কালকূট নিবন্ধ
নবকুমার বসু
চাল অথবা চুলো কোনটাই তখন তাঁর ছিল না। কিন্তু চলা ছিল নিরন্তর। আর হ্যাঁ, সংসারও ছিল।
সে কেমন চলা? খামখেয়ালি ভবঘুরের মতন শুধুই পথে পথে ফেরা? বিবাগী–বৈরাগী হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো! ঘর সংসার ফেলে রেখে সম্বল করে ভেসে ভেসে বেড়ানো?
কে বলতে পারে, এক অর্থে কিছুটা তাও বা! কিন্তু আর এক অর্থে! ভাবনার ঠেক খেতে হয় যে তখনই। যাঁর চাল নেই, চুলো নেই, তাঁর আবার ঘরসংসার! ধন্দ লেগে যায়। কে হদিশ দেয় সেই মনের, যার একদিকে আঁটোসাঁটো ঘরের বাঁধন, নেই-নেই এর ধূ ধূ হাহাকার, কোত্থেকে, কী দিয়ে নিরন্তর চলে সে?
মন চলে যাও, নিজের মনে। ভাবি তারই আর এক বয়ান। বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো। একদিক শক্ত হতে হতেই টুটছে আরেকদিকে। মানুষটা নিজেই কবুল করেছেন, সংসার তাঁকে ঘিরে। আবার তিনি নিজেও খোঁটায় বাঁধা বিশ্বস্ত অবলা জীবটির মতই বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করে চলেছেন সংসার মন্ডলকে। তাঁর সারা অঙ্গে অদৃশ্য সংসারের হাজারো বেড়ি। তাহলে? আসলে মানুষটা কানে শোনে এক বাঁশির সুর। কে বাজায় জানে না। বুকের গভীরে টের পায় প্রেম ঢাকের বোল। সাড়া না দিয়ে পারে না। পাখি যেমন নীড় ছেড়ে ধায় আকাশ পথে, তাঁরও তেমন ধাওয়া আছে। মনের পাখায় কাঁপন ধরে, বাঁশির সুর, ঢাকের বোল, যাই চলো, উধাও করে দেয় পথের ডাকে। লোকটা বেরিয়ে পড়ে।
পলাতক তিনি! যদি কেউ বলে, বলুক গিয়ে। তাঁর মাথাব্যথা নেই। ঠেক-ঠিকানা কুলা ছেড়ে মুক্তবিহঙ্গ হওয়ার প্রাক্কালেও তাঁর মনে থাকে, জীবনে ফাঁকি দিয়ে সংসার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। মহৎ কাজও করা যায় না সংসার থেকে পালিয়ে। যে পথকে কেউ ভেবেছেন সংসারের বাইরে, তার ব্যাখ্যায় সে বিশাল, বিশ্বসংসারেরই আর এক রূপ। ভাবো কথা! চালচুলো, ঘরসংসার– ছোট ছোট কথার মধ্যেই এনে ফেলেছেন বড় বড় শব্দ ব্যঞ্জনা – জীবন, বিশ্বসংসার। সহজ কথার মধ্যেই তোমায় চমকে দিল সহজিয়া। তিনি বলেই পারলেন। ছোট সংসারটির দায়ে ধুঁকতে ধুঁকতে লোকটা যখন কাহিল, কণ্ঠশুষ্ক তৃষ্ণার্ত, তখনই বিশাল সংসারের আঙিনায় তিনি অঞ্জলিবদ্ধ। জল দাও, গণ্ডূষ ভরে পান করি। আর কিছু না। চালাঘরের ছোট পরিসরে হাঁপিয়ে উঠেছেন। বড় সংসারের ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে রয়েছে জীবনের ধারাবাহিক চলাচল। ওগো নিঠুর দরদী, বাচিয়ে রাখো, মেরো না। নিজেকে খুঁজতে, যাচাই করতে বেরিয়েছে লোকটা। আমায় পলাতক বোলো না।
অচিন পাখি গেয়ে উঠেছে তাঁর হিয়ার মাঝে। সে গান আর কে শোনে! রাজনীতির ফন্দিফিকিরে তিতিবিরক্ত লোকটা। দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পড়া অসহায়। ধর্ম, যা ধারণ করে, সংশয় সেখানেও। কুঠরি সংসারের চাহিদা গলায় ফাঁসের মতন। ওদিকে মনের ভাব অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। পালাব না, পালাতে চাইও না। তাই, যাকে বলে, ভুজুং-ভাজুং দেওয়া, তাই দিয়ে, ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। ‘এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে।’ জীবন দেখতেই বেরুনো। কিন্তু ছোট অথবা বড়, কোনও সংসার থেকেই তাকে বাদ দেননি, আলাদা করতেও পারেননি। না পারতে পারতেই পেয়েছেন, বিষের মধ্যে অমৃতের স্বাদ। অমৃতের মধ্যেও বিষের। মানুষটার প্রকাশের মাধ্যম ছিল ভাষা আর শব্দ। জীবনের সঙ্গে, সম্পর্কে, যা সম্পৃক্ত তাই সাহিত্য, তাই ছিল তাঁর অবলম্বন উপজীব্য। আহরণ আর শিকার ছিল জীবন থেকে। ঘেরাটোপের সমাজ সংসার বলো, কিংবা সীমাহীন বৃহৎ সংসার বলো – লোকটা ঝাঁপিয়েছে, ডুবেছে, ভেসেছে। চর্চায় বাদ দেয়নি কোনও কিছুকে। জীবনবোধের কী এক দুরন্ত ব্যাপ্তি ছিল লোকটার, কূল ছেড়ে ভেসেছে অকূলে। কখনও স্বনামে, কখনও ছদ্মনামে, কখনও ভিজতে ভিজতে, কখনও রক্তাক্ত হতে হতে কিংবা করতে করতে বিলিয়ে দিয়েছে অমৃত অথবা বিষ। সাহিত্যের ছড়ানো জমির যেখানে, যেটুকুতে প্রবেশাধিকার, সেখানে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন বীজ। কিন্তু ঘুরে ফিরেই সার উচ্চারণ করেছেন, ‘সাহিত্যের থেকে জীবন বড়।’ (গুরুচণ্ডালি দোষ ধরো না এ যদি কিঞ্চিৎতম সাহিত্যপ্রয়াসও হয়, তবু তাও যে জীবনেরই কথা) তাই ছড়ানো বীজে, অমৃত বিষ, যাই থেকে যাক না, জীবনের স্পর্শে তাই হয়ে উঠেছে সৃষ্টি, শিল্প।
গরলে তাঁর অঙ্গ জর-জর, তাই তিনি কালকূট। কিন্তু কার, কোন অমোঘ ভাবনায় নির্দেশে তিনি কালকূট? না, তিনি নিজেও জানেন না। শুধু জানেন, তাঁর নিরন্তর সন্তান অমৃতের। কী সেই অমৃত? স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেননি তারও। পেয়েছিলেন কি? তাঁর হেঁয়ালি উত্তর, যে জানো মন, বুঝহ সন্ধান। এ কথা অবশ্য স্পষ্টই বলেন, খুঁজে ফিরি সেই মানুষে। বহু বিচিত্রের মধ্যে মানুষের থেকে বিচিত্র আর কিছু তিনি দেখেননি। কথার ভাঁজে ভাঁজে ওই হল লোকটার কায়দা। সমাজ, সংসার জীবন, এমনকী বিশ্বসংসারও। কিন্তু থামল এসে বড় দরিয়ার পাড়ে। মানুষ, মানুষ সমুদ্র। কতরকমভাবেই দেখেছেন। দেখতে দেখতে বলেন, সব মানুষের মধ্যে আছে আর একজন। নিজের সম্বন্ধেও সেই এক কথা। একজন সবার, একজন আপনার। চেনা অথচ চেনা নয়। পরস্পর বিরোধিতার ছোঁয়াচ রয়েছে কি কোথাও! জট পাকিয়ে দিয়েছেন। সবার মধ্যে থেকেও যখন তিনি একা, সেই একাকিত্ব কাটাতেই প্রাণ আকুলিবিকুলি – অন্য কোথাও… কোনও অন্য কোথাও? লোকটা হারিয়ে যায় মানুষেরই হাটে। তখন তিনি কার? খাঁচার মধ্যেই অচিন পাখি। কখন আসে, কখন যায়, কখন গায় কে জানে!
মানুষ তিনি। মানুষ নিয়েই জন্মবিভোর। যাপনের পদে পদে আবির্ভাব অনুভব করেছেন। ভেতর থেকে টের পেয়েছেন সব আবির্ভাবের মধ্যমণি হয়ে বসে রয়েছে কোনও না কোনও মানুষ। তাঁর ভাবের আকাশে আর কোনও অপরূপ দর্শন ছায়াপাত ঘটায়নি মানুষ ছাড়া। আর ভাবের প্রকাশে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। কখনও সেই প্রকাশ ব্যবচ্ছেদের নামান্তর, স্বনামের লেখনী তখন এমনকী শানিত তরবারিও। আবার সেই মানুষকেই কখনও ঢুঁড়ে বেড়িয়েছে হা-অমৃত ছদ্মনামের কালকূট। মমতাঞ্চুন মাখা কলমটি তখন ব্যকুল বাঁশরি, অচেনাকে চিনে চিনে নিভৃত প্রাণের সুর-স্বরলিপি এঁকে দিয়েছেন। নগর জীবনের উত্তাপ, আলোক–ঝলক, রোশনাইয়ের মধ্যে যে মানুষকে দেখেছেন হাস্যে-লাস্যে, অশ্রুতে-বেদনায়, সেই মানুষকেই দেখেছেন নদী-পর্বত-অরণ্যের সীমান্তে, হাটে-মাঠে-মেলায়, আপন উদ্ভাসে গোধূলির মতো আলোয়, জ্যোৎস্নার মতো হাসে।
তাঁর কোনও ঈশ্বর-ভগবান-ঠাকুর ছিল কি? জানতেন না। কিন্তু কেউ তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। তাই চলেছিলেন। চলেছিলেন জীবনভর। যখন ছিল না-র পাল্লা সব দিকেই ভারি, একমাত্র বে-আক্কেলে সংসারটি ছাড়া, তখন ফাটা মেঝের ওপরে জলচৌকির ওপর বাঁশ কাগজ রেখে, দোয়াতে ডোবানো কলম দিয়ে লিখতেন। টালির চাল তপ্ত হতো, বর্ষায় জল পেয়ে পিঁপড়ের সার বেরিয়ে আসতো মুখে ডিম-ডিম সাদা নিয়ে। কুট কুট কামড়াতো। তবু মিল কলে কাজ ধরবেন না। লিখবো। বাগদীপাড়ার প্রতিবেশিরা হ্যাক-ছি করেন, এ কোন সৃষ্টিছাড়া! বউ ছেলে খেতে পায় না, মুখ গুঁজে নেকাপড়া! তিনি মুখ ফিরিয়ে হাসেন, মুখ লুকিয়ে কাঁদেন। আর লিখতে লিখতে চলেন, চলতে চলতে লেখেন। খবর পান কুম্ভ মেলার। পূর্ণকুম্ভ।
না, পুণ্যার্জনের আকুতি ছিল না। আসলে বাঁশি বাজছিল লোকটার প্রাণের মধ্যে। আবেগের কথা ছেড়ে দিয়েও ভাবি, কী সাহস! মাটির ঘর টালির চাল, পরিবার আর চার চারটি কচিমুখ মহাপ্রাণী নিয়ে সংসার। রইল পড়ে। পড়ে থাকতে পারল, কেননা বামনী সর্বংসহা। মুখে হাসি, চোখে জল, রওনা করিয়ে দিয়ে ছেঁড়া শাড়ির আঁচলে গিঁট বেঁধে রাখলেন। ফিরে এসে খোলা হবে। ভাবা যায়, সে কোন নারী!
লোকটার পালে লেগেছে উদ্দাম হাওয়ার টান, মজতে চলল মানব সঙ্গমের ভিয়েনে, মজেও গেল। কিন্তু সঙ্গমের দেশোয়ালি লক্ষ লক্ষের ভিড়ে কী এক গভীর রসায়ন ঘটে যেতে লাগল। ‘ভোটদর্পণ’ প্রারম্ভিক লেখার জন্য যে ছদ্মনাম কালকূট, আগামীকালের জন্য পালটে গেল সেই ছদ্মনাম নেওয়ার উদ্দেশ্য। বিশ্বলোকের সাড়া পেয়ে লোকটা ফিরে এলো। আবেগ আর অস্থিরতার তীব্র দ্বন্দ্ব, নিরন্তর টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত। মানুষকে জানার জন্যই তো ছুটে বেড়ানো… তাহলেও, তাহলেও দেখতে দেখতে, দেখার পরেও, কী যে অতৃপ্তি কাজে!
দিন যায়। দেখা হল শ্বেতাঙ্গিনী বিদুষী বয়স্কার সঙ্গে। প্রশ্নটা থমকে দিল। কেন শেখো? ভুরু কুঁচকে উঠল উদ্ধত সত্ত্বার জীবন প্রেমিক বহুচর লেখকের। দ্বন্দ্বের মধ্যেও সপ্রতিভ উত্তর, মানুষকে জানার জন্য। বিদুষীর মায়ামুখে মোলায়েম হাসি। খাঁটি বঙ্গ উচ্চারণে চারিয়ে দিলেন ক’টি শব্দ। নিজেকে জানার জন্য লেখো না?
মানুষটার চরম উৎকণ্ঠার সঙ্গেই মিশেছিল এক নিথর নির্জনতার বোধ। ভাবনার আকাশ জুড়ে ছিল নিরন্তর সৃষ্টির প্রয়াস এবং তা দুই ধারায়। উভয় ধারাতেই বারবার বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর শিল্পীসত্ত্বা। কেননা দৃষ্টিভঙ্গি আর আপন সৃষ্টির নির্মিতিগত শৈথিল্য নিয়ে, এমনকী কালকূট ধারাতেও তিনি ছিলেন নিতান্ত খুঁতখুঁতে। কিন্তু ধারা রুদ্ধ হয়নি। বাঁশির ডাক শুনে যে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিল, কূল নিয়ে সে ভাবে না। শুধু অকূলে ঠিকানাগুলো হাতড়াচ্ছিল বারবার। অরণ্য – পর্বত – নগর – সমুদ্র ঘুরতে ঘুরতেও বাইরে ছেড়ে ভিতরে অন্বেষণের আকুতি টের পাচ্ছি যেন। তার মধ্যে ডানা ঝাপটানো প্রাণপাখি, কাঁধের ঝোলা সাময়িক স্খলিত। সাবধানতা, সতর্কতা বেড়ি এবার চতুর্দিকে, নিষেধের মোলায়েম শাসন। কালকূট হাসেন, তাঁর সেই ভুবনজয়ী হাসি। আর হাসতে হাসতে বাঁক নেন বাহির থেকে অন্তরে। পুরাণ-ইতিহাসে চলতে থাকে তাঁর মানসভ্রমণ, অতীতের অন্ধকার থেকে চরিত্রদের তুলে নিয়ে আসেন কালের প্রেমময়, উচ্ছলতায়। বারবারই তিনি নির্বাচন করেন এমন চরিত্রদের, কি স্বনামে, কি ছদ্মনামে, যাঁরা অতি দুঃসময়েও বিশ্বাস হারান না। হাজার মানসিক-শারীরিক কষ্ট আর নির্যাতন সত্ত্বেও নিরন্তর উত্তীর্ণ হবার চেষ্টা করেন।
কে ঠেকায় তাঁকে! ক্লান্তিহীন বিচরণে অনিবার্য দুঃসাহসী লোকটা। যেমন জীবনে, তেমনি সৃষ্টিতে বরাবর বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে টুপ টুপ ডুব দিয়ে উঠেছে। দৃষ্টিতে সুদূরের পিয়াসী, সৃষ্টিতে নিষ্পাপ তিনি। ইতিহাস-পুরাণের কাল থেকে কালান্তরে পরিক্রমা করতে করতেও টের পান কোন এক আবছায়ায় যেন তাঁর দুই সত্ত্বাই মেশামিশি হয়ে যাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। টানাপোড়েনের মাঝখানে দাঁড়িয়েও এক সংহত শিল্পীসুলভ অবিচলতায় স্বাক্ষরিত হয়ে যান মানুষটা। আর ফিরে দেখেন না। এক ধ্যানের মধ্যে ডুবে যান স্বনাম-ছদ্মনামের মেধা-মনন মন্ত্র একত্রিত করে। কী জানি কোন বাঁশির সুরে, সে কোন অচিন পাখি গেয়ে যায়…!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
বাঁশির সুরটি ছুঁয়ে যায় কালকূট পাঠকদের মনে। এই লেখাও এক মানস ভ্রমণ। শ্রদ্ধা জানাই।