binodan-all-india-radio-rani-bela

অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর রানী, বেলা
ফিল্ম রিভিউ
অদিতি বসুরায়

 


১৯৪৭ সালের চোদ্দই আগস্ট রাতে, যখন ভারতবর্ষ দীর্কদিনের শেকল ছিঁড়ে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর জাতির উদ্দেশ্যে সেই বিখ্যাত ভাষণের জন্য আপামর দেশবাসী উদগ্রীব – তখন দেশের পূর্বপ্রান্তের শহর কলকাতায় একটি মেয়ে সেই যজ্ঞে নিজের অংশটুকু নিশ্চিত করতে, আপন স্বাধীনতার জয় – জয়কারে প্রায় মধ্য যামিনীতে  অভিভাবকদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে, পৌঁছে গিয়েছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিও-র আপিস, ১ নম্বর গারস্টিন প্লেসে। সেই ঐতিহাসিক রাতে, বেলা দেও নারী জাগরণের ইতিহাসে, এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। পরিচালক অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়, এইভাবে  রেডিও-তে চাকরির কারণে তাঁকে বাপের বাড়ি ছাড়তে হয়। তার আগেই স্বামী-সংসারের কাহিনীতে লেগেছে অন্ধকারের রং। বিলেত গিয়ে সেখানেই মেমসাহেব বিয়ে করে থেকে যাওয়া, অবিশ্বস্ত স্বামীকে মুখোমুখি হয়েছিলেন বেলা। সেখানে আরেক মেমসাহেবের কাছে তাঁর ‘হোমসায়েন্স’-এর পাঠ নেওয়া এবং দেশে ফিরে রেডিও-তে কাজ নেওয়া। ‘বেলা’ ছবিটি আসলে এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের দলিল। যেখানে কলকাতার রেডিও-যুগের প্রথম দিকের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তখনকার প্রায় সব আলোকপ্রাপ্ত মহিলা, আসতেন রেডিও স্টেশনে – টক দিতে, গল্প শোনাতে, পাঠ দিতে। আশাপূর্ণা দেবী, আশা দেবী, রাধারানী দেবী পরে কবিতা সিংহ, নীলিমা সান্যাল নিয়মিত রেডিও স্টেশনে আসতেন – মহিলা মহল ছিল তাঁদের খাস দপ্তর। বেলা এসে যোগ দিলেন যখন তখন মহিলা মহল দেখতেন রেখা মেনন। রেখা স্থানান্তরে যাওয়ার পর, মহিলা মহলের দায়িত্বভার আসে বেলার কাঁধে। পর্দায় আসেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জগন্নাথ বসু, ইন্দিরা গান্ধির মত স্মরণীয় ব্যক্তিত্বরা। ইতিহাসের সুতোকে সিনেমার রুপোলী সুতোকে  অসামান্য দক্ষতায় মিশিয়েছেন অনিলাভ। তিনিই এই ছবির কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকারও। খুব সহজ করে সে কালের প্রেক্ষাপটে, মেয়েদের অবস্থানকে তুলে ধরেছেন তিনি। শেকলভাঙ্গা মেয়েদের কথাও বলে হয়েছে বারবার। বেলা দে-এর নিজের জীবনটিই তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এবং জানানো হয়েছে, নারীস্বাধীনতার প্রথম ধাপ শিক্ষা হলেও মূল যে দরকার তা হল, স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতা আসতে পারে নিজের উপার্জনের মাধ্যমে। গত শতকের চারের দশকের শেষে, দেশের স্বাধীনতা-প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই, গণমাধ্যমে বেলা দে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাধীনতা, জীবিকার সঙ্গে যেভাবে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটির প্রতি আলোকপাত করেছিলেন – তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। আজ থেকে প্রায় আশি- পঁচাশি বছর আগে, ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটিও প্রায় নিষিদ্ধ শব্দের আওতাভুক্ত ছিল – সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, রেডিওতে এই বিষয়ে মেয়েদের নানা জরুরী পরামর্শ দিতেন বেলা দে। কী-ই না করেছেন তিনি – আকাশবানীতে প্রোগাম হেড, টক শো, স্ক্রিপ্ট লেখা, রান্নার বই লেখা – তারপর বেলা, ইন্দিরা, নীলিমার মতো কালের গর্ভে তলিয়ে গেছেন। সেই ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’কে আলো দেখালো এই ছবি, এতকাল পর।


পরিণত বেলার ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সাম্রাজ্ঞীর মতো কাজ করেছেন। পুরো ছবিই তাঁর বিচরণ-ক্ষেত্র। তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গতে ছিলেন – বিশ্বজিত চক্রবর্তী, বাসবদত্তা চ্যাটার্জি, ভদ্রা বসু, দেবপ্রতীম দাশগুপ্ত, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়। বেলার ছেলেবেলার ভূমিকায় ভাল কাজ করেছেন শ্রী ভট্টাচার্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গল্প মীরের ঠেক-কে সেলুলয়েডে দেখে, মন ভাল হতে বাধ্য।  অল্প সময়ের জন্য পর্দায় উপস্থিত হয়ে, ভাল কাজ করেছেন মধুজা বন্দোপাধ্যায়, সৌরভ চক্রবর্তী। মানসী সিনহার কাজ, যথারীতি দুর্দান্ত। মাত্র মিনিট তিনেক তিনি ছিলেন – কিন্তু তাতেই জয় করেছেন। আর আলাদা ভাবে যার কাজের কথা উল্লেখ করতেই হবে – তিনি তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস। ছবিতে তিনি আরতি হিন্দু হোটেলের মালকিন – দেশভাগের পর, ছিন্নমূল পরিবারকে দাঁড় করাতে তিনি স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাতের হোটেল চালান। দুর্দান্ত কাজ করেছেন – যেমন অপূর্ব বাঙাল উচ্চারণ, তেমনই অভিনয়।

‘বেলা-তে মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছেন রণজয় ভট্টাচার্য, অমিত চ্যাটার্জি। চমৎকার গেয়েছেন অরিজিত সিং, সোমলতা ও ইক্ষিতা। দীর্ঘদিন বাদে, সপরিবারে দেখার মতো ছবি, উপহার দেওয়ার জন্য পরিচালক ও তাঁর টিমকে ধন্যবাদ। পিরিয়ড পিস হিসেবে এই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ন স্থান রয়ে যাবে বাংলা ছবির ইতিহাসে। এবং রেডিও-এর হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের কাছেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *