ভুল

ভুল
তন্ময় মণ্ডল

অর্পণ বারবার করে চাইছিল ছবিটা মিথ্যে হোক। দিন দুই আগে কেনা ইয়োলো টি-শার্টের কনুই বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে এই এসির মধ্যে বসেও। ফোনটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই কেমন একটা কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। পাশে বসা বীজেশদা সিগারেটটা অ্যাশটেতে ডলতে ডলতে বলল, “কীরে ব্যাটা কী হয়েছে? দেখি মোবাইল।’’ মোবাইলটা হাতে নিয়ে বীজেশদাও একটু অপ্রস্তুত হতে হতে নিজেকে সামলে নিল।
অর্পণ সাংবাদিকতা করতো। মাস ছ’য় হল সেমিটাইপ বেকার। মাঝে মধ্যে দু-একটা মাঝারি মানের কাগজে আর্টিকেল লেখে আর নিজের একটা ছোট্ট ব্যবসা দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় আছে। তার প্রেমিকা একটা আছে, মানে ছিল। নাম রুচিরা। নামে যতই রুচির বাহার থাক না কেন, এই রুচি নিয়েই ওদের সম্পর্কে যত বিপত্তি। মেয়েটির পছন্দ টিকটকে ভিডিও বানানো, চোখে লাগার মতো জায়গায় হার্ট শেপের ট্যাটু করা। আর অর্পণের পছন্দ আর রুচি একেবারে টিপিকাল মধ্যবিত্ত। তবে ইমেজ নিয়ে খুব সিনসিয়ার ছেলে অর্পণ। লোকে যখন এসে বলে- ভাই তোর বউ দেখলাম একটা খোলা পিঠের ছবি লাগিয়েছে ফেসবুকের স্টোরিতে বা কেউ যখন এসে বলে- অর্পণ তোর বউ ট্যাটু করেছে ভালো কথা। তবে সেটা আবার ভিডিও করে টিকটকে ছাড়ার কী ছিল? বুঝিনা ভাই কী দাবী এদের! অর্পণের মাথার কোনও নার্ভই আর কাজ করে না।
রেগে গিয়ে অর্পণ মুখ খুললেই ছ-সাত অক্ষর বেরিয়ে পড়ে। ফলে উল্টোদিকের মানুষটার ক্ষেত্রেও তা হজম করা একটু মুশকিলই বটে। এইরকম একটা ছোট্ট চিৎকার থেকে শুরু হয়ে ছ’বছরের সম্পর্ক প্রায় তলানীতে। অর্পণ যে খুব ভালো আছে তা নয়। মেয়েটি এমনিতে ভালোই ছিল। একটিই বদভ্যাস। অর্পণ চিৎকার করলে সে থামাবার চেষ্টা করেনি কোনদিন, আর অর্পণও তথৈবচ। ফলে আজ প্রায় পাঁচ মাস বিয়েটা ভেঙে গেছে ওদের। অর্পণের যে মনখারাপ হয়নি তা নয়। এদিক সেদিক অনেক মেয়েদের সঙ্গেও কথাটথা বলেছে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক রাখার জন্য, তবে লাভ কিছু হয়নি। এখন অবশ্য ব্যবসা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ওসব আর খুব একটা ভাবেনা ও। মাঝে যে ক’বার মেয়েটা ভালো করে কথা বলে মিটিয়ে নিতে চেয়েছিল, ও-ই মেটায়নি। কী এক বিরক্তি আর তিক্ততা যে মেয়েটির প্রতি জন্মে গেছিল অর্পণ নিজেও ঠিক করে জানেনা। তার একটা বড় কারণ হল মেয়েটি কখনও নিজের ভুলকে ভুল বলে মানতে চায়নি। এতে তিক্ততা আরও চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছেছে।
গত পরশু মেয়েটা ফোন করে বলেছিল আগামীকাল আমার রেজিস্ট্রি। মাঝে মধ্যেই যেহেতু বলে, “আমাকে ছেলে দেখতে আসছে” ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্পণ তাই সিরিয়াসলি নেয়নি ব্যাপারটা। তবে বেশ কয়েকদিন অর্পণেরও মনে হচ্ছিল মিটিয়ে নেওয়া যাক আর না যাক একবার সামনাসামনি বসে কথা বলা দরকার।
আজ যে ছবিটা দেখার পর বীজেশদা আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছে সেটা রুচিরার এনগেজমেন্টের। সারা দেশ জুড়ে লকডাউন চলছে। অর্পণ ভেবেছিল এই পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হোক তারপর দেখা যাবে। কিন্তু জীবন কবে থেমে থাকে কারোর ভাবনার জন্য! এই মুহুর্তে অর্পণের মনে হচ্ছে ওর হৃদপিণ্ডটার ওপর দিকে একটা ছুরি চলছে অনবরত। কয়েক মিনিট আগেও যে মেয়েটার দোষগুলোই শুধু চোখে পড়তো, এখন তার দোষ-ত্রুটি ঝাপসা হয়ে আসছে। ভালো মুহুর্তগুলো যন্ত্রণা দিচ্ছে ভয়ঙ্কর। আসলে আলো যখন কাছে থাকে, চোখ ঝলসে যায়। উত্তাপে মন পোড়ে। ফের শুকায় ক্ষত। অন্ধকার আসে। আলোও ফেরে তারপর। তবে আজ পাকাপাকি বিদায়। কেউ পাকাপকিভাবে চলে যাওয়ার পর বোধ হয় তার উপস্থিতি আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
অর্পণ নিজেকে নিয়ে, নিজের দ্যোলুল্যমান স্বপ্ন নিয়ে এতটাই নিমগ্ন হয়ে পড়েছিল যে সে ভুলে গিয়েছিল প্রত্যেকটা সম্পর্কেরই সংস্কার প্রয়োজন। সত্যিই শেষ একবছরে শুধু মেয়েটার ওপর সে চিৎকারই করে গেছে। তবুও তো মেয়েটা কতবার ঠিক করে নিতে চেয়েছে সব। চোখ দুটো জলে ভরাট হয়ে আসছে ওর। এর মধ্যেই বীজেশদা ওর পিঠে হাত রেখে বলল, “আসলে কী জানিস তো একজন মানুষ দোষ-গুণ মিলিয়েই হয়। নইলে তো ভালোবাসার জন্য পুতুল খুঁজতে হয়। যাই হোক ভেঙে পড়িস না ভুল তোদের কারোর ছিল না। তোরা পরিস্থিতির শিকার।“ এই কথাগুলো কেমন যেন সান্ত্বনার মতো শোনাল অর্পণের কাছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে ভুলের দাড়িপাল্লাটা তার দিকেই একটু বেশি ঝুঁকে আছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *