।
মোহনের মতিগতি ভালো না দেখে তর্কে গেল না বদু। সংশোধন করে বলল, মুহাম্মদ আবদুল রউফ সরকার।
এইতো, ভেরি গুড। এহন কও, কই যাইতাছ?
কইলাম ত ষাটনল যাইতাছি।
ওই মিয়া আমার লগে ফাইজলামি করতাছ। ঠাকুরচর থন ষাটনল যাওনের সোজা রাস্তা রাইখা কেউ এই রাস্তায় যায়?
না যায় না।
তয় যাইতাছ ক্যান? মতলবটা কি?
সোজা রাস্তায় ভেজাল আছে।
কী ভেজাল?
হুনছি, নবাবনগর প্রাইমারি স্কুলে মেলিটারি উঠছে।
মেলিটারি উঠলে তোমার কি? তুমি অইলা পোলাপাইন মানুষ। তোমার আবার ভয় কিসের? তাছাড়া হেরা দেশের শান্তির লাইগা আইছে। তোমার ভয় পাওনের কী আছে! তুমি ত আর শান্তির বিপক্ষে না? তুমি কি মুক্তি? তোমার বাপ কি করে?
আপনে ত বড়ো বেশি প্যাঁচাল পারেন? আমার ইন্টাভিউ নিতেছেন ক্যান?
তুমি চোর না বাটপার, মুক্তি না শান্তি, এইডা জানতে অইব না?
আপনে জাইনা কি করবেন?
জায়গা মতো খবরডা পৌঁছাইয়া দিমু।
কই পৌঁছাইয়া দিবেন?
মেলিটারিগ কাছে।
আপনে কি হেগ চামচা?
মহূর্তে বদুর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পর বসিয়ে দেয় মোহন। গাল ধরে হতভম্ব বদু মোহনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার রাগ হয়। ইচ্ছে করে হারামিটাকে মাটিতে পুতে ফেলতে। তবে তা সম্ভব নয় বুঝতে পারে। বয়সে মোহনের থেকে সে অনেক ছোট। এছাড়া সে ভিন গাঁয়ের। শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারবে না।
মোহন থাপ্পর দিয়েই ক্ষান্ত হয় না। বদুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সাইকেলটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয় বদু তেড়ে আসে।
আমার সাইকেল ধরেন ক্যান?
তোর সাইকেল মানে? মোহন উল্টা ফাঁপড় নেয়।
আমার সাইকেল মানে আমারই।
না তোর সাইকেল না। এইডা আমার সাইকেল।
আপনে কিন্তুক বেশি বাড়াবাড়ি করতাছেন। আপনের ভালা অইব না কইলাম। আমারে একলা পাইয়া রাজাকারগ মতো উল্টাপাল্টা ব্যবহার করতাছেন। ভালয় ভালয় আমার সাইকেলটা দিয়া দেন।
না দিমু না। যা, খালি পায়ে হাইটা ষাটনল চইলা যা। তেড়ামি করবি ত, গাছের লগে বাইন্ধা পিটামু। ইউনুস চাচারে ডাইকা কমু তুই মুক্তির স্পাই। তহন বুঝবি কত ধানে কত চাল।
অ- আপনে ইউনুস মিয়ার ভাতিজা? আপনের চাচায় ত বড় রাজাকার।
মোহন এবার পুরোপুরি ক্ষেপে যায়। সাইকেলটা একটা গাছের সাথে রেখে বদুর দিকে তেড়ে আসে। বদুকে কিল-ঘুষি দিতে থাকে। বদুও সমস্ত শক্তি দিয়ে মোহনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু মোহনের শক্তির সাথে পেরে উঠে না। একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

এক এক করে মানুষজন জড়ো হতে থাকে। সেখানে হাজির হয় বাতেনও। মোহন আর বদুকে ঘিরে মানুষের বৃত্ত তৈরি হয়। মোহনের গায়ে পড়ে ঝগড়ার সমালোচনায় মুখর হয় উপস্থিত সবাই। প্রতিবাদ করে বাতেন। মোহনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সে। বদুকে টেনে তুলে।
কাঁদতে থাকে বদু।
মোহন বাতেনের উপস্থিতি সহজভাবে নেয় না। সে বাতেনের ধাক্কার প্রতিবাদ করে।
তুই আবার এহানে নাক গলাইতে আইছস ক্যান?
তুই একটা অচেনা ছেলেকে মারবি, আর আমি কিছু বলব না?
বেয়াদবি করলে কী ছাইড়া দিমু?
তুই অর সাইকেল তোর বইলা চালাইয়া দিতে চাইলি, আর বলতাছস বেয়াদবি করছে ওই ছেলে? ওর সাইকেলটা দিয়া দে। অয় চইলা যাউক।
তুই সব জায়গায় মাতবরি করতে আইছ না কইলাম বাতেন। বেশি ভালা অইব না।
মোহন মানববৃত্তের ফাঁক ভেঙে বেরিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মানুষজনের উপস্থিতি কমতে থাকে। একসময় পুরো ফাঁকা হয়ে যায়।
বাতেন বদুকে সান্ত্বনা দেয়।
মোহনের ঘটনার জন্য গেরামের পক্ষ থেকে আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। মাফ কইরা দেও, ভাই।
আপনে মাফ চাইবেন ক্যান? আপনে কি আমারে মারছেন?
বাতেন থমকে গিয়ে বলে, তুমি কই যাইবা?
ষাটনল। বলে সতর্কতার সাথে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বদু বলল, তয় তার আগে এই গেরামের আবুল কাশেমের কাছে যামু।
তোমাগ গেরাম কি ঠাকুরচর? বাবার নাম কি মন্টু মিয়া?
হ, বাবাই আমারে পাঠাইছে কাশেম কাকার কাছে।
তুমি আমার কাছে কইতে পারো। আবুল কাশেম আমার ভাই।
বুঝতে পারছি।
ক্যামনে বুঝলা?
বাবায় কইছে কাশেম কাকার ভাইয়ের নাম বাতেন। কাশেম কাকারে না পাইলে আপনের কাছে চিঠিটা দিতে কইছে।
বাতেন চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। আশেপাশে কেউ নেই। তবুও সাবধানের মার নেই। বদুকে নিয়ে গাছে আড়ালে যায়। বলে, দেও, চিঠিটা দেও।
বদু পকেট থেকে চিঠি বের করে দেয়।
বাতেন চিঠির ভাজ খুলে পড়ে।
প্রিয় কাশেম
শুভেচ্ছা জানিও।
কোনো উপায় না পেয়ে চিঠি দিয়ে আমার ছেলে বদুকেই পাঠালাম।
আমি ভেবে দেখলাম আর দেরি করা ঠিক হবে না। আগামীকাল ভোররাতেই রওনা দেব। বাতেন আর তুমি নৌকা করে ষাটনল চলে এসো। সেখান থেকে আমরা অন্য জায়গায় যাবো। রাজাকাররা মিলিটারিদের গ্রামে ঢোকাচ্ছে। আর বসে থাকা যায় না।
ভাবিকে আজই তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিও।
সাক্ষাতে বিস্তারিত বলবো।
ইতি
মন্টু মিয়া

চিঠি পড়ে বাতেন বলে, এত রিস্ক নিয়া তোমারে পাঠানো ঠিক হয় নাই।
কী আর করা। কেউ নাই ত।
ঠিক আছে। তুমি এহানতেই চইলা যাও। আমাদের বাড়ি যাওন ঠিক অইব না।
হ, চইলা যাইতাছি।
বদু সাইকেলে ওঠে প্যাডেলে চাপ দেয়।
বাতেন চিঠি নিয়ে বাড়িমুখো হয়।
এইসময় দূর থেকে তার বড়ভাই আবুল কাশেমকে দেখা যায়। এগিয়ে আসছে সে। বাতেন দেখে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। আরেক মুক্তিযোদ্ধার চিঠি নিতে আসছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *