bibidho-parasmoipadi

পরস্মৈপদী
রম্যরচনা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়

 

‘অ্যাই শিবেন, তোমার ছাতার তলায় করে আমাকে একটু বাজারে পৌঁছে দিবি? যাচ্ছেতাই রকমের বৃষ্টি নামল।’

বিরক্ত হল শিবেন। এই ছাতায় দুজন মিলে গেলে এক দিকের হাত অবশ্যম্ভাবী ভিজবে। অন্তত এক দেড়শো পা হাঁটতে হবে বাজারের গেট অবধি পৌঁছতে। কিন্তু কিছু বলা যাবে না, পাড়ার লোক তায় ভারি ঘ্যানঘেনে। 

অচিন্ত্যর মণিহারী দোকানের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সহৃদয়বাবু। শিবেন সেই অবধি এগিয়ে বলল, ‘আসুন।’

সহৃদয়বাবু এক পা বাড়িয়ে টকাস করে শিবেনের ছাতার তলায় চলে এলেন। ‘এত জোরে বৃষ্টি নামবে বুঝিনি, বুঝলে ছাতা আনতুম। ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয় কথাটা কতখানি সত্যি তা প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারি, বুঝলে হে শিবেন। এই যেমন তুমি, সময়কালে শিব হয়ে এসে উদ্ধার করলে।’

শিবেনের ডান দিকটা অলরেডি ভিজে গেছে। সহৃদয়বাবু লম্বায় খুব একটা বেশি না হলেও চওড়ায় বেশ ভালোই। তেনার গুঁতোয় বেচারা শিবেন খানিকটা ছাতার বাইরে। সহৃদয়ের কথা শুনে মনে মনে গালাগাল দিল শিবেন। ‘শালা, হাড়কিপ্টে ঘাড়ে পড়া লোক একটা। সকাল থেকে মেঘ করে আছে, উনি বোঝেননি যে বৃষ্টি হতে পারে। ন্যাকামো।’ মনে ভাবলেও মুখে কোনো শব্দ খরচ করল না শিবেন। বাজারের গেট এসে যাওয়ায়, টা টা’ বলে সহৃদয়বাবু ঢুকে গেলেন ভেতরে।

‘অ্যাই নাড়ু, ওটা কি মাছ? রুই না কাতলা? ইস, পুরো বরফের পিরামিড করে রেখেছিস দেখছি। নির্ঘাত পচা মাছ নইলে এত বরফ কেউ চাপায়!’

‘মাছ চেনেন বা আবার নিন্দে করছেন? আমি কি আপনাকে নেবার জন্যে সাধছি যে শুদুমুদু বাজারে দাঁড়িয়ে খদ্দেরদের শুনিয়ে যা তা বলছেন?’

‘সুনাগরিক হিসেবে আমার একটা কর্তব্য আছে তো না কী? তুই টাকা নিয়ে পচা মাছ খাওয়াবি, আমি বাকি খদ্দেরদের সতর্ক করব না?’

‘দেখুন জেঠু, আপনাকে চেনে না এ তল্লাটে তেমন একজনও নেই। আপনি কতটা ধান্দাবাজ কিপ্পুস, সক্কলে জানে। কেউ আপনার কথা বিশ্বাস করবে না।’

‘নাড়ু, আমাকে তুই খুব অপমান করছিস কিন্তু। ভদ্রভাবে কথা বল বলে দিলাম। কিপ্টে আর সঞ্চয়ীর তফাত তোর মতো মূর্খ কী বুঝবে!’

ইতিমধ্যে এক ভদ্রলোক নাড়ুর সামনে এসে বললেন, ‘কাতলা কত করে ভাই? টাটকা হবে তো?’

‘খেয়ে দেখে তবে টাকা দিয়ে যাবেন কাকু, এইটুক বলে দিলাম।’

‘ওইটা কত?’ নির্দিষ্ট মাছের দিকে আঙুল দেখালেন ভদ্রলোক।

‘গোটা দেব?’

‘তাই দাও।’

ওজন করে নাড়ু বলে, ‘সাড়ে চারশো টাকা দিন কাকু।’

‘মাছটা কেটে দাও দেখি। মুড়োটা বাদ দিয়ে দিও। মুড়ো খাবার লোক নেই। নাও, টাকাটা ধরো।’

‘কী অদ্ভুত দেখুন দিকি, আপনার বাড়িতে মুড়ো খাবার লোক নেই আর আমার বাড়িতে মুড়োর হরেক কিসিমের পদ রান্না হয়, হে হে। মুশকিল হল, শুধু মুড়ো এই নাড়ুগোষ্ঠী বেচে না। ফলে গোটা মাছ কিনতে হয়। মুড়োর খদ্দের যত, মাছের খদ্দের অত…’

সহৃদয়বাবু কথা শেষ করার আগেই ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘মুড়োটা ওনাকে দিয়ে দাও।’ টাকাপয়সা মিটিয়ে ভদ্রলোক চলে যাবার সময় সহৃদয়বাবু ‘ধন্যবাদ’ বললেও ভদ্রলোক উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন। নাড়ু বলল, ‘সত্যি জেঠু, আপনি পারেন বটে!’

‘ওহ, পারেন বটে বলছে আবার। তুই তো ও-ই মুড়োটা আবার বেচতিস। এ তো দিনে ডাকাতি!’ থালের মুখ ফাঁক করে নাড়ুর সামনে ধরেন সহৃদয়বাবু।

‘আর কিছু নেবেন না? এই একটা মুড়োয় হয়ে যাবে?’

‘মাছের তেল কত করে বেচছিস?’

‘১২ টাকা কিলো।’

‘দে, ৫০০ তেল দে। পেঁয়াজ কুচি, লঙ্কা কুচি দিয়ে গরম গরম তেলের বড়া… ওহ, কোথায় লাগে মাছ! থালা থালা ভাত সাবাড় হয়ে যায়।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ছাড়া কি, মাছের তেল খেয়েই কাটিয়ে দিন, সত্যি মাইরি!’

‘অ্যাই, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করছিস যে বড়, জানিস মাছের তেল খেলে হার্ট ভালো থাকে। জানে না কিছু আবার বেশি কথা!’

মাছ বিক্রেতাদের ঠাট্টাকে পাত্তা না দিয়ে থলে হাতে সবজির দিকে চলে যান সহৃদয়বাবু। জীবন থেকে একটা শিক্ষা তিনি নিয়েছেন। লোকের কথায় কান দিলে নিজের মতো করে বাঁচা যায় না। কিলো কিলো তেল গায়ে ঢেলে রেখেছেন যাতে মানুষের ত্যাড়াব্যাঁকা কথা পিছলে নেমে যায়।

‘হ্যাঁ গো, কল্মি কত করে?’

মাঝবয়েসী মহিলা সহৃদয়বাবুর দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘২৫০ গেরাম ১০ টাকা।’

‘বলো কী মাসি! ৪০ টাকা কিলো কল্মি! এতো পুকুরের ধারে গাদা গাদা হয়ে থাকে। বিনে পয়সার শাক ৪০ টাকা কিলোয় বেচছ?’

ট্যারা চোখে সহৃদয়বাবুর দিকে তাকালো মহিলা৷ মুখ ঝামটে বলল, ‘তা পুকুরধার থিকেই গুড়িয়ে নিয়ে আসুন তবে, বিনিপয়সায় পাবেন।’

সহৃদয়বাবু দেখলেন লোকজন আসছে আর দেদার সবজিপাতি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। মুখে বলছে বটে ‘বাবা, কি দাম!’ কিন্তু ব্যাগ ভরে ভরে নিচ্ছে। এদের জন্যেই এই ব্যাপারীগুলো মাথায় ওঠে। এটা কত ওটা কত করতে করতে শেষে ২৫০ আলু আর একটা কাঁচা পেঁপে কিনে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি।

যেতে যেতে নানান চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। শহরে থাকার এই মুশকিল। সবই ফড়েদের হাত ঘুরে বাজারে আসে আর আগুন দাম হয়ে যায়। গ্রামে থাকলে আশপাশে কত ফল সবজির গাছ থাকত। আধা জিনিস কিনতেই হতো না। দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়লেন সহৃদয়বাবু।

বাড়ি ঢুকে গিন্নির হাতে বাজারের থলেটা ধরাতেই সরমা বললেন, ‘আজ পার্থর বউভাত, মনে আছে?’

যুগপৎ আনন্দ এবং চিন্তা ঘিরে ধরল সহৃদয়বাবুকে। পার্থ হল সহৃদয়বাবুর স্কুলের বন্ধু সুব্রতর ছোট ভাই। এই একটামাত্র বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ আছে সহৃদয়বাবুর। বাকিদের বাড়ফাট্টাই অত্যাধিক বলে সম্পর্কে রাখেন না তিনি।

বউভাত শুনে আনন্দের কারণ হল ভালো খাওয়াদাওয়া হবে। আর চিন্তার কারণ হল, আবার কিছু গচ্চা যাবে। কী করা যায় ভাবতে হবে।

খুব একটা নেমন্তন্ন পান না সহৃদয়বাবুরা। অনেক পরিচিত ঘনিষ্ঠ মানুষও ওঁদের এড়িয়ে যান। হয়তো ওদের স্বভাবের জন্যই। অনেকদিন পর একটা জব্বর খাওয়াদাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে, এটা ছাড়া যাবে না। গিন্নির সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

‘কী দেওয়া যায় বলো তো গিন্নি। জিনিসপত্রের যা ভয়ানক দাম!’

‘জিনিস কিনে লাভ নেই, পছন্দ হবে না। তার চেয়ে খামে করে টাকা দেওয়া ভালো।’

‘এইটে ঠিক বলেছ। তা, কত টাকা দিতে হবে?’

‘শোনো, গুচ্ছের লোক খাম দেবে। কে কোনটা দিচ্ছে অত কি হিসেব থাকবে ওদের? যারা নাম লিখে দেবে তাদের কথা আলাদা। তুমি কিছুই লিখবে না। এক টাকা লাগানো যে খাম কিনতে পাওয়া যায়, সেই একখানা কিনে আনো। ৫০ টাকা ভরে মুখ আটকে দিয়ে দোবো।’

‘খাসা বলেছ গিন্নি। তোমার বুদ্ধি আছে গো। খামের দাম কত নেবে?’

‘৫/৬ টাকা নেবে বড়জোর। ৬০ টাকার ভেতর তোমার খরচ মিটে যাবে।’

‘ওহ’ বলে আনন্দে এক পাক ঘুরে নিলেম সহৃদয়বাবু।

আবারও ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বইলেন। সহৃদয়বাবুর ক্ষেত্রে কথাটা বারে বারে প্রযোজ্য বলা চলে। হল কি, নেমন্তন্ন বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা গাড়ি প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। গিন্নিকেও দাঁড়াতে বললেন।

সহৃদয়বাবুর একেবারে সামনে গাড়ির দরজা খুলে গেল। তিনি দেখলেন, একজন খুবই বয়স্কা মহিলা হাতে ঢাউস একটা উপহারের বাক্স নিয়ে নামার চেষ্টা করছেন। সহৃদয়বাবু তক্ষুনি এগিয়ে গিয়ে বাক্সটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমি ধরছি, আপনি সাবধানে নামুন।’

‘অনেক ধন্যবাদ। বয়েস হলে কী যে অবস্থা হয় শরীরের, খুব বুঝতে পারছি।’

‘সরমা, ওনার হাতটা ধরো।’ গিন্নিকে উদ্দেশ্য করে বললেন সহৃদয়বাবু।

সরমা এগিয়ে এসে ভদ্রমহিলার হাত ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন, পেছনে উপহারের বৃহৎ বাক্স নিয়ে সহৃদয়বাবু। বর কণের সামনে পৌঁছতেই পার্থ মঞ্চ থেকে সটান নেমে এসে, ‘অমলাদিদা, তুমি এসেছ, খুব ভালো লাগছে’ বলেই ঢিপ করে পায়ে ঝুঁকে প্রণাম করল। আর সেই সুযোগে মঞ্চে উঠে সেই বিশাল উপহার কণের হাতে তুলে দিলেন সহৃদয়বাবু, পাশে সরমা।

‘আমি পার্থর দাদার বন্ধু। সুখী হও।’ এটুকু বলেই দ্রুত মঞ্চ থেকে নেমে গিন্নিকে চোখের ইশারা করলেন। দুজনে চলে গেলেন খাবারদাবারের দিকে।

এদিকে তখন অমলাদিদার সঙ্গে কথালাপ চালিয়ে যাচ্ছে পার্থ। ততক্ষণে সেখানে এসে পড়েছেন পার্থর দাদা বৌদি। অমলা আসাতে সকলেই খুব উচ্ছ্বসিত। ভদ্রমহিলা ভুলেই গেছেন তার আনা উপহারের কথা।

উফ, আজ উঠেই নিজের মুখ দেখেছিলাম বলে দিনটা এমন অসাধারণ কাটছে। অন্যদিন গিন্নি ডাকে তাই ওর মুখ দেখেই উঠতে হয়। আজ চোখের পাশটা জ্বালা করছিল দেখে নিজেই উঠে আয়নার সামনে গেছিলেন তিনি। এবার থেকে রোজ তাই করবেন। নিজে নিজেই উঠে পড়বেন।

গলা অবধি খেয়ে অনড় হয়ে চেয়ারে বসে পড়েছিলেন সহৃদয়বাবু। সরমারও প্রায় সেই অবস্থা। সেই মুহূর্তে সেখানে এলেন সহৃদয়বাবুর বন্ধু সুব্রত।

‘কেমন আছিস সদু? ভুঁড়িটা তো ভালোই বাগিয়েছিস! খেয়েছিস ঠিক করে। আগের মতোই লুভো আছিস তো না কি? কেমন আছেন বৌদি? বৌদিকে নিয়ে এসেছিস, খুব খুশি হলাম।’

সহৃদয়বাবুকে স্কুলে কলেজে বন্ধুরা সদু বলেই ডাকত। সুব্রতর কথার উত্তরে সহৃদয়বাবু হেসে বললেন, ‘তুই যে আমায় মনে রেখে নেমন্তন্ন করেছিস তাতে আমিও বড়ই আহ্লাদিত হয়েছি রে। খুব ভালো আইটেম করেছিস, রান্নাও চমৎকার। ভালো করে খেয়েছি। এবার আসি রে। বয়েস হয়েছে তো, শরীরটা কেবল বিশ্রাম চায়।’

সরমাও ‘ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন’ বলে ভদ্রতা করলেন।

‘সাবধানে যাস সদু। দেখি ওদিকটায় একবার।’

‘গিন্নিকে নিয়ে একদিন আসুন আমাদের বাড়ি।’ সরমার কথা শুনে সুব্রত হেসে বলেন, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’

সুব্রত অন্যদিকে চলে গেলে পরে সহৃদয়বাবু সরমার দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলেন, ‘দরকার কী ছিল পিতলামির আলাপের বলো তো? বউ নিয়ে এলেই তো আপ্যায়নের ঝামেলা, খরচা কত বোঝো না, নাকি?’

‘আরে উনি তো হাতে করে কিছু আনবেন, ধরো মিষ্টি আনলেন। সেই দিয়ে আর বাড়িতে আমি কুচো নিমকি বানাই যে, সেসব দিয়ে হয়ে যাবে। এত খেলাম, একটু তো বলতে হয়।’

সহৃদয়বাবুর হৃদয়ে হঠাৎ কেমন ঝড় উঠল। সত্যিই তো, ঠাকুর্দার দেওয়া নামটার সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে কি? উত্তাল হৃদয়ের ভয়ঙ্কর দোলায় গিন্নির হাত ধরে বললেন, ‘গিন্নি, চলো আজ ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরি।’

আঁৎকে উঠে সরমা বললেন, ‘ও বাবা, সেতো অনেক ভাড়া পড়বে গো?’

‘সে পড়ুক। ও নিয়ে ভেবো না। আঁইঢাঁই শরীর নিয়ে আর বাসে উঠতে ইচ্ছে করছে না। চলো, এখন থেকে একটু আরাম করি।’

সরমা বিগলিত। তিনিও চিন্তা করতে লাগলেন, আজ ঘুম থেকে উঠে কার মুখ প্রথম দেখেছেন। মনে পড়ল, জঞ্জালের প্লাস্টিক বের করে দিতে গিয়ে সুইপার ভজনের মুখ দেখেছিলেন প্রথম। ছেলেটা ভারী পয়া তো! অন্যদিন ভোরবেলা দরজায় কড়া নাড়লে বিরক্ত হতেন, এবার থেকে চট করে উঠে জঞ্জাল বের করতে হবে যাতে ওর মুখখানা দেখা যায়। ব্যাটা অনেক সময় আবার কড়া নেড়ে পাশের বাড়ি চলে যায় ময়লা তুলতে।

ট্যক্সি দাঁড় করিয়ে কত্তা গিন্নি জমিদারি চালে ঢুকলেন ভেতরে। বিয়ে হয়ে নতুন বউ হিসেবে সেই যে গাড়ি চড়েছিলেন, এই দ্বিতীয়বার চড়লেন। আরামে চোখ বুঁজে এল সরমার। সহৃদয়বাবু পাঞ্জাবীর পকেটটা দেখে নিলেন না-দেওয়া খামটা জায়গামতো আছে কিনা। মনটা গেয়ে উঠল ট্রা লা লা লা…।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *