ফিল্ম রিভিউ
অদিতি বসুরায়
জনপ্রিয় কবির ছবি নিয়ে উৎসাহ ও ঔতসুক্য থাকেই পাঠক থেকে দর্শকের। কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির জন্য – দীর্ঘদিন ধরেই অপেক্ষা ছিল।
শ্রীজাত কবি তো বটেই সেই সঙ্গে গী্তিকার,ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার। অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে দেখা গেছে। এবার মুকুটে তাঁর নতুন পালক – চিত্র পরিচালক। ছবির নাম মানবজমিন। গল্প, চিত্রনাট্য পরিচালকেরই। ছবির টাইটেল-কার্ডে পরপর ছবি আসতে থাকে – খাতা পেন্সিল, মাছের কাটা মাথা বঁটি, ইস্কুল ব্যাগ বই ইত্যাদি। অন্যরকম আবহ রচনা হয় পর্দাজুড়ে। পরমব্রত, প্রিয়াঙ্কার দেখা পাই। গল্প এগিয়ে যায়। ঘন সন্ধ্যেয় এক তীব্র চুমু দেখি – দেখি হতাশা – মোহভঙ্গের মুহুর্ত। গল্প সম্পূর্ণ বলা যাবে না। কারণ, গল্পের নানা উত্থান-পতন জেনে যাওয়া ঠিক হবে না। সামান্য নির্যাস দিয়ে রাখি – একটি এন জি ও, বালিকা বিদ্যালয় গড়তে চায়। উদ্দেশ্য, বাল্যবিবাহ রোধ। সেই প্রকল্পের সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে যুক্ত হয় সংকেত (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়)এবং তার জেঠু বরেনবাবু (পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। এন জি ও-টির সঙ্গে প্রত্যক্ষ কাজ করে কুহু(প্রিয়াঙ্কা সরকার)। সংকেত, কুহুর প্রেমিক। এছাড়া আছেন জীবন এবং বিজন নামের দুই ব্যক্তি। কিভাবে ইস্কুলটি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা হবে – এই নিয়েই গল্প। পরিচালক, আমাদের বেশ খানিক ধাঁধার মধ্যে রেখেছেন এই বিষয়টি নিয়ে। স্যুরিয়ালিজমের হাত ধরে এসেছে ম্যাজিক রিয়্যালিজম। আর এই খানেই ছবির ধারাবাহিকতার খামতি নজরে আসে। তবে দ্রুত পরিস্থিতি বদল হয়। এই পর্বে বারবার সেলুলয়েডে ভেসে ওঠে একটেরে বিস্তৃত সবুজ একফালি ‘জমিন’ – মনের জমি। স্বপ্নের সেই ভূমিটুকুতে কুহু-সংকেতের সঙ্গে পাড়ি জমাই আমরাও। পুরোনো মরচে রঙা গেট পার হতে হয় সেই স্বপ্নে ছাড়পত্র পেতে। সেই গেটটিও এক সময় ছবির চরিত্র হয়ে ওঠে। ‘হেমন্তে’ অরণ্যের সে যেন ‘পোস্টম্যান’।
কবির নানা কাব্যময় চিন্তার প্রতিফলন ছবির পরতে পরতে। শঙ্খ ঘোষের কবিতার ব্যবহার সেই মননশীলতার প্রমাণ। চমৎকার আবহ – ছবিটিকে কাব্যিক রূপ দেওয়ার দিকে নিয়ে যায়। গল্প এবং নির্মাণে কাহিনীর যে ধারাবাহিক ঘটনাবলি – সেখানে কবিতা মিলে মিশে গেছে এক বৃদ্ধের একাকীত্ব, এক তরুণীর সমাজসচেতনতা, এক যুবকের অহং এবং একটি বালিকা বিদ্যালয়ের আসন্ন নির্মাণ। পরিচালকের অনুসন্ধিৎসা, অরিজিত সিং-র গলায় রামপ্রসাদের গানের দৃশ্যায়ণকে প্রভাবিত করে। ছবির মেজাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গানগুলি ব্যবহার করেছেন পরিচালক। মানবজমিন কথাটির অসামান্য ব্যবহার এই গান পার করে শ্রীজাতর ছবিটিকে সার্থকভাবে তার উপস্থিতি রেখেছে।
মানবজমিনের সেরা মুক্তো, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বরেন চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রে তিনি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। পর্দায় যতবার এসেছেন, আর কোনও দিকে চোখ ফেরানো যায় না। যে কোনও প্রশংসা-বাক্যই পরাণ বন্দোপাধ্যায়ের জন্য যথেষ্ট নয়। যেভাবে চরিত্রটিকে তিনি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন তার তুলনা নেই। যথাযথ ভাবে নিজেদের চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করেছেন পরমব্রত এবং প্রিয়াঙ্কা। এবং তাঁরা সফল। খরাজ মুখোপাধ্যায় যথারীতি দুর্দান্ত। তাঁর কমিক টাইমিং অসামান্য। বেশ ভালো লাগে দুর্বা বন্দোপাধ্যায়কে। চিকিৎসকের ভূমিকায় মিসকা হালিমের উচ্চারণ, আরও যত্নের দাবি রাখে। এই প্রতিবেদন লেখার পূর্বেই, কবি তাঁর দ্বিতীয় ছবির আগমন-বার্তা ঘোষণা করেছেন। আমরা সেই ছবিতে আরও পরিণত-মনস্কতার আশায় রইলাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন