রম্যরচনা
মানস দে

নামেই গব্বর, স্বভাবে জব্বর ভীতু। পাড়ার রুগ্ন বিড়ালটাও ওর সামনে নিজেকে চিতাবাঘ ভাবে। গব্বর সুলভ চেহারার মধ্যে একটা ভীতু গোবেচারা গবা কিন্তু জাঁকিয়ে বসে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তবে বেশ ভালোমানুষ।
তাই পাড়ায় যখন স্পোর্টসের আসর বসল, মিউজিক্যাল চেয়ারে গান বাজানোর জন্যে উপযুক্ত লোক ঠিক হলো গব্বর। কারো বোন, কারো বৌ, কারো পিসি মিউজিক্যাল চেয়ারে নাম দিয়েছে কিন্তু গব্বরের বাড়ির কেউ নেই। গব্বর সেই দায়িত্ব পেয়ে বেশ গম্ভীর। গুরুদায়িত্ব। গব্বরের ঠিক পাশের বাড়িতে থাকে বাসন্তী। গব্বরের ডাকাবুকো চেহারার মধ্যে কোথাও যে একটা প্রেমিক গুপ্তধনের মতো লুকিয়ে আছে, তাকে শুধু আবিষ্কার করেছিল বাসন্তী। দুই বাড়ির দুই ছাদে গব্বর ও বাসন্তী সবাইয়ের নজর এড়িয়ে যেন শোলের অমিতাভ-জয়া। সেই গব্বর এমন জায়গায় গানগুলো থামাল যে বাসন্তী একদম ফার্স্ট। বদলে প্রথমবার বাসন্তী একটা অর্থপূর্ণ হাসি হেসে গব্বরকে ‘থ্যাংক ইউ’ বলেছিল।
গব্বরের সাহসের ওপর বাসন্তী ভরসা করতে পারেনি। গব্বরকে নিজেই প্রপোজ করেছিল। গব্বরের ভীতু হৃৎপিন্ডটা তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছিল। বাসন্তী বলেছিল – “জীবনে শুধু একবার সাহস করে আমার বাবাকে বিয়ের কথা বলো।” ঘর্মাক্ত গব্বর কোনরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলেছিল – “না না এতে ভয়ের কি আছে? আমি কি ভীতু নাকি?”
তারপর সত্যি একদিন হৃৎপিণ্ডে সাহস পুরে গব্বর বাসন্তীর বাবা, গোবর্দ্ধনের কাছে বাসন্তীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সেই শুনে গোবর্দ্ধনের কী অট্টহাসি! পড়ে যাবার ভান করে বলেছিল – “তোর মতো ভীতুকে কে মেয়ে দেবে?” গব্বর মাথা নিচু করে চলে এসেছিল।
তারপর একদিন সন্ধ্যেবেলায় গব্বর দেখে বাসন্তীর বাড়ির ছাদে কে যেন পাইপ বেয়ে উঠছে। গব্বর ‘চোর চোর’ বলে বাসন্তীর বাড়ির দরজায় ধাক্কা মারতে থাকে। গোবর্ধন দরজা খুললে বলে – “আপনাদের ছাদের ওপরে চোর।“ ছাদে যেতে গোবর্দ্ধন যখন ভয় পাচ্ছে তখন গব্বর বীরের মতো বলে – “আমি যাচ্ছি” বলে ছাদে উঠে দুজনকে কলার ধরে নিচে নামিয়ে আনে, যেন রজনীকান্ত। নিচে তখন অনেক লোক। চোরের জন্যে নয়। গব্বরের জন্যে। গব্বর নাকি একা হাতে চোর ধরেছে। তারপর “এ আবার এমন কি” মুখ করে গোবর্দ্ধনের দিকে সচেতন ভাবে দৃষ্টি এড়িয়ে বেরিয়ে যায় গব্বর। গোবর্দ্ধন যেন থেকেও নেই। সাইকোলোজিক্যাল গেম। এরপর গোবর্দ্ধন গব্বরের সঙ্গে মেয়ের বিয়েতে অরাজি না হলেও গব্বর নাকি সুযোগ পেয়ে হবু শ্বশুর গোবর্দ্ধনের কাছে হেব্বি ভাও নেওয়া শুরু করে। বিয়েতে রাজি না হওয়ার ভান করতে থাকে। এতটাই ভাও নিয়েছিল যে গোবর্দ্ধন বেঁকে বসে। শেষমেশ বাসন্তীর কাছে কান্নাকাটি করে গব্বর বলেছিল – “বুঝতে পারিনি, একটু বেশি করে ফেলেছি। তোমার বাবাকে আরেকবার আমার কাছে পাঠাও। আমি রাজি হয়ে যাব।” বাসন্তীও খুব ভাও নিয়ে বলেছিল – “মনে রেখ, এই শেষবার।”
টোপর পরে গব্বর তখন বর। বিয়ের অনুষ্ঠান তখনো বাকি। অন্যদিকে লোকজন ভূরিভোজে ব্যস্ত। হঠাৎ পংক্তি থেকে ‘চোর চোর’ চিৎকার। সবাই ছুটে আসে। ছুটে আসে গব্বরও। দেখে দুজন লোককে ঘিরে জনতার চিৎকার, চড়-থাপ্পড়। পরে জানা গেল, যে দুজন লোক বাসন্তীদের বাড়িতে চুরি করতে এসেছিল তারাই নাকি রবাহূত হয়ে বিয়েবাড়ি খেতে এসেছে ভদ্রপোশাকে। মুখ নিচু করে বেশ খেয়ে যাচ্ছিল, নিচু মুখ একটু উঁচু হয়েছিল শুধু কয়েক পিস খাসি মাংসের লোভে। ব্যস। তাতেই ধরা পড়ে গেল। এই মুখ তো সেই চোরের মুখ! গব্বর যাকে ধরে এনেছিল বাসন্তীদের বাড়ি থেকে। প্রথমে স্বীকার করতে চায়নি। তারপর টেবিলের তলা দিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল।
হঠাৎ করে গর্জন করে গব্বর- “ওদের ছেড়ে দাও। ওদের কোন দোষ নেই। চোর ওরা নয়, চোর আমি। আমিই প্ল্যান করে ওদের চুরির কথা বলেছিলাম বাসন্তীর বাড়িতে। তারপর আমিই ওদেরকে প্ল্যানমাফিক ধরে নিয়ে আসি। যাতে আমার ভীতু বদনাম ঘোচে বাসন্তীর বাবার কাছে। যাতে উনি আমাদের বিয়েতে মত দেন।” এই শুনে গোবর্দ্ধনের কী আস্ফালন! বলেন – “ছিঃ! জালিয়াত একটা। চোর। এই বিয়ে আর হবে না।” টোপর নামিয়ে রেখে গব্বর চলে যেতে উদ্যত হলে বাসন্তী প্রতিবাদ করে – “জানা আছে কার কত সাহস। কটা লোকের এমন সৎ সাহস আছে সবাইয়ের সামনে এমনি করে নিজের দোষ স্বীকার করে? এটাই কি যথেষ্ট নয়?” বাসন্তীর ঠাকুমা বলেন – “গোবরা, তুই বাসন্তীর বাপ হতে পারিস। আমিও কিন্তু তোর মা। এমনি উচ্চিংড়ের মতো লাফাস না। তোর সাহসের নমুনা সবার সামনে পেশ করব একবার? “গোবর্দ্ধন যেন একটু দমে যায় – গরম ফুলকো লুচি থেকে ঠান্ডা হয়ে চুপসে যাওয়া লুচির মতো। বলে – “তুমি আবার এর মধ্যে এলে কেন?” ঠাকুমা বলেন – “শোন ভালোবাসতেও সাহস লাগে। তাছাড়া ভালোবাসায় এমনি একটু আধটু হয়। আমরা কেউ বর্বর নই। গব্বরের মত জব্বর বর পেলে বাসন্তীও বর্তে যাবে।” তারপর গব্বরের দিকে তাকিয়ে বলেন – “নে গব্বর, বাসন্তীর হাতটা ধর।”