(২০২০ বই মেলায় আজ পাঁচ ভাই পান্ডব এসেছে সাধারণ সাজপোশাক)যুধিষ্ঠির বিহ্বল গলায় বললেন:চারিদিকে ছড়িয়ে আছে বই আর বই। এমন মেলা কখনো দেখি নি। আহা। জীবন ধন্য গো ধন্য।অর্জুন ভুরু কুঁচকে বলল:শুনুন ধর্ম দাদা, মানুষ এত পড়াশুনো করলে, যুদ্ধ বিগ্রহ ছেড়ে দেবে তো! এই আপনাকেই দেখুন না, ওতো বেদ পুরাণ পড়তেন বলেই না, কেবল সন্ধি করতে চাইতেন!যুধিষ্ঠির রেগে উঠে বলেন:তোমার মুন্ডু। সারাক্ষণ মহিলা পরিবৃত হয়ে থাকলে মাথায় আর ঢুকবে কী! বই পড়লে জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। আর জ্ঞান বৃদ্ধি হলে লোক বোঝে যুদ্ধ করা একটা নির্বোধের মত কাজ।: সে তো বটেই ধর্ম দাদা। তবে কি না, ওই নির্বোধ কাজের ফলেই আপনার সিংহাসন প্রাপ্তি। সে টি ভুলে গেলে চলবে?ভীম এতক্ষণ ঘুরে ফিরে মেলা দেখছিল। খাবার দাবার প্রচুর আছে দেখে, পুলকে গুণ গুণ করছিল। যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে খ্যাঁক করে তেড়ে উঠে বলল: থামুন বড়দা। অমন জ্ঞানের মুখে আগুন। একঘর লোকের মধ্যে, দ্রৌপদীর বস্ত্র খুলে ফেলল, উনি জ্ঞান দিয়ে গেলেন! বই পড়ার প্রচুর কুফল আছে। সেই দিন আমি বুঝেছি।।: আর তোমার মত সারাদিন খাই খাই করলেই মোক্ষ মিলবে? বুঝবে যখন সুগার হবে। প্রেশার হবে।: ভীমসেনের সুগার? প্রেশার? বড়দা, শুনে রাখুন, সারা মহাভারতে আপনার ফ্যান ফলোয়ার সবচেয়ে কম। তার উপর যদি আপনি ভীমসেন নিয়ে এই সব বলেন… !অর্জুন তাড়াতাড়ি বলে:ভীম দাদা, আপনি বরং মেলায় ঘুরে ঘুরে দেখুন। অনেক খাবার দাবার আছে।: আর তুমি? তুমি কি করবে? মাঠ ভর্তি সুন্দরী মহিলা। তুমি লক্বা পায়রার মত তাদের পিছনে ঘুরবে না কি?যুধিষ্ঠির দেখল এসব কথায় কাজ নেই। তিনি গুটি গুটি পায়ে বড় দেখে একটা বইয়ের স্টলের ভিতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন:এই যে ভাই, দর্শন পুরাণ বেদের ব্যাখ্যা এসবের বই হবে?কাউন্টারে লোক বেজায় ব্যস্ত। তড়িঘড়ি বলে::থ্রিলার আছে।: থ্রিলার? সে কি বস্তু বাপু?: হত্যা রহস্য মার্ডার ভূত। পরকীয়া… যা চাইবেন।যুধিষ্ঠির অবাক হয় বললেন:: হত্যা! ভূত! পরকীয়া! ও ভাই। বলি, সে গুলো মোটেই ভালো কথা না বাপু। বিপদের খবর বইতে পড়ে হবে কি? ওতো চোখের সামনে ঘটছে ক্রমাগত।বিক্রেতা বিরক্ত হয়ে বলল::এখন লোক ওই সব পড়ে। উত্তেজনা চায়। পকেট খালি করে, বেদ পুরাণ কে পড়বে? বাঙালি কি ক্ষ্যাপা?যুধিষ্ঠির মিন মিন করে বললেন:মানুষ কি চায়?: উত্তেজনা চায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে চারটে খুন। তান্ত্রিক। গলা কাটা লোকের হাসি… হিহিহিহি… এসব না কিনে, কবে রাম রাজা হলেন, কবে কোন মুনি কি বলিয়াছিলেন…ছ্যা ছ্যা।যুধিষ্ঠির খুব ভয় পেলেন। ছোকরা বলে কি! এত কান্ড করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বন্ধ করা হল, আর এখন কি না যুদ্ধ বিগ্রহ মারামারি ঘরে ঢোকাচ্ছে? কি কান্ড !তিনি মনের দুঃখে স্টল ছেড়ে বাইরে বেরোতে যাবেন, ছোকরা ডেকে বলে:ও দাদু, শাস্ত্রের বই আছে একখান।: দাদু? যাক গে যাক! কি বই বাবা?: কাম শাস্ত্র। নেবেন তো নিন। পয়সা উশুল।*অর্জুন আর নকুল এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কতগুলি সুন্দরী মহিলাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। অর্জুন বলল:নকুল। আয় একটু ঝাড়ি মারি। দ্যাখ, কত সুন্দরী ।: এরা কিন্তু মহা বিদ্যেবতী। পারবে সামলাতে? পড়াশুনোর ধার পাশ মাড়াও নি কোনোদিন!অর্জুন বললে:: ভুলে গেলি? আমার বউগুলো সবকটা লেখাপড়ায় ভালো ছিল। দ্রৌপদী এমন আইনের প্যাঁচ মারত রে ভাই, সে আর কি বলব? আর ওই চিতু… চিত্রাঙ্গদা! বিদ্যের চোটে মুখ সবসময় গোমড়া। একমাত্র সুভদ্রা একটু সরল সোজা ছিল।নকুল মাথা নেড়ে বলল:: তুমি যাও সেজদা। মহিলায় আমার রুচি নেই। আমি বরং ওই চশমা পরা কবির কাছে যাই। কি মিষ্টি কচি লাউ ফুলের মত চেহারা!অর্জুন লম্বা লম্বা পা ফেলে মহিলা দলের একটু দূরে দাঁড়িয়ে পোজ দিল। আহা! কি অপূর্ব সাজসজ্জা করা রমণী। শাড়ির কি বা বাহার! একবার আলাপ হলে কি ভালই না হত।বেশিক্ষণ ভাবতে হল না। এক সুন্দরী মহিলা কবি তার কাছে ঘেঁসে দাঁড়াল। অর্জুন ধুকপুক বুকে ভাবল, ওরে বাবা। এ দেখি মেঘ না চাইতে জল।উফফ। এই সব সংকট সময়ে কৃষ্ণ কেন কাছে থাকে না? তবু যথাসম্ভব স্মার্ট হতে বলল;বলুন দেবী। আমি কি করতে পারি?খোলা চুলের ঝাপটা দিয়ে মেয়েটা বলল:আপনি কবিতা পড়েন?কবিতা! অর্জুন ঢোঁক গিলে বলল:মানে কবিতা পড়া মানে ইয়ে আর কি, হ্যা হ্যা …!( কি বিপদে পড়া গেল! কলকাতার পুরুষগুলো কি রে বাবা। এখানে, রমণী মন হরণ করতে গেলে লক্ষ্যভেদ করলে চলবে না যে! কবিতা? ওরে বাবা)সুন্দরী লক্ষ্য করল না অর্জুনের ভাবান্তর। সে বলল ::শুনবে কবিতা?শোনো না গো। কেউ শুনছে না গো। তোমার নাম কি?: অর্জুন।: ও বাবা। তাহলে আমি দ্রৌপদী।: না না। দ্রৌপদী কেন? সে বড় কটকট করে। তুমি তোমার মতই থাকো।: শোনো না গো অর্জুন, তুমি আমার বই কিনবে?: কেন কিনব না? কেন কিনব না? কই দেখি তোমার বই? কি নাম!কবিনী চোখ নাচিয়ে, আঁচল উড়িয়ে বলল::নীল ভুতুড়ে চোখের জল আর কলা বনের সোন্দর বাঘ। মাত্তর একশ টাকা। পি লি জ।সহদেব ওদিকে পৌঁছে গেছে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন। সেখানে ভিড়ের চোটে তার প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড়। ও মা গো। এত লোক বই পড়ে? কোনোমতে একটু জায়গা করে দাঁড়াতেই কে যেন এক গোছা ম্যাগাজিন হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল::এগুলো নিয়ে এখানে একটু দাঁড়ান তো।তোতলা হয়ে সহদেব বলল;: আমি ? আমি কেন? কিভাবে?: আরে মশাই টেবিল পাইনি। ম্যাগাজিন ছেপে এসে গেছে। একটু হেল্প করুন না। সাহিত্যের খাতিরে এটুকু করবেন না?: আমি তো টেবিল হতে পারব না দাদা।মরিয়া হলে সহদেব বলল।সম্পাদক চটে গিয়ে বলল:আরে ধুর মশাই।আপনাকে টেবিল হতে কে বলেছে? আপনি এখানে মাটিতে বসে এগুলো পাহারা দিন। আমি আসছি।সহদেব অবাক। লোক টাকা ধন রত্নর জন্যে লড়াই করে। আর এখানে না খেয়ে না শুয়ে এত লোক লড়াই করছে বইয়ের জন্য? সে কেমন অবাক হয় গেল।হঠাৎ আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হল। চারিদিকে হাহাকার। সকলে দৌড়াদৌড়ি করে প্রাণপণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে বই। সহদেব দেখল ভীম দাদা একটা বিরাট ত্রিপল টেনে ঢেকে দিচ্ছে সব। নকুল রোগা পটকা কবিকে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে নিরাপদ স্থানে। অর্জুন এক হাতে অনেক বই আর আর এক হাতে কতগুলো মহিলা নিয়ে দৌড়চ্ছে। সহদেব হাতের ম্যাজিগাজিন গুলো জাপটে ধরল বুকের ভিতর। মনে মনে বলল:যুদ্ধ বড় না বই? যুদ্ধ প্রাণ নেয়। আর এখানে মানুষ বই বাঁচাতে চেনা অচেনা ভুলে গেছে। বৃথাই যুদ্ধ করে জীবন নষ্ট করলাম। তার চাইতে বই পড়লে কাজ দিত। ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন
অসম্ভব রকমের সুন্দর রম্যরচনা জয়তী! খুব ভালো লেগেছে! তোমার রসবোধ প্রশংসনীয়! লেখার এমনই গুণ যে, তুমি “কি” আর “কী” নিয়ে প্রায়ই গুবলেট করলেও তা নিয়ে একটাও বিরূপ মন্তব্য করব না! এমনভাবেই লিখে যাও। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
দুর্দান্ত এক রম্য রচনা। ভেতরে রসবোধ না থাকলে এমন রচনা লেখা যায় না। তবে, মনটা খুতখুত করছে… কৃষ্ণ বেচারা মেলায় আসতে পারলো না! দেরী করে হলেও আসতে পারতো…
এখানেই থেমে যেও না…৷ প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিলে। মনে থাকে যেন
দারুণ দারুণ ! কি সরল সুন্দর লেখা । মন ছুঁয়ে গেল। এই জন্য সবাই তোর লেখা পছন্দ করে । তুই যেমন মিষ্টি , তোর লেখা তেমনি মিষ্টি ।
❤️❤️❤️❤️❤️
এরকম লেখা পড়লে চিত্তশুদ্ধি হয়। কি অসাধারণ! নেহাত রম্য তো নয়, রীতিমতো শিক্ষণীয়। শুধু একটু মোড়ক খুলে ভাবতে হবে। আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও ভালোবাসা জানালাম।