binodan-aasa-jawar-majhe

আসা যাওয়ার মাঝে
ফিল্ম রিভিউ
সুরশ্রী ঘোষ সাহা


আজ যে ছবিটার কথা বলব সেটা নতুন হলেও পুরনো। হ্যাঁ, ২০১৪-তে হলে রিলিজ হলেও সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত হয়েছে হই-চই ওটিটিতে। সিনেমাটা হল, আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের ‘আসা যাওয়ার মাঝে: লেবার অভ লাভ’।

চারিদিকে যখন এত এত কথা, সেই সংলাপের যুগে দাঁড়িয়ে একেবারে সংলাপহীন একটি সিনেমা এটি। কথার সীমানা ছাড়িয়ে সিনেমা যে দেখার আর উপলব্ধি করারও বটে, সেটি আমাদের পুনরায় মনে করিয়ে দিয়েছেন পরিচালক।

ইতালো ক্যালভিনোর একটি দুই পৃষ্ঠার গল্প থেকে এই ছবির কাহিনি অনুপ্রাণিত। যদিও এই সিনেমার গল্প একেবারে উত্তর কলকাতার দু’জন মানুষের। তাদের যাপিত জীবনের। অভিনয়, শব্দ আর সিনেমাটোগ্রাফি এই তিনের সাবলীল মিলনেই তৈরি এই সিনেমা।

২০০৯ সালে প্রচুর মানুষ পশ্চিম বাংলায় চাকরি হারিয়েছিল, শ্রমিক অসন্তোষও দেখা গিয়েছিল চারিদিকে। সিনেমা শুরু হয় সেই সময়ের প্রেক্ষাপটটিকে পরিবেশন করার মাধ্যমে, এক সংবাদ পাঠিকার কণ্ঠ দিয়ে। রেডিওতে খবর পাঠ চলছে এমনভাবেই যা দর্শকের সামনে উপস্থিত করা হয়। তারপর দৃশ্য ফুটে ওঠে উত্তর কলকাতার গলি-ঘুপচি পেরিয়ে হেঁটে কাজে যাচ্ছেন এক কমবয়সী নারী। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী বাসবদত্তা চ্যাটার্জি। পরের দৃশ্যে দেখা যায় জানালার ধারে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন পুরুষ। সেই চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। যদিও এই দু’জন মানুষ গোটা সিনেমা জুড়ে আমাদের কাছে নাম-পরিচয়হীনই থেকে গেছেন। আসলে তারা স্বামী ও স্ত্রী। যাঁরা ডে ও নাইট এই দুই শিফ্টে কাজ করেন। স্ত্রী কাজে বেরুনোর সময় স্বামী অফিস থেকে ফেরেন। শুধু এই আসা যাওয়ার মাঝে একটুকু যে মিলন, তা নিয়েই পুরো গল্পটা।

 দৃশ্যায়ন আর অদ্ভুত সুন্দর শব্দায়নের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, কতটা যত্ন নিয়ে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিনকার পরিচিত মহলটাকেই যেন নতুনভাবে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক। দৃশ্যপটে দু’জনের প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে। স্নানের সময় দুটো সাবান আলাদা করা, কাপড় মেলে দেওয়ার সময় চোখে পড়ে ভেজা কাপড়ের মাঝে জড়িয়ে থাকা ভাঁজ, একা খাওয়া-দাওয়া করা, ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে – সেটিও বুঝে নেওয়া টেবিলের উপর থাকা চেক দেখে, বাজারে যাওয়া, জীবন্ত কানকো দেখে মাছ কেনা, সেই মাছ ঘরে এনে ফ্রিজে রাখা, এরপর কিছুটা বিশ্রাম। তারপর সন্ধ্যা হতেই কাপড় তুলে ঘরে আনা, কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি, সন্ধ্যায় পুজোর ধূপকাঠি জ্বালানো, কাজে চলে যাওয়ার পর স্ত্রীর ঘরে ফেরা, আবার তার একা খাওয়া-দাওয়া করে সব গুছিয়ে শুয়ে পড়া, সকালে স্বামীর ফোন করে রিং বাজিয়ে স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগানো। কিন্তু কোনো কথা হয় না। সেই ফুরসতটুকুই-বা জীবন দিয়েছে কোই!

 বেশ কিছু দৃশ্যায়নে এই ছবিতে ফুটে উঠেছে চমৎকার কিছু মুহূর্ত। যেমন, কৌটোয় গোটা মাসের ডাল, মশলা, বড়ি ভরে ওঠার দৃশ্য। কিংবা কড়াইয়ে তেল ও সবজি দেওয়া, বাথরুম থেকে ভেজা পায়ে বেরিয়ে ভেজা জামাকাপড় মেলার সময় একটু একটু করে পায়ের ছাপটা শুকিয়ে ওঠা। সবকিছুতেই যেন পরম মমতা ফুটে উঠেছে ছবিতে। এরপর আগের ধূপকাঠি ফেলে নতুন কাঠি জ্বালিয়ে পুজো শেষ করতেই দেখা যায় অপরজন ফিরে এসেছে কাজ থেকে। অবশেষে দেখা হয় দু’জনার, একটখানি মুহূর্তের জন্য। তখন আমরা বুঝতে পারি, এটাই জীবন, এটাই তো পেটের দাবি মেনে কাজে ছোটা, এটাই যে লড়াই আমাদের মতো মধ্যবিত্তের। আর ঐ এক মুহূর্তের দেখা হওয়াটাই হল প্রেম। যা একান্ত নিজের।

সিনেমাটি দেখার সময় সেই মুহূর্তটুকু অপূর্ব সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে। যেন কত উৎকণ্ঠা, কত অপেক্ষার পর এই মিলন। কোনো ভাষা নেই, সংলাপ নেই, কেবল দু’জনের মুখের শান্তির ছায়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অল্প কিছু সময়ের মাঝে চা করে এনে আবার কাজে যাবার প্রস্তুতি। এভাবেই পুরো সিনেমাটা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানেই আবার ফিরে গেছে প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামে।

আসলে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ গল্পটি আমাদেরই রোজকার যাপিত জীবনের গল্প। এখানে কোনো তাড়া নেই, বড় কোনো সুখ নেই, আবার বড় কোনো দুঃখও নেই, কেবল শান্তি আছে। কিছু না হওয়াটাও যে একটা বড় শান্তি এটাই যেন বারবার বোধ করিয়ে দেয় আমাদের। মাঝে মাঝে শোনা যায় এ বাসা ও বাসা থেকে ভেসে আসা পুরোনো দিনের গান, জাফরিকাটা বারান্দা, ঘুলঘুলি আর পুরোনো সেই বাড়ির আবহাওয়া আরও বেশি মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।

 এক ঘন্টা বিশ মিনিটের এই সিনেমা। দেশ বিদেশ থেকে একাধিক এওয়ার্ডও পেয়েছে সিনেমাটি। ৬২তম ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। বেস্ট ফিল্ম এবং বেস্ট অডিওগ্রাফি ক্যাটাগরিতে’ মারাকেচ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পেয়েছে সেরা পরিচালকের উপাধি। নিউইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পেয়েছে বেস্ট ফিল্ম, বেস্ট ডিরেক্টর, বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লের আখ্যা। আবুধাবি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও বিএফআই লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরিদের কাছ থেকেও প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’।

যারা ভালো সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন তারা দেখে নিতে পারেন সিনেমাটা। কোনো সংলাপ নেই ভেবে এড়িয়ে গেলে কিন্তু ভুল করবেন। জানবেন, অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে বহু সময় নীরবতাই সুন্দর।




এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *