bibidho-aloukik-anish

অলৌকিক অনীশ
স্মৃতিচারণা
সৌভিক চক্রবর্তী
সৌভিক চক্রবর্তী - পয়লা বৈশাখে দেব সাহিত্যকুটীর (সঙ্গে রূপা মজুমদার)। ২০১৯

‘অপার বাংলা’ শারদসংখ্যার জন্য অনীশ দেবের স্মৃতিচারণা লিখতে বসামাত্র হাতটা কেঁপে উঠল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল না, অনীশ স্যার আর আমাদের মধ্যে নেই! একরকম জোর করেই আঙুলগুলোকে কী-বোর্ডে ফিরিয়ে আনলাম। সত্যিকে অস্বীকার করি কী করে? বাস্তব এটাই—গত ২৮শে এপ্রিল ভোররাতে করোনা অতিমারী গ্রাস করেছে বাংলা জঁর সাহিত্যের অন্যতম কাণ্ডারিকে। প্রায় মাস পাঁচেক হল অমৃতলোকের পথে পাড়ি দিয়েছেন অনীশ স্যার, রেখে গিয়েছেন এক বিশাল শূন্যতা। যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, চিনেছেন, ভালোবেসেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই সেই শূন্যতা অনুভব করে চলেছেন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে। শনিবারের দিনগুলো এখনও আমার প্ল্যান্টেই কাটে, কিন্তু সন্ধে সাতটার সময় আর কারোর ফোন আসে না। কেউ আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করেন না, ‘কী সৌভিক, পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও পত্রিকা দপ্তর নেই তো যেখানে এখনও তোমার গল্পের পাণ্ডুলিপি পৌঁছয়নি?’ মৃত্যু মায়া, জানি, পুরোনো বস্ত্র ছেড়ে নতুন বস্ত্র ধারণের মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু প্রিয়জন চলে যাওয়ার শোকে আকুল মন সেকথা মানতে পারে কই?

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, স্যারের পাঠকসংখ্যা কম ছিল না। প্রতিবছর কলকাতা বইমেলায় নামী প্রকাশনার স্টলে বসে অকাতরে বইয়ে সই বিলোতেন তিনি। পাশে অবাক চোখে আমি শুধু দেখে যেতাম। হয়তো তখন আলোচনা চলছে ড্যান ব্রাউন অথবা অ্যালিস্টার ম্যাকলিন-কে নিয়ে। একমুহূর্তের জন্যও অন্যমনস্ক হতেন না স্যার, নিজের মতামত রাখতেন স্পষ্টভাবে, অন্যের মতটাও শুনতেনও মনোযোগ সহকারে। একইসঙ্গে চলত ডান হাতের কাজ। গোটা গোটা অক্ষরে শুভেচ্ছাবার্তা, একের পর এক সই, ঠোঁটে ক্লান্তিহীন হাসি—এই ছিলেন আমার চেনা অনীশ দেব। ছোট টেবিলের সামনে লম্বা লাইন পড়ত। কেউ হয়তো প্রাক্তন ছাত্র, বই কেনার পাশাপাশি প্রিয় প্রফেসর-কে প্রণাম করতে এসেছেন। কেউ বা গুণমুগ্ধ ভক্ত, দ্বিতীয় প্রজন্মকে হাতে ধরে সঙ্গে এনেছেন, লেখকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। কেউ আবার হয়তো উঠতি লেখক, মনে তার হাজার প্রশ্ন। সবার আবদার পূরণ করতেন অনীশ স্যার, অত্যুৎসাহীর আবেগকে মর্যাদা দিতে কখনও কখনও সেলফিতেও রাজি হতেন। সফল রহস্য-রোমাঞ্চ-কল্পবিজ্ঞান-ভৌতিক সাহিত্যিক আগেও অনেকে ছিলেন, আগামীতেও নিশ্চয়ই আসবেন। কিন্তু অনীশ দেব একমেবাদ্বিতীয়ম; তাঁর মতো কেউ আর আসবেন না।

রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্য ছিল অনীশ দেবের প্রথম প্রেম। ক্রাইম ও ডিটেকটিভ গল্প পড়া শুরু করেছিলেন কিশোর বয়সেই। তখন ষাটের দশক, বাংলা পাল্প পত্রিকার স্বর্ণযুগ। ‘মাসিক রোমাঞ্চ’, ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’, ‘মাসিক গোয়েন্দা’—চারদিকে ম্যাগাজিনের ছড়াছড়ি। এদের হাতের তালুর মতো চিনতেন অনীশ স্যার। প্রতি মাসে ম্যাগাজিন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হয়ে যেতেন ফুটপাথের স্টলে। নেশা এতটাই প্রবল ছিল যে পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কেজি দরে কিনে আনতেন আগের ইস্যুগুলো। তাঁর লেখালিখির হাতেখড়ি হয়েছিল অত্যন্ত অল্প বয়সে। প্রথম রহস্য গল্প ‘ভারকেন্দ্র’ যখন ছেপে বেরোয় ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’র পাতায়, তখন অনীশ দেবের বয়স, তাঁর নিজের ভাষাতেই, ‘সতেরো মাইনাস’। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গল্পটা আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, অনীশ স্যারের শুরুর দশ পনেরো বছরের লেখালিখি সেই অর্থে অসংকলিত। একাধিকবার জানতে চেয়েছি—“তিন খন্ডে ‘আর্লি আসিমভ’ পাওয়া যায় যখন, ‘হারিয়ে যাওয়া অনীশ’ পাওয়া যাবে না কেন?” স্যার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উত্তর দিয়েছেন—“আমি মনে করি ওগুলো আমার দুর্বল লেখা। স্রেফ কটা টাকার জন্য ওগুলো বই হিসেবে বের করা মানে পাঠককে ঠকানো।’ কতটা নির্মোহ হলে একজন লেখক এমনটা বলতে পারেন? বলতে পারেন–“লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা একটা ফাইলে আমার পুরোনো গল্পগুলো রাখা আছে। আমার জীবিতাবস্থায় সেগুলো পুনঃপ্রকাশের মুখ দেখবেনা, কোনও বইয়ে সংকলিতও হবে না”? কথা রেখেছেন অনীশ স্যার, লেখাগুলো আজও আমাদের অধরা।

সৌভিক চক্রবর্তী - বইমেলায়, সন্ধেবেলায়। ২০২০

বাংলা থ্রিলার-কে সম্মানের আসনে বসানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন অনীশ দেব। আগাথা ক্রিস্টি, জন ডিক্সন কার থেকে ড্যাশিয়েল হ্যামেট, মিকি স্পিলেন—তাঁর পাঠাভ্যাসই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল বাংলা রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প-উপন্যাসে একেবারে অভিনব কিছু ‘থিম’ এবং ‘ট্রিটমেন্ট’ ব্যবহার করতে। বৃদ্ধ হুনুর এসিজি-কে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে নির্মিত ‘বিশ্বাসঘাতকদের জন্য’ এক অনবদ্য লকড রুম মিস্ট্রি তো বটেই, আশির দশকের বাংলা ক্রাইম ফিকশন জগতের নিখুঁত চালচিত্রও। “এই উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্রই বাস্তব, এবং আমার পরিচিত। তখনকার সময়ের রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক লেখিকা, নামগুলো অবশ্য কিছুটা বদলে দেওয়া। একমাত্র ভাস্করদার নামটাই বদলাইনি, সেটা ওঁর প্রতি আমার ট্রিবিউট।” উপন্যাসটা নিয়ে আলোচনাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন অনীশ স্যার। দুর্দান্ত অ্যাকশন থ্রিলার ‘কিরাত আসছে’ বিষয়ে বলেছিলেন, “উপন্যাসটা লেখার সময় রীতিমতো জাল নোট নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছিল।” ‘সাপের চোখ’, ‘পায়ের শব্দ নেই’, ‘পাতালঝড়’-এর মতো উপন্যাসে বিকৃতমস্তিষ্ক খুনি বা সাইকোপ্যাথের মনের গহিন অন্ধকার যেভাবে তুলে ধরেছেন অনীশ দেব, তা উচ্ছ্বসিত প্রশংসার দাবি রাখে। সেকথা তাঁকে বলেওছিলাম, জবাবে শুনেছিলাম, “লরেন্স স্যান্ডার্স-এর ‘ফার্স্ট ডেডলি সিন’ তো পড়োনি, তাই এমন বলছ।” বিদ্বান ব্যক্তি আদতে বিনয়ী হন–অনীশ স্যার-এর সঙ্গে কথা বললেই এই আপ্তবাক্যের সত্যতা প্রমাণিত হত।

বাংলা ভৌতিক অলৌকিক সাহিত্যের ভরা বাগানে অনেক সুগন্ধী ফুল ফুটিয়েছিলেন অনীশ দেব, প্রায় একা হাতে হরর শাখায় এনেছিলেন বাঁকবদল, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। সেই ছোটবেলা থেকে টানা একবছরের অপেক্ষা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল—কখন ‘শুকতারা’ ও ‘কিশোর ভারতী’ পুজোসংখ্যায় ভয়ের উপন্যাস লিখবেন অনীশ দেব। ‘পিশাচের রাত’, ‘আমি পিশাচ’, ‘রইল না আর কেউ’, ‘দেখা যায় না শোনা যায়’, ‘বাড়িটায় কেউ যেও না’—স্মৃতির মণিকোঠায় আজও অমলিন। ভ্যাম্পায়ার এবং ওয়্যারউলফ মিথ-কে বাংলার জল হাওয়া রোদ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে দক্ষতা অনীশ স্যার দেখিয়েছিলেন, তা এককথায় অতুলনীয়। হরর সাহিত্যিক এডগার অ্যালেন পো এবং স্টিফেন কিং-এর ভক্ত ছিলেন অনীশ দেব। পো-র ভাষার ব্যবহার, কিং-এর ‘পেনম্যানশিপ’ তাঁকে মুগ্ধ করত। কিং-এর হরর বিষয়ক নন-ফিকশন বই ‘ডান্স ম্যাকাবার’ থেকে প্রায়ই উদ্ধৃতি দিতেন স্যার, শেখাতেন হরর সাহিত্যে প্লট-ই আসল কথা নয়, তার বাইরেও অনেক কিছু রয়েছে। ‘শেপলেস ফিয়ার’-এর প্রতি অনীশ স্যারের বিশেষ আকর্ষণ ছিল, তাই হয়তো স্বরচিত গল্পগুলোর মধ্যে ‘নীল আলো ভালো নয়’ বা ‘আরশিনগরের অসভ্য লোকটা’ তাঁর মতো খুঁতখুঁতে লেখকেরও পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিতে পেরেছিল।

কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে অনীশ দেবের সম্পর্ক ছিল বহুদিনের, সেই ‘আশ্চর্য’, ‘বিস্ময়’, ‘ফ্যান্টাস্টিক’-এর সময় থেকেই। বাংলা সায়েন্স ফিকশনের আঙিনায় যে বিপ্লব অদ্রীশ বর্ধন এনেছিলেন, তাতে সহযোদ্ধার ভূমিকা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন অনীশ স্যার। কীভাবে অর্ধশতকেরও আগে ছোট্ট এক লেখকগোষ্ঠী কল্পবিজ্ঞানকে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্নকে সত্যি করার পথে এগিয়েছিলেন সেই গল্প অনেকবার শুনেছি তাঁর মুখে, জেনেছি কলেজে পড়াকালীন তাঁর ট্রেনে ঘুরে ঘুরে পত্রিকা বিক্রির কথা। নিজে ফলিত পদার্থবিদ্যার অধাপক হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানের অযথা জটিলতা এবং জার্গন থেকে সায়েন্স ফিকশনকে দূরে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন অনীশ স্যার, নির্দ্বিধায় বলতেন, “অল্পবিজ্ঞান ও গল্পবিজ্ঞান, এই দুই নিয়েই কল্পবিজ্ঞান”। পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞানের কৃতী সাহিত্যিক, ‘নিউ ওয়েভ’ ঘরানার স্তম্ভ টমাস এম ডিশ-এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অনীশ দেবের, ভারতীয় কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম প্রাণপুরুষ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার-এর সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ আলাপ। মারাঠি সায়েন্স ফিকশন লেখক বাল ফোন্ডকে সম্পাদিত ‘ইট হ্যাপেন্ড ইয়েস্টারডে’ (যা বাংলায় ‘এসব আগামীকাল ঘটেছিল’ নামে অনূদিত হয়) সংকলনে গল্প প্রকাশ পাওয়া থেকে শুরু করে আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আমেজিং’-এ ইংরেজি গল্প মনোনীত হওয়ার বিরল সম্মান—কল্পবিজ্ঞান লেখক অনীশ দেবের মুকুটে পালক অসংখ্য (দুঃখের বিষয়, ‘আমেজিং’ পত্রিকায় তাঁর গল্পটা ছেপে বেরোবার আগেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়)। এসব সাফল্য যদি দূরেও সরিয়ে রাখি, কেবলমাত্র নব্বইয়ের দশকে আনন্দ থেকে প্রকাশিত দুটো ‘কাল্ট’ সংকলন, ‘সেরা কল্পবিজ্ঞান’ ও ‘সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞান’ সম্পাদনার জন্যই অনীশ দেব বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে থেকে যাবেন।

সৌভিক চক্রবর্তী - বইমেলার দুপুরে সাহিত্য আড্ডা (সঙ্গে সৈকত মুখোপাধ্যায়, চুমকি চট্টোপাধ্যায়,দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, সমুদ্র বসু)। ২০১৯

এবার আসি অনুবাদক অনীশ দেবের কথায়। বিদেশি ভৌতিক-অলৌকিক কাহিনির বঙ্গানুবাদ মানেই দেড়শো বা দুশো বছর আগে লেখা এবং বাংলায় বহুবার অনূদিত কিছু গল্পের চর্বিত চর্বণ—প্রচলিত এই ধারণাকে নস্যাৎ করেছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী অনীশ দেব। তার মানে এই নয় যে বিদেশের প্রথিতযশা লেখকদের বাদের খাতায় ফেলেছিলেন স্যার, বরং এডগার অ্যালেন পো-র ‘দ্য ওভাল পোর্ট্রেট’, অ্যাম্ব্রোস বিয়ার্স-এর ‘দ্য বোর্ডেড উইন্ডো’, সাকি-র ‘গেব্রিয়েল আর্নেস্ট’ রীতিমতো অন্য মাত্রাই পেয়েছিল তাঁর পারঙ্গম কলমকারীতে। ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিত অনুবাদ করেছেন তিনি, গল্প বেছে নেওয়ার ব্যাপারে সবসময় জোর দিয়েছেন মানের ওপর। আগাথা ক্রিস্টি-র ‘ইভল আন্ডার দ্য সান’, হাওয়ার্ড ফাস্ট-এর ‘পীকস্কিল’ তো বটেই, ছোটগল্পের ক্ষেত্রে রবার্ট ব্লক-এর ‘ইয়োরস ট্রুলি, জ্যাক দ্য রিপার’, জোসেফ পি ব্রেনান-এর ‘লেভিটেশন’ জাতীয় অসাধারণ অথচ আগে বাংলায় অনুবাদ হয়নি এমন সব সৃষ্টি পাঠকদের সামনে পরিবেশন করেছেন তিনি। এখানেই তাঁর মুন্সিয়ানা, এজন্যই পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত তাঁর অনুবাদ সংকলন ‘বিশ্বের সেরা ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প’-এর প্রশংসা আজও সবার মুখে মুখে ফেরে।

শূন্য দশক পরবর্তী সময়ে অবশ্য অনীশ স্যারের অনুবাদ অনেকটাই কমে এসেছিল। মৌলিক গল্পকে দূরে সরিয়ে স্রেফ অনুবাদ সাহিত্যের চর্চাকে কখনওই ভালো চোখে দেখেননি তিনি। একাধিকবার বলেছেন, “যে মৌলিক লেখা লিখতে পারে সে কেন শুধু অনুবাদ করে সময় নষ্ট করবে? অনুবাদ করবে নিজের লেখা শেষ করে, চিন্তার জট ছাড়াতে, একঘেয়েমি কাটাতে।’ আরও বলেছেন, ‘সবকিছু অনুবাদের জন্য নয়। কিছু গল্প উপন্যাস পড়লেই তোমার মনে হবে, এগুলো যদি নিজের ভাষায় বলতে না পার তাহলে জীবনটাই বৃথা। সেক্ষেত্রে তোমাকে কিছু করতে হবে না, গল্পগুলোই তোমাকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নেবে।” ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ‘নবকল্লোল’-এর পাতায় শেষবারের মতো অনীশ স্যারের অনুবাদ প্রকাশিত হয়ঃ র‍্যামসে ক্যাম্পবেল-এর হরর কাহিনি ‘হেডিং হোম’-এর বঙ্গানুবাদ ‘মাথা খাটিয়ে’।

পাঠক অনীশ দেব সম্বন্ধে দু’ চার কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না, তাঁর সাহিত্যপাঠের ব্যাপ্তি ছিল বিস্ময় উদ্রেক করার মতো। এইচ জি ওয়েলস থেকে এডগার রাইজ বারোজ, ডব্লিউ ডব্লিউ জেকবস থেকে পিটার স্ট্রব, ফ্রেড্রিক ফরসাইথ থেকে ক্লাইভ বার্কার—কী না নিয়ে আলোচনা হত আমাদের মধ্যে! শার্লি জ্যাকসন-এর ‘দ্য হন্টিং অফ হিল হাউজ’, স্টিফেন কিং-এর ‘ডোলান’স ক্যাডিলাক’ আলাদাই মাত্রা পেত অনীশ স্যার-এর বিশ্লেষণে। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রথমে বজবজ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, তারপর অ্যাডামাস ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট-এর ‘এইচওডি’ হয়েছিলেন অনীশ দেব। বাড়ি থেকে কলেজ—দীর্ঘ পথ যাতায়াতের সময়টা বই পড়েই কাটাতেন তিনি। একবার পত্রভারতীর এক অনুষ্ঠানে আমার হাতে ভ্যাল ম্যাকডারমিড-এর ছোটগল্প সংকলন তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নাও, তোমাকে গিফট করলাম। আমার পড়া শেষ, ট্রেনে বসে বসেই পড়ে ফেলেছি গত দু’ সপ্তাহে।” বললে সবাই বিশ্বাস করবে না, কিন্তু পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সাহিত্য এবং বাংলা মূলধারার সাহিত্য বিষয়েও অনীশ দেবের জ্ঞানের কোনও সীমা ছিল না। হেমিংওয়ে-র উপন্যাস, আর্থার মিলার-এর নাটক নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তব্য রাখতে পারতেন স্যার, পারতেন সন্দীপন, কমলকুমার, বিমল কর বা নরেন্দ্রনাথ মিত্র নিয়ে জমিয়ে সাহিত্য আলোচনা করতে। আধুনিক কবিতার মনোজ্ঞ পাঠক ছিলেন অনীশ দেব, খবর রাখতেন কোন কবি কোথায় কেমন লিখছেন। আমার পরম সৌভাগ্য, এমন বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম।

সৌভিক চক্রবর্তী - সল্টলেকে, সিসিডি-র আড্ডায় (সঙ্গে সৈকত মুখোপাধ্যায়, বিবেক কুন্ডু, সৌরভ চক্রবর্তী)। ২০১৯

সন্ধে যে ঘনিয়ে আসছে, শেষদিকে হয়তো কোনওভাবে তা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন অনীশ স্যার। তাঁর কিছু কিছু কথায় সেই আভাস পেতাম। হয়তো আমাকে কিছু একটা বোঝাচ্ছেন, আর আমি নাছোড়বান্দার মতো তার বিপক্ষে তর্ক করে যাচ্ছি। তখন কপট রাগ দেখিয়ে তিনি বলতেন, “আজ আমি আছি তাই বলছি, কাল যখন থাকব না তখন কেউ দেখবে বলবেও না।” সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে থামিয়ে দিতাম আমি, বলতাম, “কী যে বলেন স্যার! এতো তাড়াতাড়ি কোথায় যাবেন আপনি, বটগাছের আয়ু নিয়ে আমাদের মাথার ওপর ছাতা হয়ে থাকবেন আরও অনেকদিন।” আবার হয়তো কখনও ফোনে সাহিত্য আড্ডার মাঝখানে হালকা চালেই বলতেন, “বিদেশি সাহিত্য পড়ার এই যে বদঅভ্যেস তৈরি করেছ, আমি চলে গেলে কার সঙ্গে আলোচনা করবে এসব নিয়ে?” আমি গুরুত্ব দিতাম না, দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সময়, সে তার যতই তাড়া থাক না কেন, সহসা অনীশ দেবকে ছোঁয়ার সাহস করবে না। ভুল ভেবেছিলাম। পয়লা বৈশাখের পরপরও স্যারের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। তখন ঘুণাক্ষরেও জানি না, সেই শেষ কথা, আর কোনওদিনও ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠবে না ৯৮৩০১২৩১২৩ নম্বরটা।

টমাস ডিলান-এর একটা কবিতা আমার খুব প্রিয়। “Do not go gentle into that good night/ Old age should burn and rave at close of day;/Rage, rage against the dying of the light.” অনীশ স্যারের সঙ্গে যদিও এটা নিয়ে আমার কোনওদিনও কথা হয়নি, তবু কেন জানি মনে হয়, তিনিও এই কবিতাটা পড়েছেন, অন্তর থেকে উপলব্ধিও করেছেন। অনেকক্ষণ কথা বলার পর যখন ফোন রাখার সময় হত, তিনি বলতেন, “সৌভিক, লড়ে যাও।” নিজের জীবনে বারবার লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছেন তিনি, অধ্যাবসায় এবং পরিশ্রমকে বন্ধু বানিয়েছেন। রূপাদি (দেব সাহিত্য কুটীরের কর্ণধার রূপা মজুমদার)-র মুখে শুনেছি, করোনা আক্রান্ত হয়ে তখন অনীশ দেব হসপিটালে শয্যাশায়ী, কথা বলার মতো অবস্থা নেই। রূপাদি হোয়াটসঅ্যাপ করলেন, “তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন, অনীশদা।” উত্তরে স্যার লিখে পাঠালেন, “চেষ্টা করছি, খুব চেষ্টা করছি।” এই অদম্য ইচ্ছেশক্তি, এই আপ্রাণ চেষ্টাটাই অনীশ দেবের পরিচয়। জীবনের সব যুদ্ধ কেউ জেতে না, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়ার মানসিকতা ও অদম্য ইচ্ছেশক্তি মানুষকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যায়। জীবনের কুরুক্ষেত্রে যখনই বিষাদ এসে গ্রাস করে আমাকে, গাণ্ডীব নামিয়ে রেখে যখন পথ খুঁজি আমি, তখনই কানের কাছে কেউ বলে ওঠেন, “সৌভিক, লড়ে যাও।” মহাভারতের গুরু দ্রোণকে আমি দেখিনি, কিন্তু অনীশ স্যার-কে দেখেছি। আমার শিক্ষাগুরু, আমার ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড অনীশ দেব। অলৌকিক অনীশ দেব!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “bibidho-aloukik-anish

  1. অপূর্ব স্মৃতিচারণ,প্রকৃত শিষ্যই পারেন
    তাঁর গুরুকে এভাবে বন্দনা করতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *