নাঃ,ওই কথাটা অত সহজে বলতে পারতেন না ষোড়শ শতাব্দীর ইংরেজ নাট্যকার (বা বলাতে পারতেন না তাঁর নাটকের রোম্যান্টিক চরিত্রের মুখ দিয়ে), যদি আজকের যুগে জন্মাতেন। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় গেলেই দেখতেন ট্যুইটারের কল্যাণে কাটছাঁট হতে হতে তাঁর নিজের নামটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। Sexpr। আর এই বেয়াড়া সংক্ষিপ্তকরণ দেখে যদি তুমি রেগে যাও তাহলে U R 2 old fshnd। অর্থাৎ তুমি বড় সেকেলে। আমাদের জোড়াসাঁকোর নোবেল লরিয়েট অবশ্য নামের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার ভুল করেননি। ‘শেষের কবিতায়’ শিলংয়ের বাড়ীতে অমিত রায়ের সঙ্গে লাবণ্য দত্তের প্রথম সাক্ষাতে নাম নিয়ে তাদের মধ্যে এক উপভোগ্য কথোপকথন রেখেছেন, যার শেষে অমিত হয়ে গেছে “মিতা” আর লাবণ্য “বন্যা”। এমনিতেই পৃথিবীর যেসব ভাষায় বা সংস্কৃতিতে মানুষের লম্বাচওড়া নামকরণের প্রবণতা আছে, দৈনন্দিন কথ্যভাষায় সেসব নামের একটা ব্যবহারিক সরলীকরণ ঘটে। তারা আপনিই ছোট হয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে। যেমন বীরভদ্রণ বালদন্ডায়ুথপাণি হয়ে যায় বীরু, বা সুপাচাই ক্ষত্তীয়কর্নারুণ হয়ে যায় সুপি। প্রথম উদাহরণটা তেলুগু ভাষা থেকে আর দ্বিতীয়টা থাই। তবে দক্ষিণ ভারত বা থাইল্যান্ডের মতো না হলেও বাংলা ভাষাতে লম্বা নাম একেবারে বিরল নয়। ছেলেবেলাতেই শিশুসাহিত্য পাঠের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার আর সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র নামদুটোর সঙ্গে। পরে অরুন্ধতী হোমচৌধুরীর গান শুনতে শুনতে একদিন খেয়াল হল ওঁর নামটাও কম বড় নয়। ইংরেজীতে লিখতে গেলে লাগে ২২টা লেটার। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মনে আছে আমাদের কলেজের এক প্রোফেসরের না। পদ্মনাভন শিবগনেশন নারায়ণস্বামী ভীমাপ্রসাদ রাও। আমরা বলতাম এ -টু-জেড রাও। ভাবতাম উনি ব্যাংকে টাকা তোলার সময় চেকে সই করেন কী করে? জায়গায় কুলোয়?
এই বেঢপ নামের সমস্যা থেকে অব্যহতি পাবার দুটো রাস্তা। হয় নামের বেশ খানিকটা ছেঁটে ফেলে শুধু অংশবিশেষ ব্যবহার করা, অথবা নামের পদবী ছাড়া অন্য শব্দগুলোর আদ্যক্ষর ব্যবহার করা। দুটোতেই অবশ্য বিপত্তি। না, পুরোনো আমলের সেই মজাদার হিন্দী সিনেমাটার মতো বিপত্তি নয়,যেখানে প্রাচীনপন্থী আদর্শবাদী শিল্পপতির সামনে তাঁর ছোকরা কর্মচারী নিজের নাম লক্ষ্মণপ্রসাদ দশরথপ্রসাদ শর্মা না বলে “লখি” বললে তার গান শেখানোর চাকরি চলে যাবে। অন্যরকম বিপত্তি। যেমন ধরা যাক, পার্থসারথি, পার্থপ্রতিম, পার্থজিৎ আর পার্থজ্যোতি — সবাইকেই যদি ‘পার্থ’ বলে ডাকি, কে কোনটা বুঝব কী করে? একই প্রশ্ন ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রনীল, ইন্দ্রনাথ আর ইন্দ্রমোহনকে ঘিরেও। তাছাড়া মানেটাও তো বদলে যায়। পার্থ আর পার্থসারথী কি এক? তাহলে তো মহাভারতটাই নতুন করে লিখতে হয়। ইন্দ্র আর ইন্দ্রজিতে গুলিয়ে ফেললে আবার রামায়ণ নিয়ে ঝঞ্ঝাটে পড়তে হবে। এ যেন সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপানের’ সেই জল চাইতে গিয়ে জলপাই বা আলু চাইতে গিয়ে আলুবখরা চাওয়ার মতো। তার চেয়ে বোধহয় দুনম্বর উপায়টাই ভাল — আদ্যক্ষর ব্যবহার করা। কিন্তু সেখানেও যে মুশকিল। করো নামের আদ্যক্ষর যদি হয় K K Roy, তিনি কিরণকিঙ্কর রায় না ক্যাবলাকান্ত রায় — তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। ফলে প্রথম আলাপে তাঁকে কী বলে ডাকব সেটা মনস্থির করা কঠিন। “কে কে বাবু” বলে তো আর ডাকা যায়না। পুরোনো স্টাইলে ‘রায়মশাই’ বা ‘রায়বাবু’ বলাটাও আজকালকার যুগে অচল। সুতরাং একটাই রাস্তা — ‘মিস্টার রায়’। কিন্তু ধরুন যদি তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ না হয়ে চিঠিতে বা ইমেলে প্রথম যোগাযোগ হয়? কোনোদিন চোখেও দেখেননি, ছবিও দেখেননি। এবার কী করবেন? আন্দাজে ‘মিস্টার রায়’ বলেই সম্বোধন করলেন হয়তো, আর সেই চিঠি বা ইমেল পেয়ে প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সম্পাদিকা কৃষ্ণকলি রায় তো চটে লাল। এটা মোটেই বিরল ঘটনা নয়, বাস্তব জীবনে এরকম হয়েই থাকে। এই সূত্রে পুরোনো দিনের একটা বহুলপ্রচলিত চুটকি মনে পড়ছে, যা কিছুটা কষ্টকল্পিত হলেও তার অন্তর্নিহিত বার্তাটি খুবই প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমবঙ্গের জনৈক মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর মাতৃভাষাপ্রেম একটু বেশীই প্রখর, ঠিক করলেন রাজ্যের সব সরকারী কাজকর্ম বাংলাতেই হবে। বিভিন্ন সরকারী নথিপত্রে আর বিজ্ঞপ্তিতে অফিসার ও কর্মচারীরা বাংলাতেই তাঁদের নাম সই করবেন বা আদ্যক্ষর (ইনিশিয়াল) দেবেন। যেমন, কোনো অফিসারের নাম অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় হলে তিনি লিখবেন অ. মু.। এখন ঘটনাচক্রে একটা সরকারী নথি তিন দপ্তরের তিন অফিসারের হাত ঘুরে মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে পৌঁছেছে, যাঁদের নাম যথাক্রমে তুষার মিত্র, শান্তনু লাহিড়ী আর পাঁচুগোপাল ঠাকুর। এবং তাঁরা ঠিক সেই ক্রমানুযায়ী তার তলায় ইনিশিয়াল দিয়েছেন। ফলে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যখন সেটা হাতে পেলেন, দেখলেন তার তলায় লেখা —
যাইহোক, গল্প গল্পই, আর বাস্তব নানা বিচিত্র জটিলতায় ভরা। যেমন জীবিকার প্রয়োজনে বা যুদ্ধ-দাঙ্গা-অশান্তির দরুণ ছিন্নমূল হয়ে এক দেশের মানুষ অন্য দেশে গিয়ে থাকে। আর ভিন্ন ভিন্ন দেশ বা সংস্কৃতি থেকে আসা মানুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এবং এই দুটো ক্ষেত্রেই নামের ওপর তার প্রভাব পড়ে। যেমন আমেরিকায় বা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোয় পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যেসব অভিবাসী থাকেন, তাঁদের আসল নামের বানান আর উচ্চারণ ইংরেজী, ফরাসী বা জার্মান ভাষায় এতই খটোমটো যে স্থানীয় মানুষের সুবিধার জন্য অনেকসময় তাঁদের একটা স্থানীয় নাম ধারণ করতে হয়। শুধু তাই নয়, তাঁরা চেষ্টা করেন তাঁদের আসল আর নকল নামের মধ্যে যতটা সম্ভব ধ্বনিগত সাদৃশ্য রাখতে। যেমন, ঝেনজং ওয়াং নিজেকে পরিচয় দেন Jason বলে বা শিয়াও-লি পেং হয়ে যান Charlie। তবে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের নাম রাখার সময় আর কোনো ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে একেবারে পাশ্চাত্য স্টাইলের নামই বাছেন তাঁরা। আর বিয়ের ক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়েই যেহেতু স্ত্রীর পদবী পরিবর্তনের রীতি, তাই দুই দেশ থেকে আসা দুজন মানুষ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলে স্ত্রীর নাম আর পদবী হয় দুটো ভিন্ন ভাষার। কিন্তু আজকাল আবার ফ্যাশন বিয়ের পরেও স্ত্রীদের পুরোনো পদবী ধরে রাখা, এবং নতুন পদবীর সঙ্গে সেটাকে জুড়ে একটা হাইব্রিড তৈরী করা। ফলে পদবীগুলো একেকটা যা দাঁড়ায়, তার পাশে নামগুলোকে মনে হয় যেন ট্রাকের পাশে মিনি-স্কুটার। জুলি ম্যাকডোনাল্ড-হেটমানস্পার্গার, মীরা বালসুব্রাহ্মণিয়াম-উইলিয়ামস, হেরা পাপানডোনাটোস-রডরিগেজ — এইরকম আর কী। সুতরাং পশ্চিমী দুনিয়ার যেসব দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা বেশী, সেখানে নাম-টামগুলো সব এমন জগাখিচুড়ি পাকানো যে সেখানকার লোকে ভাবতেই পারেনা এমনও অনেক দেশ আছে যেখানে মানুষের নাম শুনেই বলে দেওয়া যায় তাদের ভৌগোলিক অবস্থান। যেমন বিজলানি, লাখানি, আসুদানি, মীরচন্দানি — এইসব পদবীধারীরা সিন্ধের লোক। ইনজ্যাসুলিয়ান, কার্দাশিয়ান, নালবান্দিয়ান, আর্সলানিয়ান ইত্যাদির থাকে আর্মেনিয়ায় (অবশ্য সেখানে বাগরাটুনি, আরশাকুনি, আর্টসরুনি — এইসব ‘উনি’দের সংখ্যাও কম নয়)। আবার পেত্রোভিচ, ইভানোভিচ, সলতিচ কিংবা ইনিয়াতকিন, সাখারিন, কোকোরিন নিঃসন্দেহে রাশিয়া বা তৎসংলগ্ন কোনো স্লাভিক ভাষাভাষী দেশের বাসিন্দা। নামের মধ্যে ‘van’ আর ‘ij’ থাকলে সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবে ডাচ (অর্থাৎ হল্যান্ডের) আর ‘poulos’ দিয়ে পদবী শেষ হলে সেটা গ্রীক। আমাদের ভারতেও নামের মধ্যে সিংহ থাকলে পঞ্চনদের তীরে বাড়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, পদবীর শেষে ‘কার’ মানেই ”ইয়ে হ্যায় বোম্বে মেরি জান” (বা অন্ততঃ মহারাষ্ট্রের), ‘রাও’ হলেই আগে অন্ধ্রপ্রদেশ বা তেলঙ্গানার কথা মনে পড়তে বাধ্য। আর চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়-দের কথা তো বলাই বাহুল্য।
এতক্ষণ যা বলা হলো সবই ভালোনাম বা শুভনাম নিয়ে। এবার আসা যাক তার ছোটভাই অর্থাৎ ডাকনামের (nickname) কথায়। তার দুই স্যাঙাত ছদ্মনাম (pseudonym বা alias) আর আদ্যক্ষরনামের (acronym) ব্যাপারস্যাপারও কম মজাদার নয়। আমাদের মাতৃভাষায় ভালনামের সঙ্গে ডাকনামের কোনো বাঁধাধরা সম্পর্ক নেই। অর্চিষ্মান, বিকাশকলি বা নবপল্লবের মতো বাহারী নামধারীদের হয়তো বাড়ীতে ডাকা হয় বাবাই, ভুলু বা খোকন বলে। সংঘমিত্রা বা প্রজ্ঞাপারমিতা তাদের পাড়ার বন্ধুদের কাছে হয়ত তিতলি বা বুলবুল। কিন্তু পাশ্চাত্যের অনেক দেশেই ডাকনামগুলো তৈরী হয় ভালনামের সঙ্গে মিলিয়ে। রিচার্ডকে ডাকা হয় ডিক বা রিচ বলে, উইলিয়াম অবধারিতভাবে বিল, আর্থারের ডাকনাম আর্ট আর জেমস হলো জিম বা জিমি। এতে বৈচিত্র্য কমে বটে, কিন্তু স্মরণশক্তির ওপর চাপও কমে। টুথপেস্ট কিনলে টুথব্রাশ ফ্রি পাওয়ার মতোই ভালনামটা মনে রাখতে পারলে ডাকনামের জন্য আলাদা করে ‘মেমোরি’ খরচ করতে হয়না (এবং উল্টোটাও)। তবে ডাকনাম ভুলতে না দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের প্রতিবেশী পদ্মাপারের দেশটির জুড়ি মেলা ভার। অনেক বাংলাদেশীই নিজেদের নাম বলার বা লেখার সময় তাঁদের ইসলামিক শুভনামের সঙ্গে ডাকনামটাও জুড়ে দেন। যেমন আতাহার হোসেন বাবুল বা মোহাম্মদ আশরাফুল ছোটন। এপার বাংলায় সেরকম কোনো রীতি না থাকলেও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরই পরিচিতি মূলতঃ তাঁদের ডাকনামে। যেমন ফুটবলার বদ্রু ব্যানার্জী বা পিন্টু চৌধুরী, ক্রিকেটার সুটে ব্যানার্জী এবং অবশ্যই কিংবদন্তী গায়ক মান্না দে।
আচ্ছা, পাঠকদের মধ্যে যাঁরা পুরোনো বাংলা ছায়াছবির খবরটবর রাখেন, বলতে পারবেন অভিনেতা অরুণ চট্টোপাধ্যায় কখনও লেখক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে তৈরী কোনো ছবিতে অভিনয় করেছেন কিনা? প্রশ্নটা একটু দুরূহ শোনাচ্ছে, তাই তো? এবার যদি জানতে চাই উত্তমকুমার কখনও বনফুলের গল্পভিত্তিক কোনো ছবির নায়ক ছিলেন কিনা? এখন নিশ্চয়ই আর উদ্ভট লাগছে না ব্যাপারটাকে। বলিউড গুলে খাওয়া যেকোনো হিন্দী ছবির পোকাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন প্লেব্যাক গায়ক আভাস গঙ্গোপাধ্যায়ের গাওয়া আর গীতিকার সম্পূরণ সিংহ কালরার লেখা কোনো গান মনে পড়ছে কিনা। প্রশ্নটা শুনে এমন দৃষ্টিতে তাকাবে আপনার দিকে, যেন বুঝে উঠতে পারছে না আপনি মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছেন না নেপচুন। কিন্তু কিশোরকুমারের গাওয়া আর গুলজারের লেখা কোনো গানের কথা জানতে চান। সঙ্গে সঙ্গে একগাল হাসি। এই হলো ছদ্মনামের মাহাত্ম্য। আসল নামটাকেই সে অনেক সময় বিস্মৃতির অন্ধকারে বিলীন করে দেয়। লালমোহন গাঙ্গুলীর ‘জটায়ু’ কাল্পনিক হলেও রাজশেখর বসুর ‘পরশুরাম’, সমরেশ বসুর ‘কালকূট’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নীললোহিত’ বা বিমল ঘোষের ‘মৌমাছি’ তো ঘোর বাস্তব। আর ‘ভানুসিংহের পদাবলীর’ ভানুসিংহ যেন কে ছিলেন? তবে এক্ষেত্রে অবশ্য ছদ্মনাম হেরে গেছে আসল নামের কাছে, কারণ আসল নামটাই বাংলার সাহিত্যাকাশে অস্তহীন সূর্যের মতো চিরউজ্জ্বল। আসল নামের কাছে ছদ্মনামের হেরে যাবার একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ পাওয়া যাবে বিদেশী সাহিত্যে। কাল্পনিক কিশোরসাহিত্য জগতের অবিসংবাদী সম্রাজ্ঞী যিনি একবিংশ শতকে, সেই হ্যারি পটার স্রষ্টা জে. কে. রাউলিং কোনো এক বিচিত্র খেয়ালে জনৈক পুরুষ লেখকের ছদ্মনামে একটা নতুন বই বাজারে ছাড়েন। লোকে তো দোকানে গিয়ে বই পড়ে তবে কেনে না, লেখক-লেখিকার নাম দেখে কিনে নিয়ে গিয়ে তারপর পড়ে। সুতরাং একজন আনকোরা, অজ্ঞাতকুলশীল লেখকের সে বই আদৌ কাটল না। প্রায় বিক্রিই হলনা। ঠেকায় পড়ে প্রকাশক (নাকি লেখিকা নিজে?) আসল কথাটা চাউর করে দিতেই ব্যাস। এক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে-বিদেশে কয়েক লক্ষ কপি নিঃশেষ। এই ঘটনার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা লুকিয়ে আছে। আজকালকার বিশ্বায়িত বাজারভিত্তিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় ক্রেতা আর উপভোক্তারা অসংখ্য ব্র্যান্ড আর মডেলের ভীড়ে কয়েকটি বিখ্যাত ‘ব্র্যান্ডনেমেই’ অন্ধের মতো নির্ভরযোগ্যতা আর নিশ্চয়তা খোঁজেন। এই প্রবণতার জন্য মানুষকে ঠকতেও হয়। আমাদের দেশে গরমকালে রাস্তায় ঘাটে ধাবায় চায়ের দোকানে যে ‘মিনারেল ওয়াটারের’ বোতল পাওয়া যায়, তার গায়ে পরিচিত ব্র্যান্ডনেমের লেবেল দেখলেই আমরা নির্দ্বিধায় কিনে নি। কিন্তু অনেক সময়েই সেটা ওই ব্র্যান্ডের খালি বোতলে ভরা সাধারণ কলের জল।
আপনারা যাঁরা এসি চালিয়ে আরাম করে বসে টিভি দেখতে দেখতে এই লেখাটা পড়ছেন ‘অপার বাংলার’ ইলেক্ট্রনিক সংস্করণ ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ পিসি-তে ডাউনলোড করে, তাঁদের নিশ্চয়ই আর বোঝাতে হবেনা আদ্যক্ষরনাম বা অ্যাক্রোনিম জিনিসটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে জড়িয়ে গেছে। এসি, টিভি বা পিসির পুরো শব্দগুলো যদি কেউ সাধারণ কথোপকথনের মধ্যে ব্যবহার করে, আমরা ভাবি কী অদ্ভূত। ইউরোপে বা এশিয়ার কোনো দেশে বেড়াতে গেলে জিনিসপত্র কেনার সময় VAT (value-added tax) দিতে গিয়ে কিন্তু আমাদের জঞ্জালের ভ্যাটের কথা মনে পড়ে না, কাউকে CAT scan (computerized axial tomography) করাতে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময় চোখে ভাসে না বেড়ালের ছবি, কিংবা রাজনৈতিক নেতারা শিল্পপতিদের সঙ্গে নতুন শিল্পস্থাপনের MOU (memorandum of understanding) সই করলে আমরা মৌ-বনের মধুগন্ধ পেতে শুরু করিনা। কারণ ওই অ্যাক্রোনিমগুলো আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আচ্ছা, ‘বি টি রোডের ধারে’ নামের একটা বাংলা সিনেমা ছিল এককালে — মনে পড়ে? ভাবুন তো, তার নাম যদি হতো ‘ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের ধারে’? আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে এক ভূগোলের অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, যিনি কাউকে তাঁর অফিসে আসার পথনির্দেশ দিতে গিয়ে বলতেন, “I am in the dog that is right behind the cat”। অর্থাৎ কিনা তিনি আছেন ডিপার্টমেন্ট অফ জিওসায়েন্সেস-এ (DOG), যা কলেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন টাওয়ারের (CAT) ঠিক পিছনে। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক প্রবেশিকা পরীক্ষার আদ্যক্ষরনাম শুনে শুনে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে তাদের পুরো নাম শুনলে থমকে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবতে হয়। যেমন ACT, SAT, CoGAT, MCAT, GRE, JEE, IAS বা NET/SET। তবে আদ্যক্ষরনামের সবচেয়ে স্মরণীয় উদাহরণ শুনেছিলাম এক আমেরিকান সাংবাদিক বন্ধুর কাছে। বেশ কয়েক বছর আগে জানুয়ারী মাসের এক বিকেলে তার গাড়ীতে চড়ে যেতে যেতে শুনলাম সে মোবাইল ফোনে তার সিনিয়র করেসপন্ডেন্টকে জিজ্ঞেস করছে, “পোটাস যখন আজ সন্ধ্যায় সোটু দেবে, তখন ফ্লোটাস কি সেখানে থাকবে?” শুনে মনে হয়েছিল হয় ও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছে নয়তো কোনো অজানা, বিজাতীয় ভাষায় কথা বলছে। পরে ও ব্যাখ্যা করেছিল, সেদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি আমেরিকান কংগ্রেসের সভাকক্ষে দেশের হাল-হকিকত জানিয়ে যে বার্ষিক ভাষণ দেবেন তা চলাকালীন প্রেসিডেন্ট-পত্নী ওখানে উপস্থিত থাকবেন কিনা — সেটাই ছিল ওর প্রশ্ন। POTUS হল President of the United States, SOTU হচ্ছে State of the Union আর FLOTUS মানে First Lady of the United States।
তাহলে সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল, শেক্সপীয়ার সাহেব? নাম কিছুই আসে-যায় না? Zaaয় Zaaয় — Zaaন্তি পারেন না। নাহলে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখে কেন লোকে? পাড়ার রেস্তোরাঁটায় মন্দা চলছিল যখন, মেনুর কোনো আইটেম না বদলে শুধু নামগুলো ফ্রেঞ্চ আর ইতালিয়ান করে দিয়েছিল কেন? কেন লেখক-তালিকায় কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির নাম না থাকলে জার্নালে গবেষণাপত্র বা পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ বার করা এতো কঠিন? কেনই বা আজকাল বাবা-মায়েরা সদ্যোজাতদের নাম রাখার সময় অনেকটা আপনার হ্যামলেটের ভঙ্গীতে ডিবেট করে – To use or not to use the dictionary?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন
অসাধারণ লেখা সুজয়, যদিও আমি দুটো slot এ শেষ করলাম। এত চমৎকার বাঁধুনি লেখা টার মধ্যে, ছোট্ট, সংবদ্ধ, ঝরঝরে। একটা শান্ত নদী, যে স্রোত হারায় নি।
অপেক্ষায় রইলাম আরো লেখার জন্য।