bibidho-pnpc-naam

পি এন পি সি নাম
রম্যরচনা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়


ও আকাশ সোনা সোনা… ও মাটি…
‘ আসছি আসছি, দাঁড়া রে বাবা… রান্নাঘর থেকে হাঁচড়পাঁচড় করতে করতে শোবার ঘরের দিকে ছুটল সোনা। বলা কথাগুলো মোবাইলের উদ্দেশে বলা। ‘

ফোনটা তো রান্নাঘরে রাখলেই পারে। যতবার ফোন বাজবে, ততবার দৌড়ে আসাটা বিপজ্জনকও বটে গিন্নির পক্ষে। ওজন তো ক্রমবর্ধমান! পদ্মনাভ ভাবলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। সকাল সকাল মৌণ থাকাই পছন্দ করেন তিনি।

‘ কে, রূপা, বল বল, কতদিন পর ফোন করলি। কেমন আছিস তোরা? দিদির কথা তো ভুলেই গেছিস। ও মা, তাই নাকি? ওহ, কি আনন্দের খবর দিলি রে রূপা। আজ দিনটাই ভালো করে দিলি রে বোন। ইস, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ‘

বেডরুমের ইজিচেয়ারে বসে সেদিনের খবরের কাগজের ক্রোড়পত্র পড়ছিলেন পদ্মনাভ নিয়োগী। গিন্নির এ হেন উচ্ছ্বাসে প্রমাদ গুণলেন তিনি। কী এমন খবর দিলো শ্যালিকা যে তার দিদির গায়ে কাঁটা দিচ্ছে? ব্যাপারটা সন্দেহজনক!

‘কবে আসছিস বল। আচ্ছা আচ্ছা, বাহ, খুব ভালো খবর! আরে না, না, ওসব লাগবে না। তোদের ওখানকার সাবানের ফ্যানা আমাদের দেশের জলে ভালোভাবে ধোয় না। তুই বরং আমার জন্যে একটা ছোট দেখে স্লিং ব্যাগ আনিস। আজকাল সবাই কেমন ক্রস করে নেয়, আমার দারুণ লাগে!

সব্বোনাশ, ষাটোর্ধ বয়সে ছুঁড়িদের মতো ক্রস করে ব্যাগ নেবার সখ হয়েছে! যা লাগবে না, আহা হা হা! ঠোঁট চেপে হাসি সামলান পদ্মনাভ।

আরে বাবা, আর কিছু লাগবে না। হ্যাঁ, পারফিউম আনতে পারিস। ওটা কাজের জিনিস…।’

গিন্নির কথায় পদ্মনাভর সন্দেহ বাস্তবে পরিণত হয়। বুঝে যান, ওয়াশিংটন থেকে শ্যালিকা রূপা এবং ভায়রা পরিতোষ চট্টখুন্ডি ভারতে আসছে।

পরিতোষের বাড়ি উত্তরপাড়ায়। এসে সেখানে উঠলেও কলকাতায় দিদির বাড়িতে সপ্তাহখানেক তো ঘাঁটি গাড়বেই চট্টখুন্ডি দম্পতি।

শালি এসে থাকবে তাতে কোনও আপত্তি নেই পদ্মনাভর। কিন্তু ভায়রাটিকে এক্কেবারেই সহ্য হয় না ওঁর। অসম্ভব বাচাল, নাক উঁচু, উজবুক টাইপ। আমেরিকায় কি আর কোনো বাঙালি থাকে না? তাতে অ্যাত ঘ্যাম নেবার কি আছে তা বুঝে পান না পদ্মনাভ। ইনটলারেবল পার্সোনালিটি যাকে বলে।

‘ওগো শুনছ, রূপা আর পরিতোষ দেশে আসছে দু সপ্তাহ পরে। কতদিন বাদে আসছে বলো। এর আগে যখন এসেছিল, তুমি বিশেষ সময় দিতে পারোনি। এখন তো অনেক সময় তোমার, ভালো করে গল্প কোরো।’ গদগদ কন্ঠে বলেন সোনাদেবী।

মেথি চেবানো মুখ করে পদ্মনাভ বলেন, ‘দেখা যাবে।’

‘এই জানো তো, ওরা না একটা ব্রিটিশ বুলডগ পুষেছে। তাকেও নিয়ে আসছে। সে নাকি অনেক কান্ডকারখানা করে তবে পারমিশন মিলেছে। ভালোই হয়েছে বলো, ছেলেপুলে নেই, তার দু:খ খানিকটা কমবে। ‘

‘সেরেছে, বাঘা ওলে রক্ষে নেই সঙ্গে আবার কচুরমুখী!’ কর্তার শ্লেষবাক্য পুলকিত গিন্নির কানে ঢোকে না। উলটে ‘তুমি কি চা খাবে?’ জিগ্যেস করে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা লাগান সোনা।

অবাক হন পদ্মনাভ। কিছুক্ষণ আগেই তো চা খেয়েছেন, এরই মধ্যে চা দিতে রাজি… আনন্দে মাথাটা গেল না কী কে জানে! বোন আসার আনন্দ বেশি নাকি বিদেশী মাল মশলা পাবার ফুর্তি বেশী, বিষয়টা ভেবে দেখার।

পদ্মনাভ নিয়োগী রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশনে আইসি হয়ে রিটায়ার করেছেন। পুলিশ মেডেল পাওয়া দক্ষ অফিসার। তাকেও কি না গাড়ি ঘোড়ার তদারকি করা মাল টন্ট করে!

পরিতোষ চট্টখুন্ডি ইউ এস ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রান্সপোর্টেশনে চাকরি করে। পাঁচ বছর আগে যখন এসেছিল তখনও পদ্মনাভ অবসর নেননি। তবে নিজস্ব একখানা আস্তানার ব্যবস্থা করে উঠতে পেরেছিলেন ততদিনে, দু-কামরার ছোট একখানা ফ্ল্যাট।

ভায়রা এসে থাকাতে খুশিই হয়েছিলেন। এরকম সুযোগ আগে তেমন আসেনি। কারণ পদ্মনাভ বিভিন্ন জায়গায় বদলি হয়েছেন, সেখানে শ্যালিকা ভায়রাকে থাকতে বলার মতো পরিবেশ ছিল না। যতই হোক, বিদেশে এরা আরামে থাকে তো। আপাতত কলকাতাতেই বদলি হয়েছেন।

রাতে দুই ভায়রা একসঙ্গে শুয়েছিলেন। কারণ, দুই বোন তখন অনর্গল বকবক করে যাচ্ছিল, দিন রাতের হিসেব গুলিয়ে গেছিল তাদের। সোনা করে চলছিল দেশীয় গল্প আর রূপা বিদেশী।

‘লক্ষ্মী কাকিমাকে মনে আছে তো? নিমাই কাকা মারা যাবার পর সালোয়ার কামিজ পরা শুরু করল। বলিহারি শখ! ইচ্ছে যখন ছিল তখন কাকা বেঁচে থাকতেই তো পরতে পারতিস।’

‘আমাদের ওখানেও তো এরকম স্যাম্পল কম নেই রে দিদি। শাড়ির সঙ্গে স্নিকার পরে পার্টিতে এসেছে। কি বদখত লাগছে দেখতে। পায়ের প্রবলেম থাকলে জিন্স পরে বা ট্রাউজার পরে স্নিকার পর। উফ, একেক জনের ফ্যাশন সেন্স দেখলে ডিগবাজি খেতে ইচ্ছে করে জানিস তো!’

এই ধরণের ভয়ঙ্কর আলোচনার থেকে মুক্তি পেতে পদ্মনাভই পরিতোষকে বলে, ‘কি ভায়রা, এরা তো সারা রাত ঘুমোবে না মনে হচ্ছে। আমরা দুজনে বরং পাশের ঘরে গিয়ে শুই। নিজেদের মতো কথা বলা যাবে।’

পরিতোষের মুখ দেখে পদ্মনাভ বুঝেছিল যে ব্যবস্থাপনাটা মোটেও পছন্দ হয়নি তার তবু নিমরাজি হতে হয়েছে। পদ্মনাভকে পরিতোষের বড্ড পাতি লাগে। কিছু করার নেই, গিন্নি তার দিদির ভক্ত। অতয়েব আসতেই হবে বড় শ্যালিকার বাড়ি আর সহ্যও করতে হবে এই সব ন্যাতানো লোকজনকে।

নিজের চাকরি জীবনে যত কঠিন কেস সলভ করেছেন পদ্মনাভ, সে রাতে প্রাণ খুলে ভায়রাকে সে সব গল্প শুনিয়েছেন। কী ভাবে বোঝা যায় নিজে ডুবে মরেছে না কেউ খুন করে ডুবিয়ে দিয়েছে। পোস্ট মর্টেমে কি কি দেখে বোঝা যায়

সুইসাইড না হোমিসাইড ইত্যাদি ইত্যাদি।

পরিতোষ দু একবার ইউ এস এ-র ল অ্যান্ড অর্ডার নিয়ে মুখ খুলতে গেলেও পদ্মনাভর কথার তোড় সেসব বক্তব্যকে শোলার মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

রাতে নিজের কথা বলতে না পেরে পরিতোষ কতটা বিরক্ত সেটা বোঝা যায় পরদিন চায়ের টেবিলে। গদগদ বড় শ্যালিকা প্রবাসী ভগ্নিপতিকে জিগ্যেস করে, ‘ঘুম ঠিকঠাক হয়েছে তো পরিতোষ? তোমরা আরামে থেকে অভ্যস্ত, আমাদের তো সবই দেশী। অসুবিধে হয়নি তো?’

‘না, না, সেসব অসুবিধে কিছু হয়নি কেবল দাদার ওই সারা রাত ধরে লাশ ওঠানো নামানো ছাড়া। এত লাশের মধ্যে কখনো থাকিনি তো, একটু ভয় ভয় লাগছিল।’

প্রথমটায় থমকে গেলেও পরমুহূর্তে হাসিতে ফেটে পড়ল ডাইনিং রুম। সোনা এবং রূপা হেসে পাগল হয়ে যাচ্ছে পরিতোষের বলার ভঙ্গি দেখে।

অসম্ভব অপমানিত বোধ করলেন পদ্মনাভ। কষ্টও পেলেন। ওঁর কেরিয়ারের সলভ করা দুর্ধর্ষ কেসগুলো নিয়ে মস্করা!!

কিন্তু সেই মুহূর্তে যুৎসই কোনো জবাব কিছু খুঁজে পেলেন না। মনে মনে চুটিয়ে গালাগাল দিলেন পরিতোষকে। শালা পি সি… সুযোগ পাই তখন দেখে নেব।


‘আয় আয় রূপা, উফ কত বছর পর দেখলাম তোকে। এসো এসো পরিতোষ। ও মা! কি সুইট ডগি রে! ওর নাম কি?’

সাদা-বাদামি কম্বিনেশনের ছোট সাইজের একটা কুকুরছানা পরিতোষের কোলে। মুখটা থ্যাবড়াপানা। এই হল ওদের নতুন পোষ্য। রূপার হাতে একটা চৌকো খাঁচা, পাখির খাঁচার থেকে বড়।

‘আগে ভেতরে আসুক, বসুক, তারপর নয় সব জানা যাবে। দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকলে ওরা ঢুকবে কি করে?’ ভালোমানুষি করার সুযোগটা কাজে লাগালেন পদ্মনাভ।

ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসল চার জনে।

সামনে চা এবং গরম গরম মোচার চপ।

‘দিদি, তুই বানিয়েছিস নাকি চপ? এত সব করতে গেলি কেন রে?’

‘আরে না রে রূপা। আমি বানাইনি। তোর পি.এন. কিনে এনেছে।’ লাজুক হেসে বলল সোনা।

দিদির বিয়ের দিন বাসরেই রূপা ঘোষণা করে দিয়েছিল, জামাইবাবু-ফাবু সে বলবে না। নামের আদ্যক্ষর বলে ডাকবে। পদ্মনাভ নিয়োগী অর্থাৎ পি. এন।

‘সে তো বোঝাই যাচ্ছে তোর শরীর দেখে যে পি.এন তোর যথেষ্ট যত্ন করে।’

ব্রিটিশ বুলডগ ইতিমধ্যে তার জন্যে আনা নির্দিষ্ট খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে দৌড়ে এসে পরিতোষের কোলে উঠে পড়েছে। পরিতোষ তার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে চকাস করে একটা হামি ডগির মাথায় দিয়ে বলে, ‘এই হল আমার ছেলে বুশকা। খুব ভালো ছেলে, তাই না বুশু?’

বুশকা ‘খুক’ করে কী জবাব দিল তা বোঝা না গেলেও পরিতোষ ‘ইয়েস মাই বয়’ বলে অ্যাপ্রুভ করল।

পরিতোষের কথায় রূপা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘আমার ছেলে আবার কি কথা শুনি, আমি বুঝি বুশকার কেউ না? বলো, আমাদের ছেলে।’

পদ্মনাভর মাথায় হঠাৎ করে কেউ যেন হাতুড়ির বাড়ি দিয়ে বলে, ‘সুযোগ ছেড়ো না, পাঁচ বছর আগের ঘটনা ভুলে গেলে নাকি? পরে পস্তাতে হবে।’

চেয়ারে সোজা হয়ে বসে পদ্মনাভ বলে ওঠেন, ‘সে যাই বলো রূপা, বুশকা যে পি. সি.’ র ছেলে সে কাউকে বলে দিতে হবে না। মুখের প্রচন্ড মিল! আমি প্রথম দেখেই বুঝে গেছি যে এ পরিতোষের বাচ্চা না হয়ে যায় না! ‘

মুখের রঙ যে বদলায় তা চাক্ষুষ করলেন পি. এন। পি. সি’র মুখের রঙ সেই মুহূর্তে ভাতের ফ্যানের মতো। আর ডাইনিংরুমে তখন হাসির জলতরঙ্গ বাজছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “bibidho-pnpc-naam

  1. দারুণ , চুমকি দি, বাঙালি, আর, ডাইনিং টেবিল , সেখানে পি,এন পি, সি না হলে প্রাতরাশ থেকে নৈশ ভোজন পুরোটাই অসম্পূর্ণ 😁

  2. সুলেখিকা চুমকির এই অসাধারণ লেখাটি রম্য অবশ্যই, কিন্তু এটি তো সার্থক ছোটো গল্পও।
    খুব এবং খুবই ভালো লেগেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *