সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার গ্রহণে: শুভশ্রী নন্দী
অপার বাংলা এবং সম্পাদক শুভ নাথের উদ্যোগে এক অবিষ্মরণীয় ঐতিহাসিক লগ্নের সাক্ষী হল আটলান্টা। দেখা হল সময়ের অগ্রসর একজন স্বনামখ্যাত লেখিকা — তসলিমা নাসরিন-কে। কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার কারণে মাত্র চার ঘন্টা আগে স্থানটির ঠিকানা জানানো হয়েছে। জানানো হয়েছে, লেখিকা বিমানে উড়ে ফিরে যাওয়া না অবধি, কোন সমাজমাধ্যমে এই অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু প্রকাশ করা যাবে না। এত সব ঝুঁকি নিয়ে আটলান্টাবাসীকে এক অনন্য সুরুচিশীল সাংস্কৃতিক ও সাক্ষাৎকারভিত্তিক দ্বিপ্রহর উপহার দিয়ে নিজেদের অনন্য প্রমাণ করল অপার বাংলা। আলোচনার ফাঁকে দর্শক মুগ্ধতার আবেশে শুনল কবির কন্ঠে কবিতা, ‘মৃত্যুহীন মেঘ’।
শুভশ্রী নন্দীঃ তসলিমা, আমরা জানি, কলমকে বহুজনহিতায় করতে গিয়ে আপনি আজ গৃহহারা। এমন কী কলমের জন্য জীবনকে বাজিও রেখেছেন। মুখে কালি মাখানোর প্রস্তাব ও মাথার মূল্য ধার্য হয়েছে বারবার। আবার জীবন কেমন আয়রনিক! বহুদিন জুড়ে ২২-শে নভেম্বরে, প্রতিবছর লজ্জ্বাদিবস পালিত হয়েছে সাধারণ পাঠক দ্বারা। নন্দিত, নিন্দিত, বিশ্ববন্দিত। বাংলাদেশে তিনটি এবং ভারতবর্ষে পাঁচটি ফতোয়া রয়েছে আপনার। এই জীবনটা তো খুব সহজ নয়। কেমন লাগে এই ‘তসলিমা-জীবন’? আরেকবার সুযোগ এলে এই ‘তসলিমা-জীবন’-টাই চাইবেন, না অন্য কিছু ভাববেন
তসলিমা নাসরিনঃ আমি তো পুনর্জন্মে বিশ্বাসী নই, তবুও বলছি, যদি আবার আসি, অবশ্যই আমি ফতোয়া, দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া, নির্বাসন নিশ্চয়ই চাইব না। তবে আমার যে বোধ, যুক্তি-বুদ্ধি, যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়া—সঙ্গে সমতার সমাজ, সবার জন্য মানবাধিকার যেন থাকে, নারীর জন্য সমানাধিকার যেন থাকে, সেসব তো চাইতামই। এসবের জন্য যদি দেশ ছাড়তে হ’ত কখনো, আবারও ছাড়তাম। আসলে এবারেও তো আমি বাধ্য হয়েছিলাম দেশ ছাড়তে।
শুভশ্রী নন্দীঃ সাল ১৯৯৪ -এর ৮-ই আগস্ট। প্রায় ত্রিশ বছর দেশে ফেরার অনুমতি নেই। দুই বাংলা থেকেই আপনি নির্বাসিত। অথচ মাত্র ১৭ বছর বয়সে যখন ‘সেঁজুতি’ পত্রিকাটি বের করেছিলেন, তখন দুই বাংলাকে সঙ্গে করেই আপনি এগোতে চেয়েছিলেন। এত বিশ্বখ্যাত হয়েও দুই বাংলায় আপনার অনেক ক’টি বই নিষিদ্ধ। ইংরেজি বা বিশ্বের অন্য কোন ভাষার পাঠকের কাছে আপনার পৌঁছে যাওয়া যতটা সহজ, সমভাষী মানুষের কাছে পৌঁছুনো ততটাই কঠিন। কী বলবেন?
তসলিমা নাসরিনঃ আপনি যেমন বললেন, অনেক বার চেষ্টা করেছি দেশে যাবার কিন্তু সম্ভব হয়নি। ইউরোপে যখন ছিলাম, দশ বছর পর আমি কলকাতায় যেতে চাইলাম, যেহেতু বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া আমার সম্ভব ছিল না, কিন্তু কলকাতায়ও সাড়ে তিন বছরের বেশি আর থাকা সম্ভব হ’ল না। খারাপ লাগে যে আমি একজন বাঙালী লেখক– কাউকে খুন করিনি, কোন অন্যায় করিনি, সমাজের ও মানুষের সবার ভালো চেয়েছি—আর আমারই জায়গা হলনা কোন বাংলায়! এই দুঃখটা তো আছেই। কারণ আমি বাংলায় লিখি, অন্য কোন ভাষায় লিখি না। যদি বাংলা ভাষার মধ্যে আমি থাকতে পারতাম, আমার মনে হয় আমি অনেক ভালো লিখতে পারতাম। অনেকে আমার লেখা বা মতবাদ পছন্দ করেন না বলে ধর্মীয় বা মৌলবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে চায় না আমি সেখানে ফিরি ও থাকি। সেকারণে আমি যাইনা তা নয়, আমাকে সরকারী তরফ থেকেই যেতে দেয়া হয় না। আর পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের মত অবস্থা না হলেও, আমায় পশ্চিমবঙ্গ ছাড়তেও বাধ্য করা হল।
তবে আমি যেখানেই থাকি, যেখানেই বাস করি, আমি লিখে যাব, অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। লিখে যাব নারীর সমানাধিকারের জন্য। সেটা আমি জানি। সে যেকোন জন্মেই হোক।
শুভশ্রী নন্দীঃ তসলিমা, আপনি আমাদের মেয়েদেরকে একটি শব্দ উপহার দিয়েছিলেন— সেই সূত্র ধরে বাংলা অভিধানকে ঋদ্ধ করেছিলেন। ‘মেয়েবেলা’—সেই নিজস্ব শব্দ পেয়ে আমাদের আর ধার করে কথা বলতে হয়না। আমরা এযুগের শহুরে মধ্যবিত্ত মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছি, বলার অধিকার অর্জন করেছি। এমনকি পরিবারে ভাই বোনের মধ্যে খুব একটা বৈষম্য পাইনি। মেধার কথা বাদ দিয়ে সাহসের কথা বলছি। তবু আমরা কেউ ‘কমফোর্ট জোন’-এর বাইরে গিয়ে ‘তসলিমা’ হতে পারলাম না। আমি আপনার ‘মেয়েবেলা’-র সেইজায়গায় সার্চলাইট ফেলতে চাই, যেখানে একটি মেয়ে কিভাবে ‘তসলিমা’ হয়ে ওঠে?
তসলিমা নাসরিনঃ সেই যে বললেন, সেঁজুতি পত্রিকা করতাম। আমার বাড়িতে সেকুলার পরিবেশ ছিল। আমার বাবা ধর্মটর্ম মানতেন না। আমার মা মানতেন। তবে বাবার কথায় সব চলত বলে তিনি ধর্মকর্মে বাধা দিতেন। তিনি ডাক্তার ছিলেন, মেডিকেল কলেজের প্রফেসার। তিনি চাইতেন ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করবে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে। দাদারা সাহিত্য পত্রিকা করতেন, সেই কারণে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ হয়েছিল। যখন কবিতার বই প্রকাশিত হয, তখন আমি ডাক্তার। কিন্তু বহু ডাক্তার দেখেছি তাঁরা বিজ্ঞানমনস্ক নয়। একটা সেকুলার পরিবেশ পেয়েছিলাম বলে আমি এমন গড়ে উঠেছি। আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানমনস্ক ছিলাম। যে কোন কুসংস্কার বা ধর্ম আসুক, আমি প্রশ্ন করতাম। প্রশ্নের যখন আমি সঠিক উত্তর পেতাম না, আমি যুক্তি দিয়ে জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু যে ক্ষেত্রে আমি যুক্তি খুঁজে পাইনি, আমি তা মেনে নিইনি। কিন্তু সেই কারণে আমার বাড়িতে কোন সমস্যা হয়নি। আর আমি কি করে গড়ে উঠেছি? আমি দেখেছি এটি একটি ভীষণ রকম পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, নারীবিদ্বেষী সমাজ। আমি প্রশ্ন করেছি, ‘শুধু মেয়ে বলে, কেন একটি নারীকে অত্যাচারিত হতে হবে?’ ছোটবেলা থেকে এই করে আসা প্রশ্নের ভালো কোন উত্তর আজও আমি পাইনি । তখনই আমার মনে হয়েছে নারীর সমানাধিকার পাওয়া উচিত। ধর্মের ব্যাপারে সমস্যা হয়নি। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে আমরা বোনেরা, দাদাদের মত স্বাধীনতা পাইনি। তখন থেকেই প্রশ্ন মনে এল, ‘শুধু পুরুষেরা কেন সুবিধা পাবে? আমি বা অন্যান্য মেয়েরা কেন পাব না? এই প্রশ্ন করতে করতেই, আমার লেখায় গদ্যে পদ্যে — প্রতিবাদ, স্বাধীনতা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই – এই বিষয়গুলো এল। আমার কবিতার বই সবার ভালো লাগছিল, বিক্রী বাড়ছিল। তখন কলাম লেখার প্রস্তাব এল। ভাবলাম মেয়েদের কথাই লিখব, তাঁদের কথা তো কেউ লেখে না। আর যাঁরা লেখে তাঁরা পুরুষ, তাঁরা মেয়েদের কষ্টের কথা অত বোঝে না, যতটা মেয়েরা বোঝে। সেই মেয়ে হিসেবে মেয়েদের কথা বুঝতে পেরেছিলাম বলেই আমি লিখতে শুরু করেছিলাম। যখন আমি নিজের গল্প বলছিলাম, কত হাজারো মেয়ে আমার কাছে এসে বলেছে যে আমি তাঁদের গল্প বলছিলাম। এবং তাঁরা আমার এই লেখা থেকে শক্তি ও সাহস খুঁজে পাচ্ছে, সেটা আমার জন্য একটা বড় প্রেরণা। যত পুরস্কার পেয়েছি, সেটা বোধহয় আমার জন্য এত প্রেরণাদায়ক ছিলনা, যতটা মেয়েরা আমায় দিয়েছে। তাঁরা জীবনে জানিয়েছে অনেক কিছু করছে, যা আমার লেখা না পড়লে হয়তো তারা করত না। যা আমাকে আরও লিখতে ও ভাবতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
শুভশ্রী নন্দীঃ এই বছর বাবরি মসজিদ কাণ্ডের ৩২ বছর। বাংলাদেশে আপনি সেই সময় সংখ্যালঘুদের পাশে কলম নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
তসলিমা নাসরিনঃ হ্যাঁ, একজন ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে আমি সংখ্যালঘুদের কথা সবসময় বলেছি। আমি যখন সংখ্যালঘুদের হয়ে লিখেছি, তখন আমাকে বিজেপি সমর্থক, ‘র’-এর এজেন্ট বলে গালি দেয়া হয়েছে। আমার মনে হয়েছে আমার পাশে কেউ অত্যাচারিত হচ্ছে। আমাকে পাশে দাঁড়াতে হবে। ঠিক নারীর-পাশে দাঁড়ানোরই মত। কারণ আমি চাইনা যে শুধু অন্য ধর্মাবলম্বী বা অন্য মতে বিশ্বাস করছে বলে তাঁকে নির্যাতিত বা বৈষম্যের শিকার হতে হবে, এমনটা নয়। এটা কোন সুস্থ সমাজব্যবস্থা হতে পারে না। যাঁরা প্রগতিশীল, সুস্থ সুন্দর সমাজ, মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাস করেন, তাঁরা অনেকে চিৎকার করে মৌলবাদের প্রতিবাদ করছেন, লড়াই করছেন। আমি একা নই। আমি যেমন ৩২ বছর আগে প্রতিবাদ করেছি, এখনও সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে একই ভাবে সরব প্রতিবাদে রয়েছি আমি। তবে বাংলাদেশে সংখালঘুর ওপর নির্যাতন নতুন কোন গজানো সমস্যা নয়। পূর্ববর্তী সকল সরকারের সময়ই নির্যাতন ও দেশ ছাড়ার এই সমস্যা ছিল। যত সরকার এসেছে, ধর্মকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে। এখন অবশ্য বর্তমান সমস্যা সব কিছু ছাপিয়ে গেছে। এখন ‘প্রপাগাণ্ডা’ বলে সমস্যা ঢাকার চেষ্টা চলছে। আমি এই নিয়ে প্রচুর লিখছি ও প্রতিবাদ করছি।
তেমনি পৃথিবীর কোথাও যেখানে ভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-মতবাদের জন্য সমস্ত ধর্মের যত সংখালঘু যে যেখানে অত্যাচারিত হচ্ছে, তার বিপক্ষে সরব আমি। আমি পৃথিবীটাকেই বলি, এ আমার দেশ। এখানে মানুষ ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক, সভ্য হোক, সুস্থ হোক। পৃথিবীটা আমাদের বাসযোগ্য হয়ে উঠুক, সেটাই চাই। আমি একটি বিশেষ এলাকায় জন্মেছি বলে সেটুকুই আমার, পৃথিবীর অন্য এলাকা আমার নয়, এ আমি কখনোই ভাবি না। যখন আমি কাঁটাতার দেখলাম, আমার খুব কষ্ট হয়। পাখী যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। মানুষ কেন পারবে না! আসলে সব মানুষকে আমরা বর্ণে ধর্মে ভাগাভাগি করে আলাদা করে দিই। আমার বাবার ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষার জন্য কখনো আলাদা করে ভাবতে দেননি। আমি তা কখনো করে উঠতে পারিনি।
এইটুকু বোধ আমার হয়েছে, সেই বোধ থেকেই আমি এখনও লিখি। আমি লেখা দিয়ে অনেকের বোধবুদ্ধি জাগ্রত করার চেষ্টা করব। এবং যতদিন বাঁচব ততদিন লিখব।
শুভশ্রী নন্দীঃ আমরা সচরাচর যখন জীবনী পাই। পূর্ণজীবনের বদলে অর্ধেকজীবনই বেশি দেখি। আপনার লেখার মধ্যে যেহেতু সততা ও পরিপূর্ণতা রয়েছে। সম্পূর্ণ জীবনটাকে যেহেতু আপনি মেলে ধরেছেন, নানা রকম প্রতিকূলতার হার্ডেল অতিক্রম করে আপনাকে যেতে হচ্ছে। বাবার কথা মায়ের কথা বারবার ফিরে ফিরে এসেছে লেখায়। কিন্ত মনকে প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সময় চারপাশকে আঘাত দেয়া হয়ে যায়। আসলে, সম্পর্কগুলো চারপাশের হানিকমের মত বুনে থাকা সমাজকে কেমন যেন কেলিডোস্কোপিক ভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধের পর লেখা এবং তার পর এতটা ঝড় বা অভিঘাতের মুখোমুখি হওয়া। আবার সম্পর্কগুলোকে স্বক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনা। কি করে সম্ভব হয়েছিল?
তসলিমা নাসরিনঃ আমার নারীর হয়ে লেখাগুলোকে ‘পুরুষবিদ্বেষী’-রা পছন্দ করে না। কখনো তারাই আমার ফাঁসীর দাবী করে। যা হয়েছিল নব্বুইয়ের দশকে। আমি ভয় পাইনি। আমি সত্যি কথা বলছি। আমি কেন লেখা থামাব? দেখ, লেখক আমি। আমি তো পারিই প্রেমের গল্প-কবিতা লিখতে। ওইসবে কী কাজ? অনেকে পারে, আমি তা পারিনা। অনেক লেখকই সমস্যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। আমি সাহিত্য দিয়েই প্রতিবাদ করেছি। তাই মানুষ আমার ‘প্রতিবাদী সাহিত্যিক’ বলে। বলুক। আমি বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব। আমি এতে যদি লেখক না হয়ে প্রতিবাদী হই-তাতে কিছু যায় আসে না। আমি নিজেকেই কথা দিয়েছি, নিজের মধ্যে যে আগুনটা আছে, তা যত আবর্জনা আছে তা পোড়াতে, সবসময় জ্বলবে।
শুভশ্রী নন্দীঃ আপনার কথায়, বিশেষ ভাবে কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে একটি কথা- ‘আমি ভালো নেই।’। ‘দেশ তুমি কেমন আছ? কেমন আছ তুমি দেশ? মানুষ হয়ে যেতে না পারি, পাখী হয়ে ফিরে ফিরে যাব।’ “কেমন আছে আপনার দেশ, তসলিমা? আপনার কি এখনও পাখী হয়ে যাবার সাধ হয়, এই বাংলাদেশে?”
তসলিমা নাসরিনঃ “আমার বাংলাদেশ ভালো নেই, সেটা শুধু আমি নই, সবাই জানে। কিন্তু তারপরও কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে হয়। আমি জানি আমি যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমায় হয়তো মেরে ফেলবে। কিন্তু যদি সম্ভব হত ওখানে থাকার, থাকতাম। থেকে চেষ্টা করতাম সমাজটাকে আরও শিক্ষিত ও সভ্য করার জন্য। সেটা কাছে না হলেও দূর থেকেই আমি করছি। কিন্তু মনে মনে তো আমি বাস করি সেই দেশে, যে দেশে আমার জন্ম, বড় হওয়া। এই বাংলা-কে ভালোবাসি বলেই, সুইডেনের নাগরিক ও আমেরিকার গ্রীনকার্ড থাকা সত্বেও, ইউরোপ আমেরিকায় আমি কখনো থাকতে চাইনি। এখন তো যে দেশটা দেখতে আমার দেশের মত, সেই ভারতবর্ষে বাস করছি, যা বাংলার কাছে। বাংলা হয়তো আমাকে বাস করতে দেয়নি বাংলায়। তবু এখানে যে ফুল বা গাছ আছে তাকে আমি চিনি, তাঁর নাম জানি। এখানকার পাখীর নাম আমি জানি। আমার খুব চেনা বলে মনে হয়, দেশ বলে মনে হয়।
শুভশ্রী নন্দীঃ ‘মিটু মুভমেন্ট’ হালের কথা। কিন্তু সেই কবে আপনি ‘আমার মেয়েবেলা’-তে সেকথা বলেছেন। অপর্ণা সেন একটি সাক্ষাৎকারে খুব হাল্কা করে বলেছেন, ‘জান তো পুরুষেরা একটু স্বার্থপর হয় গো।’ এই মি টু-র যুগেও আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যে নিজেদের অধিকারের জমিটির জন্য লড়ে যাই, তাঁরাও অর্ধেক আকাশ চেয়ে সমানাধিকারে বিশ্বাসী। আপনার কলম সরাসরি বলে, ‘ওরা তো মানুষ নয়, ওরা তো পুরুষ।’ পুরুষতান্ত্রিক নারী বা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নারীর বিপক্ষে আপনি কথা বলেছেন। আজ আমাদের দর্শকদের মধ্যে ‘নারীবাদী পুরুষ’ ও হয়তো রয়েছেন। রয়েছেন বিদ্যাসাগর-রামমোহন…এভাবে সাধারণীকরণ করা যায়? এখানেও কী নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ক্ষতায়ণের একটা ভূমিকা থাকছে না? কী বলবেন?
তসলিমা নাসরিনঃ আমি অনেক নারী দেখেছি যারা পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক। এটা খুব স্বাভাবিক। একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করতে করতে নারীরা সেই পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাস করতে শুরু করে। আসলে একটা মগজধোলাই তো সেই জন্মের পর থেকেই হয় – পুরুষেরা জানে বেশি, পারে বেশি। নারীরা কম জানে, কম পারে। একটি শিশু যখন এমন সমাজে বড় হয়, তারা এমনই শিখে বড় হয়ে ওঠে। একটা সময় দেখা যায় যে নারীরা নারীদের ওপর অত্যাচার করছে। আবার এমন অনেককে দেখেছি যারা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করে। এখানে কে নারী বা পুরুষ হয়ে জন্মালো সেটা আমি দেখছি না। যে সমানাধিকারের সংগ্রামে এগিয়ে আসবে, সে নারী বা পুরুষ যে কেউই হতে পারে। আমাদের দেশে তো নারীরা ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তাতে কি নারীদের কোন উন্নতি হয়েছে? এরা পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী নারী যারা সেই বিশ্বাসটি প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। নারীর স্বাধীনতা কায়েমের সমর্থক যদি পুরুষ হত, তাহলে আমি তাঁদের সমর্থন করতাম। আবার যাঁরা মনে করেন পুরুষতন্ত্রের অবসানে নারীততন্ত্র আসবে, তা ঠিক নয়। পুরুষতন্ত্রের বিকল্প নারীতন্ত্র নয়। সেইজন্য সমানাধিকারের কথা উঠে এসেছে বারবার। সমানাধিকারের সুবিধে শুধু নারীদের নয়, পুরুষদেরও হবে।
এই পুরুষ চেতনার মৌলবাদে বাউল মেলা বন্ধ হল, লালন মেলা বন্ধ হবে। গান-বাজনা বন্ধ হবে। মেয়েরা ঘরবন্দী ও পর্দানশীন হবে। আফগানিস্তানের দিকে যাবে– যা ভয়াবহ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর একটা সময়ে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার স্বাদ ও সমানাধিকার পেয়েছিলাম । সমাজ ও মানুষ তো এগিয়ে যায়। কিন্তু এরা যেন পিছিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একধর্মী হওয়া সত্বেও নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য লড়াই করেছে। এখন সেই আবেগ কোথায় ভেসে গেল!
শুভশ্রী নন্দীঃ তসলিমা, আমাদের শহরটার নাম আটলান্টা। আজ আপনি আসছেন শুনলে, একজন এখানে আসতেন। তিনি ব্লগার অভিজিৎ রায়।
স্বাধীন কলমের সপক্ষে যাঁরা এগোচ্ছেন, দেখা যাচ্ছে হয় তাঁরা খুন হচ্ছেন বা দেশান্তরী অথবা নিষিদ্ধ হচ্ছে তাঁদের লেখা। স্বাধীন কলমের পাশে ব্লগারদের হয়ে কলম ধরেছেন রাজীব, অভিজিৎ, মহিউদ্দিন, নীলয়, রহমানবাবু। এখানে অনেক লেখক আছেন, তাঁদেরকে আপনি কী বলবেন?
তসলিমা নাসরিনঃ এখানে যাঁরা আছেন তাঁরা লিখতেই পারেন। অভিজিৎ, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত, নীলয় আমার বন্ধু ছিলেন। দীপন… ওঁদের যাঁরা হত্যা করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তাঁদের মুক্তি দিয়েছেন। দেশটা আর দেশ নেই। সেখানে জিহাদী আই সি সি আই পতাকা উড়ছে।
শুভশ্রী নন্দীঃ তসলিমা, আপনার অবস্থান এই যে আপনি ধর্মের বিপক্ষে নন, মানবতার প্রশ্ন থেকে ধর্মান্ধতার বিরূদ্ধতা এসেছে। ধর্মকে আপনি রূপকথার গল্পের মত বলেছেন। সলেমন রুশদিও যখন লেখেন তখনও সেখানে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে রূপকথারই আশ্রয় নেন। এমন না হোক কখনো। কিন্তু আমরা না চাইলেও রুশদির ক্ষেত্রে এমন হয়েছে। ২০১৭-তে আপনিও হায়দ্রাবাদে আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রচণ্ড আঘাতের পর রুশদি ফিরে এসেছেন একটি শব্দ নিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদে। ‘দ্য নাইফ’। একটি শব্দে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হত?
তসলিমা নাসরিনঃ আমি কখনো অস্ত্রের কথা বলব না। শান্তির নোবেল পুরস্কার পাওয়া দেশনেতৃত্ব, তবু আমার দেশ অশান্ত আজ। আমি শুধু বলব একটি শব্দঃ শান্তি।
শুভশ্রী নন্দীঃ পশ্চিমবঙ্গে সমকালীন তথাকথিত নারীবাদী লেখকদের চোখেও আপনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। সেই কলকাতায় ১৪-ই আগস্ট মেয়েদের রাতদখল দেখে, কি মনে হয়েছে আপনার?
তসলিমা নাসরিনঃ ভালো লেগেছে। পথে নেমে লড়াই করছে মেয়েরা। বলছে রাস্তায় থাকব, বাড়ি যাব না।
শুভশ্রী নন্দীঃ আপনার কলম ছোঁয় হৃদয়, আপনার কলম অগ্নিময়, আপনার কলমের শক্তিতে আমরা পূর্ণ হই, নবজন্ম লাভ করি।
তাই আমাদের অগ্রসর মেয়েদের চেতনায় যেমন আশাপূর্ণা থাকেন, বেগম রোকেয়া থাকেন, তেমন থাকেন তসলিমাও। তসলিমা নাসরিন এই সময়ে এই ভূমণ্ডলের একজন খ্যাতিমান সেরা লেখিকা যিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালের চিকিৎসকের জীবন ছেড়ে দিয়ে কলমকে ভালোবেসে কলম হাতে দেশান্তরিত হয়েছেন, সমাজকে কল্যাণমুখী করতে।
জন্মভূমিকে বলা হয় ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’। তাই তিনিই হয়তো বলতে পারেন, “আমিই প্রথম ব্রাত্য নারী/ স্বর্গচ্যূত, নির্বাসিত” (কবিতা সিংহ)
আর তিনিই হয়তো সর্বপ্রথম জেনেছিলেন ‘স্বর্গেতর’ কলমজীবন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন