aparbangla-lobster-er-deshe

লবস্টারের দেশে

অর্ক ভট্টাচার্য

ওটা গলদা চিংড়ীই। লবস্টার বললে একটু ইয়ে বা ইশে লাগে বটে। কিন্তু ওটা গলদা চিংড়ীই। আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে পাতে এপিঠ ওপিঠ হতে থাকা স্বপ্নবিতরণকারী লবস্টারের দেশে গিয়ে লবস্টার খাওয়ার মজা যে কি আলাদা সে আর বলে বোঝাতে পারবো না।


সমস্যা ছিল , কখন সঠিক সময়। আকাডিয়া ন্যাশনাল পার্ক উত্তর আমেরিকার সবথেকে লোকপ্রিয় একটি ন্যাশনাল পার্ক। বসন্তে ফুল্লকুসুমিত , গরমে মনোরম সবুজ , শরতে (ফল – এ ) গাছে গাছে আগুন আর হাড়কাঁপানো শীতে চোখ ধাঁধানো নীল আকাশ আর সাদা বরফের খেলা। সারা বছর এই একটি পার্ক মাতিয়ে রেখেছে পর্যটনপ্রিয় মানুষগুলোকে। আমি আমার ভোজনপ্রিয়তাকে পর্যটনপ্রীতির বেশ কিছুটা আগে রাখি আমার “ল্যাদ” এর কারণে। কিন্তু এই রথ দেখা কলা বেচার জায়গাটা তাই টু ডু লিস্টে অনেক দিন ধরেই ঢু ঢু করছিলো। শেষমেশ হঠাৎ করেই একদিন প্ল্যান করে ফেললাম আগস্টের মাঝামাঝি। প্রচন্ড দাম দিয়েও একটা ছোট্ট মোটেলও বুক করে ফেললাম।


আমার অবস্থান কানেটিকাট ( বানান ভুল না , ক টা সাইলেন্ট ) তাই জ্ঞানীদের ম্যাসাচুসেট , বড়লোকের রোড আইল্যান্ড আর গরিবের নিউ হ্যাম্পশায়ার টপকে পৌঁছাতে হবে শান্তির মেইন – এ। ছ ঘন্টার লম্বা ড্রাইভে যখন প্রথম চোখে পড়লো Welcome to Maine … The way the Life should be তখন মনে হলো “হ্যাঁ মশাই ” জঙ্গলে মঙ্গল করাই তো আমাদের উদ্যেশ্য। রাত হয়ে গেছিলো। চার পাশে শুধু ধু-ধু জঙ্গলের মরুভূমি । ইন্টারস্টেট ছেড়ে যখন ছোট রাস্তায় ঢুকলাম তখন বেশ চাপে পড়ে গেছিলাম , ” ঠিক যাচ্ছি তো। ” আগেও অনেক বার আমার সাথে এরকম হয়েছে যে জি পি এস ভুল করে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যেখানে ল্যাঙট পরে কাঠবিড়ালি শিকার করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই।
পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সোঁতা। আকাশে পূর্ণিমার দিকে ধাওয়া করা চকচকে চাঁদ। আর এসিতে ঘামে ভিজে স্টিয়ারিং হাতে আমি। সামনে না কোনো লাল ব্যাকলাইট, না পেছনে কোনো দাম্ভিক হেডলাইট। হঠাৎ উদয় হলো একটা শহর। নাম এলসওয়ার্থ। আমাদের তখন পেট চুঁই চুঁই করছে আর রেস্টুরেন্ট লেখা দোকানগুলো সব বন্ধ। ঘড়িতে বাজে নটা। আমাদের প্রিয় ম্যাকডোনাল্ডও নেই , নেই সাবওয়ে , নেই কোনো রকম ফুড চেন। ঠিক হলো হোটেলের রাস্তায় যেটাই সামনে পড়বে বাছবিচার না করে খেয়ে নিতে হবে। কি ভাগ্যিস একটা ডেনিস এর চেন পাওয়া গেলো।
হোটেল বা মোটেল ভাড়া নেওয়াই ছিল ট্রেন্টনে। ট্রেন্টন আকাডিয়াতে ঢোকার আগে মূল ভূখণ্ডের শেষ শহর। যদি আকাডিয়াকে ছানার জল ঝরানোর মতো ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আঁকশি ঝুলবে এই ট্রেন্টন ধরে। আমাদের মোটেলের সামনে দিয়ে যাওয়া দু লেনের রাস্তাটা যেখানে ওয়েলকাম টু আকাডিয়া বোর্ড প্রথমবার পর্যবেক্ষণ করে সেখানেই আছে এক বিখ্যাত “লবস্টার পাউন্ড” , বা লবস্টার রেস্টুরেন্ট। তার কথা শেষে বলবো।


পরেরদিন ঘুম ভাঙলো ঝুপঝুপে বৃষ্টির মধ্যে। ঘুরতে এসে বৃষ্টি পাওয়ার মতো খারাপ কিছু হয় না। হোটেল যখন বুক করেছিলাম তখন বৃষ্টির সম্ভাবনা বিচার করা সম্ভব ছিল না। মোটেলের অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম , “তাহলে কি এরকমই চলবে ?” উত্তর এলো , ” মেইন ওয়েদার ইস অলওয়েজ আনপ্রেডিকটেবল ” উত্তর আমেরিকার এক্কেবারে উত্তর পশ্চিমে সমুদ্রের গা বেয়ে ওঠা পাহাড় জঙ্গলের এই পৃথিবীতে সব কিছুই যে অনভিপ্রেত সেটা তাদের সাথে কথা বলেই বুঝতে পারলাম। হোটেলের ওনার অফিস থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে নিয়ে গেলো অফিসের পিছনের দিকে। হিটেড সুইমিং পুলের সামনে দাঁড়িয়ে সামনের কুয়াশার সাদা চাদরের দিকে আঙ্গুল তুলে বললো , “”যদি সরে যায় , তাহলে এখান থেকেই ক্যাডিলাক মাউন্টেন দেখা যায়। ” আমি বললাম , “আর যদি না সরে ? ” মুচকি হেঁসে বুড়ো বললো , “তাহলে হিটেড সুইমিং পুল তো আছেই।”


কথাটার মাহাত্ম্য এই , যে আমাদের ঘটি হারিয়েছে। এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকতে মন না চাইলেও থাকতে হবে। যদিও উদ্যেশ্য ছিল আরাম করা। কিন্তু এরকম ভাবে ঘরে বসেই যদি আরাম করতে হতো তাহলে বাড়ির ব্যালকনিতেই করতাম। ঠিক ছিল সেদিনই ক্যাডিলাক মাউন্টেনে যাওয়ার। কিন্তু বুড়ো বলে দিলো যে যখন চটকেছে , তখন সৌন্দর্য্য দেখার থেকে কাজের কাজগুলো করে ফেলো। সে নিজেই খবর দিলো লবস্টার ফিশিং ট্রিপের আর কোথায় গেলে খাওয়া যাবে সবথেকে ভালো লবস্টার।
আকাডিয়া ন্যাশনাল পার্ক বলতে যাকে বোঝানো হয় সেটা সমুদ্র , পাহাড় , জঙ্গল আর ছোট ছোট সজারু দ্বীপের মিশ্রণ। আকাডিয়া ন্যাশনাল পার্ক একবারে ঘোরা সম্ভব নয়, এটা আমাকে সবাই বলে দিয়েছিলো। ” প্রথম ট্রিপে গিয়ে ব্যাপারটা মেপে এসো , আর পরের ট্রিপগুলিতে উপভোগ কোরো। ” যেহেতু আবহাওয়া খারাপ, তাই সেই মাপার কাজ করতে মানুষের সাথে কথা বলে , আর চুটিয়ে পোস্টার পড়ে এসেছিলাম। এই পার্ক উপভোগ করতে হলে , হাঁটতে হবে, বা সাইকেল চালাতে হবে মাইলের পর মাইল। যেখানেই জনবসতি শেষ , সেখানে যেকোনো জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে জঙ্গলে ঢুকে হারিয়ে যেতে হবে। ধীরে ধীরে খুঁজে পেতে হবে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে। মিশে যেতে হবে হঠাৎ ফুটে ওঠা প্রকৃতির অসামান্য শিল্পের ওপর।
আকাডিয়ার দ্বীপে সবথেকে বড় শহর বার হারবার। এই হারবার থেকেই সমস্ত ফিশিং ট্রিপ ছাড়ে। ফিশিং বলতে মূলত লবস্টার আর কাঁকড়া, মাঝে মাঝে হ্যালিবাটও আছে । আমরা টিকিট কাটলাম এক নান্দনিক শিপিং ট্রেলারের। বেশ বড় বোট, নাম মিস সামান্থা। বোটের নাম যেমন সুন্দর তেমন গাইড সুন্দরী। নিজের পরিচয় দিলো ওসেনোগ্রাফিতে মাস্টার্স। বোমকে উঠলাম। মাস্টার্স করে শেষমেশ গাইডের কাজ করে। এ মা ছি ছি। কিন্তু পরে বুঝলাম এটাই তো ল্যাবরেটরি। মুক্ত সমুদ্র আর মানুষের মিলনের ব্যবসার ক্ষেত্র। হাতে কলমে কাজ না করে , ঘরে বসে বই পড়ে জ্ঞান দেওয়া তো আর এই জ্ঞানের মঞ্চ নয়।


হারবার থেকে প্রায় দশ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রের ভেতরে “ফিশারম্যান বে ” যেতে যেতে চোখে পড়লো অজশ্র “বুই” । নানা রঙের , নানা আকারের। গাইড বলে চললো এই সমস্ত “বুই ” এর সাথে লাগানো আছে লবস্টার ধরার খাঁচা। মেইনে লবস্টার ধরতে হলে প্রচুর নিয়ম কানুন আছে। সবাই রেজিস্টার্ড। আর এই রেজিস্ট্রেশনের সময় শোলার রং বেরঙের নম্বর দেওয়া “বুই” দেওয়া হয়। কমার্শিয়াল , পার্সোনাল আর রিক্রিয়েশনাল, মানে ব্যবসায়িক , ব্যক্তিগত ও নান্দনিক, এই তিন ধরণের লাইসেন্স হয়। কমার্শিয়ালে হাজার ভাগ আছে , তবে ব্যক্তিগত হিসেবে দিনে চারটের বেশি লবস্টার ধরার নিয়ম নেই। আর নান্দনিকে চারটের বেশি খাঁচা পাতার নিয়ম নেই।


খুঁজে খুঁজে বোটটা নিজের বুই এর কাছে হাজির হলো। যান্ত্রিক কল দিয়ে খাঁচা টেনে তুলতে ভেতরে দেখা গেলো চারটে লবস্টার কিলবিল করছে। একটা স্লাইড ক্যালিপার বা গেজ দিয়ে মেপে মেপে দুটো লবস্টার প্রথমেই ফেলে দিলো। মাথার সাইজ সাড়ে তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চির মধ্যে না হলে আইনত জল থেকে তোলা বারণ। বেশি বড় হলে ছেড়ে দেওয়া হয় বংশ বিস্তারের জন্য। আর ছোট হলে ছেড়ে দেওয়া হয় বড় হবার জন্য। মোটামুটি ছয় থেকে সাত বছর লাগে লবস্টাররের প্লেটে আসার জন্য। বাকি দুটো জন্তুর মধ্যে দেখা গেলো একটা স্পাইডার কাঁকড়া আর একটা সুপুষ্টু হার্ড্সেল লবস্টার। একদম প্লেটের জন্য রেডি।
অদ্ভুত দক্ষতায় মহিলা ওই ওয়াইল্ড লবস্টারকে ধরে সবার সামনে নিয়ে এসে লবস্টারের এনাটমি বুঝিয়ে দিলো। সে ব্যাখ্যা নাই করলাম এখানে। কিন্ত যখনি বললো লবস্টার সাঁতার কাটতে পারে না আর পেছন দিকে হাঁটে, আমার প্রশ্ন জাগলো , তাহলে এসব খাঁচার ন্যাকামো কেন। ডুবুরি নামাও , টপাটপ তুলে ঝোলায় পোরো। জানতে পারলাম মেইনে যেহেতু আমেরিকার ৭০% লবস্টার হার্ভেস্টিং হয়। তাই খুব কড়াকড়ি। এমনকি ওই খাঁচাতে যে বেট বা টোপ দেওয়া হয় তাতেও আছে কঠিন নিয়ম। কোনোরকম জান্তব অবশেষ বা ছিবড়ে দেওয়া চলবে না। এই না-খাবার এর একটা গালভরা নাম আছে – ওফাল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় হেরিং বা ব্লুফিশ এর টুকরো। একমাত্র মেইনে এই কড়াকড়ি। ফ্লোরিডা সমেত অন্যান্য জায়গায় লবস্টার ডাইভিং বলে একটা খেলা প্রচলিত আছে। পর পর চারটে খাঁচায় বেশ কিছু ধরণের লবস্টার দেখলাম। জানলাম সময়ে সময়ে লবস্টারের খোলস ত্যাগের কথা। পরিণত খোলসের হার্ডশেল লবস্টারের মাংস বেশি , আর নতুন খোলসের সফটশেল লবস্টারের মিষ্টতা বেশি। এই হলো তফাৎ। ওই কচি পাঁঠা আর রেওয়াজি খাসির যা তফাৎ আর কি।
শেষ খাঁচা তুলে ফেরত আসার জন্য ট্রেলারের নাকটা ঘোরাতে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য্য চোখে পড়লো। গাইডের মুখেও তার প্রতিধ্বনি , “দ্যাটস উই কল মেইন্স ওয়েদার।” মেঘ কেটে যাচ্ছে আর দূর থেকে সূর্যের আলো এগিয়ে আসছে। ধূসর সমুদ্র ধীরে ধীরে নীল হয়ে যাচ্ছে। বেকার্স আইল্যান্ড এর ১৮৫৫ র লাইটহাউসের সামনে খেলা করা সীলের সারির গা চকচক করে উঠছে সূর্য্যের আলো পরে। সেই আলো ডানায় মেখে উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা মাথা ধূসর দেহ আমেরিকান বল্ড ঈগল। সে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য্য। বাঙালির খাবারের শুরু কেন তেতো দিয়ে হয় , তা সেইদিন বুঝলাম।

প্রকৃতি পাখনা মেলেছে , এদিকে পেটে জানিনা কে ডন মারছে। সমুদ্রের হাওয়ায় এতটাই খিদে পেয়েছিলো যে বোট থেকে নেমে যেখানে যা কিছু পাবো খেয়ে নিতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু এদিকে সামনে গাজর দুলিয়ে গাধা চালানো যায় , কিন্তু মানুষ না। তার সেদিন চাই লবস্টার। বুড়োর বলে দেওয়া দোকানটা জি পি এস এ লাগিয়ে পৌঁছে দেখি পুরানো জুটমিলের মতো দেখতে একটা বিশাল রেস্টুরেন্ট। নাম Beal’s Lobster Pier .

একটা ছোট্ট লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বড় বড় করে মেনু ঝুলছে। আর সামনে বিশাল দাঁড়িপাল্লা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুদর্শন যুবক। টি শার্টে রেস্টুরেন্টের নাম। বিশাল বড় একটা চৌবাচ্চাতে তিন ভাগ করে তিন দামের তিন ধরণের লবস্টার জলের মধ্যে লম্বা দাঁড়ায় গার্ডার লাগিয়ে বসে আছে। “প্রথম বার এসেছি , হেল্প মি ” বললে ছোট্ট ছোট্ট জ্ঞান বাইটস পাওয়া যায়। দেখলাম ছোকরা সরে গিয়ে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসে বললো , “দুটোই টেস্ট করে দেখুন। একটা সফ্টশেল একটা পরিণত হার্ড্শেল ” আমাদের মনে হলো এক পাউন্ড ওজনের শুধু লবস্টার খেয়ে বিশেষ পেট ভরবে না। যা খিদে পেয়েছিলো ! তাই একটা লবস্টার রোলও অর্ডার করলাম। অন্তত পেট ভরানোর জন্য একটু তো কার্বোহাইড্রেট ঢুকবে।
হলদে কালো লবস্টার যখন সেদ্ধ হয়ে এলো তখন টুকটুকে লাল, কিছুটা কমলা বলা চলে। কিন্তু খাবো কি ভাবে ? রেস্টুরেন্টের ট্যাগলাইনটা দেখা যাচ্ছিলো ” ইট ড্রিংক এন্ড বি মেসি ” । চারপাশে তাকিয়ে লোকেদের দানবীয় প্রকৃতি দেখে ছুরি কাঁটাচামচের সভ্যতাকে গুলি মেরে আস্তিন গোটালাম। আনারসের মাথা ছাড়ানোর মতো মুড়িয়ে ল্যাজ আর মাথা আলাদা করে ফেললাম। আর হড় হড় করে বেরিয়ে এলো জল। একটু হলেই গায়ে এসে পড়তো। কিছু করে বাঁচিয়ে নিলাম। এতক্ষন বসে বসে যে ভুরভুরে গন্ধ নাকের ডগায় মাছির মতো ভ্যান ভ্যান করছিলো , একটু মাংস বার করে মুখে দিতে তার স্বাদ পেলো জিভ। না মালাইকারি, না ডাব চিংড়ি না সর্ষে পোস্ত। শুধু নুন জলে ফুটিয়ে দেওয়া সে লবস্টারের যে কি স্বাদ সে আর কি বলবো। একটু বাটারে চুবিয়ে মুখে পুরতে ব্যাপারটা আরো খোলতাই হলো। লবস্টার রোল আমি আগে যেখানেই খেয়েছিলাম সেখানে মেয়োনিজে মাখানো থাকতো লবস্টারের মাংস।এখানে ব্যাপারটা বেশ সরলীকরন। শুধু মাংস গুলোকে ছাড়িয়ে পাউরুটির বাটার টোস্টের মধ্যে দিয়ে ভরে দিয়েছে। ছাড়ানোর খাটনির দাম অবশ্য নিয়ে নিয়েছে। জিনিসটা ভালোই খেতে , কিন্তু সিফুড স্যান্ডউইচ আমার বিশেষ জমে না। তবে আমাদের অনুমান ভুল ছিল। প্রমান সাইজের একটা লবস্টার , একজনের জন্য যথেষ্ট। লবস্টার রোলটা শেষে ঠোসাই হলো।
এই রেস্টুরেন্টটা মূল আকাডিয়া ন্যাশনাল পার্কের বাইরে। যেহেতু সূর্য উঠেছে তাই ভাবলাম গাড়ি নিয়ে একবার এক চক্কর মেরে আসি পার্কের। পার্কের এট্ট্রাকশন গুলোকে বেঁধেছে একটা রাস্তা নাম “লুপ রোড”। ক্যাডিলাক মাউন্টেন সামিট জি পি এস এ সেট করলে রাস্তায় পরে স্পট গুলো। আমাদের উদ্যেশ্য ছিল একবার ক্যাডিলাক মাউন্টেনে উঠে, নেমে চলে আসবো। মেঘ আবার ধীরে ধীরে গ্রাস করছিলো নীল আকাশকে ।


ক্যাডিলাক মাউন্টেন সমুদ্র সমতল থেকে পনেরোশো ফুট ওপরে। সামিটের কাছে যখন গাড়ি পার্ক করলাম তখন দেখি পুরো মেঘে ঢাকা জায়গাটা। ক্যাডিলাক মাউন্টেনের ওপর থেকে যা স্বর্গীয় দৃশ্য দেখা যায় তার কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু শুনিনি যার কথা তা হলো ওয়াইল্ড ব্লুবেরির গল্প। এক চাইনিস বাবা আর তার মেয়েকে ঝোপের মধ্যে ঢুকে কিছু তুলে তুলে খেতে দেখে বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে দেখিয়ে দিলো ব্যাপারটা কি ।ছোট ছোট ঝোঁপে চেয়ে আছে কালচে নীল ব্লুবেরি। চাষের ব্লুবেরির থেকে সাইজে প্রায় অর্ধেক। কিন্তু স্বাদে পাঁচ গুণ ভালো। মেইন যে ওয়াইল্ড ব্লুবেরির জন্য বিখ্যাত তা সেইদিন ফেরার পথে উইকিপেডিয়া থেকে জানলাম। আর কিনে আনলাম ব্লুবেরি সিরাপ।
পরের দিনই শেষ দিন। তাই যেমন করেই হোক , সমস্ত স্পট গুলো ভিসিট করতে হবে। এক দিনের ঘোরাঘুরিতেই মোটামুটি বুঝে গেছিলাম আকাডিয়ার সৌন্দর্য্য গাড়ির কাঁচের ভেতর থেকে বোঝা যাবে না। আর গাড়ির ভেতর থেকে যা দেখা যায় তা নিউ ইংল্যান্ডে ছড়াছড়ি। সেই পাহাড় , সমুদ্র আর জঙ্গলের কোলাকুলি। কিন্তু ঘন সবুজের নির্জন হাতছানি , আর নীল চোখ আটলান্টিকের মাঝে আটকে থাকা মাউন্ট ডেসার্ট এর এই নিরাপদ বিশালায়তন পার্কটি প্রকৃতিকে দীর্ঘক্ষণ আঁকড়ে থাকার এক অসাধারণ স্থান।
প্রতিটি স্পটের বিবরণ দিয়ে বোর করার কোনো মানে হয় না। শুধু এইটুকু বলে রাখি , এক দিন , বড় কম। বার হারবার থেকে লুপ রোড ধরে পর পর সমস্ত স্পটের মধ্যে প্রথমে পরবে বল্ড পরকুপাইন আইল্যান্ড, যা আসলে আটলান্টিকের বুকে সজারুর মতো বসে থাকা আইল্যান্ড। এ ছাড়াও আছে তিনটে নাম করা লেক , জর্ডন পন্ড , ঈগল লেক , ইকো লেক, আর আছে স্যান্ড বিচ নামক হলুদ বালির বিচ। ইকো লেকে প্রায় অর্ধেক হেঁটে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু কোমর পর্যন্ত ডুবতেই হাড় হিম হয়ে গেছিলো – এতো ঠান্ডা। মেইন যেহেতু অনেক উত্তরে , তাই আটলান্টিক কখনোই সেখানে গরম হয় না।

থান্ডার হোল নামের একটা স্পট খুঁজতেই আমাদের অনেক সময় চলে গেছিলো। সবার ফেসবুকে বেশ জলের ঝাপ্টার ওপর ঝুঁকে পড়া ছবি দেখে মনে হয়েছিল নো-মিস জায়গা। কিন্তু আসলে বুঝতে পারলাম সেই চালু আমেরিকানদের মার্কেটিং এর খেলা। ফেনোমেনন টেনোমেনন এসব বলে একটা ছোট্ট খাঁজের কথা বলা হয়েছে। যেখানে জোয়ারের সময় জল তীব্র বেগে ঢুকে বেরিয়ে আসে। আর বেরোনোর সময় এক বিশাল আওয়াজ হয়। আমি নেহাত হেলাফেলা করে বললাম বটে, কিন্ত শহরের লোকেদের বেশ ভালোই লাগবে। আর মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে , “ও মাই গড।”

ক্যাডিলাক মাউন্টেনের ওপর সেদিনও ছিল মেঘের ছায়া, তাই সূর্যাস্তের আশায় বসে না থেকে আমরা নিচে নামতে আরম্ভ করলাম । সূর্যাস্ত তখনও মিনিট দশেক দেরি। নিচে নামতে নামতে দেখলাম এক একটা স্পটের সামনে রাস্তা আটকে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে , মেঘের কোলে যদি রোদ মুচকি হাঁসি দেয়। দিলোও। মিষ্টি একটা বিদায় দিয়ে আমার কানে কানে বলে দিলো , “আবার এসো কিন্ত ! “

সেদিন রাতে নাজেহাল হলাম খাওয়া নিয়ে। খাওয়া দাওয়ার দুদিন ধরে এতো অনিয়ম গেলো, তার ওপর অতটা ড্রাইভ। রাতে বাঙালির মন চাইছিলো একটু ভাতে ভুতে ভাত। কিন্তু সে কি আর ওখানে পাওয়া যায়। হালকা খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিলাম , কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার যে চাইনিস রেস্টুরেন্ট নেই। একটা ছিল, কিন্তু সেটা সন্ধ্যে সাতটায় বন্ধ। একটু ড্রাইভ করে দেখে এলাম কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা। এমনকি ডোমিনোস পিজা বলে দিলো যে নটার পর ডেলিভারি করে না। কি খেলাম সেটা আর বলে কাজ নেই। তবে বুঝতে পারলাম কেন স্টেটের ট্যাগলাইন , “The way the Life should be” .
এবার বিদায় নেওয়ার পালা। শেষ হল্ট ট্রেন্টন ব্রিজ লবস্টার পাউন্ড। গত দু দিন ধরে এই ছোট্ট রেস্টুরেন্টটিকে দশবার পেরিয়েছি। আমার হোটেলের বুড়োর কথায় লবস্টার নিয়ে যেতে হলে ওদের কাছ থেকে নিও। ওরা সারা দেশে ট্রান্সপোর্ট করে । আর সুভেনির তো নিতেই হবে। যদিও তা একরাত্রির বেশি সঙ্গে থাকবে না, তবু। দোকানটা ঢোকার আগেই এলো লবস্টার রান্না করার তীব্র গন্ধ। আর প্রথম বার লক্ষ্য করলাম বিশাল বিশাল লবস্টার সেদ্ধ করার মেশিন।পুরানো দিনের কারখানার মতো দেখতে বয়লার। নিচে বদ্ধ জায়গায় কাঠের আগুন জ্বলছে , আর চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে । ওপরে জলে সেদ্ধ হচ্ছে লবস্টার।
দোকানদার বেশ বুড়ো। আমি যখন বললাম আমি লবস্টার নিয়ে যেতে চাই। প্রথমেই বললো স্টিম করা না জ্যান্ত। আমি বললাম বাঁচবে কতক্ষন। বললো , “আমরা এমন ভাবে প্যাক করে দেব যাতে অন্তত চব্বিশ ঘন্টা বেঁচে থাকে। শুধু একটা সমস্যা তোমাদের এই ছ ঘন্টার ড্রাইভে , মাঝে মাঝে দেখতে হবে যে বরফ গলে জল না হয়ে যায়। লবস্টার ডুবে গেলে মরে যাবে।” কি জ্বালাতন। সমুদ্রের তলার প্রাণী নাকি ডুবে মরে যাবে। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টাও অনেক কম সময়। এই এতটা ড্রাইভ করে তাহলে গিয়ে আবার পরের দিন সকালেই রান্না করতে হবে। জ্যান্ত প্রাণী ঘরের কড়াইতে মরবে সেটা যতটা বেদনাদায়ক , তার থেকে বেশি বেদনা আসবে যদি এই ভয়ঙ্কর গন্ধ বাড়ির মধ্যে ছড়াতে থাকে। একেতেই বদ্ধ ঘরে গন্ধ যেতে চায়না।
আমার মুখচোখ দেখে বুড়ো বুঝতে পারলো। বললো তাহলে কুক করে নিয়ে যাও কিন্তু ফ্রোজেন করবে না। আবার গেরো। ভেবেছিলাম বেশ ছ সাতটা নিয়ে যাবো। আসতে আসতে খাবো। মেইনে লবস্টারের দাম প্রায় অর্ধেক। কিন্তু ফ্রোজেন ছাড়া তো গতি নেই। বুড়ো বলে দিলো , “ফ্রোজেন করলে এর কোনো স্বাদ থাকবে না। ” ঠিক যেমন আমরা বলি টাটকা চারাপোনার স্বাদ আড়াই কিলোর কাটাপোনার থেকে ভালো। ঠিক তেমনটাই শোনালো। যারা জানে , তারা টাটকা বাসীর তফাৎ বোঝে। শেষমেশ ঠিক হলো চারটে হার্ডশেল বড় সাইজের লবস্টার কুক করে নিয়ে যাওয়া হবে। এখন রান্না করে দেবে আর রাস্তায় ঠান্ডা হলে , বরফের বাক্সে বসিয়ে নিতে হবে।
চারটে লবস্টার একটা কাপড়ের ব্যাগে তুলে নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম , ” আচ্ছা এই লবস্টার শ্যাক , পাউন্ড আর পিএর মানে কি ? ” লোকটা মুচকি হাসলো। তারপর একটা বেশ বড় মনোলোগ বললো। তার সার হলো এই। লবস্টার শ্যাক আর পাউন্ড একই । রেস্টুরেন্ট হতে গেলে মেনু হতে হবে অনেক বড় এবং বিবিধ। তার বদলে এই পাউন্ড বা শ্যাক তোমাকে সমুদ্র থেকে লবস্টার তুলে কাঠের আগুনে সমুদ্রের জলে সেদ্ধ করে সহজ খাবার পরিবেশন করছে , খুবই সাধারণ ভাবে। আমাদের ভাষায় দীঘার সমুদ্রের ধারে যারা মাছ ভাজা বিক্রি করে তাদের সাথে এদের কোনো ফারাক নেই। একটা পুরানো ধাঁচের ঘর , নানা সাইজের জ্যান্ত লবস্টার সাজিয়ে রাখা ট্যাংক , আর কাঠের আগুনে রাখা বিশাল বড় বড় ফুটন্ত জলের কেটলি এই পাউন্ড বা শ্যাকের পরিচায়ক। এই দোকানগুলিই যদি পিয়ার দিয়ে সমুদ্রের সাথে যুক্ত থাকে তাহলে তাদের নামের সাথে পিয়ার জুড়ে যায়। আরো হাজার ল্যাজের নাম বলে গেলো। অর্ধেক মাথায় নেই।

তবে বুড়ো যে সত্যি বলেছিলো সে পরে বুঝতে পেরেছিলাম। যেহেতু আমরা মিলেনিয়াল ও সবজান্তা। তাই বুড়োর কথায় পাত্তা না দিয়ে সেই চারটে লবস্টারের দুটোকে ফ্রোজেন করে দিয়েছিলাম। দু সপ্তাহ পরে, যখন বার করে সামান্য মসলা দিয়ে নেড়ে খেলাম তখন মনে হলো রাবার চেবাচ্ছি।এখন আসল খেয়ে বুঝতে পারি এতদিন কি উল্টোপাল্টা স্বাদ খেয়েছিলাম। সবার আভিজাত্য আলাদা। সবার মরণের পারে উপন্যাস এক ভাষায় লেখা নয়। লবস্টার অনেক খেয়েছি , কিন্তু সেরা খেলাম সত্যি লবস্টারের দেশে গিয়ে। ঠিক করেছি প্রত্যেক গরমে একবার করে যাবো। আর লম্বা ট্রিপ করে আসবো। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সাথে আরও নতুন তথ্যে আবিষ্কার করবো সেই ভূখণ্ড , যেখানে মানুষ আজও এমন ম্যানসনে থাকে যে বাড়িতে তালা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *