short-story-valobasar-kobitara

ভালবাসার কবিতারা
শাশ্বতী নন্দী



আজ আমার জীবনে একটি বিশেষ দিন। কেউ বলতে পারবে, কেন? এনি গেস ওয়ার্ক? কী বলছ, জন্মদিন? না, না।

ওয়েডিং অ্যানিভরসরি? তাও না। আমার বিয়ে তো হয়েছিল সে এক বৃষ্টি ঝরা শ্রাবণের সন্ধ্যা লগ্নে। কী তোলপাড় ঝড় জল সেদিন, বাপ রে। আর এখন তো ফাগুন বসন্ত। আকাশ শিমুলের লালে একেবারে বহ্নি শিখা।

আরে না বাবা, ফার্স্ট লাভ অ্যানিভারসারিও নয়। উজানের সঙ্গে আমার প্রথম ভালবাসার দিনটি থোড়িই মনে রেখেছি। আলাপ তো হয়েছিল সুরে সুরে। ও গাইত একতলার ঘরে, আমি দোতলার জানলায় মুখ বাড়িয়ে হাঁ করে শুনতাম, কখনও গলা মেলাতাম মিনমিন করে। সে থেকেই প্রেম।

মুখোমুখি দেখা হয়েছিল অনেক পরে। এক মুখ দাড়ি নিয়ে একদিন দোতলায় উঠে এসেছিল বাবাকে ডাকতে। অপরিচ্ছন্ন চেহারা। ময়লা শার্ট, উড়োঝুড়ো চুলে কাকের বাসা। কম সে কম দশদিনের না-কাটা দাড়ি। অমন মানুষের গলায় অমন সুর খেলে কেমন করে অবাক হয়েছিলাম।

উজান তখন আমাদের ভাড়াটিয়া, বিনে পয়সার যদিও। মাসের পর মাস টাকা বাকি, তবু ছেলের হুঁশ নেই। নির্লজ্জের মতো দিব্যি ঘর আঁকড়ে পড়ে থাকত। সবটা বাবার প্রশ্রয়ে, উজানের সাত খুন মাপ ওই সুরে, বাবা ছিলেন সুর পাগল মানুষ।

ও হো, সরি, সরি। অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি বোধহয়! হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার বলেই দিচ্ছি আজকের দিনের বিশেষত্ব কী। শুনলে অবাক হবে। আমাকে ভুলভাল ভেবেও নিতে পারো। শোন, আজ আমাদের …

দাঁড়াও, এক ঢোক জল খেয়ে নিই। গলার কাছটায় কী যেন গুটলি পাকিয়ে আছে।

হ্যাঁ, এবার বলি। এই তারিখে, আমি উজানের হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আসলে আমরা দুজনেই দুজনের মুঠোয় মুড়ে থাকা পরস্পরের আঙুলগুলো ছেড়ে দিয়ে একসঙ্গে পথ চলা শেষ করেছিলাম। ওই যেই মুহূর্তে জজ সাহেব কোর্টের রায়টা শুনিয়ে দিলেন।

তবু আমরা এই তারিখটা উদযাপন করি। বলতে পারো, সেলিব্রেট করি আমাদের ব্রেক আপ অ্যানিভারসরি। উজান যেখানেই থাকুক, উড়ে চলে আসে আমার কাছে। হ্যাঁ, এখন ওর পকেটে অনেক টাকা। এ বেলা ও বেলা ফ্লাইটে উড়ে বেড়ায় এক তল্লাট থেকে অন্য তল্লাটে।

একদিন জানতে চেয়েছিলাম, ‘সারা বছর দেখা নেই, শুধু এই দিনটায় তুমি ধূমকেতুর মতো উপস্থিত হও। কোথায় থাকো বাকি সময়?’

ও হেসেছিল। আজকাল বেশ বুদ্ধিদীপ্ত হয়েছে ওর চোখ মুখ। উত্তরটাও। বলে, ‘সারা বছর কোকিল কোথায় বাসা বাঁধে একবারও জানতে চেয়েছ? শুধু বসন্তে কোকিল আসবে, গান শুনিয়ে মাতাল করবে, এই অপেক্ষায় বছর পার করে দাও।’

আমি হাঁ। উজান এতো স্মার্ট হল কবে ? তারপর থেকে আর কোনদিন এমন প্রশ্ন করি না। শুধু এই দিনটার জন্য থাকে এক লম্বা প্রতীক্ষা আর অনেক জমানো গান, কথা, লুকোনো অভিমান।

কিন্তু এবার ও এল না। ঠিক দুদিন আগে ছোট্ট একটা মেসেজ, ‘এক্সট্রিমলি সরি, এবার আটকে গেছি।’

তার মানে? আমি হতাশ। আমার সিন্দুক ভরা জমানো কথাগুলোর কী হবে?

উজান অবশ্য এরকমই। নিজের সুরের বাইরে কোনও দিকে নজর নেই। কোনও সীমানায় নিজেকে আটকে রাখতে চায় না। হয়তো এ কারণেই বাবা রাজি ছিলেন না বিয়েতে। আমিও তখন একরোখা, বিয়ে করলে, ওকেই।

টানা ক’দিন সামনে এলেন না বাবা। পরে নিজেই স্ট্রাইক ভাঙলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘শেষে একটা বাউন্ডুলেকে মন দিলি? ফ্রিতে থাকতে দিয়েছি, তাই দুটো বছর টানা আছে এ বাড়িতে। নইলে আজ এখানে, কাল সেখানে। নিজের ভারই বহন করতে পারে না, তোরটা পারবে?’

আমিও উজানের সাইড নিয়ে ফাটিয়ে তর্ক জুড়লাম, ‘তোমার তো খুব ভালবাসা ছিল ওর প্রতি, এখন সব শেষ?’

বাবা হাসলেন, ‘জানিস, রোজ ভোরে যেই অন্ধ ভিখিরি যায় এই গলি দিয়ে, গলাটা এমন মিষ্টি, ওকে ভালবেসে ফেলেছি, ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ। ডেকে ওর গান শুনি, দু-চার পয়সা সাহায্য করি, কখনও খেতে টেতেও দিই। ওর সুরই ওকে প্রিয় করেছে। তা বলে ওকে কি কখনও ঘরের মানুষ বানাতে পারব? আশা করি বুঝেছিস, কী বলতে চাই? কোনও কিছুর বিনিময়েই সন্তানের ভাল মন্দর সঙ্গে কমপ্রোমাইজ চলে না।’

‘এটাই তোমার সিদ্ধান্ত বাবা?’

‘একদম। তুমি ওকে ভুলে যাও। আমি তোমার পাত্র দেখা শুরু করছি।’

ভুলে যাব মানে? উজানের মধ্যে তখন আমি নিজেকে হারিয়ে বসে আছি। আমার জীবনের সমস্ত গান যেন ওর স্বরলিপিতেই লেখা। বিয়েটা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই স্বপ্নগুলো একে একে ভাঙতে শুরু করল। বাবাই ঠিক। শুধু সুরে যে পেট ভরে না। ডিভোর্স হল দু’বছরের মাথায়। এর কিছুদিনের মধ্যে বাবাও চলে গেল। আমি সব দিক থেকেই নিঃস্ব হলাম।





আজ কিছুতেই ঘরে মন বসছে না। একটা স্মৃতি বোঝাই পালতোলা নৌকো ভোর থেকেই হাজির আমায় স্রোতে ভাসাবে বলে। দিনটাও কেমন কেমন। ভেজা ভেজা, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ল দু-চার ফোঁটা। রাস্তায় বেরোতেই একটা ফাঁকা বাস সামনে এসে দাঁড়ায়। জানলার পাশে সিট, এলোমেলো হাওয়া। আহ্‌! আর কী চাই। কন্ডাকটর টিকিট চাইতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভাবি, কোথায় আমার গন্তব্য? তখনই বাইরেটা চেনা লাগল। রবীন্দ্রসদন। ভাড়া মিটিয়ে তড়িঘড়ি নেমে পড়লাম। আজ কি এখানে কোনও অনুষ্ঠান? চত্তর জমজমাট। এক ঝাঁক কচিকাঁচার কিচির মিচির। কী সুন্দর সাজগোজ।

বাবার চলে যাওয়ার পর ছোটদের স্কুলে একটা চাকরি নিয়েছি, বাড়ির পাশেই। মন, সময়, দুটোই বেশ কাটে। বাবার রেখে যাওয়া টাকায় যদিও চলে যেত একলা জীবন, তবু একটা কাজ তো দরকার। এখন একটা নতুন নেশাও ভর করেছে, ছোটবেলার লেখালেখির শখটা ফিরে এসেছে। গল্প, কবিতা, যখন যা খুশিতে মন দৌড়ে চলে, পাতা ভরে ওঠে সে লেখায়। সময়ের কোনও মাপ জ্ঞান নেই, লিখতে লিখতে রাত ভোর হয়। এভাবেই দুঃখী রাতগুলো ভেসে যায় সুনামির ঢেউয়ে। তবে ওই নিশুত নির্জনে কোথ থেকে জুটে গেছে দুটি সঙ্গী। এক, একটি রাত চরা পাখি, যে থেমে থেমে ডেকে ওঠে আর জানান দেয়, আমি জেগে আছি, তুমি লিখে চলো। ওর একটা নাম রেখেছি, নিশা। রাতভর আমায় পাহারা দেয় বলে। আর রাতের দ্বিতীয় সঙ্গী দূর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি এক সেতারের সুর। সেটাও বাজে সারা রাত ধরে। কে যে বাজায়?

বেশ বড় সামিয়ানা টাঙিয়ে মুক্তাঙ্গনে কোনো অনুষ্ঠান চলছে। স্টেজের ওপর বেশ কয়েকটা চেনা মুখ। টিভির পর্দায় প্রায়ই দেখা যায় এঁদের, নামী নামী সব ব্যক্তিত্ব। সামনের চেয়ার প্রায় সবই ভর্তি। আমি পেছনে বসলাম। মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান, “সাহিত্যের দুর্দিন”, তর্ক বিতর্ক, কাটাছেঁড়া চলছে। পাশ দিয়ে হেঁকে গেল চা-ওলা, চা চা। ডেকে এক ভাঁড় চা নিলাম।

বিয়ের আগে এবং পরেও এখানে কতবার এসেছি। তবে ভিড়ভাট্টা উজান এড়িয়ে চলত। ওর প্রিয় পথ, সরু সরু নির্জন গলি আর নিরালা পুকুর ঘাট। একটা ঝিলকে তো আমরা দিব্যি কল্পনায় বানিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের ছোট নদী। পারে ছিল একটা পাকুড় গাছ।

এখনও প্রতি বছর সে নদীর কাছে যেতেই হবে। সৌন্দর্যায়নের হিড়িকে সে আরও রূপসী হয়েছে। বাঁধানো পার, ধারে ধারে গাছগাছালি, টালি বসানো বিশ্রামের জায়গা। তবে আমাদের ছোট নদীটা হারিয়ে গেছে। পাকুড় গাছটাও নেই। একটা অশোক ফুলের গাছ ছিল। কটা চেনা চেনা পাখি গান গাইত। কোথায় তারা? আঁতিপাঁতি খুঁজে বেড়াই পুরনো স্মৃতিকে। আগে হেঁকে যেত হাতে ঝুনঝুনি বাঁধা ঘটি গরম চানাচুরওলা, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম। ওরা সব হারিয়ে গেছে। এখানে এখন নতুন পাখির মেলা। বিচিত্র রঙ, বিচিত্র ডাক। সেবার উজান ছবির পর ছবি তুলে নিয়ে গেল মোবাইলে। বলে, ‘কী ক্যাপশন দেব, নাম তো জানি না। সব পরিযায়ী পাখির দল। অল্প দিনের জন্য ঘর বাঁধতে আসে।’

অন্যমনস্ক ছিলাম, বলে ফেললাম, ‘কেন এই অল্পদিনের জন্য আসা বলো তো। শুধু মায়া রেখে যাও।’

উজান অনেকক্ষণ পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল, তারপর আমার হাতের ওপর আলতো চাপ দিয়ে বলে, ‘কেন, ভাল লাগে না এই পাখি পাখি জীবন’।

কিছু কথা বলতে গিয়েছিলাম, আটকে গেল স্বর। ওখানে কান্না জড়িয়ে গেছে।

‘আরে আপনি এখানে? অনুষ্ঠান আছে কোনো?’ – পাশ থেকে কেউ একজন হেসে জানতে চাইল।

চিনি না মানুষটাকে, আমার চোখে জিজ্ঞাসা।

লোকটার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি, লম্বা, রোগা সোগা গড়ন। কাঁধে ঝোলা, আবার পরিচিতের মতো হাসল, ‘আজ কি আপনার লেখার ছুটি?

আপনাকে তো ঠিক … মানে আগে পরিচয় হয়েছিল আমাদের?

কিছু বলার আগে সে হাসল, হাসিটা খুব খোলামেলা, ‘আরে না, সামনা সামনি আমাদের পরিচয় হয়নি। তবে আপনাকে চিনি। সারাদিন লেখার মধ্যে ডুবে থাকেন। আমার বারান্দা থেকে আপনার ঘরের জানলা সোজাসুজি। বাতাসে পর্দা ওড়ে, দেখতে পাই, আপনি লেখায় মগ্ন।’

‘ওরে বাবা, তাই!’ আমি হাত জড়ো করে নমস্কার জানালাম। ‘আপনি তাহলে আমার প্রতিবেশী। তা অত রাত অবধি আপনিও জেগে থাকেন নিশ্চয়ই।’

‘তা থাকি। নিস্তব্ধ রাতেই তো সুরের খেলা জমে ওঠে।’

কানের মধ্যে যেন সেতারের একটা ধুন বেজে উঠল। তাহলে ইনিই সেই! তাড়াতাড়ি আর একবার নমস্কার জানালাম, ‘আরে আপনি তো বিরাট শিল্পী। সেতারের হাতটা কী যে মিষ্টি! কাল দরবারী কানাড়া বাজাচ্ছিলেন না!’

ভদ্রলোক অবাক, ‘বলেন কী, রাগ রাগিণীর ব্যাপারে এত স্পষ্ট ধারণা। তাহলে আপনিও কি…?’

‘মোটেই না’ আমি হেসে উঠলাম। ‘সুরের জগতে আমি কেউ না। তবে পরিবারে চর্চা ছিল। তা থেকে কানটাও তৈরি হয়েছে। ছোটবেলায় বাবা একবার জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্লাসিক্যাল মাস্টারমশাইয়ের কাছে। মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছি।’

লোকটি মন দিয়ে শুনে চলেছে কথা।

‘তবে আপনার সুরে বড্ড মনকেমনিয়া গন্ধ। আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোন দূরে’ স্বগতোক্তির মতোই কথাগুলো বলে ফেলেছিলাম, চোখাচোখি হতেই সাবধান হলাম।

ভদ্রলোক নিজেই এবার প্রসঙ্গ পাল্টালেন, ‘তা বলুন আপনার কথা। এত কী লেখেন আপনি? উপন্যাস?’

‘ওরে বাবা। না, না। আমি বড় কোনও লেখিকা নই। এমনিই লিখি মনের আনন্দে।’

‘কোন লেখা আমায় একটু পড়তে দেবেন?’

‘আমি কিন্তু জাস্ট লিখতে ভালবাসি, তাই লিখি।’

‘হোক না। আমি পড়ব। লিটারেচর আর মিউজিক, আমার প্যাশন। দু-চারটে কবিতার বইও আছে আমার।’

আমি আরও আড়ষ্ট। ‘আপনার দেখছি বহুমুখি প্রতিভা। আমার লেখায় কিন্তু কোনও গ্রামার নেই, ছক নেই। শুধু আবেগ আর অনুভূতিই সম্বল।’

‘সেটাই দরকার। আমার বিশ্বাস আপনি খুব ভালো লেখেন।’

হয়তো সাহস পেয়েই গুটি গুটি ব্যাগ থেকে সদ্য লেখা একটা ছোট গল্প বার করলাম। বলি, ‘পড়তে ভাল না লাগলে ছিঁড়ে ফেলবেন। ওটা ফেরত চাই না।’

‘ছিঃ, নিজের সৃষ্টিকে এত ছোট করছেন কেন ? আচ্ছা, এতক্ষণ কথা বলছি কেউ কারোর নামই তো জানি না।’

‘রশ্মি চৌধুরী।’

‘আমি বিশাখ সেনগুপ্ত।’

আরও খানিকক্ষণ গল্প চলল দুজনের। বিশাখ একসময় তাড়া দেয়, ‘চলুন বাড়ি ফেরা যাক। গিয়ে আবার প্র্যাকটিসে বসব। সামনে একটা কনসার্ট।’

একই জায়গায় ফিরব, তাই একই উবারে ফিরলাম। সেখানেও আর এক দফা গল্প। মানুষটা বেশ, কথাও বলে দারুণ। উবার থেকে নামার সময় ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হল। দিনটা বেশ কাটল।

ধীরে ধীরে মেলামেশাটা আরও গাঢ় হয়ে চলেছে। রোজ মোবাইলে আমরা নির্দিষ্ট সময় কথা বলি। কত ধরনের গল্প। তবে একটা জিনিস মেনে চলতাম, কারোর ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলতাম না। বিশাখ সিংগল, এটা খানিকটা অনুমান করেছিলাম। ওর ব্যালকনিতে ও ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মানুষের ছায়াও পড়তে দেখি নি, কাজের মাসিকে মাঝে মাঝে বারান্দায় কিছু জামাকাপড় মেলতে দেখা যায়। সবই ছেলেদের পোশাক।

কথার নেশা আজকাল আরও বেড়েছে। মোবাইল ছেড়ে তাই বাইরে দেখা করছি। কখনও কফি শপ কখনও নন্দন চত্তর বা প্রিন্সেপ ঘাট। জাহাজের ভোঁ শুনতে বিশাখ খুব ভালবাসে, আমার কিন্তু বুকের ভেতরটা টনটন করে। ওই ভোঁ শব্দে কেমন বিচ্ছেদের সুর।

তবে বিশাখ কথা বলে সুন্দর, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। শুনতে শুনতে মনে হয়, ও আমার বহু দিনের পরিচিত কেউ, একটু দেরিতে দেখাদেখি হল, চেনাচেনি হল।

বেশ অনেকদিন নিজের কাছে আমার লেখা গল্পটা রেখে দেওয়ার পর একদিন ফেরত দিল বিশাখ, সঙ্গে মৃদু সমালোচনা আর অনেকখানি প্রশংসা। বলে, ‘লেখা থেকে ভুলেও কোনদিন সরে আসবেন না। এটাই আপনার জীবন।’





আমার লেখালেখির পরিচিতি এখন বেশ কিছুটা বাড়ছে। প্রথমে কিছু লিটল্‌ ম্যাগাজিন, তারপর বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকা। সময় হু হু কেটে যায়। কখনও মনে হয়নি লেখা নিয়ে এতখানি ব্যস্ত হয়ে পড়ব। এ যেন এক স্বপ্নের উড়ানে চড়েছি। তবে বিশাখের ওপর নির্ভরতা বাড়তে শুরু করল। যে কোনও লেখার ওই প্রথম পাঠক। ও টান টান হয়ে চোখ বুজে শুনবে, মাথা দোলাবে। তাহলেই না পরীক্ষায় পাশ!

লিখতে লিখতে কোথাও আটকে গেলেও সেই বিশাখ। রাত দুটোতেও ফোন করে জ্বালাই- ‘হ্যালো, ঘুমোচ্ছ?’ সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে এসেছে।

‘সেটাই স্বাভাবিক।’

‘একটা সুন্দরী পাখির নাম বলে দেবে? বেশ শিস দিয়ে দিয়ে মাতোয়ারা করে।’

‘এই রাত দুটোয় সুন্দরী পাখি! কাল সকালে ভেবে বলব।’

‘অসম্ভব, লেখাটা আজই মেইল করব।’

‘তাহলে যা মনে আসে লেখো, শালিখ, চড়াই, কোকিল … শুধু সুন্দরীটা

কেটে দিও, ম্যাচ করে যাবে। গুড নাইট।’

আমিও রাগ করে ভাবলাম, বন্ধুত্বের তালিকা থেকে এবার ওকে ডিলিট করতেই হবে। কিন্তু ইচ্ছেটা ওই রাতেই আসে, ভোরে মিলিয়ে যায়।





মনটা কদিন ধরেই ভীষণ ফাঁকা। কেন? নিজেই বুঝি না। লেখাও আসছে না, হয়তো রাইটার্স ব্লক। সকাল থেকেই আজ খোলা খাতায় আঁচড় পড়ে নি। হোয়াটস্‌ আপ করলাম বিশাখকে ‘তুমি কোথায় ? ঘরের জানলা বন্ধ, এখনও ঘুমোচ্ছ?’

পাল্টা জবাব, ‘সে কী! দেখতে পাচ্ছ না। তোমার এত কাছে …’

‘মানে? কোথায়?’

‘একবার মুখটা ঝুঁকিয়ে দেখো।’

‘ধুস, কোথায় ? খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘খোঁজার মতো খুঁজছ না।’

‘অনেক হয়েছে। সত্যি বল, কোথায় এখন?’

‘আমায় রাখোইনি যত্ন করে। তাই হারিয়ে গেছি।’

‘যত্তসব হেঁয়ালি। রাগ করে অফ লাইন হই। এবার আর হোয়াটস অ্যাপে নয়, বিশাখ স্বয়ং এসে দাঁড়াল নিজের বারান্দায়। হাসছে, হাত নাড়িয়ে ইশারায় কী বলল। হঠাত ওকে মনে হল এক মহাবৃক্ষ। ছায়া বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টানটান হয়ে।

আজকাল কী যে হয়েছে, রাতেও ঘুম আসে না। লিখতেও পারি না। কেন এমন হচ্ছে? বিশাখের সঙ্গেও কথা হয় না। ও রাতদিন প্র্যাকটিসে মগ্ন। সামনেই কনসার্ট। তবু ওকে আজ জোরাজোরি করলাম, ‘প্লিজ কোথাও চল, ঘন্টা খানেকের জন্য। এই এদিক সেদিক’।

ও কথা রাখল। আমরা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসলাম। বিশাখ আজ অন্যমনস্ক, উসকো খুসকো চুল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, ‘হলটা কী? এবার থেকে একটু একটু করে নিজেকে সামলাতে শেখো। এই তো আমি সামনের পাঁচ তারিখ থেকে আউট। একেবারে নিউ ইয়র্ক।’

এক মুহূর্তে পৃথিবীটা টলে গেল। এতদূর চলে যাবে!

‘কী জন্য ডেকেছ বল?’ বিশাখ তাড়া দেয়।

সত্যিই কি কিছু বলার জন্য ডেকেছি? মনে পড়ছে না। আজকাল একাকিত্বকে ভয় পাই। মনে হয় শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়ানো জীবন এবার শেষ হোক। কিন্তু কীভাবে বলব?

বিশাখ সিগারেট ধরিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। জলে অস্তরাগের আলো। একটা নৌকো দুলে দুলে চলেছে। ওই নৌকোতে কারা ভেসে ভেসে যাচ্ছে? আমি ফিসফিস করে বলি, ‘কবে ফিরবে? তুমি না থাকলে ভাল লাগবে না’।

ও অনেকক্ষণ একভাবে চেয়ে রইল। সূর্যটা একটা কমলা বলের মতো টলটল করে ভাসছিল আকাশে, হঠাত ঝুপ। আকাশে শুধু সন্ধ্যারাতের আলো।

‘আসলে নিউ ইউর্কে কনসার্ট সেরে আমি অ্যালিসের কাছে যাচ্ছি। এতদিন পর ও আমার কাছে থাকবার পার্মিশন পেয়েছে।’

‘কে অ্যালিস?’ একটা ছোট ঢিল কুড়িয়ে আমি জলের দিকে ছুঁড়লাম। কিন্তু জলে কোনও তরঙ্গ উঠল কিনা বোঝা গেল না, জলটা ধীরে ধীরে কালো রঙ ধারণ করেছে।

‘আমার মেয়ে। তিন বছর বয়েস। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে একটা কনসার্টে ওর মা, এমিলির সঙ্গে আমার পরিচয় । লিগাল ম্যারেজ হয় নি। কিন্তু প্রায় দু বছর আমরা লিভ-ইন করেছি। এমিলি আমার সঙ্গে ও দেশ ছেড়ে আসতে চায় নি। অ্যালিসকে নিয়ে ওর বাবা মায়ের কাছেই রয়ে গেছে। মাস খানেক আগে এমিলির মা বাবা দুজনেই একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। এমিলি এখন অকুল পাথারে মেয়েকে নিয়ে। আমায় যোগাযোগ করেছে। আমার সঙ্গে থাকতে চায়।’

আমি একের পর এক ছোট ছোট ঢিল ছুঁড়ে গেলাম জলের দিকে লক্ষ করে। বিশাখ অবাক হয়ে দেখল খানিক। পিঠের ওপর একটা হাত রেখে বলে, ‘যেখানেই থাকি, তোমাকে কোনদিন ভুলব না।’

‘তাই!’ আমার চোখে মুক্তো বিন্দুর মতো জল আটকে আছে। কিন্তু গড়িয়ে নামল না গালে। ‘আর কি কখনও ফিরবে না এখানে?’

‘জানি না। তবে সম্ভাবনা কম।’ বিশাখ বলে, ‘একটা সত্যি কথা বলব? আজকাল অ্যালিসকে দেখবার জন্য আমারও মন ছটফট করে। ও যে আমার সন্তান।’

নিমেষে আমি মূক হয়ে গেছি যেন। তবে স্বজন হারানোর হাহাকারে গুঁড়িয়ে গেল ভেতরটা। উজান জীবন থেকে চলে যাওয়ার পরও এত কষ্ট হয়নি। কিন্তু বিশাখ… কেন ও এল জীবনে? কেন এভাবে বাঁচার মন্ত্র শেখাল? একবার বাঁচার পর যে আর মৃত্যুর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।

এই শ্যাওলা ভাসা জীবন নিয়ে সত্যিই আমি ক্লান্ত। একটা ঠিকানা চাই, যেখানে আমার ভালবাসারা নিশ্চিন্তে ভাল বাসা পাবে।

ফিরে আসার আগে অদ্ভুত একটা কথা বলল বিশাখ, ‘তোমরা মেয়েরা না কাদামাটির মতো, ভালবাসাকে আঁকড়ে রাখতে পারো। আর পুরুষরা…’

‘বোধহয় বালির মতো। শুধু উড়ে যায়, উড়িয়ে চলে যায়।’ আমি বিড়বিড় করে বলি।

বাড়িতে ফিরেও ঘর অন্ধকার করে বসে আছি অনেকক্ষণ। আকাশে কি মেঘ জমে উঠল হঠাৎ? গুরুম গুরুম শব্দ বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোলপাড় বৃষ্টি। হঠাৎ কী যে হল! দমকা ঝড়ের মতো পার ভাসানো কান্না বেরিয়ে এল চোখ থেকে। একসময় মনে হল, আমার কান্না আর পৃথিবীর কান্না যেন এক হয়ে মিশে যাচ্ছে। কী পেলাম জীবনে? একের পর এক ভালবাসার মৃত্যু। নাকি স্বপ্নের মৃত্যু?

ঠিক তখনই আচমকা একটা পাখি শিস দিয়ে উঠল। খুব চেনা ডাক। আমি টলমল পায়ে ছুটে আসি ব্যালকনিতে। প্রকৃতি এখন শান্ত। শনশনে একটা বাতাস শুধু বয়ে চলেছে। অনেক গাছের ডাল ভেঙ্গে গেছে। পাখিটা ডেকেই চলেছে। আরে ও আমার নিশা না! আজকাল নিশা আসে না। কিংবা ও আসে, আমি ওর ডাক শুনতে পাই না। আমি যে এতদিন বিশাখের সুরেই শুধু বুঁদ হয়ে ছিলাম। তাই কি নিশার অভিমান হয়েছিল?

কিন্তু আজ আবার নিশা ডাকছে। তুমুল ভাবে শিস দিচ্ছে। খুব কাছেই বসে আছে বোধহয়। কিন্তু আমার চোখের আড়ালে। আমি অভিমানে ফুঁপিয়ে উঠলাম, ‘সামনে আয় নিশা। আমি ভীষণ একা।’

আশ্চর্য! ডানা ঝাপটানোর শব্দ পাচ্ছি যেন। কিন্তু নিশাকে দেখতে পাচ্ছি না। অনেক অপেক্ষার পর ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে এলাম। থাক, নিশা তুই দূরেই থাক। দূরে থেকেই তুই ডেকে যা রাত ভোর।

আজকাল আমার একমাত্র সঙ্গী নিশা, ও আমার ভালবাসা। ভালবাসারা দূরে দূরেই ভাল থাকে, কাছে এলেই হারিয়ে যায়। অনেকদিন পর লেখার খাতাটা টেনে নিলাম। আজ নিশাকেই নিয়ে গল্প লিখব। ভেজা চোখেও হেসে উঠলাম, ভাগ্যিস নিশা ছিল, তাই স্বপ্ন দেখার চোখ দুটো এখনও জেগে থাকতে চায়।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-valobasar-kobitara

  1. খুব সুন্দরএকটা গল্প পড়লাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *