সুপ্রিয় চৌধুরী
হাসপাতালের বেডে শুয়েই চোখে পড়েছিল দৃশ্যটা। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে। বছরখানেক আগে এক রাতে কঠিন হৃদরোগে আক্রান্ত হলাম এবং মাসখানেকের মধ্যে বাইপাস সার্জারিতে যেতে হল। অপারেশনের পর দিন তিনেক আই সি সি ইউয়ের ঝক্কি কাটিয়ে স্থানান্তরিত করা হল নর্মাল ওয়ার্ডে। বাইপাসের ধারে সুপার স্পেশালিটি হসপিটালগুলোর মধ্যে একটা। আশপাশ দিয়ে একাধিক হাইরাইজ মাথা তুলছে। বিশাল কাঁচের জানলার ধারেই আমার বেডটা। জানলা থেকেই চোখে পড়েছিল লোকটাকে। হসপিটালের গায়েই নির্মীয়মাণ আরেকটা বিশাল বহুতল। কমপক্ষে বিশ বাইশতলা তো হবেই। তার গায়ে মাকড়সার মত ঝুলছিল লোকটা। ছাদ থেকে নেমে আসা একটা মোটা কাছিদড়ি। অনেকটা বিশাল একটা ইংরিজি ইউ অক্ষরের মত। দড়ির একপাশে আটকানো একটা রঙের বালতি। মাঝখানে একটা কাঠের পিঁড়ির মত। বড়জোর হাতখানেক লম্বা। তার ওপর কোনমতে পাছা ঠেকিয়ে বসে বালতি থেকে রঙ তুলে তুলে একমনে বহুতলের দেয়ালে বুরুশ বুলিয়ে চলেছে লোকটা। জমি থেকে অন্তত চোদ্দ পনেরতলা উঁচুতে। একবার বেসাবধানে নীচে….ভাবতেই কিরকম একটা শিরশিরানি ভাব খামচে ধরছিল পেটের মধ্যে। শেষ চৈত্রের নিস্তব্ধ দুপুরে নীল আকাশে গ্লাইডারের ভঙ্গীমায় ভেসে থাকা একা একটা চিল। মনে হচ্ছিল এই নিঃসঙ্গ নির্জন দুপুরে ওই যেন একমাত্র সঙ্গী লোকটার। ঘুরেফিরে এসে যেন ভরসা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। “ভয় পেয়োনা, সঙ্গে আছি।” বিছানায় শুয়ে শুয়ে কুহকিনী মায়ার মত দৃশ্যটা টানছিল আমাকে। হালকা ঘোরের মধ্যে মনে হচ্ছিল মাঝখানে কাঁচের জানলার দেয়ালটা যেন আর নেই। আমিও গিয়ে বসে পড়েছি লোকটার পাশে। ঠিক এই সময় রবারের দস্তানা পড়া হাতে ইঞ্জেকশনের সুচ বাগিয়ে এগিয়ে এলেন মালায়ালি নার্স দিদিমনি। “অ্যাবার একটু গুমোতে হবে আঙ্কল।” অননুকরণীয় দক্ষিণী উচ্চারণে কথাক’টি বলে দক্ষহাতে ইঞ্জেকশন ঠুসে এবং সড়াৎ করে জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে চলে গেলেন দ্রুত। নকল ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে অবধি আমার চোখে আঠার মত সেঁটে রইল মাকড়শা মানুষ।
ঘটনার মাসতিনেক বাদে। অসুস্থতাজনিত একাধিক ধকল আর বিধিনিষেধ কাটিয়ে সবে একটু আধটু বাইরে বেরনোর ডাক্তারি অনুমতি মিলেছে। বাড়ির অদূরেই বেকবাগান মোড়ে কোয়েস্ট মলের দেয়ালে দেখা মিলেছিল ওরকমই আরেকজন মাকড়শা মানুষের। তবে এবার রঙের বদলে ওয়াটার স্প্রেয়ার দিয়ে কাঁচের দেয়াল পরিষ্কার করছেন তিনি। এবার আর সুযোগটা হাতছাড়া করিনি। প্রায় ঘন্টাখানেক ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করার পর অবশেষে পুলি ঘোরানোর কায়দায় দড়ি টেনে টেনে মাটিতে নেমে এলেন মানুষটি। ফুট পেরিয়ে এপাড়ে এসে উড়িয়া পান-সিগারেটের দোকান থেকে একপ্যাকেট বিড়ি কিনে সস্তার গ্যাস লাইটার জ্বালিয়ে ধরালেন একটা। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম খানিকটা যেচেই। নাম জগত সর্দার। বাড়ি লক্ষীকান্তপুর লাইনে। প্রত্যেকদিন মাকড়শা মানুষ হয়ে দেয়াল বেয়ে ওঠার মজুরি অর্থাৎ রোজ ৮০০-১০০০টাকা। মাসে দিন দশ-বারোর বেশি কাজ পাওয়া যায় না আর চাইলেও দিনকুড়ির বেশি একটানা কাজ করা যায় না। অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজ করা যায় না ঘূর্ণি (ভার্টিগো – অনেক উঁচু থেকে নীচে তাকালে মাথা ঘোরার রোগ) বেমারির সমস্যা থাকলেও। জগতের কথায় শহরে এধরনের ‘এস্পেশাল’ কাজ করার কারিগর মাত্র জনাপঞ্চাশেক। তবু রোজ কাজ জোটে না। কথা বলতে বলতে ভাবছিলাম, দক্ষ পর্বতারোহীদেরও পাহাড় চড়তে চড়তে পাহাড়টা ঘষে ঘষে পরিষ্কার অথবা রঙ করতে হয়না। কুশলী ট্র্যাপিজ শিল্পীদেরও খেলা দেখানোর সময় নীচে থাকে জালের নিরাপত্তা। সেখানে এইসব মানুষেরা? কোনরকম প্রশিক্ষণ নেই, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করে আর ভয়ঙ্কর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কলকাতার দেয়াল বেয়ে উঠছেন বছরের পর বছর। পড়ে মরলে পাঁচটা টাকাও বীমা করা নেই!
“ভয় করে না?” জিগ্যেস করেছিলাম নীচুগলায়। চকচকে একটা হাসি মুহূর্তে ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল জগতের চোখে!
“ভয় করলে পেট শুনবে বাবু?” বিড়িতে শেষ টানটা দিয়ে সেটাকে পায়ের তলায় পিষে চলে গেলেন মাকড়শা মানুষ।
‘তুম পাস আয়ে/ইঁউ মুস্কুরায়ে/তুমনে না জানে ক্যা সপ্নে দিখায়ে….’ একটু দূর থেকে ঈষৎ খোনা এবং দোখনো টিউনে কানে গানের এই কলিগুলো ভেসে এলেই বুঝতে হবে মোনাজেত আসছে। পুরো নাম মোনাজেত আলি লস্কর। বয়েস মাঝ পঞ্চাশের কোঠায়। বেঁটেখাটো রোগাপাতলা চেহারা। পরনে সর্বদা আধময়লা লম্বা ঝুলের বাংলা শার্ট আর লুঙ্গি। কাঁচাপাকা একগাল দাড়ি। শার্টের হাতা কনুই অবধি গোটানো সবসময়। মোনাজেতের নিবাসও দখিন লাইনে। ধপধপি স্টেশনে নেমে ওর বাড়ি ওরই বয়ানে “টেরেকারে গেলি পনেরো মিনিট আর হেঁইট্যে হেই ধরো পেরায় ঘন্টাখানেক।” মোনাজেত, দুর্দান্ত কথক, একইসঙ্গে ব্যবহার আর গানের গলাটি ভারি মিঠে। মোনাজেতের পেশা – একজন ফুলটাইম বেগার।
কেউ যদি প্রশ্ন করে “খেটে খাও না কেন?”
“বেশি খেইট্যে কী হবে বাবু? ইদিকে ( পড়ুন কলকাতায় ) রাস্তাঘাটে ঘন্টাতিনেক হাঁটলেই তো দুশ আড়াইশ কামাই। তারপর গবরমেন্টের ফিরি টেরেন তো আছেই। সকাল নটায় রাস্তায় নেইম্যে দুপুর দুটো আড়াইটের মধ্যি ফের বাড়িতে। বিবিরা খানা পাকিয়ে রেডি কইর্যে রাখে। একপেট ভর্তি খেইয়ে ঠেইস্যে ঘুম দি একখানা।”
একটুও বিব্রত না হয়ে চটজলদি স্মার্ট উত্তর মোনাজেতের। আমার মানুষ দেখার অভিজ্ঞতায় মোনাজেত একমাত্র ভিক্ষুক, যে তার মনোভাব লুকিয়ে রাখতে কোনরকম ভণিতা বা বাহানার আশ্রয় নেয় না। তবে একটু চা-বিড়ি খাইয়ে বসালে এর পিছনে আরেকটা গল্প বেরিয়ে আসে। সেটা এইরকম।
“বোঝলেন বাবু, তখন আমার হেই বিশ বাইশ হবে। নিকে হয়েছিল পাশের গাঁয়ের গোলাম সর্দারের বেটির সঙ্গে। বড় ভালবাসতাম বিবিটাকে। রাজমিস্তিরির জোগাড়ের কাজ করতাম সেসময়। উদোম খাটতাম দিনরাত। তবুও মাসের মধ্যি পনের দিনের বেশি কাজ জুটতো না। রাতদিন খিটিমিটি লেইগ্যেই থাকতো অভাবের সোমসারে। এর মধ্যি এক রেইতে বিবিটা পেইল্যে গেল সব্জির ম্যাটাডোরের এক ডেরাইভারের সঙ্গে। শোকে-গমে একেবারে পাথর হয়ে গেলাম মুই। সে এক পাগলপারা অবস্থা। মাসখানেক লাগলো সেটা সামলাতে। তারপর চোখের পানি মুছে কসম খেলাম খোদাতাল্লার কাছে। নেক(সৎ) রাস্তায় খেইট্যে একটা বিবি ধইরে রাখতে পারলাম না। এবার হারামের পয়সায় দুটো বিবি পালবো।”
জবান রেখেছে মোনাজেত। ওর ঘরে এখন দু-দু’জন বিবি। একসাথেই থাকে সবাই। বড়বিবির তরফে দুই মেয়ে। দুজনেরই বিয়েশাদি হয়ে গেছে। ছোটবিবির তরফে দুই ছেলে। বড়টা ডায়মন্ড হারবার রুটে বাসের হেল্পার। বিয়ে করে আলাদা হয়েছে। ছোটটা কন্সট্রাকশনের মজুর খাটতে যায় মুম্বাই-গুজরাত-বাঙ্গালুরু। মাসে মাসে টাকা পাঠায় কিছু কিছু। সব মিলিয়ে মোটামুটি সুখের দিন এখন মোনাজেতের। দুই বিবি আর ও, সবাই মিলে একসাথে সিনেমা দেখতে যায় মাঝেমাঝে। গঞ্জ শহরের রোল কর্নারে পেঁয়াজ, শশা আর টমাটো নামক জালি কুমড়ো সসের এগ রোল খেয়ে বাড়ি ফেরে রাতে। তবে এত কিছুর মধ্যেও ভিক্ষেটা ছাড়েনি মোনাজেত। মোটামুটি সকাল ন’টার মধ্যে নেমে পড়ে পার্ক সার্কাস স্টেশনে। পার্ক সার্কাস, বেনেপুকুর, তপসিয়া, তিলজলা, এন্টালি, তালতলা, প্রত্যেকদিন আলাদা আলাদা একেকটা নির্দিষ্ট রুট বাঁধা। প্রত্যেক দিন অন অ্যান অ্যাভারেজ ইনকাম দুশো থেকে আড়াইশ টাকা। শুধু জুম্মা বা শুক্রবারের রুটিনটা একটু আলাদারকম। ওইদিন পার্ক সার্কাসে না নেমে সোজা শেয়ালদা। একটু ভুল বললাম কি? আসলে তার আগে পার্ক সার্কাসে নেমে পড়ে একটা পাঁচ টাকার টিকিট কেটে নেয় ও। কারণ শেয়ালদায় বড্ড কড়াকড়ি। হপ্তায় একবার ওই পাঁচ টাকাই এই বেগিং বিজনেসে একমাত্র ইনভেস্টমেন্ট মোনাজেতের। শেয়ালদা থেকে এম জি রোড ধরে সোজা হাঁটা মেরে চিৎপুরের নাখোদা মসজিদ। জুম্মার নামাজে সবচেয়ে বড় জমায়েত হয় ওইদিন। ভিক্ষুক-ফকিরদের খোলাহাতে দান করেন নামাজিরা। নসিব ভাল থাকলে দুশ-আড়াইশ টাকার অঙ্কটা সাড়ে তিনশ থেকে পাঁচশতেও পৌঁছয় কখনো কখনো।
অনেকবার অবাক হয়ে ভেবেছি, একটা মানুষ, যার পুরো পেশাটাই দাঁড়িয়ে আছে ভন্ডামির ওপর ভিত্তি করে তবুও তাকে কেন পয়সা দেয় লোক? পরমুহূর্তেই চমকে উঠে ভুল ভাঙে প্রত্যেকবার! আরে! আমার শহুরে মন এটাকে ভন্ডামি ভাবছে কেন? উল্টে ওর সোজাসাপ্টা স্বীকৃতি, অসম্ভব বিনয়ী ব্যবহার আর চূড়ান্ত সপ্রতিভ কথাবার্তা, দুর্দান্ত রসবোধ আর কথার ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেয়া গ্রাম্য মিঠে গলায় দু’এক টুকরো হিন্দিগানের কলি, এগুলোই কি ওর পেশার ইউ এস পি নয়? এই সমস্ত গুণগুলোকেই মানুষের সামনে পারফর্ম করেই তো পয়সা চায় ও, একজন দক্ষ পেশাদার শিল্পীর মত। এইসব সাতপাঁচ চিন্তাভাবনার মাঝখানেই উঠে দাঁড়ায় মোনাজেত। গেঁয়ো গলায় গুনগুনিয়ে ওঠা সেই মিঠে সুর – “আচ্ছা তো হাম চলতে হ্যায়….আসি গো বাবু, ফের দ্যাখা হবে আসছে বুধবারে!”
আজও মনে আছে মানুষটাকে। সেটা সত্তরের দশকের প্রায় শেষ ভাগ। পার্ক সার্কাস চার নং পুলের বাইপাস কানেক্টরের মোড় তখনো গাড়ি আর মানুষের জঙ্গলে ভরে যায়নি। পুলের ওপারে একটু এগোলেই তখনো দু’হাত অন্তর অন্তর প্রচুর মেছোভেড়ি, মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো ধানখেতি। কালেভদ্রে কলকাতা কর্পোরেশনের এক-আধটা ময়লা ফেলার গাড়ি বিকট ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দ তুলে আর বিষাক্ত ডিজেলের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ব্রিজ টপকে চলে যেত ধাপার দিকে। তপসিয়ার খালে জল তখনো স্রোতস্বিনী, বদ্ধ নালায় পরিণত হয়নি এখনকার মত। সেই সময়, ট্যাংরার চীনেপাড়া থেকে পায়ে হেঁটে চার নং পুল পেরিয়ে এপারে আসতেন তিনি। প্রৌঢ় মানুষটি। ঢলঢলে খাকি ফুলপ্যান্ট আর হাতাগোটানো শাদা ফুলশার্ট। ছোট ছোট চোখ আর খর্বকায় নাক সংযুক্ত চ্যাটালো মোংগলিয়ান মুখাবয়ব। নাম জেনেছিলাম – আ উন সিন। ব্রাইট স্ট্রিট মোড়ের মাথায় এসেই হাঁক পাড়তেন – “আও আও বাচ্চালোগ, জাগলারি কা খেল দেখনে আও, বল কা খেল, আগ কা খেল, রিং কা খেল, চাক্কু কা খেল।” বাচ্চাদের সঙ্গে বুড়োরাও জুটতো চীনেসায়েবের জাগলারির খেল দেখতে। ভিড় জমলে খেলা শুরু হত আটটা কাঠের বল দিয়ে। সে এক মেসমারাইজিং গেম শো ! একের পর এক বল দুহাতের তালুতে পড়েই ফের উঠে যাচ্ছে শূন্যে। ঘুরছে চক্রাকারে। মাটিতে পড়ছে না একবারের জন্যও। বলের পর লোহার রিং আর শেষ দুটো খেলা যথাক্রমে জ্বলন্ত মশাল আর ধারালো আট-আটখানা ভোজালির। দেখতে দেখতে দম আটকে আসতো ভিড়ের মধ্যে বাচ্চা বুড়ো সব্বার! খেলার শেষে, মাঝখানে ড্রাগনের ছবি আঁকা কলাইয়ের একটা থালা নিয়ে এগিয়ে আসতেন সায়েব। “কুছ দো” – বলতেন প্রায় বুজে আসা চোখের কোনে ভারি মিষ্টি হেসে। ছেলেবুড়ো, প্রায় সবাই দিতো, যে যার সাধ্যমত। ‘সময় বহিয়া যায়/নদীর স্রোতের ন্যায়।’ বয়স তার শরীরে দাঁত ফোটাতে শুরু করেছিল। ক্রমে ক্রমে শিথিল হচ্ছিল বেতপেটা শরীরের চামড়া। প্রৌঢ় থেকে দ্রুত বৃদ্ধ হচ্ছিলেন চীনেসায়েব।
শেষবার দেখেছিলাম ৯০-এর গোড়ায়। দু’চোখে পুরু ছানির স্তর। প্রায় অন্ধ। তবুও খেলা দেখিয়ে যাচ্ছেন স্রেফ আন্দাজের ওপর ভরসা করে। মাঝে মাঝে হাত ফস্কে বল বা মশাল পড়ে যাচ্ছে। আগুনের ছ্যাঁকা লাগছে হাতে। লোকজন হাসাহাসি করছে। খেলার শেষে কাঁপা কাঁপা হাতে হাতড়ে হাতড়ে ঝোলার মধ্যে ভরছিলেন খেলা দেখানোর সরঞ্জামগুলো। অন্যদিন একটাকা দু’টাকা দিই। সেদিন কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতে গুঁজে দিয়েছিলাম পাঁচটা টাকা। ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসেছিলেন সায়েব। সেই দেখা শেষবারের মত! আর কোনদিন শহরের কোথাও চোখে পড়েনি মানুষটাকে। এ শহরের শেষ এবং একমাত্র চীনে জাগলার, আ উন সিন।
শীলাকেও দেখেছিলাম ওই হাসপাতালের বেডে শুয়েই। শীলা মন্ডল। বাড়ি উল্টোডাঙ্গার মুরারিপুকুর বস্তি। বয়েস বছর পঁচিশ। পেশাগত পরিচয় – বাইপাসের ধারে সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের ক্যাজুয়াল গ্রুপ-ডি স্টাফ। নো ওয়ার্ক নো পে। গোদা বাংলায় – কাজে এলে দিনমজুরী আছে, না এলে নেই। হসপিটালে সব মিলিয়ে দিনদশেক থাকতে হয়েছিল। অপারেশনের পর দিনআড়াই আই সি সি ইউয়ের বেডে অজ্ঞান অনন্তশয়নম হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া হাতে অখন্ড অবসর। বাড়ি থেকে দিয়ে যাওয়া বই পড়ে আর কাঁহাতক সময় কাটানো যায়। ফলে আমার সময় কাটানোর সঙ্গী হল শীলা। অপারেশন হয়ে জেনারেল বেডে স্থানান্তরিত হবার পর ওই ওয়ার্ডে নাইট ডিউটি ছিল ওর। এর আগে অন্যান্য প্রয়োজনে বহুবার যেতে হলেও নিজেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি কোনদিন। ফলে ব্যাপারটা খেয়াল করিনি সেভাবে। খুব ইন্টারেস্টিংলি লক্ষ্য করেছিলাম, এইসব সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেশিরভাগ পেশেন্টই খুব ঠেকায় না পড়লে ডাক্তার বা নার্স ছাড়া শীলার মত ক্যাজুয়াল ফোর্থ ক্লাস স্টাফদের সঙ্গে কথা বলেন না। আড্ডার চিরন্তন বদভ্যাস আমার রক্তে। ফলে শীলার সঙ্গে জমে গেল খুব। গোটা ওয়ার্ড জুড়ে চরকিপাক খাওয়া উদোম খাটনির মাঝখানে একটু আধটু সুযোগ পেলেই বেডের পাশটায় এসে দাঁড়াতো মেয়েটা। বসতে বললেও বসতো না কিছুতেই। “না স্যার, মানা আছে। রিপোর্ট হয়ে যাবে।” প্রত্যাখ্যান করতো প্রত্যেকবার, অত্যন্ত বিনীতভাবে। ফলে আড্ডা টুকটাক যেটুকু হত, সেটা দাঁড়িয়েই। ওর কাছেই শুনেছিলাম মুরারিপুকুরের ঘিঞ্জি বস্তির দশফুট বাই দশফুট ঘরে প্রৌঢ় মা, কাজ করে তিন বাবুর বাড়িতে। পরের ভাই রবীন্দ্রভারতীতে এম এ, প্রথম বর্ষ। সবচেয়ে ছোট বোনটা উচ্চ মাধ্যমিক দেবে এবছর। “আর তোর কি হবে? নিজের কথা ভেবেছিস কিছু? বিয়েটিয়ে? কিছু ঠিক করা আছেটাছে নাকি?” জবাবে মাটিতে যেন মিশে গিয়েছিল মেয়েটা। “সে আছে একজন।” জবাব দিয়েছিল মাথা নীচু করে মেঝেয় নখ খুঁটতে খুঁটতে। “তা সে কি করে ?” প্রশ্ন করেছিলাম ফের। “অটো চালায় শোভাবাজার উল্টোডাঙ্গা রুটে কিন্তু আমি পস্টাপস্টি বলে দিয়েছি, অপেক্ষা করতে হবে। আগে ভাইবোনগুলো একটু দাঁড়িয়ে যাক। এখনি আমি চলে গেলে সব ভেসে যাবে। অভাবের সংসারে আমার এইটুকু রোজগার যে অনেক। ও যদি সত্যিই আমায় ভালোবাসে, তাহলে অপেক্ষা করবে আমার জন্য।” শোনামাত্র যেন ৪৪০ ভোল্টের শক লেগেছিল শরীরে! একি শুনলাম? বহুবছর আগে হুবহু এই একই সংলাপ শুনেছিলাম ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সেই নীতার মুখে। “অপেক্ষা করবেনা? আপনি কি বলেন কাকু?” এবার প্রশ্ন করল নীতা থুড়ি শীলা। ঠিক সেই সময় প্রায়ান্ধকার ওয়ার্ডে কাচের জানলা ভেদ করে ঠিকরে আসা আধো চন্দ্রাতপ লক্ষ নিয়নের দ্যুতি হয়ে ঝলসাচ্ছিল শীলার মুখে ! “হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেন করবে না? অবশ্যই করবে।” জবাব দিয়েছিলাম খানিকটা হোঁচট খেয়েই। কিন্তু মনে জোর পাচ্ছিলাম না তেমন। কারণ নীতার অভিজ্ঞতাটা তেমন সুখকর ছিল না।
সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেছিল বেডে। আমার গায়ে দুটো কম্বলের আস্তরণ। জানলার ধারে গুঁড়িসুড়ি মেরে দাঁড়িয়ে কনকনে এসির ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে শীলা। পরনে সবুজরঙা পাতলা সুতির ঢোলা হাফহাতা বুশশার্ট আর পাজামা। হাসপাতালের ইউনিফর্ম। বাড়ি থেকে পাঠানো আলোয়ানটা দিতে চেয়েছিলাম। নেয়নি কিছুতেই। ওতে নাকি ড্রেস কোড রুল ব্রেক করা হবে।
অতঃপর শহরের সমস্ত সুপার এবং মাল্টি স্পেশালিটি প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষর কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনাদের ঝাঁ-চকচকে বিলাসবহুল চিকিৎসালয়গুলিতে মানুষকে সুস্থ করে তোলার দক্ষিণা নেহাত কম নয়। ব্যক্তিগতভাবে সে অভিজ্ঞতা আছে। এইসব মেয়েদের ছুটিছাটা, অন্যান্য আর্থিক সুযোগসুবিধা, কিছুই তো দেন না আপনারা, দয়া করে একটা সোয়েটার আর গভীর রাতে একটু বসবার অনুমতিটুকু অন্তত দিন যাতে হাজার হাজার শীলা যে কোনদিন ওই মেঘে ঢাকা তারার নীতার মত টুপ করে আকাশ থেকে খসে না যায়।
নাম ইভলিন হুপার। এখনো একদা কসমোপলিটান এই শহরটায় রয়ে যাওয়া স্বল্পসংখ্যক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে একজন। নিবাস মধ্য কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে। তবে ওই নামে ডাকলে পাড়ায় কারো পক্ষে চেনার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু একবার যদি বলেন বেড়াল মাসি বা ক্যাট আন্টির বাড়ি যাব, মাইলখানেক দূরের বাড়ি থেকেও বলে দেবে। কারণ ইভলিন আন্টির বাড়ি আক্ষরিক অর্থেই দুনিয়ার যত মার্জারের অভয়াশ্রম। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০-৮০ টা মত বেড়াল রয়েছে এন্টালির বেজায় পুরোন বাড়িটার একতলায় আন্টির শ-চারেক স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। বিছানা থেকে বসার চেয়ার হয়ে ফ্রিজ কিম্বা র্যাকের ওপর বরাভয়দানকারী প্রভু যীশুর কোল ঘেঁষে, যেদিকে তাকানো যায় শুধু বেড়াল আর বেড়াল। অনেকেই সেটা জানেন। ফলে বাড়ির স্টোররুমে বা সিঁড়ির প্যাসেজের নীচে জন্মানো অবাঞ্ছিত মিনিটার আরো অবাঞ্ছিত ক্ষুদে ক্ষুদে ছানাগুলোকে রাতের অন্ধকারে এনে ফেলে রেখে যান আন্টির দোরগোড়ায়। আন্টি ফেরান না কাউকে। ফলে ওনার ফ্ল্যাট নামক ‘দাদুর দস্তানা’ বেড়ালের চাপে ফাটো ফাটো প্রায়। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মুচকি হেসেছিলেন আন্টি। “লুক মাই সন, ওরা তো নিজের ইচ্ছেয় এ বাড়িতে আসেনি। হয় আমি ওদের এনেছি নয়তো অন্য কেউ দিয়ে গেছে। আসলে এটাই হয়তো আমার ডেস্টিনি, ইউ ক্যান সে – ব্লেসিংস অফ গড।” বলতে বলতে ঝলমলে হাসিতে ভরে উঠেছিল বেড়াল মাসির মুখটা।
রোজ সকাল এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ এন্টালি আর তালতলার শেষবেলার অর্থাৎ ‘ভাঙা বাজারে’ যান আন্টি। একটু সস্তা মাছ, মুর্গির ছাঁট, গিলেমেটে, মাথা আর লর্ডপাড়ার গায়ে চার্চ থেকে ক্রিশ্চান সাবসিডির সস্তা গুঁড়ো দুধ কিনে নিয়ে আসেন। অতঃপর রান্না চড়ে। সে এক যজ্ঞিবাড়ির আয়োজন। সবকিছু মিটতে মিটতে বেলা গড়িয়ে তিনটে সাড়ে তিনটে। অতঃপর নিজে যা হোক দুটো নাকে মুখে গুঁজে পোষ্যদের পাশেই একটু গড়িয়ে নেন বিছানায়। সেসময়টায় সঙ্গী মিলস অ্যান্ড বুনসের পেপারব্যাক, নইলে টিভিতে বে ওয়াচ কিম্বা বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল। আন্টির আক্ষেপ একটাই আর সেই আক্ষেপটা মাঝেমাঝেই ঝরে পড়ে গলায় – “খারাপ লাগে একটা ব্যাপারেই, এত লোক বেড়াল দিয়ে যায়, আমি তো তার বদলে পয়সা চাইছি না। শুধু বলি, মাঝে মাঝে একটু দুধ বা মাছ দিয়ে যেও। আমার একটু সুরাহা হয়। কেউ দেয়না, জানো ! এনিওয়ে, দিস ইজ লাইফ !” ম্লান হাসেন আন্টি।
আন্টির ‘বাডি’ মিঃ হুপার ( স্বামীকে ওই নামেই ডাকতেন ), একটি বহুজাতিক কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, গত হয়েছেন বেশ কয়েকবছর হল। দুই ছেলেমেয়ের দুজনেই অস্ট্রেলিয়া। চাকরিবাকরি, বিয়েশাদি করে সেটলড দুজনেই। প্রতি মাসে কিছু কিছু টাকা পাঠায় নিয়ম করে। এছাড়া বাডির রেখে যাওয়া ওই যেটুকু, সব মিলিয়ে চলে যায় কোনমতে। প্রতি রোববার সকালে মৌলালি মোড়ের চার্চে যাওয়া ছাড়া এটাই মোটামুটি ডেইলি রুটিন ইভলিন হুপারের। দু’একবছর বাদে বাদে ছেলেমেয়েরা আসে ছুটিছাটায়। বলে “এখানে একা একা পড়ে থেকে কি হবে? অস্ট্রেলিয়া ইজ আ ড্রিমল্যান্ড! চলো, আমাদের সঙ্গে ওখানে গিয়ে সেটল করবে।” বিশেষত মেয়ে। মেয়ের কথায় হাসেন ইভলিন। “যেতে তো পারি কিন্তু তাহলে তো আমার সাথে সাথে এন্টালি তালতলার বাজার, পাড়ার সরু গলি, মাই নেইবারস, মৌলালি মোড়ের মাথায় লাল ইঁটের চার্চ, এগুলোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট মাই লিটল এঞ্জেলস?” পাশে বসে থাকা গম্ভীরমুখো হুলোটার মাথায় হাত বোলান আন্টি, “আমার এই ক্ষুদে বিচ্ছুগুলোর কি হবে?”
শোনামাত্র চমকে উঠছিলাম। অনেকগুলো বছর আগে দুনিয়া কাঁপানো এক মার্কিন রকস্টার এই একই কথা বলেছিলেন সানাইয়ের ইশ্বর বিসমিল্লা খান সাহেবকে, বেনারসের বাড়িতে বসে। জবাবে মুচকি হেসে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন খান সাহেব “কাশী বিশ্বনাথের গলি, হনুমানটোলি, দশশ্বমেধ ঘাট, রোজ ভোরে গঙ্গাস্নান, গোধুলিয়ার চৌরাহা….তব তো ইয়ে সবকো ভি সাথ লেনা হোগা। সেটা কি পারবে তুমি?” কোথায় বেনারসে খান সাহেবের বাড়ি আর কোথায় এন্টালি পাড়ার সরু গলি, তবুও কি আশ্চর্য মিল দুটো সংলাপের মধ্যে!
“ইউ নো মাই সন, কথাটা শোনার পর মেয়ে রেগে উঠে চলে গিয়েছিল আমার সামনে থেকে। কিন্তু আমি তো সত্যি কথাটাই বলেছিলাম। আই রিয়েলি ডিড মিন ইট!” গলা ধরে এসেছিল আন্টির। প্রায় পনের ষোল বছর আগেকার কথা, তখনই সত্তরের গন্ডি পেরিয়ে গেছিলেন আন্টি। কেমন আছেন এতদিনে? আর তাঁর সেইসব লিটল এঞ্জেলরা? সব বহাল তবিয়তে তো? যতবার ওদিকটা দিয়ে গেছি ততবার ওই গলিতে ঢোকার প্রবল ইচ্ছেটা হার মেনেছে পেট খামচে উঠে আসা একটা অজানা গা ছমছমে আশংকার কাছে। যদি… ?
শেষ কাহিনী বা ঘটনার কুশীলব অথবা প্রধাণ চরিত্র একজন নয়, দুজন। দুজনেরই দেখা মিলেছিল আলিপুর চিড়িয়াখানায়। তবে একসঙ্গে নয়, বেশ কয়েকবছর আগেপরে। প্রথমজনের সঙ্গে মোলাকাতের ঘটনাটায় আসি প্রথমে। প্রায় বছর পনের আগেকার কথা। শীতকালের এক দুপুরে, ছুটিছাটা নয়, সাধারণ একটা কেজো দিনে গিয়েছিলাম চিড়িয়াখানায়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, সেই ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি চিড়িয়াখানায় যাওয়াটা একটা নেশার মত আমার কাছে। আর এই যাওয়ার ব্যাপারে যে কোন একটা সাধারণ দিনই সবচেয়ে পছন্দের। কারন ওই কেজো দিনগুলোয় পশুপাখিদের বিরক্ত করা ( যা কখনো কখনো ভয়ঙ্কর অমানবিক আর নিষ্ঠুরও বটে ) আদেখলে দর্শকের ভিড় অনেকটাই কম থাকে। ফলে পশুপাখিদের অনেক বেশি খোশমেজাজে দেখা যায়। যাকগে, অতঃপর মূল প্রসঙ্গে ফিরি আবার। আজো মনে আছে দিনটা। শেষ বিকেলের রোদ দ্রুত ঝিমিয়ে পড়ছে। পৌষের শীতবাতাস তার গতি বাড়িয়ে কামড় বসাতে শুরু করেছে শরীরে। আম দর্শকের ভিড়ও পাতলা হতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। পশুশালার দরজা বন্ধ হতে আর বড়জোর আধঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি। দাঁড়িয়েছিলাম কুমীরদের থাকার জায়গা সদ্যনির্মিত বিশাল জলাশয়টার সামনে। সেসময় একেবারে ফাঁকা, দর্শকশূন্য জায়গাটা। জলাশয়ের মাঝখানে একাধিক কৃত্রিম দ্বীপ। সেগুলোর ওপর রোদ পোয়াচ্ছে অসংখ্য ছোটবড় আকারের কুমীর। তারমধ্যে কোন কোনটা তো আকারে ১১-১২ ফুট হবে। শরীরে তিলমাত্র প্রাণের স্পন্দন নেই। হঠাত দেখলে বিশালকায় কাঠের গুঁড়ি বলে ভুল হতে পারে। এইসময় দূর থেকে ঘড়ঘড় করে কিছু একটা এগিয়ে আসার শব্দ। আওয়াজটা আরও কাছে এগিয়ে আসা মাত্র কাঠের গুঁড়িগুলোয় চকিতে প্রাণের স্পন্দন জাগলো যেন। আলোড়ন তুলে বিদ্যুতগতিতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো কুমীরেরা। চোখ তুলে তাকালাম সামনে। জলাশয়ের পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়ালেন একজন। রোগাপাতলা, মাঝারি উচ্চতা, শ্যামবর্ণ। অতি সাধারণ চেহারা। দুহাতে ধরা লোহার ঠেলাগাড়ির হাতল। দেখতে অনেকটা ঝাড়ুদারদের গাড়ির মত, তবে উচ্চতায় অনেকটা কম আর আকারেও বেশ খানিকটা ছোট। গাড়ির ডালায় ভর্তি বড় বড় মাংসের টুকরো। পাঁচিলের এপার থেকে মাংস তুলে তুলে জলাশয়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন মানুষটা। সঙ্গে সঙ্গে জল জুড়ে একটা সুনামি শুরু হয়ে গেল যেন। ওই উথালপাথাল জল তোলপাড়ের মধ্যেও চারদিকে নজর ঘুরছিল মানুষটার। হঠাৎই চোখ গেল জলাশয়ের ভিতরদিকটায়। সামনে ধেয়ে আসা ধাড়িগুলোর ভিড়ে কুচোকাঁচাগুলো এগিয়ে এসে খেতে পারছে না। আর ঠিক তখনই ঘটে গেল সেই রোমহর্ষক কান্ডটা! হাতের বালতিতে মাংস নিয়ে পাঁচিল টপকে জলাশয়ের পাড়ে লাফিয়ে পড়লেন মানুষটা। ভেঙে পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল তুলে নিয়ে স্রেফ লাফিয়ে পেরিয়ে গেলেন গোটা দুতিনেক ছোট ছোট চর। এসে দাঁড়ালেন একেবারে মাঝখানের একটা চরে। একহাতে ক্রমাগত গাছের ডাল দিয়ে জলে বাড়ি মেরে ধাড়িগুলোকে হঠিয়ে রেখে অন্যহাতে মাংস ছুঁড়ে ছুঁড়ে খাওয়াতে লাগলেন ক্ষুদেগুলোকে। একইসঙ্গে মুখে অবিশ্রান্ত গালি বড়দের উদ্দেশ্যে, “শালা হারামিলোগ, বাচ্চোঁকো খানে নহি দে রহা।” অতঃপর মিনিটদশেক বাদে নিশ্চিন্ত হয়ে একটা ভারি তৃপ্তির হাসি ঠোঁটের কোনে, “চলো, সবকোই খা লিয়া।” বলে চর টপকে টপকে ফিরে এলেন একই কায়দায়, ঠিক যেভাবে গেছিলেন।
প্রিয় পাঠক, সমগ্র দৃশ্যটা চোখ বুজে কল্পনা করার চেষ্টা করুন একবার। পায়ের একহাত নীচে জলের তলায় খেলে বেড়াচ্ছে জলজ্যান্ত শমন! একটু এদিকওদিক হলেই….অথচ সে সবকে থোড়াই কেয়ার, একমাত্র মিশন – অপেক্ষাকৃত ছোটগুলোকে কিভাবে একটু খাওয়ানো যায়। এদিকে এই অধম প্রতিবেদকের পা তো মাটিতে জমে পাথর ততক্ষণে! কোনমতে সেটা কাটিয়ে এগিয়ে গেছিলাম সামনে। একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে আলাপ জমেছিল। নাম বলেছিলেন সম্ভবত ইউসুফ। এতদিন বাদে স্মৃতিবিভ্রমও হতে পারে। সে যাকগে, নামে কি আসে যায়। কাজটাই আসল। চিড়িয়াখানায় রেপটাইল ডিপার্টমেন্টে সরীসৃপদের খাওয়াদাওয়া আর দেখভালের কাজটা করে থাকেন পঞ্চাশোর্ধ এই মানুষটি। ওনার কাছেই নিয়েছিলাম জীবজগতের কত পাঠ। ভীমকায় একটা কুমীরও হপ্তায় খায় মাত্র একবার। বড়জোর কেজিপাঁচসাতেক মাংস। কারণ দেহের তুলনায় ওদের পাকস্থলী অনেক ছোট। ফলে হজম করতেও সময় লাগে অনেক বেশি। শুধু কুমীর নয়, সমগ্র সরীসৃপ জগতেই এটা সত্য। ওনার কাছে আরো জেনেছিলাম, একটা ১৭-১৮ ফুটের অজগরের ডায়েট চার্ট – পূর্ণবয়স্ক একটা মুর্গি, আর সেটাও ওয়ান্স ইন আ উইক। একইভাবে ১৪-১৫ ফুট একটা রাজ গোখরো বা শঙ্খচূড়ের ( কিং কোবরা ) খোরাক গোটা তিনচারেক ঢোঁড়া বা হেলে সাপ। সাধারন গোখরো, কেউটে, চন্দ্রবোড়া, শাঁখামুটি, দাঁড়াশ, ঢোঁড়ার জন্য ধেড়ে ইঁদুর আর ব্যাং। তক্ষক, কালনাগিনী, লাউডগা আর কালাচের পাতে ছোটখাট কয়েকটা আরশোলা, নেংটি ইঁদুর বা ব্যাঙের বাচ্চা হলেই চলবে।
হ্যাঁ, সেই কদ্দিন আগে শহুরে শিক্ষার বড়াই করা এই অধম প্রতিবেদক একজন নিরক্ষর কিন্তু যথার্থ প্রকৃতি বিজ্ঞানীর কাছে নিয়েছিল এই অপার প্রকৃতিপাঠ। কোন ইশকুলের জীববিজ্ঞান ক্লাসে শেখানো হয় না এসব। অতঃপর ক্লাস শেষ করে হাসতে হাসতে গাড়ি ঠেলে চলে গেছিলেন আমার নেচার ক্লাসের শিক্ষক। নাহ, ইউসুফ ভাই কোন ক্রোকোডাইল হান্টার স্টিভ আরুইন, ডঃ ব্রাডি ব্রার বা জঙ্গল অভিযাত্রী বেয়ার গ্রিলস নন। ন্যাট জিও বা ডিসকভারি চ্যানেল ওর মত অজ্ঞাতকুলশীল কোন নেচার মায়েস্ত্রোকে কভার করবে না কোনদিন। তবু ওর মত মানুষেরা নিজেদের কাজটা করেই যাবেন নিজদের মত করে, অসীম সাহসের ওপর ভরসা রেখে, নিঃস্পৃহ, নির্মোহ কোন নির্জনবাসী সাধকের মত। নাহ, ইউসুফ ভাইয়ের সন্ধানে আমাকে অস্ট্রেলিয়ার নোনাজলের নদীঘেরা বাদাবন বা আমাজনের গহীন অরণ্য, কোত্থাও যেতে হয়নি। দেখা হয়ে গেছিল আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় এই শহরটায়। এই কলকাতায়! এটা কি কম গর্ব, কম আত্মশ্লাঘার ব্যাপার নাকি?
মানুষটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন উনি জিরাফের খাঁচার পিছনদিকটায় ইয়া উঁচু খিলানওয়ালা ঘরটায় আন্ডাবাচ্চা সমেত গোটাসাতেক জিরাফের একটা পরিবারকে ছাঁটা ঘাস, গাছের পাতা আর চানা দানা ভুষি খাওয়াতে ব্যস্ত। ওনাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের মত জিরাফেরা। নিজের হাতে ভাগ করে করে সবার দিকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছিলেন উনি। বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নীচু করে ওনার সেই মধ্যস্থতা মেনে নিচ্ছিল সবাই। এই অবধি পড়ে যাদের মনে হল – ধুত! এ আর কী এমন ব্যাপার, জিরাফের মত একটা নিরীহ তৃণভোজী প্রাণী, ওকে সামনে দাঁড়িয়ে ক’টা ঘাসপাতা খাওয়ানো এমন কি একটা কঠিন কাজ। তাঁদের অবগতির জন্য জানাই – ‘আজ্ঞে না মশাই, কাজটা যতটা সোজা ভাবছেন আসলে সেটা মোটেই অতটা জলভাত নয়। প্রতিবছর আফ্রিকার সাভানা প্রান্তরে বেশ কিছু সিংহ সাঙ্ঘাতিক রকম আহত হয় অথবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জিরাফ শিকার করতে গিয়ে, ওদের দেঢ়তলা বাড়ি সমান পেছনপায়ের চাঁট খেয়ে। ফলে হামেশা জেব্রা, ব্ল্যাকবাক হরিন বা অ্যান্টিলোপদের শিকার করে খাওয়া বুনো কুকুর, লেপার্ড, চিতা, হায়নারা তো বটেই, স্বয়ং পশুরাজও জিরাফকে বেশ সমীহ করে চলে। ঠিক এই কারণেই ন্যাট জিও বা এনিম্যাল প্ল্যানেট চ্যানেলে মাংসভোজী প্রাণীদের অন্যান্য অনেক তৃণভোজীদের শিকার করে খাওয়ার দৃশ্য আকছার দেখানো হলেও জিরাফ শিকার দেখানো হয়না বললেই চলে। আসলে এতগুলো অতিরিক্ত বাক্য খরচ করলাম এটা বোঝাতে যে কাজটা আদৌ সহজসাধ্য নয় এবং কতটা মমতা এবং অসীম ধৈর্য সহকারে লেগে থাকলে এরকম একটি বন্যপ্রাণীর এতটা কাছে আসা যায়।
যাই হোক, পোষ্যদের খাইয়েদাইয়ে খাঁচা থেকে বেরোনর পর নিজেই যেচে গিয়ে আলাপ করেছিলাম। নাম শম্ভু সাউ। আদি নিবাস বিহারের প্রত্যন্ত কোন গ্রামে। চাকুরিজীবনের পুরোটাই চিড়িয়াখানার ছোট কোয়ার্টারে। একটু কম কথারই মানুষ। কাজের প্রশংসা করায়, “ইয়ে অওর কউন সি বড়ি কাম হ্যায়” জবাব দিয়েছিলেন নির্বিকার, নির্লিপ্ত গলায়। তবে পরবর্তীতে এই শম্ভুভাইয়েরই একটা ‘বহোত বড়িয়া কাম’-এর খবর শুনেছিলাম ওনার দুয়েকজন সহকর্মীর মুখে। মাত্র বছরখানেক আগেকার কথা। একটা মাদী জিরাফের বাচ্চা হয়েছে কিন্তু মায়ের বুকে দুধ আসে নি তখনো। প্রমাদ গনেছিলেন চিড়িয়াখানার পশু চিকিৎসক। শাবকটিকে বাঁচাতে মায়ের প্রথম দুধ অর্থাৎ ‘গ্যাঁজা দুধ’ চাই-ই চাই। বিকল্পে এমন গরুর দুধ হলেও চলবে যার প্রায় ওই একইসময়ে বাছুর হয়েছে। শোনামাত্র নিজের ভাঙা স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন শম্ভু। কিন্তু শহরে গোয়াল কোথায়? ফলে মাইল মাইল স্কুটি ঠেঙিয়ে মহেশতলা না কোথাকার একটা গোয়াল থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেই কাঙ্খিত বস্তুটি, ঠিক যেটি ডাক্তারবাবু চেয়েছিলেন। জিরাফ ছানার প্রাণ বেঁচেছিল সেই দুধ পেয়ে। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই দুধ এসে গেছিল মায়ের বুকেও। সহকর্মীদের পিঠ চাপড়ানির জবাবে নাকি ওই একইরকম নির্বিকার ছিলেন শম্ভুভাই। “আরে ভাই, জিনা তো ওহ বাচ্চা কা নসিব থা, ওহ বচ গিয়া। হামে বাধাই দেনে কা ক্যা জরুরত হ্যায়?” ঘটনার সময় রিটায়ারমেন্টের নাকি আর মাত্র মাসখানেক বাকি ছিল মানুষটার। এতদিনে নিশ্চয়ই কোয়ার্টার, প্রাণাধিক প্রিয় পোষ্যকূল আর এ শহরের মায়া কাটিয়ে ফিরে গেছেন বিহারের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে। যেখানেই থাকুন খুব ভাল থাকবেন। সেলাম শম্ভুভাই!
প্রিয় পাঠক, এই এতক্ষণ ধরে যাদের কথা বললাম তারা কেউই তেমন একটা উল্লেখযোগ্য মানুষ নন। রাস্তাঘাটে ব্যস্ত চলাফেরার মাঝে হামেশাই এদের পাশ কাটিয়ে চলে যাই আমরা। দেখেও দেখি না, বলা ভালো খেয়ালই করি না আমাদের সবকিছু গুছিয়েগাছিয়ে নিতে চাওয়া পরিপাটি কেজো চোখে। তথাকথিত মিডিয়া বা প্রচারের সার্চলাইট কোনদিনই হয়তো আলোকপাত করবে না ওদের ওপর। তবুও কি অলৌকিক অভ্যাস ও যাপনে নিজেদের কাজটুকু করে চলেছেন এরা, মনের সূক্ষ্মতম কোণে মিথ্যা বা ভণিতার লেশটুকু মাত্র না রেখে। ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু’ শুধু এই আপ্তবাক্যটুকুর ভরসায়। অতঃপর কাজ (নাকি পালা?) ফুরোলে এদের মধ্যেই হয়তো কেউ কেউ, চলে গেছেন চুপচাপ, এই বিশাল রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে। এরা এমনই সব অমৃতের সন্তান, চাইলেই যাদের সামনে যাওয়া যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না কেমন যেন। অলৌকিক একটা জাদু বাস্তবের বলয় যেন সদাসর্বদা ঘিরে থাকে ওদের। যাবার আগে অথবা এই এখনও কোথাও কোন স্বপ্ন বা চোরা আশাবাদের ঝিলিক উঁকি মেরেছে কি? ওই জাদু দেয়ালের আবরণটা ভেদ করে জানা গেল না তো সেসব গোপন তথ্য? খুব ভালো থাকুন অথবা থাকবেন এ শহরের অলৌকিক মানুষেরা!
ঘটনার মাসতিনেক বাদে। অসুস্থতাজনিত একাধিক ধকল আর বিধিনিষেধ কাটিয়ে সবে একটু আধটু বাইরে বেরনোর ডাক্তারি অনুমতি মিলেছে। বাড়ির অদূরেই বেকবাগান মোড়ে কোয়েস্ট মলের দেয়ালে দেখা মিলেছিল ওরকমই আরেকজন মাকড়শা মানুষের। তবে এবার রঙের বদলে ওয়াটার স্প্রেয়ার দিয়ে কাঁচের দেয়াল পরিষ্কার করছেন তিনি। এবার আর সুযোগটা হাতছাড়া করিনি। প্রায় ঘন্টাখানেক ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করার পর অবশেষে পুলি ঘোরানোর কায়দায় দড়ি টেনে টেনে মাটিতে নেমে এলেন মানুষটি। ফুট পেরিয়ে এপাড়ে এসে উড়িয়া পান-সিগারেটের দোকান থেকে একপ্যাকেট বিড়ি কিনে সস্তার গ্যাস লাইটার জ্বালিয়ে ধরালেন একটা। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম খানিকটা যেচেই। নাম জগত সর্দার। বাড়ি লক্ষীকান্তপুর লাইনে। প্রত্যেকদিন মাকড়শা মানুষ হয়ে দেয়াল বেয়ে ওঠার মজুরি অর্থাৎ রোজ ৮০০-১০০০টাকা। মাসে দিন দশ-বারোর বেশি কাজ পাওয়া যায় না আর চাইলেও দিনকুড়ির বেশি একটানা কাজ করা যায় না। অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজ করা যায় না ঘূর্ণি (ভার্টিগো – অনেক উঁচু থেকে নীচে তাকালে মাথা ঘোরার রোগ) বেমারির সমস্যা থাকলেও। জগতের কথায় শহরে এধরনের ‘এস্পেশাল’ কাজ করার কারিগর মাত্র জনাপঞ্চাশেক। তবু রোজ কাজ জোটে না। কথা বলতে বলতে ভাবছিলাম, দক্ষ পর্বতারোহীদেরও পাহাড় চড়তে চড়তে পাহাড়টা ঘষে ঘষে পরিষ্কার অথবা রঙ করতে হয়না। কুশলী ট্র্যাপিজ শিল্পীদেরও খেলা দেখানোর সময় নীচে থাকে জালের নিরাপত্তা। সেখানে এইসব মানুষেরা? কোনরকম প্রশিক্ষণ নেই, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করে আর ভয়ঙ্কর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কলকাতার দেয়াল বেয়ে উঠছেন বছরের পর বছর। পড়ে মরলে পাঁচটা টাকাও বীমা করা নেই!
“ভয় করে না?” জিগ্যেস করেছিলাম নীচুগলায়। চকচকে একটা হাসি মুহূর্তে ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল জগতের চোখে!
“ভয় করলে পেট শুনবে বাবু?” বিড়িতে শেষ টানটা দিয়ে সেটাকে পায়ের তলায় পিষে চলে গেলেন মাকড়শা মানুষ।
‘তুম পাস আয়ে/ইঁউ মুস্কুরায়ে/তুমনে না জানে ক্যা সপ্নে দিখায়ে….’ একটু দূর থেকে ঈষৎ খোনা এবং দোখনো টিউনে কানে গানের এই কলিগুলো ভেসে এলেই বুঝতে হবে মোনাজেত আসছে। পুরো নাম মোনাজেত আলি লস্কর। বয়েস মাঝ পঞ্চাশের কোঠায়। বেঁটেখাটো রোগাপাতলা চেহারা। পরনে সর্বদা আধময়লা লম্বা ঝুলের বাংলা শার্ট আর লুঙ্গি। কাঁচাপাকা একগাল দাড়ি। শার্টের হাতা কনুই অবধি গোটানো সবসময়। মোনাজেতের নিবাসও দখিন লাইনে। ধপধপি স্টেশনে নেমে ওর বাড়ি ওরই বয়ানে “টেরেকারে গেলি পনেরো মিনিট আর হেঁইট্যে হেই ধরো পেরায় ঘন্টাখানেক।” মোনাজেত, দুর্দান্ত কথক, একইসঙ্গে ব্যবহার আর গানের গলাটি ভারি মিঠে। মোনাজেতের পেশা – একজন ফুলটাইম বেগার।
কেউ যদি প্রশ্ন করে “খেটে খাও না কেন?”
“বেশি খেইট্যে কী হবে বাবু? ইদিকে ( পড়ুন কলকাতায় ) রাস্তাঘাটে ঘন্টাতিনেক হাঁটলেই তো দুশ আড়াইশ কামাই। তারপর গবরমেন্টের ফিরি টেরেন তো আছেই। সকাল নটায় রাস্তায় নেইম্যে দুপুর দুটো আড়াইটের মধ্যি ফের বাড়িতে। বিবিরা খানা পাকিয়ে রেডি কইর্যে রাখে। একপেট ভর্তি খেইয়ে ঠেইস্যে ঘুম দি একখানা।”
একটুও বিব্রত না হয়ে চটজলদি স্মার্ট উত্তর মোনাজেতের। আমার মানুষ দেখার অভিজ্ঞতায় মোনাজেত একমাত্র ভিক্ষুক, যে তার মনোভাব লুকিয়ে রাখতে কোনরকম ভণিতা বা বাহানার আশ্রয় নেয় না। তবে একটু চা-বিড়ি খাইয়ে বসালে এর পিছনে আরেকটা গল্প বেরিয়ে আসে। সেটা এইরকম।
“বোঝলেন বাবু, তখন আমার হেই বিশ বাইশ হবে। নিকে হয়েছিল পাশের গাঁয়ের গোলাম সর্দারের বেটির সঙ্গে। বড় ভালবাসতাম বিবিটাকে। রাজমিস্তিরির জোগাড়ের কাজ করতাম সেসময়। উদোম খাটতাম দিনরাত। তবুও মাসের মধ্যি পনের দিনের বেশি কাজ জুটতো না। রাতদিন খিটিমিটি লেইগ্যেই থাকতো অভাবের সোমসারে। এর মধ্যি এক রেইতে বিবিটা পেইল্যে গেল সব্জির ম্যাটাডোরের এক ডেরাইভারের সঙ্গে। শোকে-গমে একেবারে পাথর হয়ে গেলাম মুই। সে এক পাগলপারা অবস্থা। মাসখানেক লাগলো সেটা সামলাতে। তারপর চোখের পানি মুছে কসম খেলাম খোদাতাল্লার কাছে। নেক(সৎ) রাস্তায় খেইট্যে একটা বিবি ধইরে রাখতে পারলাম না। এবার হারামের পয়সায় দুটো বিবি পালবো।”
জবান রেখেছে মোনাজেত। ওর ঘরে এখন দু-দু’জন বিবি। একসাথেই থাকে সবাই। বড়বিবির তরফে দুই মেয়ে। দুজনেরই বিয়েশাদি হয়ে গেছে। ছোটবিবির তরফে দুই ছেলে। বড়টা ডায়মন্ড হারবার রুটে বাসের হেল্পার। বিয়ে করে আলাদা হয়েছে। ছোটটা কন্সট্রাকশনের মজুর খাটতে যায় মুম্বাই-গুজরাত-বাঙ্গালুরু। মাসে মাসে টাকা পাঠায় কিছু কিছু। সব মিলিয়ে মোটামুটি সুখের দিন এখন মোনাজেতের। দুই বিবি আর ও, সবাই মিলে একসাথে সিনেমা দেখতে যায় মাঝেমাঝে। গঞ্জ শহরের রোল কর্নারে পেঁয়াজ, শশা আর টমাটো নামক জালি কুমড়ো সসের এগ রোল খেয়ে বাড়ি ফেরে রাতে। তবে এত কিছুর মধ্যেও ভিক্ষেটা ছাড়েনি মোনাজেত। মোটামুটি সকাল ন’টার মধ্যে নেমে পড়ে পার্ক সার্কাস স্টেশনে। পার্ক সার্কাস, বেনেপুকুর, তপসিয়া, তিলজলা, এন্টালি, তালতলা, প্রত্যেকদিন আলাদা আলাদা একেকটা নির্দিষ্ট রুট বাঁধা। প্রত্যেক দিন অন অ্যান অ্যাভারেজ ইনকাম দুশো থেকে আড়াইশ টাকা। শুধু জুম্মা বা শুক্রবারের রুটিনটা একটু আলাদারকম। ওইদিন পার্ক সার্কাসে না নেমে সোজা শেয়ালদা। একটু ভুল বললাম কি? আসলে তার আগে পার্ক সার্কাসে নেমে পড়ে একটা পাঁচ টাকার টিকিট কেটে নেয় ও। কারণ শেয়ালদায় বড্ড কড়াকড়ি। হপ্তায় একবার ওই পাঁচ টাকাই এই বেগিং বিজনেসে একমাত্র ইনভেস্টমেন্ট মোনাজেতের। শেয়ালদা থেকে এম জি রোড ধরে সোজা হাঁটা মেরে চিৎপুরের নাখোদা মসজিদ। জুম্মার নামাজে সবচেয়ে বড় জমায়েত হয় ওইদিন। ভিক্ষুক-ফকিরদের খোলাহাতে দান করেন নামাজিরা। নসিব ভাল থাকলে দুশ-আড়াইশ টাকার অঙ্কটা সাড়ে তিনশ থেকে পাঁচশতেও পৌঁছয় কখনো কখনো।
অনেকবার অবাক হয়ে ভেবেছি, একটা মানুষ, যার পুরো পেশাটাই দাঁড়িয়ে আছে ভন্ডামির ওপর ভিত্তি করে তবুও তাকে কেন পয়সা দেয় লোক? পরমুহূর্তেই চমকে উঠে ভুল ভাঙে প্রত্যেকবার! আরে! আমার শহুরে মন এটাকে ভন্ডামি ভাবছে কেন? উল্টে ওর সোজাসাপ্টা স্বীকৃতি, অসম্ভব বিনয়ী ব্যবহার আর চূড়ান্ত সপ্রতিভ কথাবার্তা, দুর্দান্ত রসবোধ আর কথার ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেয়া গ্রাম্য মিঠে গলায় দু’এক টুকরো হিন্দিগানের কলি, এগুলোই কি ওর পেশার ইউ এস পি নয়? এই সমস্ত গুণগুলোকেই মানুষের সামনে পারফর্ম করেই তো পয়সা চায় ও, একজন দক্ষ পেশাদার শিল্পীর মত। এইসব সাতপাঁচ চিন্তাভাবনার মাঝখানেই উঠে দাঁড়ায় মোনাজেত। গেঁয়ো গলায় গুনগুনিয়ে ওঠা সেই মিঠে সুর – “আচ্ছা তো হাম চলতে হ্যায়….আসি গো বাবু, ফের দ্যাখা হবে আসছে বুধবারে!”
আজও মনে আছে মানুষটাকে। সেটা সত্তরের দশকের প্রায় শেষ ভাগ। পার্ক সার্কাস চার নং পুলের বাইপাস কানেক্টরের মোড় তখনো গাড়ি আর মানুষের জঙ্গলে ভরে যায়নি। পুলের ওপারে একটু এগোলেই তখনো দু’হাত অন্তর অন্তর প্রচুর মেছোভেড়ি, মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো ধানখেতি। কালেভদ্রে কলকাতা কর্পোরেশনের এক-আধটা ময়লা ফেলার গাড়ি বিকট ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দ তুলে আর বিষাক্ত ডিজেলের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ব্রিজ টপকে চলে যেত ধাপার দিকে। তপসিয়ার খালে জল তখনো স্রোতস্বিনী, বদ্ধ নালায় পরিণত হয়নি এখনকার মত। সেই সময়, ট্যাংরার চীনেপাড়া থেকে পায়ে হেঁটে চার নং পুল পেরিয়ে এপারে আসতেন তিনি। প্রৌঢ় মানুষটি। ঢলঢলে খাকি ফুলপ্যান্ট আর হাতাগোটানো শাদা ফুলশার্ট। ছোট ছোট চোখ আর খর্বকায় নাক সংযুক্ত চ্যাটালো মোংগলিয়ান মুখাবয়ব। নাম জেনেছিলাম – আ উন সিন। ব্রাইট স্ট্রিট মোড়ের মাথায় এসেই হাঁক পাড়তেন – “আও আও বাচ্চালোগ, জাগলারি কা খেল দেখনে আও, বল কা খেল, আগ কা খেল, রিং কা খেল, চাক্কু কা খেল।” বাচ্চাদের সঙ্গে বুড়োরাও জুটতো চীনেসায়েবের জাগলারির খেল দেখতে। ভিড় জমলে খেলা শুরু হত আটটা কাঠের বল দিয়ে। সে এক মেসমারাইজিং গেম শো ! একের পর এক বল দুহাতের তালুতে পড়েই ফের উঠে যাচ্ছে শূন্যে। ঘুরছে চক্রাকারে। মাটিতে পড়ছে না একবারের জন্যও। বলের পর লোহার রিং আর শেষ দুটো খেলা যথাক্রমে জ্বলন্ত মশাল আর ধারালো আট-আটখানা ভোজালির। দেখতে দেখতে দম আটকে আসতো ভিড়ের মধ্যে বাচ্চা বুড়ো সব্বার! খেলার শেষে, মাঝখানে ড্রাগনের ছবি আঁকা কলাইয়ের একটা থালা নিয়ে এগিয়ে আসতেন সায়েব। “কুছ দো” – বলতেন প্রায় বুজে আসা চোখের কোনে ভারি মিষ্টি হেসে। ছেলেবুড়ো, প্রায় সবাই দিতো, যে যার সাধ্যমত। ‘সময় বহিয়া যায়/নদীর স্রোতের ন্যায়।’ বয়স তার শরীরে দাঁত ফোটাতে শুরু করেছিল। ক্রমে ক্রমে শিথিল হচ্ছিল বেতপেটা শরীরের চামড়া। প্রৌঢ় থেকে দ্রুত বৃদ্ধ হচ্ছিলেন চীনেসায়েব।
শেষবার দেখেছিলাম ৯০-এর গোড়ায়। দু’চোখে পুরু ছানির স্তর। প্রায় অন্ধ। তবুও খেলা দেখিয়ে যাচ্ছেন স্রেফ আন্দাজের ওপর ভরসা করে। মাঝে মাঝে হাত ফস্কে বল বা মশাল পড়ে যাচ্ছে। আগুনের ছ্যাঁকা লাগছে হাতে। লোকজন হাসাহাসি করছে। খেলার শেষে কাঁপা কাঁপা হাতে হাতড়ে হাতড়ে ঝোলার মধ্যে ভরছিলেন খেলা দেখানোর সরঞ্জামগুলো। অন্যদিন একটাকা দু’টাকা দিই। সেদিন কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতে গুঁজে দিয়েছিলাম পাঁচটা টাকা। ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসেছিলেন সায়েব। সেই দেখা শেষবারের মত! আর কোনদিন শহরের কোথাও চোখে পড়েনি মানুষটাকে। এ শহরের শেষ এবং একমাত্র চীনে জাগলার, আ উন সিন।
শীলাকেও দেখেছিলাম ওই হাসপাতালের বেডে শুয়েই। শীলা মন্ডল। বাড়ি উল্টোডাঙ্গার মুরারিপুকুর বস্তি। বয়েস বছর পঁচিশ। পেশাগত পরিচয় – বাইপাসের ধারে সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের ক্যাজুয়াল গ্রুপ-ডি স্টাফ। নো ওয়ার্ক নো পে। গোদা বাংলায় – কাজে এলে দিনমজুরী আছে, না এলে নেই। হসপিটালে সব মিলিয়ে দিনদশেক থাকতে হয়েছিল। অপারেশনের পর দিনআড়াই আই সি সি ইউয়ের বেডে অজ্ঞান অনন্তশয়নম হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া হাতে অখন্ড অবসর। বাড়ি থেকে দিয়ে যাওয়া বই পড়ে আর কাঁহাতক সময় কাটানো যায়। ফলে আমার সময় কাটানোর সঙ্গী হল শীলা। অপারেশন হয়ে জেনারেল বেডে স্থানান্তরিত হবার পর ওই ওয়ার্ডে নাইট ডিউটি ছিল ওর। এর আগে অন্যান্য প্রয়োজনে বহুবার যেতে হলেও নিজেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি কোনদিন। ফলে ব্যাপারটা খেয়াল করিনি সেভাবে। খুব ইন্টারেস্টিংলি লক্ষ্য করেছিলাম, এইসব সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেশিরভাগ পেশেন্টই খুব ঠেকায় না পড়লে ডাক্তার বা নার্স ছাড়া শীলার মত ক্যাজুয়াল ফোর্থ ক্লাস স্টাফদের সঙ্গে কথা বলেন না। আড্ডার চিরন্তন বদভ্যাস আমার রক্তে। ফলে শীলার সঙ্গে জমে গেল খুব। গোটা ওয়ার্ড জুড়ে চরকিপাক খাওয়া উদোম খাটনির মাঝখানে একটু আধটু সুযোগ পেলেই বেডের পাশটায় এসে দাঁড়াতো মেয়েটা। বসতে বললেও বসতো না কিছুতেই। “না স্যার, মানা আছে। রিপোর্ট হয়ে যাবে।” প্রত্যাখ্যান করতো প্রত্যেকবার, অত্যন্ত বিনীতভাবে। ফলে আড্ডা টুকটাক যেটুকু হত, সেটা দাঁড়িয়েই। ওর কাছেই শুনেছিলাম মুরারিপুকুরের ঘিঞ্জি বস্তির দশফুট বাই দশফুট ঘরে প্রৌঢ় মা, কাজ করে তিন বাবুর বাড়িতে। পরের ভাই রবীন্দ্রভারতীতে এম এ, প্রথম বর্ষ। সবচেয়ে ছোট বোনটা উচ্চ মাধ্যমিক দেবে এবছর। “আর তোর কি হবে? নিজের কথা ভেবেছিস কিছু? বিয়েটিয়ে? কিছু ঠিক করা আছেটাছে নাকি?” জবাবে মাটিতে যেন মিশে গিয়েছিল মেয়েটা। “সে আছে একজন।” জবাব দিয়েছিল মাথা নীচু করে মেঝেয় নখ খুঁটতে খুঁটতে। “তা সে কি করে ?” প্রশ্ন করেছিলাম ফের। “অটো চালায় শোভাবাজার উল্টোডাঙ্গা রুটে কিন্তু আমি পস্টাপস্টি বলে দিয়েছি, অপেক্ষা করতে হবে। আগে ভাইবোনগুলো একটু দাঁড়িয়ে যাক। এখনি আমি চলে গেলে সব ভেসে যাবে। অভাবের সংসারে আমার এইটুকু রোজগার যে অনেক। ও যদি সত্যিই আমায় ভালোবাসে, তাহলে অপেক্ষা করবে আমার জন্য।” শোনামাত্র যেন ৪৪০ ভোল্টের শক লেগেছিল শরীরে! একি শুনলাম? বহুবছর আগে হুবহু এই একই সংলাপ শুনেছিলাম ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সেই নীতার মুখে। “অপেক্ষা করবেনা? আপনি কি বলেন কাকু?” এবার প্রশ্ন করল নীতা থুড়ি শীলা। ঠিক সেই সময় প্রায়ান্ধকার ওয়ার্ডে কাচের জানলা ভেদ করে ঠিকরে আসা আধো চন্দ্রাতপ লক্ষ নিয়নের দ্যুতি হয়ে ঝলসাচ্ছিল শীলার মুখে ! “হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেন করবে না? অবশ্যই করবে।” জবাব দিয়েছিলাম খানিকটা হোঁচট খেয়েই। কিন্তু মনে জোর পাচ্ছিলাম না তেমন। কারণ নীতার অভিজ্ঞতাটা তেমন সুখকর ছিল না।
সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেছিল বেডে। আমার গায়ে দুটো কম্বলের আস্তরণ। জানলার ধারে গুঁড়িসুড়ি মেরে দাঁড়িয়ে কনকনে এসির ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে শীলা। পরনে সবুজরঙা পাতলা সুতির ঢোলা হাফহাতা বুশশার্ট আর পাজামা। হাসপাতালের ইউনিফর্ম। বাড়ি থেকে পাঠানো আলোয়ানটা দিতে চেয়েছিলাম। নেয়নি কিছুতেই। ওতে নাকি ড্রেস কোড রুল ব্রেক করা হবে।
অতঃপর শহরের সমস্ত সুপার এবং মাল্টি স্পেশালিটি প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষর কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনাদের ঝাঁ-চকচকে বিলাসবহুল চিকিৎসালয়গুলিতে মানুষকে সুস্থ করে তোলার দক্ষিণা নেহাত কম নয়। ব্যক্তিগতভাবে সে অভিজ্ঞতা আছে। এইসব মেয়েদের ছুটিছাটা, অন্যান্য আর্থিক সুযোগসুবিধা, কিছুই তো দেন না আপনারা, দয়া করে একটা সোয়েটার আর গভীর রাতে একটু বসবার অনুমতিটুকু অন্তত দিন যাতে হাজার হাজার শীলা যে কোনদিন ওই মেঘে ঢাকা তারার নীতার মত টুপ করে আকাশ থেকে খসে না যায়।
নাম ইভলিন হুপার। এখনো একদা কসমোপলিটান এই শহরটায় রয়ে যাওয়া স্বল্পসংখ্যক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে একজন। নিবাস মধ্য কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে। তবে ওই নামে ডাকলে পাড়ায় কারো পক্ষে চেনার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু একবার যদি বলেন বেড়াল মাসি বা ক্যাট আন্টির বাড়ি যাব, মাইলখানেক দূরের বাড়ি থেকেও বলে দেবে। কারণ ইভলিন আন্টির বাড়ি আক্ষরিক অর্থেই দুনিয়ার যত মার্জারের অভয়াশ্রম। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০-৮০ টা মত বেড়াল রয়েছে এন্টালির বেজায় পুরোন বাড়িটার একতলায় আন্টির শ-চারেক স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। বিছানা থেকে বসার চেয়ার হয়ে ফ্রিজ কিম্বা র্যাকের ওপর বরাভয়দানকারী প্রভু যীশুর কোল ঘেঁষে, যেদিকে তাকানো যায় শুধু বেড়াল আর বেড়াল। অনেকেই সেটা জানেন। ফলে বাড়ির স্টোররুমে বা সিঁড়ির প্যাসেজের নীচে জন্মানো অবাঞ্ছিত মিনিটার আরো অবাঞ্ছিত ক্ষুদে ক্ষুদে ছানাগুলোকে রাতের অন্ধকারে এনে ফেলে রেখে যান আন্টির দোরগোড়ায়। আন্টি ফেরান না কাউকে। ফলে ওনার ফ্ল্যাট নামক ‘দাদুর দস্তানা’ বেড়ালের চাপে ফাটো ফাটো প্রায়। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মুচকি হেসেছিলেন আন্টি। “লুক মাই সন, ওরা তো নিজের ইচ্ছেয় এ বাড়িতে আসেনি। হয় আমি ওদের এনেছি নয়তো অন্য কেউ দিয়ে গেছে। আসলে এটাই হয়তো আমার ডেস্টিনি, ইউ ক্যান সে – ব্লেসিংস অফ গড।” বলতে বলতে ঝলমলে হাসিতে ভরে উঠেছিল বেড়াল মাসির মুখটা।
রোজ সকাল এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ এন্টালি আর তালতলার শেষবেলার অর্থাৎ ‘ভাঙা বাজারে’ যান আন্টি। একটু সস্তা মাছ, মুর্গির ছাঁট, গিলেমেটে, মাথা আর লর্ডপাড়ার গায়ে চার্চ থেকে ক্রিশ্চান সাবসিডির সস্তা গুঁড়ো দুধ কিনে নিয়ে আসেন। অতঃপর রান্না চড়ে। সে এক যজ্ঞিবাড়ির আয়োজন। সবকিছু মিটতে মিটতে বেলা গড়িয়ে তিনটে সাড়ে তিনটে। অতঃপর নিজে যা হোক দুটো নাকে মুখে গুঁজে পোষ্যদের পাশেই একটু গড়িয়ে নেন বিছানায়। সেসময়টায় সঙ্গী মিলস অ্যান্ড বুনসের পেপারব্যাক, নইলে টিভিতে বে ওয়াচ কিম্বা বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল। আন্টির আক্ষেপ একটাই আর সেই আক্ষেপটা মাঝেমাঝেই ঝরে পড়ে গলায় – “খারাপ লাগে একটা ব্যাপারেই, এত লোক বেড়াল দিয়ে যায়, আমি তো তার বদলে পয়সা চাইছি না। শুধু বলি, মাঝে মাঝে একটু দুধ বা মাছ দিয়ে যেও। আমার একটু সুরাহা হয়। কেউ দেয়না, জানো ! এনিওয়ে, দিস ইজ লাইফ !” ম্লান হাসেন আন্টি।
আন্টির ‘বাডি’ মিঃ হুপার ( স্বামীকে ওই নামেই ডাকতেন ), একটি বহুজাতিক কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, গত হয়েছেন বেশ কয়েকবছর হল। দুই ছেলেমেয়ের দুজনেই অস্ট্রেলিয়া। চাকরিবাকরি, বিয়েশাদি করে সেটলড দুজনেই। প্রতি মাসে কিছু কিছু টাকা পাঠায় নিয়ম করে। এছাড়া বাডির রেখে যাওয়া ওই যেটুকু, সব মিলিয়ে চলে যায় কোনমতে। প্রতি রোববার সকালে মৌলালি মোড়ের চার্চে যাওয়া ছাড়া এটাই মোটামুটি ডেইলি রুটিন ইভলিন হুপারের। দু’একবছর বাদে বাদে ছেলেমেয়েরা আসে ছুটিছাটায়। বলে “এখানে একা একা পড়ে থেকে কি হবে? অস্ট্রেলিয়া ইজ আ ড্রিমল্যান্ড! চলো, আমাদের সঙ্গে ওখানে গিয়ে সেটল করবে।” বিশেষত মেয়ে। মেয়ের কথায় হাসেন ইভলিন। “যেতে তো পারি কিন্তু তাহলে তো আমার সাথে সাথে এন্টালি তালতলার বাজার, পাড়ার সরু গলি, মাই নেইবারস, মৌলালি মোড়ের মাথায় লাল ইঁটের চার্চ, এগুলোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট মাই লিটল এঞ্জেলস?” পাশে বসে থাকা গম্ভীরমুখো হুলোটার মাথায় হাত বোলান আন্টি, “আমার এই ক্ষুদে বিচ্ছুগুলোর কি হবে?”
শোনামাত্র চমকে উঠছিলাম। অনেকগুলো বছর আগে দুনিয়া কাঁপানো এক মার্কিন রকস্টার এই একই কথা বলেছিলেন সানাইয়ের ইশ্বর বিসমিল্লা খান সাহেবকে, বেনারসের বাড়িতে বসে। জবাবে মুচকি হেসে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন খান সাহেব “কাশী বিশ্বনাথের গলি, হনুমানটোলি, দশশ্বমেধ ঘাট, রোজ ভোরে গঙ্গাস্নান, গোধুলিয়ার চৌরাহা….তব তো ইয়ে সবকো ভি সাথ লেনা হোগা। সেটা কি পারবে তুমি?” কোথায় বেনারসে খান সাহেবের বাড়ি আর কোথায় এন্টালি পাড়ার সরু গলি, তবুও কি আশ্চর্য মিল দুটো সংলাপের মধ্যে!
“ইউ নো মাই সন, কথাটা শোনার পর মেয়ে রেগে উঠে চলে গিয়েছিল আমার সামনে থেকে। কিন্তু আমি তো সত্যি কথাটাই বলেছিলাম। আই রিয়েলি ডিড মিন ইট!” গলা ধরে এসেছিল আন্টির। প্রায় পনের ষোল বছর আগেকার কথা, তখনই সত্তরের গন্ডি পেরিয়ে গেছিলেন আন্টি। কেমন আছেন এতদিনে? আর তাঁর সেইসব লিটল এঞ্জেলরা? সব বহাল তবিয়তে তো? যতবার ওদিকটা দিয়ে গেছি ততবার ওই গলিতে ঢোকার প্রবল ইচ্ছেটা হার মেনেছে পেট খামচে উঠে আসা একটা অজানা গা ছমছমে আশংকার কাছে। যদি… ?
শেষ কাহিনী বা ঘটনার কুশীলব অথবা প্রধাণ চরিত্র একজন নয়, দুজন। দুজনেরই দেখা মিলেছিল আলিপুর চিড়িয়াখানায়। তবে একসঙ্গে নয়, বেশ কয়েকবছর আগেপরে। প্রথমজনের সঙ্গে মোলাকাতের ঘটনাটায় আসি প্রথমে। প্রায় বছর পনের আগেকার কথা। শীতকালের এক দুপুরে, ছুটিছাটা নয়, সাধারণ একটা কেজো দিনে গিয়েছিলাম চিড়িয়াখানায়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, সেই ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি চিড়িয়াখানায় যাওয়াটা একটা নেশার মত আমার কাছে। আর এই যাওয়ার ব্যাপারে যে কোন একটা সাধারণ দিনই সবচেয়ে পছন্দের। কারন ওই কেজো দিনগুলোয় পশুপাখিদের বিরক্ত করা ( যা কখনো কখনো ভয়ঙ্কর অমানবিক আর নিষ্ঠুরও বটে ) আদেখলে দর্শকের ভিড় অনেকটাই কম থাকে। ফলে পশুপাখিদের অনেক বেশি খোশমেজাজে দেখা যায়। যাকগে, অতঃপর মূল প্রসঙ্গে ফিরি আবার। আজো মনে আছে দিনটা। শেষ বিকেলের রোদ দ্রুত ঝিমিয়ে পড়ছে। পৌষের শীতবাতাস তার গতি বাড়িয়ে কামড় বসাতে শুরু করেছে শরীরে। আম দর্শকের ভিড়ও পাতলা হতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। পশুশালার দরজা বন্ধ হতে আর বড়জোর আধঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি। দাঁড়িয়েছিলাম কুমীরদের থাকার জায়গা সদ্যনির্মিত বিশাল জলাশয়টার সামনে। সেসময় একেবারে ফাঁকা, দর্শকশূন্য জায়গাটা। জলাশয়ের মাঝখানে একাধিক কৃত্রিম দ্বীপ। সেগুলোর ওপর রোদ পোয়াচ্ছে অসংখ্য ছোটবড় আকারের কুমীর। তারমধ্যে কোন কোনটা তো আকারে ১১-১২ ফুট হবে। শরীরে তিলমাত্র প্রাণের স্পন্দন নেই। হঠাত দেখলে বিশালকায় কাঠের গুঁড়ি বলে ভুল হতে পারে। এইসময় দূর থেকে ঘড়ঘড় করে কিছু একটা এগিয়ে আসার শব্দ। আওয়াজটা আরও কাছে এগিয়ে আসা মাত্র কাঠের গুঁড়িগুলোয় চকিতে প্রাণের স্পন্দন জাগলো যেন। আলোড়ন তুলে বিদ্যুতগতিতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো কুমীরেরা। চোখ তুলে তাকালাম সামনে। জলাশয়ের পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়ালেন একজন। রোগাপাতলা, মাঝারি উচ্চতা, শ্যামবর্ণ। অতি সাধারণ চেহারা। দুহাতে ধরা লোহার ঠেলাগাড়ির হাতল। দেখতে অনেকটা ঝাড়ুদারদের গাড়ির মত, তবে উচ্চতায় অনেকটা কম আর আকারেও বেশ খানিকটা ছোট। গাড়ির ডালায় ভর্তি বড় বড় মাংসের টুকরো। পাঁচিলের এপার থেকে মাংস তুলে তুলে জলাশয়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন মানুষটা। সঙ্গে সঙ্গে জল জুড়ে একটা সুনামি শুরু হয়ে গেল যেন। ওই উথালপাথাল জল তোলপাড়ের মধ্যেও চারদিকে নজর ঘুরছিল মানুষটার। হঠাৎই চোখ গেল জলাশয়ের ভিতরদিকটায়। সামনে ধেয়ে আসা ধাড়িগুলোর ভিড়ে কুচোকাঁচাগুলো এগিয়ে এসে খেতে পারছে না। আর ঠিক তখনই ঘটে গেল সেই রোমহর্ষক কান্ডটা! হাতের বালতিতে মাংস নিয়ে পাঁচিল টপকে জলাশয়ের পাড়ে লাফিয়ে পড়লেন মানুষটা। ভেঙে পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল তুলে নিয়ে স্রেফ লাফিয়ে পেরিয়ে গেলেন গোটা দুতিনেক ছোট ছোট চর। এসে দাঁড়ালেন একেবারে মাঝখানের একটা চরে। একহাতে ক্রমাগত গাছের ডাল দিয়ে জলে বাড়ি মেরে ধাড়িগুলোকে হঠিয়ে রেখে অন্যহাতে মাংস ছুঁড়ে ছুঁড়ে খাওয়াতে লাগলেন ক্ষুদেগুলোকে। একইসঙ্গে মুখে অবিশ্রান্ত গালি বড়দের উদ্দেশ্যে, “শালা হারামিলোগ, বাচ্চোঁকো খানে নহি দে রহা।” অতঃপর মিনিটদশেক বাদে নিশ্চিন্ত হয়ে একটা ভারি তৃপ্তির হাসি ঠোঁটের কোনে, “চলো, সবকোই খা লিয়া।” বলে চর টপকে টপকে ফিরে এলেন একই কায়দায়, ঠিক যেভাবে গেছিলেন।
প্রিয় পাঠক, সমগ্র দৃশ্যটা চোখ বুজে কল্পনা করার চেষ্টা করুন একবার। পায়ের একহাত নীচে জলের তলায় খেলে বেড়াচ্ছে জলজ্যান্ত শমন! একটু এদিকওদিক হলেই….অথচ সে সবকে থোড়াই কেয়ার, একমাত্র মিশন – অপেক্ষাকৃত ছোটগুলোকে কিভাবে একটু খাওয়ানো যায়। এদিকে এই অধম প্রতিবেদকের পা তো মাটিতে জমে পাথর ততক্ষণে! কোনমতে সেটা কাটিয়ে এগিয়ে গেছিলাম সামনে। একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে আলাপ জমেছিল। নাম বলেছিলেন সম্ভবত ইউসুফ। এতদিন বাদে স্মৃতিবিভ্রমও হতে পারে। সে যাকগে, নামে কি আসে যায়। কাজটাই আসল। চিড়িয়াখানায় রেপটাইল ডিপার্টমেন্টে সরীসৃপদের খাওয়াদাওয়া আর দেখভালের কাজটা করে থাকেন পঞ্চাশোর্ধ এই মানুষটি। ওনার কাছেই নিয়েছিলাম জীবজগতের কত পাঠ। ভীমকায় একটা কুমীরও হপ্তায় খায় মাত্র একবার। বড়জোর কেজিপাঁচসাতেক মাংস। কারণ দেহের তুলনায় ওদের পাকস্থলী অনেক ছোট। ফলে হজম করতেও সময় লাগে অনেক বেশি। শুধু কুমীর নয়, সমগ্র সরীসৃপ জগতেই এটা সত্য। ওনার কাছে আরো জেনেছিলাম, একটা ১৭-১৮ ফুটের অজগরের ডায়েট চার্ট – পূর্ণবয়স্ক একটা মুর্গি, আর সেটাও ওয়ান্স ইন আ উইক। একইভাবে ১৪-১৫ ফুট একটা রাজ গোখরো বা শঙ্খচূড়ের ( কিং কোবরা ) খোরাক গোটা তিনচারেক ঢোঁড়া বা হেলে সাপ। সাধারন গোখরো, কেউটে, চন্দ্রবোড়া, শাঁখামুটি, দাঁড়াশ, ঢোঁড়ার জন্য ধেড়ে ইঁদুর আর ব্যাং। তক্ষক, কালনাগিনী, লাউডগা আর কালাচের পাতে ছোটখাট কয়েকটা আরশোলা, নেংটি ইঁদুর বা ব্যাঙের বাচ্চা হলেই চলবে।
হ্যাঁ, সেই কদ্দিন আগে শহুরে শিক্ষার বড়াই করা এই অধম প্রতিবেদক একজন নিরক্ষর কিন্তু যথার্থ প্রকৃতি বিজ্ঞানীর কাছে নিয়েছিল এই অপার প্রকৃতিপাঠ। কোন ইশকুলের জীববিজ্ঞান ক্লাসে শেখানো হয় না এসব। অতঃপর ক্লাস শেষ করে হাসতে হাসতে গাড়ি ঠেলে চলে গেছিলেন আমার নেচার ক্লাসের শিক্ষক। নাহ, ইউসুফ ভাই কোন ক্রোকোডাইল হান্টার স্টিভ আরুইন, ডঃ ব্রাডি ব্রার বা জঙ্গল অভিযাত্রী বেয়ার গ্রিলস নন। ন্যাট জিও বা ডিসকভারি চ্যানেল ওর মত অজ্ঞাতকুলশীল কোন নেচার মায়েস্ত্রোকে কভার করবে না কোনদিন। তবু ওর মত মানুষেরা নিজেদের কাজটা করেই যাবেন নিজদের মত করে, অসীম সাহসের ওপর ভরসা রেখে, নিঃস্পৃহ, নির্মোহ কোন নির্জনবাসী সাধকের মত। নাহ, ইউসুফ ভাইয়ের সন্ধানে আমাকে অস্ট্রেলিয়ার নোনাজলের নদীঘেরা বাদাবন বা আমাজনের গহীন অরণ্য, কোত্থাও যেতে হয়নি। দেখা হয়ে গেছিল আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় এই শহরটায়। এই কলকাতায়! এটা কি কম গর্ব, কম আত্মশ্লাঘার ব্যাপার নাকি?
মানুষটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন উনি জিরাফের খাঁচার পিছনদিকটায় ইয়া উঁচু খিলানওয়ালা ঘরটায় আন্ডাবাচ্চা সমেত গোটাসাতেক জিরাফের একটা পরিবারকে ছাঁটা ঘাস, গাছের পাতা আর চানা দানা ভুষি খাওয়াতে ব্যস্ত। ওনাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের মত জিরাফেরা। নিজের হাতে ভাগ করে করে সবার দিকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছিলেন উনি। বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নীচু করে ওনার সেই মধ্যস্থতা মেনে নিচ্ছিল সবাই। এই অবধি পড়ে যাদের মনে হল – ধুত! এ আর কী এমন ব্যাপার, জিরাফের মত একটা নিরীহ তৃণভোজী প্রাণী, ওকে সামনে দাঁড়িয়ে ক’টা ঘাসপাতা খাওয়ানো এমন কি একটা কঠিন কাজ। তাঁদের অবগতির জন্য জানাই – ‘আজ্ঞে না মশাই, কাজটা যতটা সোজা ভাবছেন আসলে সেটা মোটেই অতটা জলভাত নয়। প্রতিবছর আফ্রিকার সাভানা প্রান্তরে বেশ কিছু সিংহ সাঙ্ঘাতিক রকম আহত হয় অথবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জিরাফ শিকার করতে গিয়ে, ওদের দেঢ়তলা বাড়ি সমান পেছনপায়ের চাঁট খেয়ে। ফলে হামেশা জেব্রা, ব্ল্যাকবাক হরিন বা অ্যান্টিলোপদের শিকার করে খাওয়া বুনো কুকুর, লেপার্ড, চিতা, হায়নারা তো বটেই, স্বয়ং পশুরাজও জিরাফকে বেশ সমীহ করে চলে। ঠিক এই কারণেই ন্যাট জিও বা এনিম্যাল প্ল্যানেট চ্যানেলে মাংসভোজী প্রাণীদের অন্যান্য অনেক তৃণভোজীদের শিকার করে খাওয়ার দৃশ্য আকছার দেখানো হলেও জিরাফ শিকার দেখানো হয়না বললেই চলে। আসলে এতগুলো অতিরিক্ত বাক্য খরচ করলাম এটা বোঝাতে যে কাজটা আদৌ সহজসাধ্য নয় এবং কতটা মমতা এবং অসীম ধৈর্য সহকারে লেগে থাকলে এরকম একটি বন্যপ্রাণীর এতটা কাছে আসা যায়।
যাই হোক, পোষ্যদের খাইয়েদাইয়ে খাঁচা থেকে বেরোনর পর নিজেই যেচে গিয়ে আলাপ করেছিলাম। নাম শম্ভু সাউ। আদি নিবাস বিহারের প্রত্যন্ত কোন গ্রামে। চাকুরিজীবনের পুরোটাই চিড়িয়াখানার ছোট কোয়ার্টারে। একটু কম কথারই মানুষ। কাজের প্রশংসা করায়, “ইয়ে অওর কউন সি বড়ি কাম হ্যায়” জবাব দিয়েছিলেন নির্বিকার, নির্লিপ্ত গলায়। তবে পরবর্তীতে এই শম্ভুভাইয়েরই একটা ‘বহোত বড়িয়া কাম’-এর খবর শুনেছিলাম ওনার দুয়েকজন সহকর্মীর মুখে। মাত্র বছরখানেক আগেকার কথা। একটা মাদী জিরাফের বাচ্চা হয়েছে কিন্তু মায়ের বুকে দুধ আসে নি তখনো। প্রমাদ গনেছিলেন চিড়িয়াখানার পশু চিকিৎসক। শাবকটিকে বাঁচাতে মায়ের প্রথম দুধ অর্থাৎ ‘গ্যাঁজা দুধ’ চাই-ই চাই। বিকল্পে এমন গরুর দুধ হলেও চলবে যার প্রায় ওই একইসময়ে বাছুর হয়েছে। শোনামাত্র নিজের ভাঙা স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন শম্ভু। কিন্তু শহরে গোয়াল কোথায়? ফলে মাইল মাইল স্কুটি ঠেঙিয়ে মহেশতলা না কোথাকার একটা গোয়াল থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেই কাঙ্খিত বস্তুটি, ঠিক যেটি ডাক্তারবাবু চেয়েছিলেন। জিরাফ ছানার প্রাণ বেঁচেছিল সেই দুধ পেয়ে। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই দুধ এসে গেছিল মায়ের বুকেও। সহকর্মীদের পিঠ চাপড়ানির জবাবে নাকি ওই একইরকম নির্বিকার ছিলেন শম্ভুভাই। “আরে ভাই, জিনা তো ওহ বাচ্চা কা নসিব থা, ওহ বচ গিয়া। হামে বাধাই দেনে কা ক্যা জরুরত হ্যায়?” ঘটনার সময় রিটায়ারমেন্টের নাকি আর মাত্র মাসখানেক বাকি ছিল মানুষটার। এতদিনে নিশ্চয়ই কোয়ার্টার, প্রাণাধিক প্রিয় পোষ্যকূল আর এ শহরের মায়া কাটিয়ে ফিরে গেছেন বিহারের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে। যেখানেই থাকুন খুব ভাল থাকবেন। সেলাম শম্ভুভাই!
প্রিয় পাঠক, এই এতক্ষণ ধরে যাদের কথা বললাম তারা কেউই তেমন একটা উল্লেখযোগ্য মানুষ নন। রাস্তাঘাটে ব্যস্ত চলাফেরার মাঝে হামেশাই এদের পাশ কাটিয়ে চলে যাই আমরা। দেখেও দেখি না, বলা ভালো খেয়ালই করি না আমাদের সবকিছু গুছিয়েগাছিয়ে নিতে চাওয়া পরিপাটি কেজো চোখে। তথাকথিত মিডিয়া বা প্রচারের সার্চলাইট কোনদিনই হয়তো আলোকপাত করবে না ওদের ওপর। তবুও কি অলৌকিক অভ্যাস ও যাপনে নিজেদের কাজটুকু করে চলেছেন এরা, মনের সূক্ষ্মতম কোণে মিথ্যা বা ভণিতার লেশটুকু মাত্র না রেখে। ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু’ শুধু এই আপ্তবাক্যটুকুর ভরসায়। অতঃপর কাজ (নাকি পালা?) ফুরোলে এদের মধ্যেই হয়তো কেউ কেউ, চলে গেছেন চুপচাপ, এই বিশাল রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে। এরা এমনই সব অমৃতের সন্তান, চাইলেই যাদের সামনে যাওয়া যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না কেমন যেন। অলৌকিক একটা জাদু বাস্তবের বলয় যেন সদাসর্বদা ঘিরে থাকে ওদের। যাবার আগে অথবা এই এখনও কোথাও কোন স্বপ্ন বা চোরা আশাবাদের ঝিলিক উঁকি মেরেছে কি? ওই জাদু দেয়ালের আবরণটা ভেদ করে জানা গেল না তো সেসব গোপন তথ্য? খুব ভালো থাকুন অথবা থাকবেন এ শহরের অলৌকিক মানুষেরা!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
কত রকম মানুষ, কত রকম নিষ্ঠা! এই নিয়েই কল্কেতে আছি , থেকে যাবো বাকিটা! লেখাটি প্রতিটি ছত্রে আরো গভীর হলো মমতায়, আরো টেনে রাখলো চমকে, শেষের দিকটা কেমন যেন ঘর এনে দিলো —- মানুষকে দেখার এরকম একটা তারিকাও আছে তাহলে ? একেকটি মানুষ খুবই সাধারণ , একেবারে সাদামাটা, কিন্তু যখন তাদের পাশাপাশি রাখলেন লেখক – কি অনবদ্য ব্যালাড হয়ে উঠলো , জোয়ান বায়েজ মনে পরে “ডিয়ামন্ডস এন্ড রাস্ট “.
দারুণ লাগলো। ফিকশন নন-ফিকশন দুয়েতেই সুপ্রিয়বাবুর অবাধ বিচরণ।