micro-story-aatmaja

আত্মজা
সহেলী রায়


ভাতটা আরেকটু ফুটলেই নামাবে কুসুমিতা। এই অবস্থায় রান্নাঘর ছাড়ার উপায় নেই একেবারেই। ডাইনিং থেকে অনবরত উচ্চগ্রামে কথাবার্তা ভেসে আসছে। ভাতে, ঘোড়ার ক্ষুরের টগবগ শব্দে সেই কথোপকথনের কখনো মাথা, কখনো লেজটুকু কানে আসলেও কুসুমিতার মরমে পশছে না। অস্থির লাগে তার। ধৈর্য হারিয়ে সিমে থাকা গ্যাসটা জোরে বাড়িয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বন্ধ করে দেয়। হাঁড়ি উপুড় দিয়ে তড়িঘড়ি ডাইনিং-এ ছোটে কুসুমিতা। এ কী ব্যতিক্রমী দৃশ্য? বাপসোহাগী মেয়ের চোখে জল? সুতীর্থর মুখটাও বজ্রাঘাতে আহত পাখির মতো কুঁকড়ে আছে।

‘কী হল বাবলি? কাঁদছিস কেন?’

খান খান করে কাচ ভেঙে পড়ার মতো কুসুমিতা, সুতীর্থর একমাত্র কন্যা বাবলি বেজে উঠল।

‘বাবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমায় যাচ্ছেতাই অপমান করেছে, আমি সবার কাছে অপদস্থ হচ্ছি, কথা শুনছি।’

কুসুমিতা ফ্যালফ্যাল করে তাকায় সুতীর্থর দিকে। সুতীর্থ? বাবলির বাবা? সত্যি এমন করেছে? প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুতীর্থ দত্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ প্রকট, এটা সত্যি। বর্তমানে ফ্যানবেস ধরে রাখার জন্য খুব প্রয়োজনীয় এ কৌশল, সুতীর্থর ষাট পেরলেও, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই পছন্দ করে।

‘আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটা পোস্টকে ঘিরে নিজের কিছু মন্তব্য রেখেছি মাত্র, প্রতিবাদ করেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যেমন করে থাকি।’

‘কাম অন বাবা! ওটা আমি। কেউ ভিডিও করে ছেড়ে দিয়েছে ,আমি অলরেডি ভীষণ ডিস্টার্বড। তোমার জন্য আমার বন্ধুরা আমায় জঘন্যভাবে আক্রমণ করছে।’

সারাদিন সংসারের খুঁটিনাটির যত্ন নিতে নিতে এমন একটা ঘটনা থেকে কুসুমিতা বঞ্চিত হয়ে গেল? সে ভাবতেই পারছে না।

‘কী পোস্ট? কী ভিডিও?’

‘অশিক্ষিত আগামী প্রজন্মের ছবি। যখনই এমন অন্যায় দেখব, বারবার ছি: জানাব। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করি না, কাজেই আমার বন্ধুবর্গ মোটেই আগ্রহী নয়, ভিডিওর ব্যক্তি ও আমার সম্পর্ক নিয়ে।’

‘বাচ্চাদের মতো কথা বলো না বাবা। তুমি একজন রেপুটেড রাইটার, আমার লিস্ট জানে তুমি আমার বাবা। আর এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এটা জানা অসম্ভব নয়, তুমি কি অন্ধ? বাকিরা যা বলছে বলুক কিন্তু তুমিও?’

বাবলি ছোট্টবেলার মতো ফোঁপাচ্ছে।

সুতীর্থর বুকটা মুচড়ে উঠলেও নিরুপায় সে। কুসুমিতা হতবাক। ঠিক কার পক্ষ নিলে মেঘ সরে রোদ উঠবে বুঝতে পারে না।

স্টাডি থেকে বেশ রাত করেই ঘরে এল সুতীর্থ। কুসুমিতা জেগে তখনও। এতক্ষণ বাবলির কাছেই ছিল সে। একটা বিষয়ে একমত কুসুমিতা, সুতীর্থ আলাদা করে বাবলির সঙ্গে কথা বলতে পারত, এভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপদস্থ না করে।

‘তুমি যখন দেখলে ভিডিওটা, আমায় একবার বলতে পারতে।’

সুতীর্থ নীরবতা ভাঙল।

‘তুমি আমায় আটকাতে। আমি দুর্বল হ’তাম। ভাবছ তো? প্রচারের আলোয় থাকার জন্য আমি!, বিশ্বাস করো, দেখা মাত্র বাবলির গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করেছিল। রিক্সাচালকের সঙ্গে তুইতোকারি করে বচসা? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? আমি তো বাবলির গায়ে কখনো হাত তুলিনি। কোথায় ভুল করলাম আমরা কুসুমিতা? জানি, আমার এই পোস্টের আঘাত একটা থাপ্পড়ের চেয়েও বেশি ওর কাছে, আর আমার কাছেও। পোস্টের মন্তব্যে আমারও ভালোমন্দ জুটছে যা আমার জন্য মোটেই লাভজনক নয়, তবু একজন সমাজসচেতন মানুষ, না না বাবলির বাবা হয়ে আমি চাই ও মানুষ হোক কুসুমিতা। জগৎ উদ্ধারের আগে ঘর আলো হোক।’

কুসুমিতার এতক্ষণ সাহস হয়নি ভিডিওটি দেখার। ফোন অন করে নিজের প্রোফাইল খুলতেই ভেসে উঠল বাবলির মিনিট পাঁচেক আগের পোস্ট। ও ক্ষমা চেয়েছে সেই রিক্সাচালকের কাছে। ক্যাপশন,

‘থ্যাংক ইউ বাবা।’

‘তোমার মেয়ে অন্যায় করলে ক্ষমা চাওয়ার সৎসাহসও রাখে গো, ও আমাদের মেয়ে।’

জানলা দিয়ে প্রথম ভোরের আলোয় দু’ জোড়া চোখ আড়াল খুঁজছে। বৃষ্টি নামবে এখনি।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *