micro-story-asphut

অস্ফুট
সৌমী গুপ্ত


বেলা পড়ে এসেছে। রান্নাঘরের পশ্চিমের জানালা দিয়ে মরা রোদের একফালি এসে পড়ছে মেঝেতে। শেফালি আসন পেতে বসল রোদের দিকে পিঠ পেতে। আজ বেশ ঠাণ্ডা। শীতের শেষ দুপুর। তার উপর আবার রোববার। দেরি হয়ে গেছে প্রতি সপ্তাহের মতো।

ভেটকি পাতুরিটা আজ তরিজুত করে বানিয়েছে শেফালি। প্রতিটি পাতুরির ভেতর বেছে বেছে লাল লঙ্কা চিরে দিয়েছে। লঙ্কার আর সর্ষের গন্ধে রান্নাঘর ম ম করছিল। আর পাঁঠার মাংস! অমন লাল লাল ঝোল কেউ বানাতে পারে? আলু গলবে না অথচ সুসেদ্ধ! মাংসও তাই! মুখে দিলেই মাখন। বাসন্তী পোলাও করেছে ঝুরঝুরে। ঘিয়ের গন্ধে গোটা ফ্ল্যাটবাড়িটা জানান দিচ্ছিল আজ রোববার। রোববার প্রতিটা বাড়িতেই যজ্ঞিবাড়ি যেন। শেফালি হাঁফিয়ে ওঠে। পা দুটো প্রতিবাদ জানায়। কোমরটাও। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল শেফালি।

রান্নাঘরের পাশে একটা নিমগাছে ঘুঘুটা ডেকেই যাচ্ছে। শেফালি গায়ের চাদরটা টেনে নিল। আজ ট্যাংরা মাছগুলো বেশ বড়ো বড়ো ছিল। প্রতিটার পেটে ডিম ভর্তি। আর বাগদা চিংড়িগুলো? ডাবের ভেতর মশলা সমেত ঠেসে ভরতে ভরতে শেফালি ভাবছিল এই রেসিপি গোটা শহরে ঘুরলেও কোনও রেস্তোরায় পাওয়া যাবে না। শুধু টাকা ফেললেই কি স্বাদের তৃপ্তি মেলে? রান্নায় চাই মায়া! ওটাই তো শেষ পর্যন্ত সেরা বানায় প্রতিটা রান্নাকে।

রুমি এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল শেফালিকে। মায়ের গায়ের গন্ধ ওর বেশ লাগে। বেচারা মুখে কিছু বলতে পারে না। চোখদুটো বড় মায়াবি। ছোট থেকেই অমন। অটিজম আছে ওর। ওষুধ চলছে। এক সময় খুব মন খারাপ লাগত রুমিকে দেখে। আজকাল গা সওয়া হয়ে গেছে। সময় বড়ো ওষুধ। আর কতক্ষণই বা কাছে থাকতে পারে! এই তো দুপুর থেকে রাত অবধি। তাও সন্ধে থেকে ঢুল আসে। সারাদিন এত রান্না, শরীর বিদ্রোহ করে তখন। এখন মনে হয় বেঁচে আছে এই অনেক। রুমির বাবা তো মরল গ্যালন গ্যালন মদ টেনে! দেখল ফিরে? শেফালির দিকে? রুমির দিকে? বারণ তো করত। শুনেছে?

সামনের ভাত ভাঙল শেফালি। এহ্ ঠান্ডা হয়ে গেছে একদম। শক্ত কাঠ। ছোট্ট স্টিলের বাটি থেকে ট্যালট্যালে ডালটা ঢেলে নিল শেফালি। আজ সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেছে বেশ। তাই আজ বরাদ্দ ডাল আর সয়াবিন আলু। কষা কষা করেই করেছে। ডালটা একটু পাতলা করেছে ইচ্ছে করেই। মুদির দোকানে আর ধার বাড়াতে ইচ্ছে করে না। মাসের শেষ! ডালও বাড়ন্ত। যতদিন টেনেটুনে চালানো যায়! রুমি ঝুঁকে এসেছে ভাতের থালার ওপর। সকালে ফ্যানাভাত খাইয়ে পাশের বাড়ির অনিমার দায়িত্বে দিয়ে গেলেও শেফালি জানে শেফালি না খাইয়ে দিলে রুমি মুখেও তুলবে না কিচ্ছুটি। শুকনো শুকনো করে মেখে গ্রাস করে খাইয়ে দিল শেফালি। চোখেমুখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি ফুটে উঠল। শেফালি হাসল। চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ভাতের থালার উপর। বাড়ি ভাড়া, ওষুধ, দুটো মানুষের চার বেলার সংস্থান। জীবন এত কঠিন মনে হয় মাঝে মাঝে!

চার বাড়িতে আজ রোববারের ভুরিভোজের আয়োজন করে এসেছে শেফালি। প্রতিটা বাড়িতে রান্না করতে সময় যায় দেড় ঘণ্টা। সকলে ওকে “গল্প হলেও সত্যির” রবি ঘোষ বলে। শেফালিও জানে ওর মতো রান্নার লোক দুটো পাওয়া মুশকিল। ওরা সবাই আঙুল চেটে খেয়েছে এও জানে শেফালি। ওদের চোখেমুখে তৃপ্তি চুঁইয়ে পড়ছে দিনের পর দিন! কিন্তু দিনের শেষে রুমির এই তৃপ্তিটুকু শেফালিকে সব ভুলিয়ে দেয়। ও ভাত মাখতে মাখতে মনে মনে মিশিয়ে দেয় ভেটকি পাতুরি, পাঁঠার লাল ঝোল, ডিমভর্তি ট্যাংরা, ডাব চিংড়ি আর শেষ পাতের চাটনি! রুমি তখন তৃপ্তি করে চোখ বুজে খায়। ঘুঘুটা ডেকেই চলে তখনও।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-asphut

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *