অদিতির ভয়
মহুয়া সমাদ্দার

ট্রেনে উঠতে না উঠতেই অদিতির শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামতে শুরু করেছে। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একজন কালো কোট পরা টিকিট পরীক্ষক গেট থেকে উঠে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আজ দুই বছর ধরে সে কল্যানি থেকে নার্সিং ট্রেনিং-এ যাচ্ছে। একটা দিনের জন্যেও সে টিকিট ছাড়া যায়নি। মান্থলি ফুরিয়ে যাবার আগেই সে মান্থলি কেটে নিয়েছে। কিন্তু আজই প্রথম সে টিকিট ছাড়া ট্রেনে উঠেছে। গত রাতেই সে ঠিক করে রেখেছিল যে আজ সকালে একটু আগে ভাগে স্টেশনে এসেই মান্থলি কিনে নেবে। কিন্তু সকালে বাড়িতে একটা ঝামেলা হয়ে যাওয়াতে তার বাড়ি থেকে বের হতেই বেশ দেরী হয়ে গেল। এতটাই দেরী যে রীতিমত ছুটে তাকে ট্রেনটা ধরতে হয়েছে। অন্য দিন হলে সে নিশ্চিন্তে এর পরের ট্রেনটা ধরে নিত। কিন্তু আজ তাদের এন বি ম্যামের লাস্ট ক্লাস। আর পরীক্ষার আগে শেষ ক্লাসে এন বি ম্যাম কথায় কথায় অনেক প্রশ্নই বলে দেন, গত বছরেই দেখেছে অদিতি। তাই কোনও কিছুর মূল্যেই আজকের এই এন বি ম্যামের ক্লাসটা মিস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে পড়িমরি করে ঠিক ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রেনে উঠে পড়েছে। তার ফোনে টাকার কোনও অ্যাপও নেই যে টিকিট ছাড়া ধরা পড়ার পরে সে অনলাইনে ফাইন পেমেন্ট করে মুক্তি পাবে। বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছে বলে বাবার কাছ থেকে মান্থলি কেনার টাকা নেবার কথা মনেই পড়েনি তার।
সে জ্ঞান হওয়া ইস্তকই দেখেছে যেদিন সে কোনও কারণে টিকিট ছাড়া ট্রেনে উঠতে বাধ্য হয়, সেদিন ট্রেনে টিটি উঠবেনই উঠবেন। এই নিয়মের কখনও অন্যথা হতে সে দেখেনি। আর সেই টিটি ঘুরে ঘুরে তার কাছে আসবেই এবং টিকিট চাইবে। কিন্তু সে যে রোজ টিকিট নিয়ে ঘোরাফেরা করে, আজ পর্যন্ত একজন টিটিও তার কাছে এসে দাঁড়াননি, টিকিট চাওয়া তো দূরের কথা। আজও যে সেই একই নিয়মের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে সেই ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহই নেই অদিতির। অদিতি প্রায় দম বন্ধ করে বসে রইল। ট্রেনে উঠে একটা ফাঁকা সিট পেয়ে বসে পড়েই সে তার চারপাশটা একবার ভাল করে দেখে নিয়েছিল। তার সামনেই প্রায় তারই বয়সের চারটে ছেলে বসে রয়েছে। ছেলেগুলো কোনও ম্যানেজমেন্ট কোর্স করছে। তার একপাশে একটা খুব সুন্দরী মেয়ে বসে ফোন টিপে যাচ্ছে। আর অন্য পাশেও হয় অফিস যাত্রী, তা নইলে ছাত্র ছাত্রীরা চলেছে তাদের গন্তব্যে। আজ এতগুলো ঝকঝকে মানুষের সামনে তাকে বেমালুম অপদস্থ হতে হবে ভেবেই তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে সমানে নিজেকেই নিজে দোষারোপ করতে লাগল। ভুলটা তো তারই। কাল রাতে বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেওয়া উচিৎ ছিল তার। কিন্তু সে তা করেনি। সে ট্রেনে উঠেই তার পার্স চেক করে দেখে নিয়েছে। মাত্র কুড়িটা টাকা সেখানে পড়ে রয়েছে। সে কী করবে? বিনা প্রশ্নে সে কি পরের স্টেশনে নেমে যাবে? তারপরে একটা লোকাল টিকিট কেটে পরের ট্রেন ধরবে? তখনই তার এন বি ম্যামের ক্লাসের কথা মনে পড়ল। আজ এই ট্রেনটা ছেড়ে দিলে সে আর ওই ক্লাসটা কিছুতেই অ্যাটেন্ড করতে পারবে না। তাই আপাতত নেমে যাওয়ার ইচ্ছেটা মন থেকে দূর করে দুই চোখ বুজে সে চুপচাপ বসে রইল। তখনই সে শুনল এক পুরুষ কন্ঠ।
–এক্সকিউজ মি ম্যাডাম!
টিটি তার কাছে চলে এসেছে। এবারই সে নির্ঘাত তার টিকিট দেখতে চাইবে! জানুয়ারির শীতেও সে রীতিমত ঘামছে। তখনই সে আবারও শুনতে পেল সেই কন্ঠ উত্তেজিত গলায় বলছে – কী আশ্চর্য! এরা কি বাড়িতে ঘুমায় না? ট্রেনে উঠতে না উঠতেই এরা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়। ডিসগাস্টিং!
অদিতির গলা শুকিয়ে গিয়েছে। এক ঢোক জল খাবার প্রবল বাসনা হচ্ছে। কিন্তু এখন সে উপায় নেই। সে চোখ বুজে একইভাবে বসে রইল। তখনই শুনল লোকটার সঙ্গে আরও দু তিনটে কন্ঠ বলছে – আরে ম্যাডাম, একটু চেপে বসুন না! ভদ্রলোক সেই থেকে দাঁড়িয়ে আছেন!
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল অদিতির। তারমানে লোকটা টিটি নয়! সে চোখ খুলে লজ্জিত মুখে ডান দিকে একটু চেপে বসে তার বাঁ পাশে লোকটাকে বসার ব্যবস্থা করে দিল। লোকটা বসেই কাকে যেন ফোন করে কিসব আইনি পরামর্শ দিতে শুরু করেছেন। সে বুঝল পাশের কালো কোট পরা লোকটা একজন উকিল। কোনও টিটি নয়। সে নিশ্চিন্ত মনে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে নেট অন করে সবেমাত্র ফেসবুক পাড়ায় উঁকি দিয়েছে। অমনি শুনল পেছন থেকে এক পুরুষ কন্ঠ কাকে যেন বলছে – এই যে আপনার টিকিট দেখি?
অদিতির হাতের ফোন হাতেই রইল। সে ভয়ে, দুশ্চিন্তায় ভারী হয়ে আসা মাথাটা সিটের গায়ে এলিয়ে দিল।