বাংলা নববর্ষ উৎসব সেকালে কীভাবে পালন করা হত সেটার টুকরো কিছু খবর আমরা জানতে পারি ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ থেকে যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৮ সালে । চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে কালীপ্রসন্ন সিংহ যার ছদ্মনাম ছিল ’হুতোম’, তিনি লিখেছিলেন , “আজ বৎসরের শেষ দিন । … আজ বুড়োটি বিদায় নিলেন, কাল যুবটি আমাদের উপর প্রভাত হবেন । বুড়ো বৎসরের অধীনে আমরা যেসব কষ্ট ভোগ করেচি , যেসব ক্ষতি স্বীকার করেছি – আগামীর মুখ চেয়ে , আশার মন্ত্রনায় আমরা সে সব মনে থেকে তারই সঙ্গে বিসর্জন দিলেমl” বুড়ো, মন্দ, পুরনো, জীর্ণ, দুঃখ, কষ্ট, ক্ষতি … এসব মুছে গিয়ে কি সত্য, সুন্দর ও ন্যায্যরুপী সাল উপহার পেত গ্রামবাসীরা? তবুও আশায় মরে চাষা … এই আপ্তবাক্যটুকুকে সম্বল করে পরবর্তী বছরের অপেক্ষায়, করত নির্মম পরিশ্রম । নিংড়ানো ঘাম, বেরিয়ে যাওয়া পাজরের হাড় ও মুখে রক্ত তুলে কড়ায় গণ্ডায় মেটাতে হত মালিকের হিসেব । দেনা শোধের পর একদিন কাটতো অনিয়ম আনন্দে । হুতোম আরও লিখেছেন “ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন । আগামীকে দাড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান—নেশার খোঁয়াড়ির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দেন । বাঙ্গালির বছরটি ভাল রকমেই যাক আর খারাপেই শেষ হক, সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরাণকে বিদায় দ্য্যান । কেবল কলসী উচ্ছগচ্ছু কর্তারা আর নতুন খাতা ওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন । “ ওনার লেখা থেকেই বুঝতে পারা যায় , বাঙালির নববর্ষ ছিল জাঁকজমকহীন একটি উৎসব যেখানে প্রধানত শুরু হত গনেশপুজা দিয়ে। এছাড়া নতুন বছরের হালখাতা খোলা হত এবং দোকানদার, পাওনাদার , ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বিষয়টি । পয়লা বৈশাখকে তখন ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে গণ্য করা হত । কৃষি ফলনের ওপর নির্ভর করে উৎসবটি উদযাপন করা হত । ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী কৃষিকাজ সম্পর্কীয় যাবতীয় হিসেব , খাজনা আদায় করা হত । কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষিকার্যের সঙ্গে মিলত না। ফলত কৃষকদের অসময়ে খাজনা মেটাতে বাধ্য করা হত। বিষয়টি শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে এবং খাজনা আদায়ের সুবিধারতে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন । প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরবর্তীকালে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে । আবার অন্যমতে , বঙ্গাব্দের আগের নাম ছিল শশাকাব্দ । অর্থাৎ রাজা শশাঙ্কের অভিষেক উতসবের দিনটি বঙ্গাব্দের প্রথম নববর্ষ । মত যা-ই হোক না কেন, উৎসবের মুল উদ্দেশ্য ছিল খাজনা আদায় শেষে প্রজাদের একটি নির্দিষ্ট দিনে খাওন-দাওন পর্ব ও মনোরঞ্জন ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে জমিদার বাড়িতেও উদযাপিত হত নববর্ষ । সারা বছরের মানসিক ও শারীরিক শোষণকে ভুলিয়ে দিতে বছরের এই একটি দিনের জন্য রাজা, শাসক কিংবা জমিদার হয়ে উঠতেন উদার মনের মানুষ ।
তবে এরপর দৃশ্যপট পালটেছে । বাঙালিরা সার্বিকভাবে তুমুল আনন্দে উদযাপন করে নববর্ষ। আমাদের বাড়িতে দেখতাম পয়লা বৈশাখের সকালে মা নিম ও হলুদ বেটে তেলের সঙ্গে মাখিয়ে রাখত । সেদিন সকালে স্নান না করলে কোন খাবারই দাঁতে কাটতে দিত না মা । ফলত হলুদ মেখে স্নান করে নতুন জামা পরে বড়দের প্রণাম সারতাম । পেটে তখন ইঁদুর দৌড় । সঙ্গে জিভে জল গড়াতে শুরু করেছে । রান্নাঘরে ভোর থেকে মা, কাকিমারা ষোড়শোপচারে জোগাড়ের ব্যবস্থায় তুমুল কাণ্ড বাঁধিয়েছে । দুপুরের বেলা রান্নাঘরের লম্বা বারান্দায় পাত পড়ত । সারি সারি পিঁড়ি, আর কাঁসার থালা গ্লাস।সেদিন খাবারে ভাতের সঙ্গে প্রথম যে সহযোগী খাবারটি পরিবেশন করা হত সেটি হল নিম-বেগুন। নাক মুখ কুঁচকে খেতে হত ওই তেঁতো পদটি । বাবা, কাকুদের দৃষ্টি থেকে সেদিন রক্ষে পাওয়া মুশকিল ছিল। তাঁরা বলতেন, এসময়ে নানা রোগ বিশেষত পক্স, হাম থেকে রক্ষা করে নিম। তারপর চলে আসত থালায় সিমের বীজের ডাল । সঙ্গে থাকত সরু বেগুনের ছোট ছোট ভাজা ও আমাদের পুকুরপাড়ের গাছের গন্ধলে্বু । আমার কাছে ধোঁয়া ওঠা সেই ডাল আর লেবু যেন ছিল স্বর্গের একটুকরো সুখ ।কলকাতা আসার পর থেকে ওই ডাল আর বেগুন খুব মিস করি। বাইশ বছরের মধ্যে তিন থেকে চারবার জুটেছিল ননদের কল্যাণে ডালের বীজটি ।কিন্তু সেই খাদ্য সুখ অনেক খুঁজেও পাইনি । কোথায় পাব এখানে পুকুরপাড় থেকে ক ফুট দূরত্বের সেই বারান্দা যেখানে নারকেলগাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদের কুচিগুলো এসে নেচে নেচে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের কাঁসার থালাগুলো ! কোথায় পাব সেই চড়ুইপাখিগুলোকে যারা থালার আশেপাশে এসে ঠুকরে খাবার নিয়ে পালাত । বাবা বলত কিছু খাবার ওদের জন্য সামনে রেখে দিতে।ওরা ওসব খাবার ছুঁয়েও দেখত না, তাদের চাই আমাদের পাশে এসে গল্প করে খাবার খাবে। কাকু রেডিওটা চালিয়ে রাখত আর আমরা শুনতাম নববর্ষের অনুষ্ঠান । তার মাঝেমাঝে চলত বায়না কাকুর কাছে গল্প শোনার । ততক্ষনে পাতে পরে গেছে পরবর্তী আইটেম… চচ্চরি। বিদেয় ঋতুর কিছু সবজি আর নতুন বছরের কয়েকটি সবজি দিয়ে , নুন, হলুদ্ , চেরা কাচালঙ্কা দিয়ে কি যে এক অদ্ভুত সবজি মা বানাতেন, আমি বহুবার অকৃতকার্য হবার পর হাল ছেড়েছি । নেই এতে কোন আহামরি মশলা, নেই আভিজাত্য। অবহেলায় সবার পাতে পড়ত সত্যি, কিন্তু হাতের আন্তরিকতায় এখনো ছুঁয়ে আছে আমাদের রসনা । শিলচরে মাছের রকম কম। আমি মাছ চিনেছি কলকাতা এসে। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ এবং পুজোয় জেলেকে ডাকা হত বাড়িতে । জাল ফেলার পর আমাদের সবার চোখ ওই জেলের হাতের দিকে । কী একটা কায়দায় সে জালটাকে টেনে তুলত আর দেখতাম মাছেরা কিলবিল করছে তার মধ্যে । ছোট যখন ছিলাম তখন ভাবতাম মাছেরা বোধহয় খেলছে হাত পা ছুঁড়ে । কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম “মছলি জল কি রানি হ্যায়, জীবন উসকা পানি হ্যায় … । ওদের ছটফটানি দেখে কষ্ট হত আমার।তারপর জীবন যুদ্ধে আস্তে আস্তে লড়াই করার ক্ষমতা কমে আসত । এলিয়ে দিত শরীর । কই, পুঁটি , কাতলা, রুই, মৌরলা মাছেদের কথাই এই মুহূর্তে মনে পড়ছে । ঝোল , কড়ুয়া (মাখামাখা তরকারীকে সিলেটীতে বলা হয়) রান্না হত সেসব মাছ দিয়ে। নেই মশলা বা তেলের আতিশয্য । পেঁয়াজ ব্যবহার খুব কম হত। অথচ সেইসব স্বাদ জিভে কেউ না ঠেকালে বোঝানো হয়ত আমার পক্ষে সম্ভব না। আর শেষ পাতে থাকত বিরুন চাল । আঠাযুক্ত হালকা লাল রঙের এই ভাত ক্ষীর ও গুঁড় দিয়ে যেমন খাওয়া যায়, তেমনি মাছ ভাজা, ভাজার অল্প সেই তেল এবং সঙ্গে কাঁচালঙ্কাতে জমে যায় দ্বিগুন । এছাড়া এই চালটি বাঁশের ভেতর পুরে ও তারপর বাঁশটিকে জলে সেদ্ধ বা পুড়িয়েও তৈরি করা হয় ভাত। যাইহোক , এ গল্প শেষ হবার নয় । দিন পাল্টেছে মহিলারা বাইরের জগতে যত পা রাখছে, এসব আচার বিধি বা রকমারি তরিজুত পদ কমে আসছে । ভুলে জাচ্ছি অনেক খাবা্র ও রান্না। কিন্তু সেটারও উপায় অনেকটাই মিটিয়েছে কলকাতার দারুন সব বাঙালি রেস্টুরেন্ট। শাক, শুক্তো থেকে শুরু করে মোচা, অম্বল , সজনে , পোস্ত অর্থাৎ নানাধরনের খাঁটি বাঙ্গালিয়ানায় ভরপুর আইটেম তো পাবেনই আর সঙ্গে রকমারি মাছ মাংস তো রয়েইছে । যদিও বাঙালিরা এখনো চেষ্টা করে নববর্ষকে খাঁটি বাঙ্গালিয়ানায় উপভোগ করতে, কিন্তু নেই তার ভাষার কদর । নেই রপ্ত করার ইচ্ছে। আমরা পর পর সাজিয়ে বাংলা মাস বলতে পারি না। এমনকি যে মুহূর্তে আমরা নববর্ষ উদযাপন করছি, অনেকেই বলতে পারেন না সালটি কত। একটানা বৃষ্টি হলে অনুমান করি, এমাস হয়ত আষাঢ় কিংবা শ্রাবন ; গরম পরলে চৈত্র । কবিগুরুর বৈশাখ মাস … আর আশ্বিনে পুজো । পরবর্তি প্রজন্ম সেটাও বলতে পারবে কতটুকু ? বাংলা ভাষা ছিল একটা মিষ্টি জলের স্রোতস্বিনী নদী যেমনটি, কিন্তু বর্তমানে সেই নদী শীর্ণকায় আকার ধারণ করেছে । তার উত্তর ? জীবিকার জন্য যে নেই দরকার এই ভাষাটির। তাই যেখানে পেট কা সওয়াল , সেখানেই ইজ্জত কা সওয়াল ।
মেয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে এসে ধরেছে।
— মা , তুমি এবারে নববর্ষে কি খাওয়াবে ?
— বললাম, ফর্দ লেখ রেসিপি সমেত । আমাকে পাঠাতেও হবে একটি ম্যাগাজিনে রেসিপিগুলো ।
— শুরুতে শসার শুক্তো , তারপর বেগুনি ও কাঁচা মুগের ডাল , নারকেলি পোলাও , চালকুমড়োর পুর , ভেটকির
পাতুরি, রুই কালিয়া ,কষা মাংস , দই ও মিষ্টি ।
কিছুক্ষণ বলার পর দেখি মেয়ের চোখ ছলছল।
–কি হল, কিছু লেখনি কেন সোনা?
— মা, আমি যে বাংলা লিখতে পারছি না । দু চোখ ভরে জল গড়াচ্ছে । দায়ী কারা? দায়িত্ব কাদের?
আঁচলে চোখ মুছে ধরা গলায় বললাম – কথা দিলাম, আগামিকাল থেকে আমি শেখাব তোমায় বাংলা ।
খাঁটি বাঙ্গালিয়ানায় ভরপুর তিনটে রেসিপি শেয়ার করছি নববর্ষের জন্য ।
শসার শুক্তো: ঝিরিঝিরি করে শসা কেটে তাতে নুন মাখিয়ে নিন । কড়াইতে তেল ও ঘি গরম করুন। তাতে সর্ষে ফোড়ন দিন । এবারে শসা ছাড়ুন । ঢেকে দিয়ে রান্না করুন। যখন শসা সেদ্ধ হয়ে যাবে আধ চা চামচ ময়দা জলে গুলে ছড়িয়ে দিন চিনি দিয়ে ভাল করে নাড়িয়ে নিন । নামানোর আগে দুধের সর ভাল করে ফেটে তাতে দিয়ে ফোটান । মাখোমাখো হলে পর নামিয়ে ফেলুনl
চালকুমড়োর পুর: চালকুমড়োর খোসা ছাড়িয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে আধ ইঞ্চি করে কাটুন । চালকুমড়োর মাঝখানে অর্ধেকটা কেটে পকেট মত করুন । এবারে এপিঠ ওপিঠ ছুরি বা বটি দাঁ দিয়ে ঘন ঘন চিরে নিন। কাঁচলঙ্কা বাটা , নারকেল বাটা ও নুন একসঙ্গে মেখে পকেটে ভরুন । একটি পাত্রে ময়দা , নুন , জল , হলুদ , লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে ভাল করে ব্যাটার তৈরি করুন । কড়াইতে তেল গরম করুন । এবারে পুর ভরা চালকুমড়ো ব্যাটারে ডুবিয়ে মুচমুচে করে ভেজে তুলে নিন ।
নারকেলি পোলাও: করতে প্রথমে গোবিন্দভোগ চাল ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখুন । কড়াইতে সাদা তেল ও ঘি দিন । গরম হলে পর তাতে তেজপাতা , গোলমরিচ , ছোট দারচিনি , দু চারটে লবঙ্গ ফোড়ন দিন । এবারে চাল ছাড়ুন । তাতে নুন ও নারকেল কোরা মিশিয়ে নাড়াচাড়া করুন । অল্প জল ঢেলে ফুটতে দিন । এবারে নারকেল দুধ মিশিয়ে আঁচ কম করে ঢেকে চাল সেদ্ধ করতে দিন । সেদ্ধ হয়ে এলে পর চিনি মিশিয়ে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিন।