অনিন্দিতা গোস্বামী
দাওয়ার পেরেকে ঝোলানো আরশিতে ঝলমল করে উঠলো কমলা রঙের সিঁদুর। ডিব্বায় আঙুল চুবিয়ে লছমী কপালের মাঝখানে এঁকে নিল একটা গোল টিপ, পাতাকাটা চুলে টেনে বাঁধলো খোপা, ঘুরিয়ে আঁচলখানা বুকের ওপরে এনে গুঁজে নিল কোমরে। প্রধান ডেকেছে তাকে, বলেছে কি নাকি বিশেষ কথা আছে। এই বিকেলের দিকে প্রধানের ঘরে অনেক লোকজন থাকে। একটু সাফ সুতরো হয়ে না গেলে নয়। এ তো ভাটার কাজ না যে যাহোক করে একটা চলে গেলেই হলো।
সে অপিসে ঢুকতেই দেখলো অপিস বেশ ফাঁকা। তাকে ঝুঁকি দিতে দেখেই গুড়াখুর ছোপ ধরা দাঁত বের করে দুবার খ্যাক খ্যাক করে হাসল প্রধান। তারপর বলল, আয় বোস। সে জড়োসড়ো হয়ে একটা টুলের ওপরে বসলো। প্রধান একটা খবরের কাগজ সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোর সোয়ামী তো ফেমাস লোক হয়ে গিয়েছে রে! আখবারে ছবি ছাপা হয়েছে!
ভয়ে ভয়ে লছমী হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরে দেখল হ্যাঁ তাই তো, তার মরদই তো বটে! বুকের মধ্যে বেশ একটু আনন্দ ছলকে উঠলো। সে অঙুঠা ছাপ, বুড়ো আঙ্গুলে কালো কালি মেখে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলে আর তার মরদের কিনা আখবরে ছবি ছাপা হয়েছে! সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকায় প্রধানের দিকে, কি ব্যাপার?
এবার প্রধানের দুপাশে দুজন লোকও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে, বলে তোর মরদ শিবেন তো রেপ কেসে ফেঁসেছে, সঙ্গে খুন। এখন লকআপে আছে।
হায় রাম! মুখে হাত চাপা দেয় লছমী। লকআপ মানে তো পুলিশ! রেপ কথাটা তার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। রেপ কি করে করবে তার মরদ!
রেপ তো করে তারা যাদের পাওয়ার আছে। এই যেমন প্রধান এখন কতো ভদ্দরলোক অথচ তার ইটভাটায় যখন কাজ করতে যায় লছমী কতো দিন পিছন থেকে ব্লাউজ খামচে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যায় ঘরে। লছমী শব্দ করে না, জানে শব্দ করলেই কাজ চলে যাবে তার এমন কি জানও চলে যেতে পারে। কিন্তু তার স্বামী তো ভিন রাজ্যে মস্ত বড় শহরে একটা ফ্ল্যাট বাড়ি পাহারা দেয়। কেয়ারটেকার। তার ওপরেই পাওয়ার নেয় সবাই। বাবুদের ভয়ে সারাদিন সে কাঁটা হয়ে থাকে। বছরে একবার যখন বাড়ি আসে এসব গল্প সে লছমীর সঙ্গে করে তো। ব্যাংকে তার নামে টাকা পাঠায় বলেই না লছমী এই কাজ করতে দিয়েছে শিবেনকে।
মহল্লায় হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে গেল কথাটা। প্রধান বলল, শোন কলকাতা থেকে ফোন এসেছিল তোকে একবার দেখতে চেয়েছে তোর মরদ। এই নে কাগজে আমি সব ঠিকানা লিখে দিয়েছি কিভাবে যেতে হবে, তুই বড় ছেলেটাকে নিয়ে চলে যা। ও তো স্কুলে পড়ছে ও ঠিক তোকে নিয়ে যাবে পথ দেখিয়ে।
পথ খুঁজতে খুঁজতে ছেলের হাত ধরে লছমী গিয়ে পৌঁছলো সেই ফ্ল্যাটে, সেখান থেকে পুলিশ লকআপে, শিবেনের সামনে। শিবেন হাউমাউ করে কেঁদে বলল লছমী তুই আমাকে বাঁচা। আমি রেপ টেপ করিনি রে আর খুন তো নয়ই। ওরা পয়সার জোরে আমাকে ফাঁসাচ্ছে। ওরা আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেবে। শোন যে মেয়েটা মরেছে আমি সেই মেয়েটাকে পেয়্যার করতাম রে লছমী। ও এগারো ক্লাসে পড়ত। ওর বড়লোক মা-বাবা সারাদিন পার্টি করত, মদ খেত, আর ঝগড়া করত। মেয়েটা মানুষ হয়েছে কাজের লোকের কাছে। খুব দুঃখী ছিলো মেয়েটা। ছাদে বসে বসে সুখ-দুঃখের গল্প করতো আমার সঙ্গে আর কাজের মেয়েটা বাজারে বেরোলে আমাকে ডাক দিতো ওর ঘরে। সেদিনও কেউ ছিলনা ঘরে আর ও আমাকে ডাক দিয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে ওর মা-বাবা ফিরে আসে আর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আমাদের দেখে ফেলে।
আমার ঘরে ঢুকে আমার মেয়েকে রেপ করছিস, বলে ওর মা ছুরি দিয়ে আমাকে খুন করতে গেলে মেয়েটা বুক দিয়ে দাঁড়ায়, বলে ও আমাকে রেপ করেনি, আমি ওকে ডেকেছি। আমি ওকে ভালোবাসি। এই শুনে ওর বাবা ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়ের ওপরে। গলা টিপে ধরে। বাবার হাতের মধ্যে ছটফট করে মেয়েটা নেতিয়ে পড়ে। বাবা যখন বুঝতে পারে মেয়েকে মেরে ফেলেছে ওরা তখন পুলিশ ডেকে আমাকে ধরিয়ে দেয়। আর খুনের দায় চাপিয়ে দেয় আমার ঘাড়ে। তুই উকিলবাবুর পায়ে পড় লছমী, সব কথা বুঝিয়ে বল, কেউ কাউকে ভালবাসলে তাকে কি খুন করতে পারে?
ঘাড় নাড়ে লছমী, তাই তো। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে। তার সাধ্য কি অত বড় বড় মানুষের সঙ্গে লড়ার। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, মাথার ভিতরে হাওড়া ব্রিজটা দুলতে থাকে, চোখে নামে গঙ্গা মাইয়া কি পানি। সে রেপ বোঝেনা, তাকে তো যখন তখন মোড়ল, প্রধান, সরদার যে কেউ খামচে ধরে নিয়ে গিয়েছে ঝোপেঝাড়ে। কিন্তু সে ভালোবাসা বোঝে, সোহাগ বোঝে। শিবেন তাকে ফেলে অন্য একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলো! তা ভালবাসলে তো তার জন্য মরাও চলে। মরুক না শিবেন ওই মেয়েটার জন্যে।
সে কোত্থাও যায় না। না শিবেন কে বাঁচানোর চেষ্টা সে করবেনা। এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে এসে দাঁড়ায় ফিরতি ট্রেনের সামনে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
সুন্দর লেখা অনুগল্প ,খুবই বাস্তবোচিত লছমীর ভাবনাতে – “যাকে ভালোবাসা যায় তার জন্য মারা ও যায়।”
Golpota khub bhalo laglo. Satyito lachhmir pakhhye ki r
Korar chhilo
.Ora j charam daridrer siker
অসাধারণ গল্প।। শরীরের চেয়ে মনের দাম অনেক বেশি ,নিজে বার বার যৌন লাঞ্ছিত হয়েও বরকেই মনে স্থান দিয়েছিলো সে ।কিন্তু বর অন্য কাউকে মন দিয়েছিলো এটা জানার পর অদ্ভুত নির্লিপ্ততায় ডুবে গেলো সে …অসম্ভব মানসিক টানাপোড়েন ,ছোট্ট গল্পে অনেক বড় কাহিনী বলেছেন লেখিকা ।
ভালো লাগলো। সুন্দর মেসেজ। অভিনন্দন জানাই 🙏
একটি দুর্দান্ত ছবি দেখলাম যেন৷ কার্যকারণসূত্রযোগে নিখুঁত যুক্তিপূর্ণ গল্প৷ অণুগল্পে উপন্যাসের আভাস৷
খুব সুন্দর….শেষ হয়ে হই্লনা শেষ
খুব ভাল লাগল।অশিক্ষিত লছমি ভালবাসার সংজ্ঞা জানে। তার বর শরীরের টানটাকেই ভালবাসা বলে মনে করল। সুন্দর ও যথাযথ পরিণতি।