সুমী সিকানদার
‘’খেয়ে নাও তো মা। জুড়িয়ে পান্তা হয়ে গেলো। ‘
মেয়ে যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে গেলেও মুখে শান্ত ভাব। রান্নার খালা এলো না। উদ্দেশ্য স্বাধীনতা দিবস পালন। এদিকে প্রিয়ার স্বাধীনতার তেরোটা। জগতের সকল নারী কবে একত্রে স্বাধীনতা পাবে কে জানে! আগামীকাল দু’দুটো অনুষ্ঠান। কিন্তু পৌঢ় সময়ে পৌঁছে যাওয়া মা আজ খাচ্ছেন না। পুরো ভাতই জাউ করা। তাতে লেবু চিপে সানন্দে মেশানো সেদ্ধ মুরগীর কুচি। মুখে দাঁতের ঝামেলা নেই যে তাকে চিবিয়ে খেতে হবে। শুধু ফুড়ুৎ করে গলা বেয়ে নেমে গেলেই চলে।
‘’আর খাবে না?’’ মাথা নাড়েন নাইমা বানু। ‘’আর খাবো না’’।
প্রিয়া ছেড়ে দেয় এবার তাকে। আধাবাটিও গেলানো গেলো না। আবার নতুন কিছু বানিয়ে নিয়ে বসতে হবে।
‘’চলো এবার শোবে। অনেক সাধনায় না খেয়ে বিরাট উপকার করেছ মা। ।‘’ কায়দা করে গৃহকর্মী ফুলিকে ইশারা করল মায়ের পাশে থাকতে। কিন্তু মায়ের তার ইন্দ্রিয় সজাগ।
‘’তুই এখন কোথাও যাবিনে।‘’
‘’ অনেক কাজ আছে মা।‘’
‘’মা’কে একা রাখতি হয় না। ভয় পায়। ‘’
‘’কে ভয় পায়? ‘’
‘’তোর মা।‘’
বুড়ির বুদ্ধি টনটনে। প্রিয়া হাসে। আচ্ছা চলো গল্প বলো।
‘’কিসের গল্প?’’
‘’বাবার কথা বলো। ‘’
‘’এত কিছু মনে থাকে ক’ দিনি। যা তুই কাজ কর।‘’
‘’আচ্ছা যুদ্ধের কথা বলো। যুদ্ধের সময় প্রেম করেছিলে মা। কি সাহস তোমার।‘’ ‘’কি বলবানি তার ঠিক নেই।‘’
“একাত্তরে তুমি আর বাবা দেশ ছেড়ে কোথায় গেছিলে?”
“বে করতি গেসলাম” একদমে এই কথা বলে মা চুপ।
‘’ সেকি, বিয়ে?” প্রিয়া হেসে ফেলে। এই গল্প কয়েক কোটিবার শোনা। ডাক্তারবাবুর পরামর্শে এভাবেই মায়ের স্মৃতি তাজা রাখা হয়। কেন যেন মনে হয়, প্রতিবার মা কিছু লুকায়।
“মা” তাড়া লাগায় প্রিয়া।
‘’বললাম তো বে করতি গেসলাম।‘’
‘’কোথায়?’’
‘বর্ডার ছেইড়ে ওইপাশে।‘’
‘তারপর? ‘
‘’তুই যা কাজ করগে।‘’
‘’সব তোমার মনে থাকে মা।‘’
‘’তাপ্পর ম্যালা লোক এইসে তোর বাপিরি ঘিরে ধরিসে। ‘’
‘’কেন?’’
‘’তাকে মুজিবকত্তার মতো লাগতিসিলো, তাই।‘’
‘সেকি?’
‘’সেই একই রকম চুলির কায়দা, সিঁথি নেই, এই লম্বা’’ মা উদাস ।
‘’দেশে ফিরলে কবে?’’
‘’একদিন লোকজন তারে ধরে নে খুব পেটালো।‘’ মা প্রিয়ার প্রশ্ন ছাড়াই আজ বলছেন।
‘’কাকে?’’
‘’তোর বাপিরি।‘’
‘’কেন? মারলো কেন?’’
‘’রেডিওতে সংরাম (সংগ্রাম ) বাজতিছিলো তাই।‘’
‘’তোমরা ফিরে এলে না কেন?’’
‘’তোমরা কিডা?‘’
‘’মানে?’’
‘’তোর বাপ এক বিটির কাছে আমাকে থুয়ে বলে সকাল হলি পরে আসপো। ‘’
প্রিয়া চুপ ।
“আমারে থুয়ে যাবার জন্যিই দেশেত্তে নিয়ে আইলো। বুঝতি পারিনি। রাস্তার বিড়ালিরি বস্তার মুখ বেন্ধে দূরে ফেলি রেখে আসে না, সেইরম। পেটের মধ্যি তুই ছিলি। সে জানতো।‘’
প্রিয়ার বুকটায় টং করে বাজে।
‘’মা ঘুমাও।‘’
“সে স্বীকার করতো না যে’’
‘’কি স্বীকার করতো না? ‘’ থমথম করে মায়ের কথা না বলা সময়টুকু।
‘’তার বউ’র তো পর্দা ছেলো না। শার্টি’র বোতাম লাগাতি পারতো না।‘
‘’ হায় রে মা।বাবার পয়লা স্ত্রী শার্টের বোতাম লাগাতে পারতো না বলে তুমি তাকে বিয়ে করেছ?’’
‘’ক্ষিদে পেইসে ময়না।‘’
প্রিয়া পাউরুটিতে গরম দুধ ঢেলে পক্ষীমাতার মত খাওয়ায়। ঠোঁটে লেগে থাকা দুধের গোঁফ মুছে দেয়। তার বুদ্ধিজীবি পিতা, বুদ্ধি করে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী’ ফেলে এলেন।
‘’বলেছিলে বাবা যুদ্ধে মারা গেছে। মিথ্যে বলেছিলে মা।‘’
‘’আমি তারে পেয়ার করতাম যে।‘’
‘’কাকে ?’’
‘’তোর বাপিরি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব সুন্দর। অল্পে বিশাল…