নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
দূরে দূরে টিলা পাহাড় আর পাহাড় ঘিরে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। এই গিরিবর্ত জুড়ে আত্মগোপন করে আছে কিছু বজ্রযানী সাধকের দল। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের উৎখাত করতে করতেই এগিয়ে চলেছেন গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহ। বৌদ্ধদের প্রতি তাঁর মনে চরম বিদ্বেষ।
সুলতানের শাসনে বাংলার বিস্তৃত অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বাণিজ্যের প্রসারের জন্য নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন করেছেন। বৌদ্ধদেবীর নামেই গ্রামের নাম বজ্রইক্ষ্যা। গ্রামের কোনো গোপন জায়গায় অতি জাগ্রত সেই দেবীমূর্তি লুক্কায়িত। তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধকেরা সেখানেই তাদের ঘাঁটি গেড়েছে। তান্ত্রিক এই অসাধুদের তাঁর রাজত্ব থেকে চিরকালের জন্য দূর করে দিতে চান সুলতান। উড়িষ্যা যাবার পথে হঠাৎ এই জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামটিতে এই কারণেই শিবির স্থাপন করেছেন তিনি।
সুলতানের সঙ্গে সৈন্যসামন্ত দাসদাসী ছাড়াও আছে তাঁর প্রিয়তমা বেগম গুলবানু। অপরূপ রূপসী বাংলাদেশের চাঁদপুরের অধিবাসিনী এই নারী হিন্দুঘরের এক ব্রাহ্মণের বিধবা ছিল। তখন নাম ছিল বাসন্তীদেবী। সে সত্যিই সার্থকনামা, গায়ের রং উজ্জ্বল স্বর্ণাভ। একসময় সুলতানের নজর পড়েছিল বাসন্তীর উপরে। তার রূপে মোহিত হয়ে তাকে বেগম করেছেন তিনি।
ভোরবেলায় বেগমের পোষা শেকলবদ্ধ বাজপাখিটি উড়ে গেছে। সুলতানের কাছে খবর গেছে। সুলতান নিজেই খবর শুনে বেগমের শিবিকায় এসে উপস্থিত হলেন। গুলবানু খুব ভোরে স্নান সেরেছে। সকালের রোদের তাপে দু’এক ফোটা ঘামের বিন্দু চকচক করছে তার নাকের উপর। শিবিকার কাপড় গরম হাওয়ায় একটুতেই তেতে ওঠে। গুলবানুর কোমল মুখশ্রী যেন হুবহু হিন্দু মন্দিরের কোনো দেবীর মুখ। মাথার কোঁকড়ানো একঢাল চুল খুলে রেখেছে সে, কেন যেন চোখদুটি তার ভেজা। বেগম কি বাজপাখির শোকে কাঁদছিল?
বাজপাখির বাচ্চা ধরে খাঁচায় রাখা হয়। এরা শত্রুদেশের খবরসন্ধানী পায়রাদের খেয়ে নেয়। বাজপাখির বাচ্চাটাকে বেগম নিজের হাতে খাওয়াত। সুলতান বেগমের সুন্দর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
”কথা দিলাম! তোমার প্রিয় বাজপাখি আমি তোমার হাতেই ফিরিয়ে দেব!”
বেগমের সঙ্গী-সাথীরা হর্ষধ্বনি করে উঠল। গুলবানু মুখে কিছু বলল না, কেবল তার দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সুলতান ঘোষনা করালেন, ‘সুলতানের বাজপাখি ধরে দিলে পুরস্কৃত করা হবে।’
বিকেলের মধ্যে বাজপাখিটাকে পাখিধরা জালে ধরে শিবিকার বাইরে এসে দাঁড়ালো একটা ছেলে। তার কোমরে বাঁশি। খালি পায়ে ধুলোমাখা।
সুলতানের লোকজন ছেলেটাকে ধরে আনল। গুলবানু চমকে উঠল। অবিকল তার পটের শ্রীকৃষ্ণের মুখ! তার মনে পড়ে গেল, চাঁদপুরের বাড়ির তুলসীমঞ্চ, রাসমঞ্চ আর সেই বহুকালের প্রিয় কৃষ্ণের পটখানা! তাঁর দুচোখে তখন জলধারা। তাড়াতাড়ি বাজপাখি নিয়ে শেকলে বাঁধল বেগম। সে যে নিজেও এমন করেই কারো খেয়ালে আজ শেকল-বন্দী!
সুলতান রাখাল ছেলেটাকে ডেকে আনলেন। বললেন,
”নাম কী তোর? ঘোড়ায় চাপতে পারবি?” একগাল হেসে রাখাল ছেলে বলল,
”আমার নাম বসন্ত দাস!”
সুলতান ঠাট্টা করে বললেন,
”আজ থেকে তুই বাজবসন্ত।”
সেই থেকে রাখালের নাম হয়ে গেল বাজবসন্ত। সুলতান পেটভরে অনেক মণ্ডা খাওয়ালেন বাজবসন্তকে। তারপর ঘোষনা করলেন তার পুরস্কার।
”ঘোড়ার পিঠে আজ রাতের মধ্যে বাজবসন্ত যতটা পথ যেতে পারবে, ততটা নিষ্কর জমি পাবে সে।” শুনে মোসাহেবরা সবাই হৈ হৈ করে উঠল। বাজবসন্ত ঘোড়ায় উঠে বসল। মুখে তার অমলিন হাসি। তার মনে আজ বড় আনন্দ। তার অনেকদিনের শখ ঘোড়ার পিঠে চড়বে।
উজির একটা ঘটি ভর্তি আখের পানা এনে দিলেন।
”ঘোড়ায় ওঠার আগে খেয়ে গেলে পথশ্রমে কষ্ট হবে না। তারপর সারারাত ঘোড়ায় চেপে বেড়াবে। সকালে উঠলেই জমিদার!”
গুলবানু ছুটে এসেছে কোথা থেকে। ”ও শরবত খেয়ো না!” উজির বললেন,
”সে কী! কেন? এ শরবত যে স্বয়ং সুলতান ওর জন্য পাঠিয়েছেন!”
”আমি বলছি, তাই ও খাবে না।”
বাজবসন্ত তক্ষুণি ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল, আখের পানাটুকু না খেয়েই। উজিরের হাত থেকে নিয়ে সেই শরবতটুকু খেয়ে নিল গুলবানু। কথা হয়েছিল কড়া আফিম ও বিষ মেশানো ওই শরবত খেয়ে ঘোড়ায় বসতে না বসতেই মুখ থুবড়ে পড়ে মরবে রাখাল। নিষ্কর জমি সুলতানকে দিতে হবে না।
গুলবানুকে বাঁচানো গেল না। তাকে গ্রামের মাটিতে কবর দেওয়া হয়েছে।
দেবী বজ্রইক্ষ্যার মূর্তি খুঁজে পেলেও সেদিকে চেয়ে কেমন যেন কেঁপে উঠলেন সুলতান। অপরূপ শ্রীময়ী দেবীর মুখটি দেখে মাথা নত হল তাঁর। ফিরে গেলেন বিনম্রচিত্তে।
পরদিন সেনাসহ শিবির গুটিয়ে উড়িষ্যার দিকে চলে গেলেন হুসেন শাহ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন