short-story-o-duto-ki

ও দু’টো কী
চিন্তন শব্দবণিক



মেয়েটার ঠিক কোণাকুণি বসেছিল অর্হণ।

ওরই মতো মেয়েটাও অপেক্ষায় ছিল সুপ্রকাশবাবুর। লোকাল কাউন্সিলর সুপ্রকাশবাবুর দর্শন দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় দরজায় লেখা রয়েছে। তবে সেটা নির্ভেজাল মিথ্যে, জানে অর্হণ। মোটেই নির্দিষ্ট সময়ে উনি দেখা দেবেন না। অফিসঘর লাগোয়া ওয়েটিংরুমে ভিড় কতটা হল, প্রথমে সেটার আপডেট নেবেন ওঁর ডানহাত, ন্যাটা বাপির কাছে। দু’একবার খবর নিতে নিতে ভিড় জমে যাবে ঘরটায়। তখন খুটুস করে দরজা খুলে আবির্ভূত হবেন কাউন্সিলর মশাই। বাপিরই ইশারায়। বাপি সুপ্রকাশবাবুর ছোটবেলার বন্ধু। কিছু কর্ম এবং বহু দুষ্কর্মের সঙ্গী সুপ্রকাশের। একসময় বোমা বাঁধতে গিয়ে ডানহাতটা উড়ে যায়। তারপর থেকেই বাপির আগে ভূষণ ন্যাটা। ওই বাঁহাতেই প্রোমোটারদের কমিশন, ফুটপাথের হকারদের কাছ থেকে সাপ্তাহিক দক্ষিণা, অটোওয়ালাদের থেকে দৈনিক চাঁদা, সবকিছুই সামলাচ্ছে বাপি। পাবলিক সামলানোও তার ওই বাঁ হাতেরই খেল। আগে মন্ত্রীরাই জনতার দরবার করতেন। দিনকাল বদলেছে। চারিদিকে টাকার ওড়াউড়ি। ক্ষমতা আর দাপেটের এখন বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। নিচুতলাতেও তার দেদার প্রসাদ। কাউন্সিলররাও বঞ্চিত নন। তাঁদেরও ছোটছোট দরবার হয়েছে। সেজন্য একটু দেখনাই, চেকনাই লাগে। বিমান কোম্পানির মহারাজার মতো বিগলিত হাসি ছড়িয়ে এক্ষুনি ঘরে ঢুকবেন সুপ্রকাশবাবু। তারপর এটা ওটা সেটা ডিল হবে।

এসবই জানে অর্হণ। তবু ঠেকায় পড়ে আসতে হয়। যেমন হয়তো আসতে হয়েছে মেয়েটাকেও। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে অর্হণের মনে হল যেন ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে। ঘুমের রেশ এখনও চোখের পাতাগুলোকে ছেড়ে যায়নি। সেগুলো যেন স্বপ্নে বিভোর।

না, একটু বেশি হল। সাতসকালে একটা অপরিচিত মেয়েকে দেখেই তার চোখে স্বপ্ন পড়ে ফেলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল বোধহয়। আসলে মেয়েটার চোখদু’টো একটু ফোলাফোলা। সেকারণেই বোধহয় একটু বেশিই এগিয়ে গিয়েছিল ও। ডেনিম জিনস আর ক্যানারি ইয়লো টিশার্ট। পনি টেইল ওর মাথার সামনের সমস্ত চুলগুলোকে পিছনে টেনে নিয়ে গেছে। মুখটা চকচকে, উজ্জ্বল। আলগা স্মার্টনেসের বিচ্ছুরণ ওর দিকে টানছে। না, এটাও বেশি হল। বলা ভাল, অসত্য। বিচ্ছুরণ আসলে মেয়েটার বুক থেকে। বিচ্ছুরণ বা বিদ্রোহ যা-ই বলা যাক না কেন, সেই বিদ্রোহ সামলাচ্ছে টিশার্ট। ওকে কি তাহলে ও’দুটোই টানছে। মনের কাছে অকপট হবার চেষ্টা করে অর্হণ। একবার চারপাশটা তাকিয়ে দেখল অর্হণ। ওই ওয়েটিংরুমে যে ক’জন বসে রয়েছেন, তাদের সকলের হাতেই প্রায় কাগজপত্র বা ফাইল রয়েছে। সকলেরই মুখে চোখে একটা অধৈর্যভাব। শুধু মেয়েটার কোনও হেলদোল নেই। সকাল সকাল এরকম একটা জায়গায় একটা ক্রাইম থ্রিলারে মুখ গুঁজে বসে রয়েছে।

অবশ্য একধরণের পড়ুয়া মেয়ে থাকে, যারা সামনে যা পায় তাই পড়ে ফেলে। পড়ে পড়ে ওই বুকিশ মেয়েগুলো খুব মোটা, নয় রোগা হয়ে যায়। আর চোখে উঠে আসে চশমা। কিন্তু এরকম ব্যালান্সড, টোনড বিউটি নজরে আসেনা বড় একটা। এখনকার মেয়েরা হয় বুকিশ নয় বুকি। এখন তো বুক মানে একটাই। ফেসবুক। রাস্তাঘাটে বা যেখানে সেখানে মোবাইলে এইসব ফেসবুকিরা ক্রমাগত বুড়ো আঙুলের নিঃশব্দ খটাখটে ক্রমাগত ভাসিয়ে দিচ্ছে কত কথা। এই মেয়েটা কি সেরকমই? বুকি? না বুকিশ? কিংবা বুকওয়ার্ম।

সে যাইহোক মেয়েটার বুক দু’টো ভারী সুন্দর। ভেতরের অর্হণ নাছোড়। হঠাৎ মেয়েটা তাকায় অর্হণের দিকে। ইস ব্যাপারটা খুব খারাপ হল। ঠিক যে সময় ডিজিট্যাল স্ক্যান করতে যাবে সেই সময়েই ক্যাচ-কট-কট। ফান্ডাটা তৃষাণের। অর্হণের কলেজের বন্ধু। একদিন ক্যান্টিনে বসে টানা দেড়ঘণ্টা জ্ঞান দিয়েছিল। বিষয়- ঝাড়ি ও তার প্রকারভেদ। ওর মতে মেয়েদের দিকে তাকানোর অনেক পদ্ধতি রয়েছে। একটা যেমন ডিজিট্যাল প্রসেস। তৃষাণের কথায়, সেটা হল একবার তাকালি একটা পঞ্চাশ মেগাপিক্সেলের ছবি উঠে গেল তোর স্ক্যানারে। ব্যাস। তারপরে তোমার হার্ডডিস্কে ডাউনলোড করে রেখে দাও। পরে প্রয়োজনে টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট জুম করে দ্যাখো না! কে নিষেধ করছে? দ্যাখো, ফ্যান্টাসাইজ় কর। তৃষাণের মতে, এটাই সবচেয়ে রিফাইন্ড প্রসেস। তাছাড়া এতে ছেলেদের ইমেজ থাকে একেবারে নিষ্কলঙ্ক। তবে এইভাবে যারা মেয়েদের দিকে দিনে একবার তাকায়, মেয়েদের চোখে তারা ‘একটু যোগী টাইপ’। এভাবে মেয়েদের একটু চমকও দেওয়া যায়। কী রকম? ধরা যাক, এভাবে প্রতিদিন শুধু একবার দেখেই যদি কেউ একটা মেয়েকে মনে রাখতে পারে, তাহলে হঠাৎ একদিন সারপ্রাইজ দেওয়া যায়। কিচ্ছু না, শুধু পরপর চারদিন মেয়েটা কী পরেছিল তার একটা কমপ্যারাটিভ স্টাডি দিতে হবে। এই যেমন, সোমবার ভায়োলেট মাস্কারাটা আরও একটু লাইট হলেই কম্বিনেশনটা ডেডলি হতো। তোমাকে সোনাক্ষি সিন্‌হার মতো লাগত। সোমবারের থিম কালার অবশ্য মভ। তাতে অসুবিধা নেই, তুমি সবকিছুই ভালভাবে ক্যারি করতে পার। আচ্ছা বুধবার ওই যে এগজটিক পোনড্যান্টটা পরেছিলে, সেটা বেজ কুর্তিটার সঙ্গে বেশি মানাতো না!… এইসব আর কি! ব্যাপারটা কী জানিস যে ছেলেটা পারতপক্ষে মেয়েদের দিকে তাকায় না, সে যদি বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এমন বোমা ফাটায়, তবে উল্টোদিকে ধস নামবেই।

আরেকটা আছে। এটা অবশ্য একটু জুলজিক্যাল। এই পদ্ধতিতে চোখটা হবে ব্যাঙের জিভের মতো। আর লুকটা হবে চুম্বকের মতো। স্যাট করে দৃষ্টিটা বেরিয়ে সব চেটেপুটে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসবে। একটা ঝটিতি লুক। সব পড়ে ফেলতে হবে তারই মধ্যে। ওই লুকটাই চুম্বকের মতো টেনে নেবে উল্টোদিকের পরম কাঙ্ক্ষিতাকে। একটু পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ রয়েছে ঠিকই, তবে মস্ত ঝাঁঝ। এখানেই শেষ নয়। পরেরটা ব্রেইল পদ্ধতি।

অর্হণ বলেছিল, ‘সে কী রে! ওটা তো দৃষ্টিহীনদের পড়ার পদ্ধতি।

তাতে কী? অন্ধের যষ্ঠি কি শুধু পথ খুঁজে নিতেই ব্যবহার করা হয়। কাউকে পেটাবার জন্যও তো লাঠি লাগে না কি! একই জিনিসের দু’রকমের ব্যবহার জগতে কালে কালে যুগে যুগে হয়ে আসছে। ছুরি দিয়ে ফল কাটা হবে না মানুষ, সে তো যার হাতে ছুরি সে ঠিক করে। অনেকটা সে রকমই। তবে ফলকাটা আর মানুষ কাটা যেমন এক নয়, সে রকমই ব্রেইল পদ্ধতিতে যারা মেয়েদের পরখ করে তারা লুকিয়ে থাকে। বাসে ট্রামের ভিড়ে। ব্যাপারটা ভীষণই কাওয়ার্ডিশ। এর বেশি ইলাবোরেট করতে পারবে না বলে ও চলে যায় পরের প্রসঙ্গে।

পরেরটা তুলনায় সাদামাঠা হলেও বেশ কঠিন সাহস লাগে। এটা হল, সরাসরি চোখে চোখ রেখে মুগ্ধতার মিসাইল ছুড়ে দেওয়া। অগ্নির বদলে শাহিন। প্রতিহত হতে পারে। কিন্তু ঘাবড়ালে চলবে না। ধৈর্য চাই। মুগ্ধতার এই শরকে তেলই বল আর স্তব, শয়তান থেকে ভগবান সকলেই এতে হড়কায়। ঠিক জায়গায় মারতে পারলে কাজ হবেই। সরাসরি। আর হ্যাঁ, অকপট হতে হবে।

চার্বাকের থিয়োরি মনে মনে ঝালিয়ে নিতে নিতেই ভাবে অর্হণ, সবই ঠিক আছে। তা বলে কি একটা অপরিচিত মেয়ের সামনে গিয়ে অকপটে গিয়ে বলা যায়, তোমার বুক দু’টো খুব সুন্দর?

সরাসরি কথা বলা অত সহজ নয়। আর অর্হণ তো পাড়ার ছোটকার মতো বেলেল্লা নিঃসংকোচ হতে পারবে না। বাপ রে সেবার ছোটকার মুখের তোড়ে অর্হণের মুখ লুকনো দায় হয়েছিল।

ওদের পাড়ারই মেয়ে তনিমার বুকে তখন সদ্য কুঁড়ি। পাড়ারই একটা দোকান থেকে কী যেন একটা কিনে মায়ের সঙ্গে ফিরছিল। হঠাৎ হাসি হাসি মুখে ছোটকা মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে বসল, বুকের ও দু’টো কী?

তনিমা প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পরে কী যেন একটা ভেবে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিল। আর ছোটকার মুখে তখন স্বর্গীয় অমলিন হাসি।

কী রে পারলি না তো? বুকের ও দু’টো যে ভাওয়েল সবাই জানে, অথচ তুই…। বি-ডাবল-ও-কে। বুক মানে বই। তাহলে ও দু’টো ভাওয়েল হল কিনা! ভালো করে পড়াশোনা কর। শুধু অন্যদিকে মন দিলে হবে!

অর্হণ অবশ্য জানে, ওই মেয়েটা ইদানীং সেন্ট পিটার্সের একটা লম্বা মতো ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। ছোটকা সেদিন ওর মাকে পাছে বলে দেয়, সেই আশঙ্কায় সম্ভবত তনিমা সেদিন আর কথা বাড়ায়নি। তাছাড়া এটা ঠিক কোন ধরণের নিগ্রহের তালিকায় পড়বে, তা বুঝে ওঠার আগেই অবশ্য ছোটকা সেখান থেকে পগারপার। ছোটকা পারেও। এতদিন ও জানতো এটা একটা জোকের মতো বিষয়। সেটাই কিনা একেবার না ভেবেচিন্তে কী ভাবে যেন বলে দিল ছোটকা। ছোটকা আমাদের বিস্ময়কর একটি স্যাম্পেল বিশেষ। মেয়েটার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিঃশ্বাস কি একটু ঘন হয়ে এল? ভেতরের উষ্ণতা ততটা প্রকট না হলেও শিরায় শিরায় বয়ে যাওয়া সুখস্রোতটা চিনে নিতে ভুল হয় না অর্হণের এই ধরণের অনুভূতিগুলো কেমন এক ধরণের শিরশিরে তৈরি করে শরীরে মনে।

বাসে-ট্রামে কোনও সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে সিট শেয়ার করলে কখনও সখনও একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় অর্হণের। ওর মনে হয় কখনও কখনও সেই স্পর্শ দুটো মানুষের মধ্যে সেতু রচনা করে দেয়। এমন কতবার হয়েছে, পাশে বসা তরুণীর শরীরে হয়তো সামান্য ছোঁয়া লেগে গেল। সেও নিজেকে সরিয়ে নিল না। হয়তো তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। যেন এদিকে কোনওকিছুই ঘটেনি। আলতো ঝাঁকুনি তখন প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই কাছাকাছি এনে দেয় দু’জনকে। তখন কি শুধুই সে উপভোগ করে অন্যজন কি সত্যিই নিঃস্পৃহ থাকতে পারে! উভয়ের উন্মুক্ত ত্বক কি সমানভাবেই অন্য শরীরের স্পর্শ পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে না? তবে এটাও ঠিক, এই ধরণের ওয়াইল্ড ভেঞ্চার কখনই খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সম্ভবত সামাজিক সংস্কারই প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুই মনের কাছে। আর সেই সংস্কারের থেকে বেরোতে চাওয়া মানুষ ভিড় বা অন্যকিছুর মতো একটা অজুহাত ব্যবহার করতে ভালবাসে। পারস্পরিক অলিখিত সম্মতির ভিত্তিতেই চলতে থাকে শরীরী সংলাপ।

ইমেজও কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অর্হণের ব্যাপারটাই তো খানিকটা সেরকম। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে হিসাবে এলাকায় সুনাম রয়েছে। কপিবুক গুডবয়রা মেয়েদের দিকে তাকাতে পারে না। বুকের দিকে? ওরে বাবা! তাহলে তো পৃথিবী রসাতলে যাবে। চারপাশে সকলের ভাবখানা এইরকমই। কিন্তু ওদের বুকে কি কোনও মেয়ের মুখের ছবি থাকে না? না কি কোনও মেয়ের বুকের ছবি থাকে না! কিন্তু সেই ছেলের মনের ভেতরে আর কে ডুবুরি নামাচ্ছে!

মেয়েটা আবার একবার অর্হণের দিকে তাকাল। আরও একবার অপ্রস্তুত হল ও। কেননা, ওর মন যেখানেই থাকুক, চোখ তো পড়েছিল আকর্ষণের পুরনো কেন্দ্রেই। চোখাচোখি হতেই অর্হণ লক্ষ্য করল মেয়েটার নাকের মাঝখানের পটিতে একটা প্ল্যাটিনামের রিং। সোজাসুজি দৃষ্টির ঝাপটা ওর চোখে লাগতেই বুঝল। সাইড থেকে প্রোফাইল ভিউয়ে যতটা ভাল লাগছিল মেয়েটা তার চেয়েও সুন্দরী। আচ্ছা মেয়েটা ওর সম্বন্ধে কি কিছু ভাবছে এখন? ভাবলে ঠিক কী ভাবছে এখন? মেয়েরা ঠিক কী ভাবে? ওর বয়েসী ছেলে মেয়েদের মনে পরস্পরের সম্বন্ধে ভাবনাগুলো কি একই রাস্তা ধরে এগোয়? যে ভাবে অর্হণ হাজারো কল্পনার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে সেভাবে কি ওরাও…! বোধহয় না। অবশ্য মেয়েদের মনের খোঁজ না কি স্বয়ং দেবতারাও পান না অত সহজে।

আসলে প্রশ্নটা এ যাবৎ কোনও মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে দেখা হয়নি। মনে মনে ও যেভাবে আদর করে কোনও মেয়েও কি সেভাবেই ভাবে?

অর্হণ নিজেকে চেনে। চেনে নিজের মনটাকে। বাইরে ছেলেটা যেমন সোজাসাপ্টা ভেতরটা ততটা নয়। ভেতরের ছেলেটার ভাবনায় ভাললাগার রাজকন্যেরা শুধু রূপকথার রাজনন্দিনী হয়ে আসে না। তাদের উপস্থিতিতে থাকে আরও বেশি কিছু। মুগ্ধতা আর সান্নিধ্যের মধ্যে মাদকতা আছে ঠিকই তবে সে যেন সদর দরজা। সেই দরজা একবার খুলে গেলে আর রক্ষে নেই। চোখের সামনে তখন দরজাই দরজা। যেন হাজারদুয়ারির ঠিকানা। দরজা খোলাটাই তখন নেশা হয়ে যায়। শুধু কল্পনার চাবি দিয়ে একটার পর একটা দরজা খুলে যাওয়া। হাজারও দুষ্টুমির হাতছানি। একেক ঘরে একেকটা। সেই দুষ্টুমিই আচ্ছন্ন করে রাখে সমস্ত সত্তা আর মনকে। চোরাকুঠুরির তালা না খোলা পর্যন্ত যেন স্বস্তি নেই। অথচ এই মনের খেলাটার কথা কাউকে মুখ ফুটে বলা যায় না। মাঝে মাঝে শুধু নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। অর্হণ বুঝতে পারে না, এই অপরাধবোধ আসে কোত্থেকে? সেটা কি চারপাশের বেঁধে দেওয়া সংস্কারের গণ্ডি মনে মনে পার হয়ে যাওয়ার কারণে? আসলে সেই জগৎটার বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব না থাকলেও মনের সমস্তটা জুড়েই তার আনাগোনা।

এই যে মেয়েটাকে দেখে অর্হণের ভালো লাগছে, কল্পনায় ওর সঙ্গে যেভাবে নানা অনুষঙ্গে, নানা শরীরী খেলায় মেতে উঠেছে, তার কি কোনও সংকেত মেয়েটার মনে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে? এই মুহুর্তে মেয়েটিও কি ওরই ভাবনার শরিক? ওরা কি ভাবনাগুলো ভাগাভাগি করে নিচ্ছে? না কি এই ভাবনাগুলো সব আসলে মেয়েটারই। ও শুধু সেই ভাবনার স্রোতে গা এলিয়ে ভেসে রয়েছে? মনের মধ্যে কৌতূহল তীব্র হয়ে ওঠে।

মেয়েদের না কি বাড়তি একটা ইন্দ্রিয় থাকে। যা দিয়ে ওরা সব বুঝতে পারে। ওরা ঠিক বুঝতে পারে কে কখন ওদের দিকে তাকাল। সেটাও সেই ছেলেটির দিকে একবারও না তাকিয়ে। কিন্তু সামনের ওই মেয়েটার সঙ্গে ওর যখন সামান্য হলেও দৃষ্টি বিনিময় হল, তখন তো কই কোনও ভাবান্তর দেখল না ওর চোখে। সামান্য উষ্মা, বিরক্তি কিংবা নিদেন পক্ষে কপট রাগ। অনেক মেয়ে তো একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিও ছুড়ে দেয়। সুন্দরীদের আবার ওই ধরণের কয়েকরকম দৃষ্টি রেডি থাকে। রাস্তাঘাটে অনেকবারই প্রয়োজন হয় কি না! কিন্তু এই মেয়েটার চোখে তেমন কোনও ভাবান্তর না দেখে একটু অবাকই হল অর্হণ। তাহলে কি সুন্দরী ওকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনল না! না কি এটাও সযত্ন প্রশ্রয়েরই একটা লক্ষণ।

একটু পরেই মেয়েটা উসখুস করতে শুরু করল। দীর্ঘ প্রতীক্ষাজনিত বিরক্তও হতে পারে। এতক্ষণ চোখের সামনে ধরা বইটা নামিয়ে হাত দু’টো ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে নিরস্ত করতে পারল না অর্হণ। এতক্ষণ যে হাতের আড়াল ছিল মেয়েটার বুক দুটোর ওপর সেটা সরে গেল। নিটোল বুকের স্পষ্ট অবয়বে আটকে গেল অর্হণের চোখ।

আশ্চর্য তারপর আর মেয়েটা বইটা পড়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না। তবে কি থ্রিলারের সাজানো ঘটনা আর ওকে টানছে না? ওর সত্তায়, অনুভবে কি তবে নতুন থ্রিল? সুঁড়িপথে অর্হণের চোরা দৃষ্টির আনাগোনায় কি রোমাঞ্চিত? একটা ভীষণ ভাললাগা বুড়বুড়ি কাটে অর্হণের শরীরে মনে। এমনও তো হতে পারে, একটা সর্বনেশে নম্বরও জেনে গেছে। নম্বরটা ওই মেয়েটার মনের চোরা কুঠুরির। কম্বিনেশন তালা খোলাটা এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। সেই নম্বর যদি শরীরেই লেখা থাকে ক্ষতি কোথায়? হতেই তো পারে ওর দুষ্টু চোখের চাউনিটাকে আর ততটা অসভ্য বলে মনে হচ্ছে না মেয়েটার।

সন্তর্পণে মেয়েটা কী আরও একটু ঘুরে বসল? বোধহয়।

অর্হণ এবার পঞ্চাশ মেগাপিক্সেল ক্যামেরার অদৃশ্য শাটারে আঙুল ছোঁয়ায়। শাটার টিপতেই একটা সপাটে চড় খেল বলে মনে হয়।

মেয়েটার বুকে টিশার্টের ওপরে লেখা ‘দেয়ার ইজ আ হার্ট বিনিথ’!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *