অস্তিত্ব-সংকট

অস্তিত্ব-সংকট
দেবব্রত দাশ
“তোমার এই চিত্র-প্রদর্শনীতে আসতে একেবারেই ইচ্ছে করে না আমার… অস্বস্তি হয় ভীষণ!” মঞ্জিরা চোখ কুঁচকে তাকায় সুখেন্দ্রর মুখের দিকে।
“কেন? — ন্যুড ছবি রয়েছে বলে!”
“বোঝোই যখন, বলো কেন আসতে?” মৃদু অনুযোগ মঞ্জিরার কণ্ঠে, “তিনবছর ধরে আসছি তোমার প্রদর্শনীতে, এখন তো একেবারে…!”
“একেবারে কী?”
“প্রায় সবই তো ন্যুড-স্টাডি… বাড়তে বাড়তে শতকরা নব্বই ভাগ ছবিই…”
“অস্বস্তি হয় কেন তোমার? — তুমি মডেল বলে?” সুখেন্দ্র মঞ্জিরার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে, “তুমি ছাড়া আমার আরো তো তিনজন মডেল আছে… না কি ?”
“তারা তো আর তোমার সঙ্গে সামনের ফাল্গুনে ছাদনাতলায় যাচ্ছে না সুখেন্দ্র!” উষ্মাভরা কণ্ঠস্বর মঞ্জিরার, “তোমার বেশির ভাগ ছবিতেই আমার মুখের আদল এসেছে… ফাল্গুনের পর কিন্তু আমি আর… “
“আশ্চর্য! সে তো আমি কথা দিয়েছি তোমায় … কথার খেলাপ করি না আমি, নিশ্চিন্ত থাকো।”
“আমি নিশ্চিন্ত নই অন্য কারণে,” মঞ্জিরা ব্যাখ্যা করে, “আমি মডেল হিসেবে তোমার সামনে না দাঁড়ালেও তোমার তুলিতে হয়তো আমার মুখমণ্ডলই ফুটে উঠবে।”
“উঠুক, তাতে কী! আগেও বলেছি, আবারও বলছি — সবচেয়ে প্রাচীন যে বেদ, মানে ঋকবেদ… তাতে উল্লেখ আছে — প্রাজ্ঞ ঋষিগণ সবচেয়ে গুরুত্ব দিতেন সৃষ্টিরক্ষায় এবং সেজন্যেই নারী-পুরুষের মিলন- সম্পর্কিত কথা বলতে আদৌ কোনোরকম ভণিতা ছিল না তাঁদের, তাঁরা যৌনমিলনকে কখনোই অশ্লীল মনে করতেন না, কোনো সঙ্কোচ ছিল না তাঁদের।” এ পর্যন্ত বলে থামল সুখেন্দ্র। তারপর মঞ্জিরার হাত ধরে এগিয়ে গেল ডিসপ্লে-বোর্ডের দিকে, “সব ভান-ভণিতা আর ধোঁয়াশা কাটাতে এবছর আমি এক অভিনব ব্যবস্থা নিয়েছি।”
“কী ব্যবস্থা?”
“এই তো সামনের দেওয়ালের দিকে তাকাও, তাকালেই বুঝতে পারবে। দ্যাখো — একবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত মুক্ত মানসিকতার মানুষজনের উদ্দেশে কী লেখা আপলোড করেছি আমি, চেয়ে দ্যাখো তুমি মঞ্জিরা। দৃশ্যমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যেই বিপুল উৎসাহে ছবি তুলে নিয়ে দেখাতে শুরু করে দিয়েছে আর তাই, মন্তব্যে মন্তব্যে ভরে উঠছে আমার মোবাইল-ফোনের ইনবক্স।”
মঞ্জিরার বিস্ফারিত চোখের সামনে ইলেকট্রনিক বোর্ডে দশ সেকেন্ড অন্তর ফুটে উঠতে থাকে এই লেখাগুলো :- যদি এই চিত্রপ্রদর্শনীতে সঙ্গমরত নারীপুরুষের চিত্রগুলিকে আপনারা অশ্লীল মনে করেন, তবে তো উত্তরসূরিদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে।

————-

8 thoughts on “অস্তিত্ব-সংকট

  1. আপনার লেখা বরাবরই আমাকে টানে,এই অণুগল্পের মধ্যে দিয়ে খুব জোরালো একটা বার্তা সমাজকে দিতে চেয়েছেন ,যার একাধিক দৃষ্টিকোণ আছে।গল্পটির শেষটা আরও একটু বিস্তারিত লিখলে ভালো লাগতো।
    ভালো থাকুন,ভালো লিখুন।

  2. খুব ভালো লাগলো। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ।

  3. যুক্তিসঙ্গত অণুগল্প। খুব সুন্দর লাগছে।

  4. ছোট্ট একটি বাক্যে আমাদের অন্তর্নিহিত মনের অগোচরের অনেক কথা প্রকাশ করেছেন লেখক তার সুন্দর বাচনভঙ্গীর মাধ্যমে। আসলে মানুষ অনেক কিছুই সামনাসামনি অপছন্দ করেন কিন্তু আড়ালে উপভোগ করতে ভালো বাসেন।

  5. খুব সুন্দর। এই বার্তাটি খুব অর্থপূর্ণ।

  6. বক্তব্যটি সঙ্গত। তবে পাঠক কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেল প্রত্যাশায়। কোনও চিত্রকর কেনই বা তাঁর সৃষ্টি নিয়ে এত কৈফিয়ত দেবেন, তাঁর বাগদত্তার অস্বস্তির জবাবে কেনই বা এভাবে ব্যাখ্যা দেবেন, সেটা ঠিক বোঝা গেল না। অণুগল্প হিসেবে কিছুটা দুর্বল মনে হল সে কারণেই।

  7. প্রাগৈতিহাসিক সত্যের স্বীকৃতি… ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *