binodan-tenet-kichu-chinta

TENET: কিছু চিন্তা – পরিচালক: ক্রিস্টোফার নোলান
ফিল্ম রিভিউ
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়


১। “Man stands face to face with the irrational. He feels within him his longing for happiness and for reason. The absurd is born of this confrontation between the human need and the unreasonable silence of the world.”
―Albert Camus, The Myth of Sisyphus and Other Essays

২। “There is scarcely any passion without struggle.”
― Albert Camus, The Myth of Sisyphus and Other Essays

বন্ধুরা, বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে সিনেমাটি সম্পর্কে আলোচনা শুনছি মূলত আমার পদার্থবিজ্ঞানী, ফিল্ম বাফ, তাত্ত্বিক বন্ধুদের কাছ থেকে। এ চত্বরেও বেশ কয়েকটি এদেশীয় তথা ওদেশীয় আলোচনা চোখে পড়ল। তার থেকেই এলোমেলো কিছু কথা মনে এলো। সেগুলোই যথাসম্ভব গুছিয়ে বলছি।

একটা অদ্ভুত ব্যাপার আগেই দেখেছিলাম, নোলানের অন্য সিনেমাগুলির থেকে এ সিনেমাটির উচ্ছ্বাস যেন একটু বেশীই ছিল এবং রিলিজের পর কোথাও গিয়ে দর্শকদের আশাভঙ্গের একটা ব্যথা যেন অধিকাংশ রিভিউয়ের মধ্যেই প্রবলতর রূপে প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কিছু ব্যতিক্রমও অবশ্যই আছে। আমি জানিনা, যারা ‘নোলানিয়ান’ তারা আসলে কি আশা করছিলেন? যারা ‘মেমেণ্টো’র মত নিও-নয়ার সাইকোলজিক্যাল গল্প থেকে ‘প্রেস্টিজ’, মুহুর্ত-মুখর ‘ইনসেপশন’, ‘ইন্টারস্টেলার’, ‘ডানকার্ক’, ‘ট্রান্সেণ্ডেন্স’ হয়ে ‘টেনেট’-এ পৌঁছেছেন তারা সকলেই এই দলে পড়বেন না বলেই আমার আশা। প্রথমেই বলি যারা এখনো ‘টেনেট’ দেখেননি, তারা দয়া করে এ লেখার শেষাবধি যাবেন না, কারণ এ আলোচনা সম্পূর্ণ স্পয়লারবিহীন করা যাবে না(হা হতোস্মি! আমার ধারণা এই পর্যন্তও আপনি ধৈর্য্য রেখে পড়েছেন সুধী পাঠক!)।

যাই হোক, আসা যাক আসল কথায়। ‘টেনেট’ সোজা ভাষায় এক বিশেষ ধরণের টাইম-ট্রাভেলের গল্প, যে ধরণটি আগে খুব একটা ব্যবহৃত হয়নি এভাবে, আমার জানা মতে। তুলনায় একমাত্র মনে পড়ছে, Shane Carruth এর ‘প্রাইমার’। সেখানেও ‘chance and coincidence’ এর একটি ক্যালকুলেটেড ভূমিকা ছিল। আর তার সাথে ‘ডার্ক’ সিরিজটি তো রয়েইছে। এখানে গল্প এগিয়েছে টেক্সট-বুক এসপিওনাজ থ্রিলারের ভঙ্গিতেই। আমাদের গল্পের যে প্রোটাগনিস্ট, তাকে আমরা প্রোটাগনিস্টই বলব, কারণ সে নামহীণ। এই ব্যক্তি তাদের পৃথিবীকে বাঁচাবার এক বিশেষ মিশন নিয়ে এডভেঞ্চার শুরু করে। যেখানে তাকে উদ্ধার করতে হবে এক বিশেষ অস্ত্র বা বলা ভালো ডিভাইসের কথা, যেটি Reverse Entropy বা inverted entropy তত্ত্বের মাধ্যমে অতীতকে মুছে দিতে সক্ষম।

কয়েকটা বিষয় জেনে নিতে হবে নোলানের সিনেমা দেখার আগে, বা পরেও। কোনও প্রস্তুতি ছাড়া সিনেমাটি বোঝা সম্ভব হবে না। আসুন আগে জেনে নিই সেগুলো। ভয় নেই পাঠক, আপনি যেই হোন, পদার্থবিদ্যা আমার থেকে ভালোই জানবেন, তাই নিজের অজ্ঞানতা খুব বেশি কথা বলে প্রকাশ করব না। অল্প কথায় প্রয়োজনীয় সূত্রগুলি বলব শুধু। আর এক্ষেত্রে কিছু কথা ইংরেজিতে বলতে বাধ্য হচ্ছি, তার জন্য অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থনা।

১. Entropy
Entropy is basically a measure of the molecular disorder, more importantly it actually signifies the randomness of a system. The second law of thermodynamics dictates that the entropy increases with time that is when its movement is forward. অর্থাৎ কবির ভাষায়, “Things fall apart; the centre cannot hold;” (“The Second Coming” –Yeats) অদ্ভুতভাবে কাব্যিক এই তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে জাগতিক উত্তরাধুনিক খন্ডতার আবহকেই তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে। আসব সে প্রসঙ্গে। আপাতত দ্বিতীয় কথা।

২. Nuclear fission
Nuclear fission is a process in which the nucleus of an atom is split into several nuclei. Why is this important? Because the split basically (the fission) produces the energy for the nuclear power. ভাঙনের এই মহতী শক্তির সাথে আমাদের নতুন করে পরিচয় করায় টেনেট। একটু কষ্টকল্পিত হলেও তুলনায় আসবে সূর্য। সূর্যের ভিতরে nuclear fusion reactions এর মধ্যে দিয়ে হাইড্রোজেন নিয়ত হিলিয়ামে পরিণত হয়ে অপরিমিত শক্তির আধার করে রেখেছে তাকে, এ উদাহরণের কারণ শুধুমাত্র এই শক্তির অমিত বিক্রমের ব্যাখ্যা, আর কিছু নয়।
(বিঃ দ্রঃ fission and fusion are two completely different things. The first takes place mainly in radioactive particles whereas the second is an occurrence in nature, hence the example of sun.)

৩. A note to Oppenheimer, Feynman and Wheeler

“I remembered the line from the Hindu scripture, the Bhagavad-Gita. Vishnu is trying to persuade the Prince that he should do his duty and to impress him takes on his multi-armed form and says, ‘Now, I am become Death, the destroyer of worlds.’” (-Oppenheimer)
-L. Giovannitti, The Decision to Drop the Bomb (Coward-McCann, 1965)

Theoretical physicist and head of the Los Alamos Laboratory, Julius Robert Oppenheimer plays a significant role in the working execution of atomic bomb, who actually arguably historically regretted the fact, as was the case of the sole begetter of the primary formula, Albert Einstein who wrote to Roosevelt urging for a ‘pacifier’!

Feynman suggested the idea that the electrons, coming back and forth, create the world around us. Hence, we have the idea of negative electron (positron(e+)). And from here we go to the concept of arrow of time and the breakthrough to it that is something which is moving only forward can also have an anti-particle with an equal and opposite charge. অর্থাৎ electron আসলে পিছনে হাঁটা Positron. ফিরে আসব।

৪. Janus Cosmological Model (JCM)

A curious one, which considers the inception of the universe to be dual-faced! One constitutes of matter while the other is of anti-matter, emanating from the singular event of the Big Bang. Therefore two opposite arrows of time where t=0. If we consider this cosmological prototype as the base of ‘Tenet’ then we will understand how the backward journey becomes relevant as it existed from the beginning of time.
গুগল থেকে নেওয়া তলার ছবিটি আশা করি বুঝতে সাহায্য করবে। সৌজন্য: ‘Predict’ site.

৫. The grandfather paradox
A ‘Post-Doctor Who’ watcher must be familiar with this one which is nothing but a paradox in time travel. If one kills one’s grandfather going back in past then, will he remain in the future? Or not? It seems that the “new Oppenheimer” that is the lady scientist from future in ‘Tenet’ who actually invented the reverse entropy thought about it negatively. She understood that it will bring a total annihilation causing the ultimate Armageddon for themselves, the posterity. So, she committed suicide. গল্পে ফিরে বাকি কথা।
এই ছিল আপাতভাবে তাত্ত্বিক কথা। আমি নিজে এসব কিছুর বাইরে থেকে একটা অন্য আলোচনায় আসতে চাইছি, কিন্তু সেটার জন্যও এটুকুর প্রয়োজন ছিল।

মূল গল্পের ভাবগত আধার

আগেই বলেছি আমাদের প্রোটাগনিস্ট এই বর্তমান পৃথিবীকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু এই বর্তমান আসলে এক অতীত, কারণ, যে ডিভাইসটি তাকে খুঁজে বার করতে হবে তা এখনো আবিষ্কারই হয়নি। তা হবে ভবিষ্যতে, যে ভবিষ্যত চাইছে তার অতীতকে ধ্বংস করতে। কারণ? কারণ এই অতীত প্রকৃ্তিকে ধ্বংস করে তার ভবিষ্যতের বাঁচার পথ নিজেই রুদ্ধ করে দিচ্ছে। একটা কথা বলি, এ ন্যারেটিভ নতুন, এ কথা নোলানের অতি বড় সমর্থকও বলবেন না। তাহলে নতুন কী? বোতলটা। মদ বা সেই পুরোন চাল, যা বয়স হলে গুরুত্বে বাড়ে। সিনেমাটি রিলিজের পর থেকেই দেখছি সবাই বিজ্ঞান অংশটা নিয়েই কেবল মাথা ঘামিয়ে চলেছেন। এটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার। সিনেমা শেষত একটি কলা। এক বিশেষ শিল্প যার শৈল্পিক, দার্শনিক তথা ভাবগত তাৎপর্য্যই তার যাবতীয় বুৎপত্তি ও গ্রহণযোগ্যতার কৈশিক আধার।

প্রিয় পাঠক, আপনি যদি ছবিটি দেখে থাকেন তাহলে বলব সেই দৃশ্যটির কথা মনে করুন, যেখানে প্রথম আমাদের প্রোটাগনিস্ট সেই reverse bullet টিকে ধরতে চেষ্টা করছে। বিজ্ঞানী তাকে তখনই বলেছিলেন “Don’t try to understand it. Feel it.” এটিই সারকথা। বলা যায় গল্পের থিম। প্রোটাগনিস্ট বুঝেছিল, এই অতীত বা ভবিষ্যত আসলে instinctual. যার আদিঅন্ত আমাদের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব নয়। এ কেবল আভাসে ধরা দেয়। যা কোন চির-অমীমাংসিত রহস্যজালে নিজেকে গ্রন্থিত করে রেখেছে আমাদেরই মনের গোপন কন্দরে। বাইরে না। কিন্তু আমাদের সব সন্ধান হয় বহির্বৃত্তে। আয়রনি হলো বাস্তবেও তাই ঘটল। গোটা দর্শকমহল সিনেমাটির কেবলমাত্র বিজ্ঞান অংশটিকে নিয়েই মেতে গেল। সেটিই হয়ে উঠল মুখ্য। ‘ফিল’ করার বদলে ‘আণ্ডারস্ট্যাণ্ড’ করার দিকেই আমরা ঝুঁকে পড়লাম। আর তার জন্যই বেখেয়াল করে গেলাম মহান শিল্পকীর্তির কিছু সূক্ষ্ম উদাহরণ, ছোট বাক্য, ইঙ্গিত, প্রকরণ। উপরে ঐ ‘আণ্ডারস্ট্যাণ্ড’ অংশটুকু দিলাম। এবার আসব আসল কথা, মানে ‘ফিল’ অংশটুকুতে।

এস্পিওনাজ থিওরি অনুসরণ করেই আমাদের প্রোটাগনিস্ট সন্ধান পায় সেই রাশিয়ান ভিলেনের(?) যার নাম আন্দ্রেই সতোর। আন্দ্রেইকে ধরতে সে সাহায্য নেয় তার দ্বারা অত্যাচারিতা তার স্ত্রীর। তার জন্য আগে তাকে মুম্বাইতে আসতে হয়, এবং এক ব্রিটিশ আধিকারিকের সঙ্গে মিলিত হতে হয়। পোস্ট-কলোনিয়ালিসমের টুকরো আভাস ভেসে আসে ছোট ছোট ডায়লগের মধ্য দিয়ে। যখন আমাদের কালো-মানুষ প্রোটাগনিস্ট ব্রিটিশ আধিকারিককে বলে, যে মোনোপলিটি একা তাঁদেরই কুক্ষিগত বস্তু নয়। চমৎকার রিপার্টি দেন বৃদ্ধ জ্ঞানী, বলেন এটি মোনোপলির থেকে বেশি কিছু, “controlling interest”. কলোনিয়ালিসমের শেষ কথা। কয়েকটি শব্দ, কিন্তু আমোঘ তার ভার। ঠিক যেমন আন্দ্রেই এর স্ত্রী ক্যাটের কথাগুলি। যে তার স্বামীকে ভালোবাসতে চেয়েও পারে না। She grew out of love. যেন আন্দ্রেই ম্যাটার আর ক্যাট অ্যাণ্টি-ম্যাটার। দুই বিপরীত প্রান্তবিন্দু। বিজ্ঞানের চিন্তক দিকটির চরিত্রায়ণ ঘটে গোটা ছবিজুড়েই।

আরো একটি উদাহরণ, অস্তিত্বের লড়াই। ভালবাসাকে তুচ্ছ করে প্রভুত্বের নিয়ন্তা হতে চাওয়া আন্দ্রেই-এর সঙ্গে ক্যাট লড়াই করতে পারে না। ভিক্ষায় পর্যবর্সিত হয় তার শ্রমলাঞ্ছিত বেঁচে থাকা, কারণ সে ভুলক্রমে একটি জাল ছবি কিনিয়ে দিয়েছিল আন্দ্রেইকে। ভুলক্রমে। কিন্তু আন্দ্রেই-এর মত ক্ষমতাপ্রধান মানুষরা failure বোঝে না, ব্যর্থতা যে কেবল মানবতার সঙ্গী! আন্দ্রেই বোঝে betrayal। সে মনে করে ক্যাট তাকে ঠকিয়েছে, ইচ্ছা করে। শক্তির সঙ্গে ব্যর্থতার আর মাধুর্য্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার এ হেন foil, তার এত কাব্যিক ফিল্মায়ন বড় বেশি দেখা যায় না। কেবল যুক্তি, কেবল হিসেব করা আন্দ্রেই এখানেই ভুলটা করে। অথচ ব্যক্তি হিসাবে তার যাপন অভিজ্ঞতা এবং তার প্রকাশ ম্যাকবেথীয় বললেও হয়ত অত্যুক্তি হবে না।
“one man’s probability of death is another man’s possibility of life…”,
“anger scars over into despair…” যে আন্দ্রেই বলতে পারে, সেই আন্দ্রেই-ই সোভিয়েত রাশিয়ার এক বিতর্কিত পারমাণবিক গোপন আগার থেকে উঠে এসে বর্তমান অলিগার্কের আসন নেয়। সেই আন্দ্রেই মানুষকে মাপে প্রয়োজনে, সময়কে মাপে টাকায়, সে জানে সে বেসাতি করেছে শয়তানের সঙ্গে, তার ঈশ্বর জরাথুষ্ট্রের সাথেই অকালীন হয়ে গেছেন। এই নব্য Faustus-জন্ম তার একান্ত নিজস্ব বাস্তব। তার একলা শয়তানের দেশ। এ থেকে তার মুক্তি নেই, আর তাই যা সে নিজে পাবে না, সেই আলো, মুক্তি তথা জীবন সে অন্যকেও পেতে দেবে না। তার বিপ্রতীপে দাঁড়ানো প্রোটাগনিস্টকে তাই সে হেলায় তার দর্শনের কথা শোনায়, নিজের ধ্বংসকে স্বীকারও করে। তাই শুধু বিজ্ঞানে বা প্রযুক্তিতে নয়, ম্যাটার, অ্যান্টি-ম্যাটারের আসল প্রদর্শন চলে চরিত্রায়ণে। এ যেন এক ঈর্ষা, ক্ষোভজাত শক্তিশালী না-পাওয়ার ধ্রুপদী প্রতিশোধের আখ্যান।

এরপরের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো Palindrome। Tenet শব্দটি লক্ষ্য করলে দেখবেন, সামনে ও পিছন থেকে এর বানান ও উচ্চারণ এক। এটিই প্যালিনড্রোম। অর্থ? অতীত ও ভবিষ্যতের মেলবন্ধন। দুই দিকই একটি বিন্দুতে মিলিত হয় শেষত। তবে ছবিতে এর আরেকটি তাৎপর্য্য আছে। সেটি বৃত্তাকার। প্রোটাগনিস্ট বুঝতে পারে সে নিজেই নিজেকে নিয়োগ করেছে এই কাজে। যা যা গোটা সময় ধরে ঘটল, তার পৃথিবীকে বাঁচাতে সমর্থ হওয়া পর্যন্ত, তা আগেই ঘটে গেছে। ভবিষ্যত আসলে অতীত, অতীত আসলে বর্তমান এবং বর্তমান অচিরেই পালটে যাবে ভবিষ্যতে। এক অসম্ভব অন্ধকার, বিমর্ষ, সিসিফাসীয় অস্তিত্বের বাস্তব উন্মোচিত হয় তার কাছে, যখন তাকে তার বন্ধু নীল বলে আবার দেখা হবে, ‘শুরুতে’। অর্থাৎ গল্প শেষ হয় না। একটি ল্যুপের একটামাত্র অংশ আমরা এতক্ষণ দেখেছি, সেটি আবার আবর্তিত হবে কালের নিয়মে। আবার ভবিষ্যত চাইবে অতীতকে মারতে। অতীতকে নিজেকে বাঁচাতে হবে ভবিষ্যতের স্বার্থে। আবার ভালোবাসা লাঞ্ছিত হবে, আবার যুদ্ধের প্রয়োজন হবে, আবার রক্তপাত ও বীরত্বের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রোটাগনিস্টকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে নিজের দায়ভার। তাও শুধুমাত্র পরবর্তী ল্যুপটিতে যাবার জন্য।

আমার বক্তব্য আরো অনেক দীর্ঘায়িত করতে পারি আমি। ফিজিক্সের অনেক তত্ত্ব বাদ দিয়ে গেছি, বাদ দিয়ে গেছি dead man’s switch, temporal pincer, hypocentre এর মত জটিল ও অনিবার্য বিষয়গুলি। কিন্তু সে আমার লক্ষ্য নয়। ওসবের জন্য প্রকৃত জ্ঞানী মানুষেরা রয়েছেন। আমি শুধু তথ্যের তত্ত্বটুকু ধরতে চাইছি।

লক্ষ্যণীয়, নোলান কিন্তু বারবারই ফিরে যাচ্ছেন সেই প্রাচীন শিকড়ে। মানুষ আদতে একটি গল্প চায়। যুদ্ধের গল্প, প্রেমের গল্প, আশঙ্কার গল্প, উত্তরণের গল্প। যে গল্পে শিভ্যালরি থাকবে, আদর্শ থাকবে, বাঁচার তাগিদ ছাপিয়ে যাবে না বাঁচিয়ে রাখার দায়কে। পাঠক, আমরা ভারতবর্ষীয়। আমাদের আত্মায় ‘শূন্যতত্ত্ব’ প্রগাঢ় আনন্দে লিখে রেখেছে তার আদিসনদ। আমরা যখন কোন শিল্পকে দেখব, তখন কী তার গভীরতর অধ্যয়নের কথা, তার বিমূর্ত মগ্নবাস্তবের কথা একবারও ভাবব না? এটা চূড়ান্ত আয়রনি, যে গল্পের যিনি প্রকৃতার্থে নায়ক বা হিরো, তাকে সারাক্ষণই প্রোটাগনিস্ট বা মূল চরিত্র বলা হয়েছে। কারণ নোলান জানেন আমরা হিরো বা নায়কোচিত অতীতকে আগেই হত্যা করেছি। একটি উত্তরাধুনিক যুগে, অ্যারিস্টটলীয় নায়কের কোন অস্তিত্বই থাকতে পারে না(যেমনটা কিনা তাত্ত্বিকটায় এতদিন দেখে এসেছি!), যেখানে লেখক এবং ঈশ্বর যুগ্মমৃত (“Death of the Author”, “God is Dead!”)।

পাঠক, মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের সেই আর্বান হরর ট্রোপ? অশনি সংকেতের সেই প্রজাপতি? বারবার করে যা ফিরে আসে, যাকে পোশাকী ভাষায় বলে আন্ডারলাইনিং? বারবার করে নোলান আমাদের মনে করাতে চেয়েছেন সেই হিরোর কথাই, এই প্রোটাগনিস্ট শব্দটার মধ্য দিয়ে। যার সবচেয়ে বড় সার্থকতা বৃহত্তর সত্তার সঙ্গে যোগের সন্ধানে। জন অসবোর্ন আমাদের বলেছেন “no good brave cause is left…”, কিন্তু পাঠক, তাই কি আমরা চুপ করে থাকব? আমাদের শিল্পে কি ধরা পড়ছে না এক অন্তিম, দেওয়ালে-পিঠ-ঠেকা লড়াইয়ের আকুল আদর? এ অস্তিত্ব সিসিফাসীয় নয় কেবল, কেবল অর্থহীনতার নিষ্প্রাণ পাহাড়ে নুড়ি ঠেলা নয়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে সার্থকতার খোঁজ। সব গান, সব ছবি, সব লেখা, সব আঁকাই আসলে এক উত্তরণ। বিজ্ঞানের ছলনায় ভুলিয়ে নোলান আসলে সেই কাব্য বিভঙ্গটুকুই তুলে ধরতে চেয়েছেন তার ন্যারেটিভে। তার বিজ্ঞান আসলে কবিতার ছদ্মবেশ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মাঝে মাঝেই ডায়লগ ডোবানো Ludwig Göransson এর অসাধারণ সাউণ্ডট্র্যাক। দেখবেন সব কথার শেষটুকু আপনি শুনতে পাচ্ছেন না সবসময়, ওটুকু আপনার অনুধাবনের জন্য রেখে দিচ্ছেন পরিচালক।

তাই তো আমরা দেখি যে একই ল্যুপে থেকেও বারবার করে ওরা বার হতে চাইছে, কী অন্যরকম করলে সবকিছু আবার সুন্দর হয়ে উঠবে? আগের মত হয়ে উঠবে? হত্যা, ঘৃণা ও মৃত্যুর এই চক্রবৎ যাত্রার কি আদৌ কোন পরিবর্তন সম্ভব? যে দ্বৈত বিশ্বের ছবি তৈরী করা হলো জানুস বিশ্ব মডেলের মাধ্যমে তার মধ্যে দিয়েই কী অদ্বৈতে যাবার এক রাস্তার কথা কোথাও খুব গভীরে প্রোথিত করে দেননি নোলান? বিজ্ঞানের পুরুষালি কাঠিন্যের আবরণের ভিতরে কোথাও কী সেই নিহিত আতুর অব্যক্ত কমনীয়, সাহিত্যিক আতান্তরের সত্তার খোঁজ করব না আমরা?

“তোমারে জানিনে, তবু মন তোমাতে ধায়…”
“You fight for a cause unknown to you…”
পাঠক, ছবিটির অবোধ্যতার বেড়াজালকে পার হয়ে এগিয়ে যান, গোঁ-ভরেই কিছুটা, না বুঝলেও থামবেন না, দেখুন, দেখতেই থাকুন, পড়তেই থাকুন সৎ-ন্যারেটিভের একটি আজব পাঠ। দেখবেন, ক্রমশ আপনি বুঝতে পারার ধার থেকে আত্তীকরণের ভারটুকু বুকে নিয়ে ডুবছেন। ধীর সঞ্চারে আপনার কাছে খুলছে সৃষ্টির আদত। দেখবেন, সাহিত্য আসলেই ধর্ম, ধর্ম আসলেই বিজ্ঞান, বিজ্ঞান আসলেই আধ্যাত্মিকতা, যে আধ্যাত্মিকতা নিজের শিখাটুকুর জোরে আবার সেই শিল্প নামের কমলহীরের দ্যুতিটুকু মেলে ধরেছে এই ছবির নিমেষ-পরিসরে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *