binodan-putul-nacher-itikatha

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’
বই ও ফিল্ম রিভিউ
সুরশ্রী ঘোষ সাহা

 

একটি ধ্রুপদী সাহিত্য নির্ভর ছবি রিলিজ হচ্ছে শুনে খুব আনন্দ পেলাম। যে সমাজে চিরকাল নারীর কামনা নামে কোন বস্তু থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করা হয় না, সেই সমাজে দাঁড়িয়ে ১৯৩৫-৩৬ এর সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “শরীর, শরীর, তোমার মন নাই, কুসুম?”

 যদিও কুড়ি বছর আগে যখন প্রথম পড়েছিলাম বইটি, তা পুতুলের মতোই পড়া হয়েছিল। কারণ, তখন বাংলা অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। শুধুই পড়া নয়, তাকে মুখস্থ ও অসংখ্য কাটা-ছেঁড়া করে, প্রশ্ন-উত্তর বানিয়ে, পরীক্ষার খাতায় পাতার পর পাতা লিখে এক মুঠো নাম্বার পেয়েছিলাম। আর আজ যখন ডিরেক্টর সুমন মুখোপাধ্যায়ের চোখে গাওদিয়া গ্ৰামের শশী ডাক্তারকে দেখতে, কামনাতাড়িত কুসুমকে চাক্ষুষ করতে সিনেমা হলে যাব বলে ঠিক করলাম, আরো একবার বসলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়ায়, বইয়ের পাতায়। হতাশ হলাম এটা ভেবে, যে, সেই উনিশ বছর বয়সে উপন্যাসটাকে তো আমি পুরোপুরি ধরতেই পারিনি! মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশের বিষেই কি বহু ফারাক ঘটে গেছে আমার মধ্যে?

যাইহোক, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ যে বাংলা সাহিত্যের একটি প্রথম সারির অপূর্ব সুন্দর পরকীয়া প্রেম ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস তা অনস্বীকার্য। মানুষের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা সকল রিপুকে নিয়ে খেলা করেছেন মানিক এই উপন্যাসে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সকল লিখিত – অলিখিত – অসমাপ্ত প্রেম চিরকাল থেকে যাবে বাঙালির কুসুম হৃদয়ে।

 বইয়ের পাশাপাশি ছবি কেমন দাগ কাটলো মনে এবার সেই প্রসঙ্গে আসি। উপন্যাসের নানা মুহূর্তই সিনেমার ফ্রেমে ফিরে ফিরে এসেছে কাব্যিক ব্যঞ্জনায়। চিত্রগ্রাহক সায়ক ভট্টাচার্যর জবাব নেই। প্রথম দৃশ্যেই বজ্রাহত হারু ঘোষের শবদেহ, তালবন, যাদব পণ্ডিতের বাড়ি, সূর্যোদয় দেখার টিলা, গ্রামের খাল সবকিছুই উপন্যাসের পাতা থেকে হুবহু উঠে এসেছে ছবিতে একইরকম ভাবে। শুধু টিলার ওপরের শিয়ালটি সুমনের সংযোজন।  

মূল চরিত্রে শশী ও কুসুমের অভিনয়ে আবীর ও জয়া আহসান অনবদ্য। বিশেষত জয়া কুসুমকে ফুটিয়ে তুলতে অসম্ভব সুন্দর শরীরী ভাষা দিয়ে অভিনয় করেছেন। কুমুদ, মতি প্রমুখ চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভীষণ রকম মানানসই। যদিও সময় বাঁচাতে পুরোপুরি উপন্যাসকে অনুসরণ করে কুসুম ও মতিকে দীর্ঘক্ষণ দেখানো সম্ভব হয়নি। আর যে অভিনেত্রীর কথা আলাদা করে বলতে হয় তিনি সেনদিদির চরিত্রে অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। চারিত্রিক গুণে যামিনী কবিরাজের চেয়ে সেনদিদি বেশি স্ক্রিন টাইম পেয়েছেন দর্শকের সামনে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে। অপরদিকে যাদব ও পাগলদিদি তুলনামূলক ভাবে গল্পের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ফুটিয়ে তুলতে বেশিক্ষণ থেকেছেন আমাদের কাছাকাছি।

এবার একটু বইয়ের পাতায় প্রবেশ করতে মন চায় —

 “শশী জ্বালা বোধ করে। এ কী আশ্চর্য যে কুসুমকে সে বুঝিতে পারে না, মৃদু স্নেহসিঞ্চিত অবজ্ঞায় সাতবছর যার পাগলামিকে সে প্রশ্রয় দিয়াছিল। শশীর একটা দুর্বোধ্য কষ্ট হয়। যা ছিল শুধু জীবনসীমায় বহিঃপ্রাচীর, হঠাৎ তার মধ্যে একটা চোরা দরজা আবিষ্কৃত হইয়াছে, ওপাশে কত বিস্তৃত, কত সম্ভাবনা, কত বিস্ময়। কেন চোখ ছলছল করিল না কুসুমের? একবার বাপের বাড়ি যাওয়ার নামে আছাড় খাইয়া তার কোমর ভাঙিয়াছিল, যদিবা শেষপর্যন্ত গেল, ফিরিয়া আসিল পনেরো দিনের মধ্যে। এখানে এমনভাবে হয়তো এই তাদের শেষ দেখা, এ জীবনে হয়তো আর এত কাছাকাছি তারা আসিবে না; আর আজ একটু কাঁদিল না কুসুম, গাঢ় সজল সুরে একটি আবেগের কথা বলিল না? কুসুমের মুখে ব্যথার আবির্ভাব দেখিতে শশীর দুচোখ আকুল হইয়া ওঠে, অস্ফুট কান্না শুনিবার জন্য সে হইয়া থাকে উৎকর্ণ। কে জানিত কুসুমের দৈনন্দিন কথা ও ব্যবহার মেশানো অসংখ্য সংকেত, অসংখ্য নিবেদন এত প্রিয় ছিল শশীর, এত সে ভালোবাসিত কুসুমের জীবনধারায় মৃদু, এলোমেলো, অফুরন্ত কাতরতা? চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবে, আর আজ এই তালবনে তার এত কাছে বসিয়া খেলার ছলে কুসুম শুধু চাবি বাজাইবে। কী অন্যায় কুসুমের, কী সৃষ্টিছাড়া পাগলামি।

পা দিয়া ছোট একটি আগাছা নাড়িয়া দিতে ঝরঝর করিয়া শিশির ঝরিয়া পড়িল। শশীর মনে হইল কুসুমকে ধরিয়া এমনি ঝাঁকুনি দেয় যাতে তার চোখের আটকানো জলের ফোঁটাগুলি এমনিভাবে ঝরিয়া পড়ে এবং দুচোখ মেলিয়া সে তা দেখিতে পায়। পা দিয়া ছোট একটি আগাছা নাড়িয়া দিতে ঝরঝর করিয়া শিশির ঝরিয়া পড়িল। শশীর মনে হইল কুসুমকে ধরিয়া এমনি ঝাঁকুনি দেয় যাতে তার চোখের আটকানো জলের ফোঁটাগুলি এমনিভাবে ঝরিয়া পড়ে এবং দুচোখ মেলিয়া সে তা দেখিতে পায়।”

মানিক মানুষের মনের গভীর থেকে গভীরতর স্থানে হাত বোলাতে পারতেন। অনুভূত হওয়া চিনচিনে ব্যথায় মলম লাগাতে জানতেন।

“কাকে ডাকছেন ছোটোবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে।…”

নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানিকের সৃষ্ট প্রতিটি চরিত্র আমাদের গভীর ভাবে নাড়া দেয়। আমরা এক আবেশে নিমগ্ন হই। তবে এরপর হয়তো উপন্যাসটি পড়লে কুসুমের চরিত্রে বার বার জয়ার মুখই ভেসে উঠবে। চরিত্রের সঙ্গে কত কাল, কী ভাবে যাপন করলে এমন অভিনয় করা যায়, তা জানতে ইচ্ছে করে। সিনেমার শেষে শশী আর কুসুমের বিচ্ছেদের দৃশ্যও কবিতার মতো নীরব হয়ে ধাক্কা দেয়। মনের ভাব সব সময় শব্দে প্রকাশ করা যায় না। ক্যামেরার কাজেও এই ভাব বার বার কাব্যিক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে সিনেমায়। শশীর হ্যামলেটসুলভ দোলাচল, কুসুমের তীব্র আশ্লেষে বাঁচার আকাঙ্খা, কুমুদের শহুরে এডভেঞ্চারইজম, যাদব পণ্ডিতের মৃত্যু ঘিরে গ্রামীণ কার্নিভাল  – উপন্যাসের প্রতিটা অভিঘাত এই চলচ্চিত্রে অনায়াসে ফুটে উঠেছে। ছবির প্রতিটা ফ্রেম সাংকেতিক সম্ভাবনায় ভরপুর। কুসুমের সব দৃশ্যে হাঁসেদের সরব উপস্থিতি, উন্মুক্ত প্রান্তরে শশী-কুসুমের আদম-ইভ হয়ে উঠা এবং শর্ত মেনেই সাপের অনিবার্য হিলহিলে উপস্থিতি সবই অসাধারণ। শেষ দৃশ্যে শশীর লোন উলফ হয়ে যাওয়ায়, চিত্র পরিচালক যেন পর্দায় কবিতা লিখেছেন। সবমিলিয়ে এই অধম নিবিড় পাঠক ও দর্শকের কাছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ সার্থক হয়ে উঠেছে বলাই যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *