ম্যারিনা নাসরীন
আচমকাই মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। দেখা হয়ে গেলো বললে ভুল হবে। আমি মাকে দেখলাম, মা আমাকে দেখেনি। শপিং মলের সামনে দামী গাড়িতে ঝাঁ চকচকে মা আমার রাণির মত বসে আছে। হয়ত কারো জন্য অপেক্ষা করছে। পাশে আট/দশ বছরের একটি ছেলে। আমার ঠিক এই বয়সেই মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তার চলে যাবার ঘটনা খুব অন্যরকম ছিল। আমি তখন ক্লা্স থ্রিতে পড়ি। একদিন স্কুল ছুটির পর মা নিতে এলো না। একে একে সবাই চলে গেলে স্কুল ফাঁকা হয়ে গেলো। এদিকে দারোয়ান মামা মা ছাড়া আমাকে বের হতে দিচ্ছে না, ওদিকে মায়ের খোঁজ নেই। খুব অস্থির লাগছিল আবার অবাক হয়েছিলাম ভীষণ। গেট থেকে বেরিয়ে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। আমাকে দেখলে মা সুন্দর একটা হাসি দিয়ে হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। অথচ সেদিন তার হাসি বা আমার হাতের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাত কোনটি ছিল না। আমাদের বাসা খুব দূরে নয়। মায়ের সঙ্গে আমি প্রতিদিন হেঁটেই ঘরে ফিরি। আমার নিশ্চিত মনে হয়েছিল, মা হয়ত বাসায় কোন কাজে আটকা পড়েছে বা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার মা আবার খুব ঘুম কাতুরে, যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ে। দারোয়ান মামা একটু অন্যমনস্ক হতেই আমি টুক করে বেরিয়েই এই দৌড়ে সোজা বাসায়। কিন্তু ঘরের দরোজায় তালা ঝুলছে।
আমাদের বাস ছিল পাঁচিল ঘেরা একতলা একটা বিল্ডিঙে। বারান্দার সামনে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। এই বাসায় আমরা নতুন এসেছি। আশেপাশের কাউকে চিনি না। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছিল। কি করব বুঝতে পারছি না। ভয়ও লাগছে। মা অনেকদিন বলেছে একা একা স্কুল থেকে না বের হতে। ছেলেধরা ধরে নিয়ে যায়। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। কোথায় গিয়েছে মা! বাবার অফিস কোথায় সেটাও জানা নেই। কাঁদতে কাঁদতে কোন এক সময় সিঁড়িতেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাবার ডাকে যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। অনেক রাত হয়ে গেলো কিন্তু মায়ের দেখা নেই। আমি কান্না শুরু করেছি। আমার বাবা এমনিতে গম্ভীর সেদিন আরো বেশি চুপচাপ। বাবা আমাকে খাইয়ে বাইক নিয়ে বের হয়ে গেলো। ফিরলো অনেক রাত করে। বাবার চেহারা কেমন পাণ্ডুর আর রক্তহীন। বারান্দার এককোণে বসে একের পর এক সিগারেট শেষ করতে থাকে। বাবার কাছে গিয়ে আমি মা কই, মা কখন আসবে এসব প্রশ্নে অস্থির করে তুলেছি্লাম। বাবা, শুধু বলেছিল, ‘তোমার মা আর কখনো আসবে না।’ মা আসবে না মানে? আমি যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মাকে ছাড়া ভাবতে গিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় অন্ধকার আমার দিকে হুম হাম করে এগিয়ে আসছিল! মেঝেতে শুয়ে মা মা করে গড়াগড়ি করে দুদিন ধরে কেঁদেছি আমি। বাবা প্রথমে নানা প্রকারে বুঝানোর চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। এরপর বেদমভাবে মেরেছিল। বলেছিল, ‘তোর মা একটা আস্ত খানকি। আরেক ভাতারের সাথে বেরিয়ে গেছে। তার জন্য কেন কাঁদিস? তোর কথা সে একবারও ভেবেছে?’
খানকি বা ভাতার সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না আমার। কিন্তু এটা বুঝে গিয়েছিলাম মা নিজেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেদিনের পর আমি আর কোনদিন কাঁদিনি। এমন কি বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী যখন মেরে আমাকে টয়লেটে বন্ধ করে রাখতো তখনো নয়।
অনেক বছর হলো একই শহরে আমরা থাকি। আমি, বাবা, মা। ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে। তবে কারো সঙ্গে কারো সংযোগ নেই। লোকমুখে শুনেছি বাবা খুব চান আমি তার সঙ্গে থাকি। কিন্তু আমার ইচ্ছে হয় না। মা কী চান সেটি অবশ্য আমি জানি না।
আমার মাকে আঠারো বছর পর আজই প্রথম দেখলাম। কিন্তু একটুও চিনতে ভুল হয়নি। মা আগের চেয়েও সুন্দর, আরো বেশি টানটান। ছেলেটিকে দেখে মনে হলো আমিই মায়ের সঙ্গে লেপ্টে বসে আছি। আমার মা আমাকে চুম্বকের মত নিজের দিকে তীব্রভাবে টানছে। চোখ-মুখ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি প্রবলভাবে সেই টানকে অস্বীকার করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন