কাবেরী নদীর তীরে জয় গোস্বামীর সঙ্গে
সাক্ষাৎকার: জয়তী রায়
অনুলিখন: সুকন্যা সাহা

হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে …
জয় গোস্বামী। যার লেখনী বাংলা কবিতার এক অমূল্য সম্পদ। অসম্ভব অন্তর্মুখী এই কবি অনায়াসে বলতে পারেন, “পাগলী তোমার সঙ্গে এক ভয়াবহ জীবন কাটাব”। আসলে তিনি বাংলা কবিতার জগতে এক অপরূপ কাব্যময়তার যুগের সূচনা করেছেন। এই প্রথম এক সাক্ষাৎকারে একদম সোজাসাপ্টা কবি ও কবিপত্নী কাবেরী গোস্বামীর সঙ্গে অকপটে কথা হয়েছে। তাঁর জীবন, কবিতা, প্রেম-অপ্রেম, ঈশ্বর সব কিছু নিয়ে। আমরা পাঠকরা আবিষ্কার করব এক নতুন জয় গোস্বামীকে। তাঁর ভিতর ঘরে আলো ফেলেছেন কবি নিজেই। তাই এই কথোপকথন নিছক সাক্ষাৎকার নয়। মানুষ জয় গোস্বামীকে চেনার মাধ্যমও বটে!
সেই ছোট্ট বেলার মেঘের মাঠে হারিয়ে যাওয়া থেকে কিশোরী বয়েসে ছাদের ঘরে মেঘকে দেখা, ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা থেকে অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে, বাংলা কবিতার জগতে নিজস্ব ভঙ্গিতে এক অপরূপ কাব্যময়তার সৃষ্টি করেছেন। কবি জয় গোস্বামী আর তেরো বছর বয়েস থেকে শুরু হওয়া কবি জীবনের পরিক্রমার কথা উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারের ছত্রে ছত্রে। কখনও কবি খোলামেলা আবার কখনও অন্তর্মুখী। স্বগত উক্তি করেছেন নিজের সঙ্গেই। আর আমি? এই নিভৃত কথোপকথনের দর্শক মাত্র …
জয় – কাবেরীর ঘর। চারিদিকে বই। আদরের পোষ্য। ঠাকুরের সিংহাসন। সেইসঙ্গে নিবিড় ভালবাসার ছায়াময়তা। ১০ নভেম্বর, ১৯৫৪ সালে তাঁর জন্ম। উত্তর জীবনানন্দ পর্বের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হিসেবে বিশ্ব বন্দিত। চমৎকার চিত্রকল্প, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষায় ঋদ্ধ তাঁর কবিতা। দুইবার আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ কাব্যগ্রন্থের জন্যে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ছোটবেলায় পিতৃহারা জয় গোস্বামীকে তাঁর মা শিক্ষকতা করে বড় করেন। সেই ছোট্ট থেকেই জয় ডুবে থাকেন কবিতা লেখায়। তাই তো থাকবেন। প্রথাগত শিক্ষা দিয়ে জয় গোস্বামী হয়ে ওঠা যায় না। এইসব আলোচনায় আমরা আসব, তার আগে বলি, অপারবাংলার পক্ষ থেকে কাবেরী গোস্বামীকে অনুরোধ করা হয়েছিল তিনি যেন স্বল্প পরিসরে তুলে ধরেন সাগরের সীমাহীন প্রতিভা। কাবেরী গোস্বামীর মত যোগ্য আর কে? ভাত খেতে ভুলে যান কবি, স্নান সেরে ভেজা গায়ে বেরিয়ে আসেন স্নানঘর থেকে কারণ মনে পড়েছে কবিতার লাইন, ঠান্ডার ধাত, একলা থাকতে ভালবাসেন অথচ অভিমানী — কাবেরী ছাড়া কে আছে? যিনি একাধারে মা অন্যদিকে প্রেমিকা — জয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত কাবেরীর পৃথিবী ভরে থাকে কল্যাণ কামনায় পুজো, উপোস, তীর্থ দর্শন। অপারবাংলা অনুরোধ জানিয়েছিল — কাবেরী বলেছিলেন — খুব কাছে থেকে দেখেছি। তাই জানি, মানুষটা কবিতায় বেঁচে থাকেন। আমি কি পারব?
অপার বাংলা বিশ্বাস করেছিল, কাবেরী পারবে। এবারের শারদীয়ার অপার বাংলার কৃতজ্ঞ স্মরণ অঞ্জলী — জয় / কাবেরীর সঙ্গে একটি সন্ধ্যা।

শ্রাবণসন্ধ্যায় উজিয়ে যাওয়া দক্ষিণ থেকে সল্টলেক মুখের কথা নয়। গভীর টানের ভরপুর এনার্জি নিয়ে পৌঁছে যেতেই একমুখ হাসি আর গরম চা নিয়ে আপ্যায়ন জয় ঘরণীর। সঙ্গে আছে ফুলকো লুচি, ছোলার ডাল, আলুরদম। অমৃত বললেও কম বলা হয়। আড্ডার মাঝে আবার চা এল। তুফানের মত হাসি উঠে এল। বুকুন এল। ঝলমলে সন্ধ্যা শুরু হল জয়ের কথা দিয়ে —-
জয় বলে, আমার প্রতিদিনের জীবনে মনের ভেতর ঘরে যে ভাষা জন্মায়, যে অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়, তাকে ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করি।
কাবেরী বলেন — এইখানে বসো আরাম করে। দরজা বন্ধ করে কি করছিলে?
জয় হেসে বলেন — ঘুমোচ্ছি। পড়ছি। ভালো লাগছিল বেশ।
কাবেরী — এই যে তুমি ১৩ বছর বয়েস থেকে এখনও পর্যন্ত লিখে আসছ … এই লম্বা সময়ের মধ্যে কোন সময়টা বেশী ভালো লাগে?
জয় — আমি মূলতঃ কবিতা লিখতাম। কবিতাই লিখেছি। খুব গান শুনতাম। গানের সুর আর কথা টান দিত। হয়ত এই আকর্ষণ থেকে কবিতার জন্ম।
কথা বলছেন জয়। বসে আছেন অল্প হেলান দিয়ে। শাদা পাজামা – পাঞ্জাবি পরণে। একটা একটা করে শব্দ বলছেন যেন জীবন্ত সরস্বতী। চারিদিকে ঢেউ তুলছে aura। চুম্বক আকর্ষণ। মহিলারা পাগলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ত। কেন? তিনি উত্তমকুমার নন। কিন্তু, আকর্ষণ এমন তীব্র যে চোখ সরানো যায় না।
“এইখানে এসে প্রেম শেষ হল। শরীর মরেছে। তোমার হাত ধরে আমি দাঁড়িয়েছি বৃষ্টির ভিতরে”
(এইখানে এসে প্রেম / জয় গোস্বামী)
নারী অগুন্তি। কিন্তু প্রেম?
আমাদের একটাই ছাতা।
তাতে দুজনেরই চলে যায়।
( ঐ ) — এই শব্দগুচ্ছ ঝরে পড়ে কাবেরী প্রসঙ্গে। তাই কাবেরী যখন গোঁসাইয়ের জীবনে আসে তখনো কমেনি নারীদের আগমন। সেই প্রসঙ্গে কাবেরী প্রশ্ন করে —- বিবাহের পরে নারী এসেছে জীবনে। আছে কোনো অপরাধবোধ?
জয়ের মুখে শিশুর মত পবিত্র হাসি। অমলিন হাসিতে নেই কোনো অপরাধবোধ।
জয় বলেন — কবিতা যখন আসে তখন যেমন বোঝা যায় না, নারীরাও তেমনি আসে। প্রেম বলে কয়ে আসে না তো? নারীদের আসা – যাওয়া সহজ সাবলীল। মেঘের মত।
কাবেরী — এত নারী কেন এল? স্ত্রীর খারাপ ব্যবহারের জন্যে?
বিস্ফোরক প্রশ্ন। কাবেরী ছাড়া কার সাহস হবে এমন প্রশ্ন করার? জয় নির্বিকার। সরু সরু চাঁপার কলির মত আঙুল নেড়ে বলেন
জয় — সংসারে থাকতে গেলে ঠোকাঠুকি লাগে, সেটা কোনো কথা নয়। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটা পুরাতনী গান ছিল – তোর কথার কথা সয় না প্রাণে, সে তো টুকটাক হয়েই থাকে। কিন্তু প্রেম বলতে যা বোঝায়, সবসময় যুক্ত থাকতে হয় তাও নয়। হাসিমুখে সৌজন্য বজায় রেখেছি।
কাবেরী — পরনারীর সঙ্গে মিলিত হবার সময় স্ত্রীর মুখ মনে পড়ত?
জয় ( মুখ নামিয়ে / একটু ভেবে ) — স্ত্রীর মুখ মনে পড়ে না এটাই সত্য সেইসঙ্গে এটাও সত্য আমার যে বেঁচে থাকা তার মধ্যে কাবেরী আছে। এখন তো আমি তোমাদের জীবন থেকে অনেকটা বাইরে চলে এসেছি। ওই একটা ঘরের মধ্যে আমি থাকি। তোমরাও দরকার পড়লে আমার ঘরের দরজা ঠক ঠক করো। এঘর থেকে ওইঘরে ফোন করো। তুমি জানো, সারাজীবন যে জিনিসটা আমি ভালবেসে এসেছি, এই বয়েসে এসে সেই জিনিসটা আমি শেখার চেষ্টা করছি। এটা আমাকে একলাই অভ্যেস করতে হবে। তাই আমার স্বেচ্ছানির্বাসন। তুমি তো আমাকে চিনেই ভালবাসো।
কাবেরী অল্প হেসে উত্তর দেয় — হ্যাঁ। তোমাকে চিনি। তাইতো প্রশ্ন করতে সাহস পাই। সংসারে তোমায় বাঁধা যাবে না। লেখা ছাপা বন্ধ করেও লিখছ। নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে লেখো। আমি নিউ আলিপুরের মেয়ে। বিয়ে ভেঙে যায়। রানাঘাটে আলাপ হয়। বাড়ি ছাড়ি ৯০ সালে। আমি আনন্দবাজার থেকে ঠিকানা নিয়ে সাহায্য চাই। আমি সাতাশ বছর। মেয়ের আড়াই বছর। রাস্তায় বসে ছিলাম। মা আশ্রয় দেয়নি। বাবার চাকরি বোন পায়। বিপদের সময় জয় তুমি হাত ধরেছিলে। আজকেও ছাড়োনি।
জয় — তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটাই অলৌকিক। আমার পরে মনে হয়েছে বারবার। এই খুঁজে পাওয়া এটা দৈব। যখন যে ভাষাটা খুঁজি হয়ত পাই আবার চলে যায়। আবার হঠাৎ করে চলে আসে যেটা চাইছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ছাপতে দেব না কিন্তু লিখব। ভিতর থেকে এলে তবেই কবিতা লিখব। কবিতা না আসে তবে লিখব না। একটা চূড়ান্ত শূন্যতা বোধ কাজ করে। যখন লিখতে যাই বেশ বুঝতে পারি। তবে আমি হতাশ নই। আত্মবিশ্বাস আছে। লিখতে বসলে অনেক সময় মনে হয় জানি না আমি কী লিখব। শব্দ দিয়ে অভিজ্ঞতা স্পর্শ করতে পারছি কি না!
কাবেরী — বলছ অলৌকিক, বলছ দৈব — ঈশ্বর কিরকম বিশ্বাস করো?
জয় — প্রতিদিন কথা বলি। কষ্ট পেলে বলি। আনন্দ পাই কথা বলি।
কাবেরী — সামনে দুর্গাপুজো। এই পুজোর গুরুত্ব কতখানি তোমার জীবনে?
জয় — আমাদের বাড়ি দুর্গাপুজো হয়। তুমি তো করো।
কাবেরী — সে তো আমি করি।
জয় — বরাবর বলে এসেছি, আমি দৈবে বিশ্বাস করি। দেবালয় যাওয়া, ধর্ম স্থান যাওয়া, তীর্থে যাওয়া — ভিন্ন জিনিস। বিশ্বাস করি, একটা কবিতাও আসত না দৈব ছাড়া। যেমন, গদ্য লেখার কথা যদি ধরো …
কাবেরী — হ্যাঁ, এটা একটা ব্যতিক্রমী কাজ। কিভাবে এল … বলো একটু।
জয় — আমি যে পঁচিশটি উপন্যাস লিখতে পেরেছি তার কৃতিত্ব সাগরময় ঘোষের।
কাবেরী — এটাও দৈব বলবে?
জয় — অবশ্যই। সাগরময় ঘোষ যখন বললেন আমি বেশ নার্ভাস হয়ে গেলাম। সাগরময় বললেন, চেষ্টা করো। ঠিক পারবে। এই বিষয়ে তোমার বড় ভূমিকা আছে কাবেরী।
কাবেরী ( মিষ্টি হেসে ) — বলছ কী! দাঁড়াও, আরেক কাপ করে চা হয়ে যাক এই আনন্দে।
জয় চঞ্চল কিশোরের মত লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বললেন — আমি নিয়ে আসছি। চা ব্রেক।
কাবেরী — তুমি বসো। কথা বলো। বুকুন আর সবাই চা খাবেন, নিয়ে আসছি।

চা পর্বে কথা উঠল কাবেরীর হোম ডেলিভারি নিয়ে। ‘গুঁড়োমশলা’ নামের কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়ে খাবার বানানো একটা আর্ট ছিল কাবেরীর কাছে। প্যাশন যাকে বলে। লোকজন পাশে রইল না। কাবেরী যেমন পাশে পেয়েছেন বন্ধুজন তেমনি হাত সরিয়ে নিয়েছে অনেক আপনজন। দুঃখবোধ নেই। প্রবল ঈশ্বর বিশ্বাসী কাবেরী মনে করে ঠাকুর মঙ্গল করবেনই। যাই হোক, চা খেয়ে ফিরে এলাম উপন্যাসের প্রসঙ্গে। জয় গোস্বামীর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘সেই সব শিয়ালেরা’ তিনি বলছেন লিখতে চাননি।
জয় ( চা খেয়ে ) — ইন ফ্যাক্ট, প্রথম উপন্যাস লেখার পরে আর লিখতে চাইনি। তখন কাবেরী আর আমি একসঙ্গে সংসার করছি। তখন ‘দেশ’ পত্রিকায় একটা উপন্যাস লিখলে পনেরো – কুড়ি হাজার টাকা পাওয়া যেত। কাবেরী আমাকে বলল, সৎ পথে তুমি আর কিভাবে এই কুড়িহাজার টাকা রোজগার করবে? এখন আমাদের মেয়ের বয়স তিন। ওর ভবিষ্যত আছে। পড়াশুনো আছে। তা, তুমি যখন উপন্যাস লিখতে পারছ, লিখবে না কেন? উপন্যাস গল্প লেখার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, আমার মনের মধ্যে এমন কিছু অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি সঞ্চিত আছে যা কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব … এবং আমি সেটা করেও এসেছি … কিন্তু, আমি আরো বুঝতে পারলাম আমার মনে এমন কিছু অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি সঞ্চিত আছে যা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয় তাদের একমাত্র গল্প উপন্যাসের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব। একটা উপন্যাসের পান্ডুলিপি এখনো আছে।
(জয় আমাদের কাছেই বসে আছেন। গদ্য লেখার কথা বলতে গিয়ে তন্ময়তা দৃষ্টি এড়ায় না। কাবেরী একটু অন্যমনস্ক। পাশের ঘর থেকে পোষা সারমেয় বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওইটুকুই শব্দ। বাড়ির চারিদিকে কাবেরী গাছ লাগিয়েছে। ছোট্ট ফ্ল্যাটের জানালা খোলা। গাছপালার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। জয়ের চোখ দুটি আধো খোলা। যেন কিছু একটা ভর করেছে )
জয় বলছেন — আঠাশ দিন একটানা লিখে শেষ করেছিলাম ‘সাঁঝবাতির রূপকথা’। ওই যে দৈব বলছিলাম … অনেকসময় যা লিখতে চাইনি … লেখা হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দ — দুজনেই বারবার কাটাকুটি করেছেন।
(জয় উত্তেজিত ভঙ্গিতে) — আমার বেঁচে থাকার মধ্যে দিয়ে কবিতা বা উপন্যাস ফুটে ওঠে। জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকেই লেখার চেষ্টা করি।
কাবেরী ( তন্ময়তা ভেঙে বাস্তবে ফিরে) — চলার পথে বন্ধু ঋতুপর্ণ ঘোষ কতটা প্রভাবিত করেছেন?
জয় — ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আমি দুটি অফিসে একসঙ্গে কাজ করেছি। এক, আমি যখন ‘দেশ’-এর সম্পাদক ছিলাম ঋতু তখন ‘আনন্দ’তে সম্পাদক ছিলেন। পরে যখন ‘রোববার’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন তখন আমাকেও সেখানে নিয়ে গেল। সেখানে আমার লেখার নতুন দরজা খুলে গেল। প্রতি পনের দিন অন্তর একটা ধারাবাহিক কলাম লিখতে বলে … কবিতা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ সাত বছর লিখেছি তার পরেও তিন বছর লিখেছি … তারপরে যখন চাকরি ছেড়ে দিই তখনো বাংলা লাইভ ডট কম ও ইনস্ক্রিপ্টে নিয়মিত কবিতা নিয়ে আলোচনা করে গেছি।
কাবেরী — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমার প্রিয় খুব!
জয় — রবীন্দ্রনাথ খ্যাতির সঙ্গে নিন্দে মন্দ সহ্য করেছেন। কিন্তু, লিখেও গেছেন। নিঃসঙ্গতা ছিল প্রবল। নিজের উপর বিশ্বাসটাও ছিল প্রবল। এটাই শেখার। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় কবি রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ।
কাবেরী — তুমি অপেক্ষা করে আছো …
জয় — অপেক্ষা করে আছি কবিতা যেন ধরা দেয়।
কাবেরী হাসছে। ঘরে তৃপ্তির বাতাস বইছে। হাসতে হাসতে কাবেরী বলল — তোমায় এবার অনুরোধ করব মায়ের কথা বলতে। বলবে কিছু? তোমার মা, আমায় চোখে হারাতেন। তখনো ওর পুত্রবধূ হইনি। উনি তো ওই সময়ের ট্রিপল এম.এ ছিলেন।
জয় ( চোখ বুজে) বাবা তো মারা গেলেন অনেক ছোট বয়েসে। মা মানুষ করেছেন। শিক্ষকতা করেছেন। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রচুর বই কিনতাম। মা আপত্তি করেননি। দুটো লাইব্রেরির মেম্বার ছিলাম, মা আপত্তি করেননি। কলকাতার ফুটপাথের উপর বিভিন্ন লেখকের বই ছড়ানো থাকত, মা কিনে দিত। মা প্রভাব ফেলেছেন বইকি। মাকে মনে করে কবিতা লিখেছি। এখন বুকুন চলে আসে কবিতায়। মাতৃকেন্দ্রিক জীবন একটা ছিল।
মায়ের প্রতি নির্ভরশীল, এখন তোমার উপর, মেয়ের উপর টান আছে।
কাবেরী —- পরিবারে সবচেয়ে বেশি টান কার উপরে?
জয় — মেয়ে।
কাবেরী — আমার জীবনে তুমি তো আশ্রয় হয়ে এলে।
জয় ( হাত পা নেড়ে ) —- আরে, তুমি আমার পাশে থেকেছ। আমরা লিভ ইন করেছি। বিয়ে না করে একসঙ্গে থেকেছি। বুকুন আমাকে গ্রহণ করল। ৯৪ সালে বুকুন আমাদের বিয়ে দিল। মানে, মত দিল। তখন মা মারা গেছে। খাওয়া জুটছে না। যত্ন করার কেউ নেই। রোজ অসুস্থ হয়ে পড়ছি। খাওয়া নিয়ে খুব সমস্যা ছিল। অনেকেই ঘিরে থাকত। অনেক কবি হওয়ার জন্যে কাছে থাকত। কিন্তু, কেউ আজ আর নেই। তুমি ছাড়া।
কাবেরী — আমারও … কেউ নেই … কিন্তু, এখন বুঝতে পারি … সুযোগ নিয়েই চলে গেছে সবাই …
জয় (একই ভাবে, চোখ বুজে) — সিঁড়ি বলছ আমাকে? তাতে কিচ্ছু হয় না। কষ্ট পাই। কিন্তু, তারা ভালো থাকুক।
কাবেরী (গলা খাঁকারি দিয়ে) — শেষ প্রশ্ন। তুমি কি এই কুড়িয়ে পাওয়া পরিবার নিয়ে খুশী?
জয় — পরিবারই আমায় কুড়িয়ে পেয়েছে (সপ্রতিভ উত্তর কবির) মেয়ের শাসন, তোমার আদর … আমি বেঁচে আছি। বসে গল্প করলাম। এইটুকুই… আর কী!
কথা শেষ হল বলব না। কাবেরী কাগজ গুটিয়ে হৈ হৈ করে হেসে উঠল। আমরা বাড়ি যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লে জয় বললেন — কেন? এত তাড়াতাড়ি কেন?
হাতদুটি পিছনে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আমরা প্রণাম জানিয়ে অভিভূত হয়ে বাড়ি ফিরলাম।
এই হল আজকের কবি জীবনের পথ পরিক্রমা করে আসা দোষে গুণে মেলানো একজন নির্ভেজাল সরল মানুষ যিনি অকপটে নিজেকে সামান্য লোক বলতে পারেন আর পারেন তার অপূর্ব সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমাদের সূদূর কাব্যময়তার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে।
