ফিল্ম রিভিউ
স্বাতী চট্টোপাধ্যায় ভৌমিক
পরিচালনা: মিতাক্ষরা কুমার
অভিনয়ে: কুনাল কাপুর, শাবানা আজমি, দৃষ্টি ধামি, দিনো মোরিয়া, আদিত্য সিল, রাহুল দেব, সেহর বাম্বা, ইমাদ শাহ, নাভেদ আসলাম, খালিদ সিদ্দিকী
পর্ব সংখ্যা: ৮
মুক্তির দিন থেকেই বিতর্ক সঙ্গী হয়েছে এই সিরিজের। টুইটারে ট্রেন্ড চালু হয়ে গিয়েছিল হটস্টার আনইন্সটল করার সপক্ষে। কারণ কী? যে মোগল দস্যুরা ভারতকে কলুষিত করেছে, ভারত আক্রমণ করে লুটে নিয়ে গিয়েছে এ দেশের ধনদৌলত তাদের গৌরবান্বিত করার চেষ্টাকে মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সত্যিই কি তা করার চেষ্টা হয়েছে কোথাও? যদি তাই হয় তবে সেই চেষ্টায় কতটা সফল হলেন সিরিজ নির্মাতা নিখিল আডভানি ও তাঁর টিম?
আলোচনা শুরুর আগে বলে নেওয়া প্রয়োজন নির্মাতারা কোথাও দাবি করেননি এই সিরিজ হুবহু ইতিহাসের কাহিনী বলবে। ইংরেজ লেখক দম্পতি অ্যালেক্স রাদারফোর্ড (সম্মিলিত পেন নেম) -এর যুগ্মভাবে লেখা ‘এম্পায়ার অফ দ্য মুঘলস’ অবলম্বনে নির্মিত এই সিরিজে ইতিহাস আশ্রিত কিছু ঘটনাক্রমকে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম সিজনের কাহিনী বাবরকে নিয়ে। কাহিনী শুরু হয় ফারগানা প্রদেশস্থিত বাবরের পিতা উমর শেখ ও তাঁর শাশুড়ি আইসান দৌলত বেগমের আদর্শগত বিরোধ দিয়ে। এর সঙ্গে রাজ পরিবার ও পার্ষদদের অন্তর্দ্বন্দ্বও ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। এরই মধ্যে বড় হতে থাকে কিশোর বাবর ও তার দিদি খানজাদা বেগম। ওদিকে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে সমরকন্দ অধিপতি মোহম্মদ শায়বানি খান ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে ফারগানার দিকে। এর মধ্যে এক দুর্ঘটনায় নিহত হন বাবরের পিতা। সমস্ত প্রদেশের দায়িত্ব এসে পড়ে কিশোর বাবরের ওপর। দিদিমা শাহ বেগম ও সেনাপতি ওয়াজির খানের তত্বাবধানে বাবর শায়বানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু তুখোড় শক্তিশালী যোদ্ধা ও ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞ শায়বানির হাতে পরাজিত হয় বাবর। তার হাত থেকে ফারগানাও চলে যায়। এই জায়গা থেকে বাবরের বড় হয়ে ওঠা ও শায়বানির শর্ত মেনে খানজাদার আত্মসমর্পণ গল্পের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। এরপর ধীরে ধীরে বাবরের চরিত্রগত পরিবর্তন ও একটা সময়ের পর প্রথমে কাবুল ও পরে হিন্দুস্থান অভিযানের সংকল্প নিয়ে কাহিনী এগোতে থাকে।
যে ধুয়ো তুলে সিরিজটিকে বয়কট করার ডাক দেয়া হয়েছিল তা নেহাতই ধর্মীয় কিছু গোষ্ঠীর পরিকল্পিত অ্যাজেন্ডা বলে স্পষ্ট হয়ে গেলেও সিরিজে বাবরকে মহিমান্বিত করার কোনও চেষ্টা চোখেই পড়েনি। বরং তার উল্টোটাই দেখা গেল, যা ইতিহাসের কাহিনীকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানায়। যে পরিবারে শাহ বেগম ও খানজাদার মত শক্তিশালী নারীরা রাজতন্ত্রের অলিন্দে ক্ষমতার ওঠাপড়া নিয়ে সদা সতর্ক সেখানে একটা গোটা উপমহাদেশের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া বাবর মানসিকভাবে এত দুর্বল ও উদাসীন এটা মেনে নেওয়া রীতিমতো কঠিন, এবং অবাস্তবও। জন্মসূত্রে তৈমুর লং ও চেঙ্গিস খানের রক্ত বইছে বাবরের শরীরে। সেই পরিবারের ছেলে যুদ্ধ না করে রোমান্টিসিজম অবলম্বন করে দিন কাটাতে পারে এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস যাকে দস্যু বলে জেনে এসেছে তার মধ্যে কোথাওই যেন সেই আগ্রাসন দেখা গেল না। মনে হলো বাবর কৈশোর থেকে মৃত্যু অবধি যা যা করেছেন সবই প্রায় পরিবারের মহিলা সদস্যদের প্ররোচনায়। প্রবল পরাক্রমী মুঘল পরিবারে যা বেশ বেমানান। এছাড়াও নানাভাবে ইতিহাস বিকৃতি ঘটেছে এই সিরিজে। ইতিহাস অনুযায়ী বাবর সিংহাসনে বসেছিলেন ১২ বছর বয়সে। এখানে তা ১৪ দেখানো হয়েছে। এই দু’বছরের হিসেব কোথাও দেওয়া হয়নি। খানজাদা ও শায়বানির এক সন্তান ছিল বলে জানা যায়। অথচ এখানে যা দেখানো হলো তা খানজাদার তরফে এক নিদারুণ বলিউডি প্রতিশোধের কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়। সে সময়ের উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান বা আফগান নেতারা সকলেই মোটামুটি উগ্র স্বভাবের অত্যাচারী ও নৃশংস ছিলেন। সেখানে শায়বানিকে আলাদা করে নৃশংস দেখিয়ে বাবরকে অত্যধিক ভালোমানুষ দেখানোর যুক্তি ধোপে টেকে না। উপরন্তু পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করার আগেও চারবার বাবর হিন্দুস্থান জয় করার চেষ্টা করেছেন এবং বিফল হয়েছেন। ফলে অত্যন্ত অনিচ্ছা নিয়ে বন্ধু কাসিম ও পুত্র হুমায়ূনের ইচ্ছেতে তাঁর যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার যে ঘটনা দেখা গেল তা কোনও মুঘল শাসকের চেয়ে বরং মহাভারতের অর্জুনকেই বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদীকে পরাজিত করে বাবরের প্রায় অবিশ্বাস্য জয়ের কারণ হিসেবে কামানের ব্যবহার একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মাত্র পনেরো হাজার সৈন্য নিয়ে লোদীর এক লাখি বাহিনীকে পরাস্ত করতে যা সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয়েছিল তা হল বাবরের অনন্য যুদ্ধ নীতি। সিরিজে তার কোনও উল্লেখ নেই। বরং বাবরকে দেখে মনেই হয়নি তিনি যুদ্ধে আগ্রহী। অথচ হিন্দুস্থান অধিকার করার অদম্য জেদ না থাকলে পাঁচবারের চেষ্টায় তিনি লোদীকে পরাজিত করতে আবারও ঝাঁপাতেন না নিশ্চয়ই। এছাড়াও হিন্দুস্তান অধিকার করার পরেও বিজিত সাম্রাজ্য রক্ষায় আরও অনেক যুদ্ধে তাঁকে জড়িয়ে পড়তে হয়। এই সমস্ত যুদ্ধের কোনও উল্লেখ সিরিজে পাওয়া যায় না। বরং বাবরের অন্দর মহলে ঘটে চলা রাজনীতিই এই সিরিজে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই ইতিহাস আশ্রিত কাহিনী হিসেবে গোটা সিরিজটাই বেশ অবাস্তব লাগে। অবাস্তবতার আরও কারণ চরিত্রদের বয়স না বাড়া। কাবুল জয়ের পরে গল্প ১৮ বছর এগিয়ে যাবার পরে যেখানে হুমায়ুন ও কামরান বড় হয়ে যায় সেখানেও বাবর, মাহম বেগম কিংবা কাসেমের বয়সের বিশেষ কোনও তফাৎ দেখা যায়নি।
এছাড়াও সমস্ত সিরিজে রিসার্চের অভাব খুব চোখে লাগে প্রথম থেকেই। প্রথমত বাবর চরিত্রে কুনাল কাপুরকে নেওয়া। কুনাল সুদর্শন অভিনেতা, এখানে তাঁকে দেখতেও অসম্ভব ভালো লেগেছে। কিন্তু সমস্যা বাবরের চরিত্রে তাঁর কাস্টিং নিয়ে। যেখানে ইতিহাসকে অবলম্বন করে সিরিজ তৈরি হচ্ছে সেখানে ঐতিহাসিক চরিত্রদের চেহারা নিয়ে রিসার্চ থাকবে না কেন? বাবরের চেহারায় মঙ্গোলিয়ান ছাপ সুস্পষ্ট ছিল। গাল ছিল সামান্য ফোলা। ইতিহাস বইয়ের পাতায় সেই চেহারা আমরা সকলেই দেখেছি। কুণালের চেহারার সঙ্গে যার কোনও মিলই পাওয়া যায় না। এমনকি তার শরীরী ভাষাতেও সেই দুর্ধর্ষ জাতির পরাক্রমের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। অন্য দিকে কাসিম যতই বাবরের বন্ধুস্থানীয় হোক সে একজন প্রজা। বাবরের সঙ্গে তার ব্যবহার, তাঁকে নাম ধরে ডাকা প্রত্যেকবার বেশ চোখে লাগে। সে যুগে যেখানে বাদশাহর স্ত্রী বা মা-ও তাঁর সঙ্গে সম্ভ্রম রেখে কথা বলতেন সেখানে কোনও অনুগত প্রজার এই ব্যবহার অকল্পনীয়! এরকম আরও অনেক কিছু আছে সমস্ত সিরিজ জুড়ে যা বারংবার বিরক্তি উৎপাদন করেছে।
এবার আসি সিরিজের ভালো দিকগুলি প্রসঙ্গে। ভারতীয় সিরিজের নিরিখে রীতিমতো তাক লাগানো সেট ও কস্টিউম ব্যবহার করে বিশাল মাপের উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সিরিজটিকে যা সাম্প্রতিক কিছু বিদেশি সিরিজের সঙ্গে তুলনীয়। সেটের সঙ্গে মানানসই করে অভিনেতাদের পোশাকের রঙের ব্যবহার চোখকে আরাম দেয়। সিনেমাটোগ্রাফি বেশ ভালো। নরম আলো ও নীলচে ধূসর রঙের ব্যবহার নিঃসন্দেহে গোটা সিরিজটিকে দর্শনীয় করে তুলেছে।
অভিনয়ের প্রসঙ্গে প্রথমেই যার কথা বলতে হয় সিরিজ আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে নিয়ে সর্বত্র অজস্র আলোচনা হয়েছে। তিনি দিনো মোরিয়া। শায়বানির চরিত্রে অনবদ্য লেগেছে দিনোকে। এতদিনের ফিল্ম কেরিয়ারে সম্ভবত প্রথমবার এভাবে চমকে দিলেন তিনি। শায়বানির চরিত্রের নৃশংসতা এবং অসহায়তাকে একইসঙ্গে অসম্ভব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করেছেন দিনো। দ্বিতীয়জন হলেন দৃষ্টি। মূলত সিরিয়াল অভিনেতা হলেও তাঁর ধারালো ব্যক্তিত্ব ও মেধার ছাপ যেভাবে খানজাদার চরিত্রে তিনি রেখেছেন আগামীদিনে আরও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তাঁকে ভাবা হবে এমনটা আশা করাই যায়। শাহ বেগমের চরিত্রে শাবানা ভালো, তবে তাঁর থেকে আরও বেশি আশা ছিল। ওয়াজির খানের চরিত্রে অনেকদিন পর রাহুল দেবকে দেখে ভালো লাগলো। দিব্যি ভালো মানিয়ে গিয়েছেন নিজের অভিনয়ের জোরে। কাসিমের চরিত্রে ইমাদ শাহকে একেবারেই মানায়নি। শহুরে যুবকের চরিত্রে ভালোই লাগে ইমাদকে। কিন্তু ঐতিহাসিক চরিত্রের ভার বহন করতে গিয়ে হতাশ করেছেন তিনি। তাঁর অতিরিক্ত ‘ক্যাজুয়াল’ শরীরী ভাষা কাসেম চরিত্রটিকে ডুবিয়েছে। হুমায়ূনের চরিত্রে আদিত্য সিল চেহারার দিক থেকে মানিয়ে গেলেও অভিনয়ে তেমন কোনও ছাপ এই সিজনে রাখতে পারেননি।
মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন দিয়ে যে সিরিজের শুরু হলো আশা করা যায় একের পর এক শাহজাদা সুলতানদের কাহিনী নিয়ে পরবর্তী সিজনও দেখা যাবে আগামী দিনে। তবে যেহেতু ভারতের ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের ভূমিকা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তাই পরবর্তী সিজনগুলিতে আর একটু রিসার্চ করে এগোলে ইতিহাসের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ‘দ্য এম্পায়ার’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন