micro-story-aamio-maa-hote-cheyechilam

আমিও মা হতে চেয়েছিলাম
অমিতা মজুমদার


মা আজ সবকিছু অন্যরকম লাগছে কেন? অন্যদিন ভোর না হতেই তুমি কত কথা বলতে শুরু করো, আজ কিছু বলছ না? গত আট মাস ধরে তুমি আমাকে একটু একটু করে পৃথিবীর গল্প শুনিয়েছ, তোমার স্বপ্নের কথা বলেছ, বাবার কথা, ঠাকুমা দিদিমা, দাদু আরও সব আত্মীয়ের কথা বলেছ। তোমার মুখে শোনা পৃথিবী ও প্রকৃতির কথা বেশি ভালো লেগেছে। অপেক্ষা করছি কবে এমন সুন্দর পৃথিবীতে আসতে পারব। এমনিতে তোমার ভেতরে আমি খুব ভালোই আছি, কিন্তু বড্ড অন্ধকার! তোমার মুখখানা দেখতে বড্ড ইচ্ছে করে, এত সুন্দর করে কথা বলো, না জানি তুমি দেখতে কত সুন্দর। তুমিও তো আমাকে দেখতে চাও, এইতো পরশুও রাতে শুয়ে শুয়ে বলছিলে কবে সেদিন আসবে যেদিন আমাদের দেখা হবে। তোমার গল্পে কত কথা উঠে এসেছে, বাবার সাথে তোমার প্রথম দেখার কথাও বলেছ তুমি। তোমার মধুময় শৈশবের কথা, যেখানে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে তুমি।

ভোর না হতেই দোয়েল, শালিখ, শ্যামা আর চড়ুই পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙত তোমার, শিশির ভেজা সবুজ দূর্বা ঘাস পেরিয়ে পুকুর ঘাটে যাওয়া। হাতমুখ ধুয়ে ফেরার পথে হাতের ডানে ছোট্ট বাগান আলো করে ফুটে থাকা বেলি, গন্ধরাজ, টগর আর স্থলপদ্ম ডালি ভরে নিয়ে ঘরে ফেরা তোমাকে যেন কল্পনায় দেখি আর নিজেকে তোমার জায়গায় দেখতে পাই। মায়ের চোখ এড়িয়ে বন্ধুদের সাথে এক্কাদোক্কা খেলা দুপুর, চড়কের মেলায় লাল, নীল ফিতে আর রেশমি চুড়ি কেনার গল্প কিছুই বাদ যায়নি।

আমি ছেলে না মেয়ে কখনো বলোনি তুমি, কিন্তু আমার মেয়ে হয়ে জন্মাতেই ইচ্ছে করে। ঠিক তোমার মতো। যদিও তুমি বলেছ পৃথিবীতে মেয়েদের না-কী অনেক সমস্যা। এক আলাদা বিপদের আশংকা ঘিরে থাকে মেয়েদের জন্মের পর থেকেই। যে শরীরকে আশ্রয় করেই মানবগোষ্ঠীর জন্ম, সেই মাতৃশরীরই তার বিপদের কারণ হয়। মেয়েদের বিচার করা হয় তার গুণ দিয়ে নয়, রূপ দিয়ে। তাই মাতৃগর্ভে থাকা সকল সন্তান ছেলে হোক এই প্রত্যাশা করে সবাই। যারা মেয়ে সন্তান জন্মাবে জেনে যায় তাদের কাছে কাম্য হয় একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ের। তুমিই একা একা এসব কথা বলো যখন আমি চুপটি করে শুনি। তারপরেও আমি তোমার মতো মেয়ে হয়েই জন্মাতে চাই। মেয়ে না-হলে আমি যে মা হতে পারব না। আমি তোমার মতো মা হতে চাই।

আজ কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, বুকের মাঝে একটা পাথর চেপে আছে যেন, মনে হয় আমার গলা টিপে ধরেছে কেউ, ভালো করে দম নিতে পারছি না। কি হয়েছে মা! তুমি বলেছিলে তোমার অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পুরণ হবে আমার হাত ধরে, আমরা বেড়াতে যাব সমুদ্রে, পাহাড়ে, শান্তিনিকেতনে। সমুদ্রের বালুকাবেলায় বসে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় দেখব। পাহাড়ের চুড়ায় যদি নাও উঠতে পারি তার পাদদেশে দাঁড়িয়ে অনুভব করব তার স্থৈর্য আর সহনশীলতা। মা তুমি আমাকে কত কী বানিয়ে খাওয়াবে বলেছ।

গত তিনদিন ধরে মনে হচ্ছে আমরা বাড়িতে নেই, অন্য কোথাও আছি, আগের বাড়িটার মতো নয়। আমি যে এখন সব অনুভব করতে পারি মা। এই ঘরটা কেমন ঠান্ডা, আর তুমি যেন নিথর হয়ে শুয়ে আছ। হাঁটাচলা করছ না। আমিও বাতাস পাই না আগের মতো। তবে কী মা তুমি যে বলেছিলে পৃথিবীতে একটা অসুখ এসেছে সেটায় তুমিও আক্রান্ত হলে? কিন্তু মা আমার যে এখনো তোমাকে দেখা হলো না, তোমার চোখে দেখা সুন্দর পৃথিবীটাকে নিজের চোখে দেখা হলো না। বাবাকে দেখব, বাবার হাত ধরে স্কুলে যাব, বাবার কাঁধে চড়ব কত কী করব আমরা সবাই মিলে। মা কী হলো মা আমার এমন লাগছে কেন! মনে হচ্ছে একটা লোহার সাঁড়াশি দিয়ে কেউ আমার গলা চেপে ধরেছে… মা মা মা তুমি শুনতে পাচ্ছ মা…মাগো

(যে সমস্ত অন্তঃসত্ত্বা মা তার অনাগত সন্তান সহ কোভিড আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তাদের স্মরণে)

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *