micro-story-bintir-bari

বিন্তির বাড়ি
তুলিকা মজুমদার

 

ঘটনাটা আমার ছোটবেলার। বাবার ছিল রাবার কাঠ এক্সপোর্টের কারবার, সেই সূত্রেই মাঝে মাঝে তাকে যেতে হত ত্রিপুরায়। কয়েকমাস থাকতেও হত সেখানে তখন মা আমাদের দুই ভাই বোনকে নিয়ে চলে আসত বাপের বাড়ি, পাঁকুরে সেই সময়টা আমাদের ভারি মজায় কাটত, পড়াশুনার চাপ ছিল না তেমন তাই মামার বাড়িতে গিয়ে খেলাধুলা আর আড্ডা মেরেই সময় কেটে যেত। মামার বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িটিকে পাড়ার লোকেরা “বিড়াল বাড়ি” বলত। সেই বাড়িতে কম করে ২০ – ২২ টা বিড়াল থাকত, তাই মামার বাড়ি গেলেই একেবারে এক ছুটে আমরা চলে যেতাম বিড়াল দেখতে। সেবার আমরা গরমের ছুটিতে মামার বাড়িতেই ছিলাম। সেই পাড়ায় হঠাৎ করেই আগমন হল এক নতুন অতিথি, বাসন্তীদির! অবশ্য নতুন অতিথি বলা ভুল। বাসন্তীদি ওই পাড়ারই মেয়ে ছিল। কিন্তু অল্পবয়সে এক কাপালিক ফুসলিয়ে নিয়ে চলে যায় ওকে। সেই বাসন্তীদি যখন ফিরে এল তখন বয়স প্রায় চল্লিশ। বাসন্তীদির মা বাবা মারা গেছেন বহুদিন আর তারা যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সেই বাড়িতেও অন্যলোক বহুদিন থাকতে শুরু করেছে। যাইহোক, এলাকার যে কজন লোক বাসন্তীদিকে চিনত তাদের সাহায্যে মামাবাড়ির ঠিক দুটো বাড়ি পরেই একটা বাড়িতে বাসন্তীদি তার বছর বারোর মেয়ে বিন্তিকে নিয়ে উঠল। বাড়িটা খালিই পড়ে থাকত, মালিক থাকত শহরে। প্রথম প্রথম সংকোচে বা নিরুদ্দেশ থাকার কারণে বাসন্তীদি খুব কম কথা বলত। ধীরে ধীরে পাড়ার পুরোনো মা কাকিমাদের প্রশ্রয়ে একসময় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল। ওর ছোটবেলার কথা, নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা বা বিয়ে সংসারের কথা কেউ আর জিজ্ঞেস করত না।

  বাসন্তীদি আসার পর যতদিন কাটতে থাকল কিছু অদ্ভুত ব্যাপার পাড়ার সকলের নজরে পড়তে শুরু করল। কানাঘুঁষো শুরু হল যে সূর্যাস্তের পর বাসন্তীদি বা তার মেয়ে বিন্তি বাড়ি থেকে বেরোয় না। কারোর বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকলেও নানান বাহানায় তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর সবাই খেয়াল করল, সকালেও বাড়ির জানালা খোলে না ওরা, এমনকি বাড়ির সব জানালা কালো কাপড় দিয়ে পর্দার মতো ঢেকে রাখত বিন্তিরা। বিন্তি আমাদের সঙ্গে দিনের বেলায় খেলত কিন্তু সন্ধে নামার সময় হলেই সে কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে যেত, ওর মা ওকে খেতে ডাকলেই, এক ছুটে খেলা ভুলে চলে যেত বাড়ির দিকে। কখনো কোনো বাড়িতে গেলে বিন্তিকে কিছু খেতে দিলেও সে খেত না, বলত ওর ছোটবেলায় অসুখ করেছিল বলে বাড়ির বাইরে খাওয়া ওর মানা। এরমধ্যেই একদিন শুনি পাশের বিড়াল বাড়ির দুটো বিড়ালকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। পরের দুই সপ্তাহে এই ভাবে আরো বিড়াল হারিয়ে গেল। কেউ কোনো ভাবে কিছু খোঁজ করতে পারল না। ইতিমধ্যে ছুটির মেয়াদ শেষ হতেই আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম।

  পরেরবার শীতের ছুটিতে যখন আমরা মামার বাড়িতে গেলাম, শুনলাম, একদিন পাড়ার মীরা কাকিমা ওই বাড়ির সামনে দিয়ে ফিরছিলেন বাজার থেকে। বিন্তিদের বাড়ির সামনে এসে দেখেন সদর দরজা হাল্কা ভেজানো। এমনিতেই ওদের সম্বন্ধে সবার কৌতূহল ছিল, উনি ভাবলেন এই সুযোগ! আস্তে আস্তে দরজা খুলে ঢুকতেই কিরকম একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে এল। আঁচলের খুঁট নাকে চেপে এগোতেই দেখলেন বাসন্তীদি উঠানে বসে পিছন ফিরে বটিতে ঘসঘস শব্দে কিছু কাটছে আর বিন্তি উবু হয়ে পাশে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই বটির দিকে। আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলেন কাকিমা। সঙ্গে সঙ্গেই দুজনে ঘুরে তাকাল! উনি দেখলেন, বাসন্তীদি বঁটিতে রক্তমাখা কাঁচা মাংসের টুকরো বিন্তিকে দিচ্ছে আর বিন্তি সেটা গোগ্রাসে চিবোচ্ছে। মটমট করে হাড় ভাঙ্গার শব্দ হচ্ছে আর ওর দুই কষ বেয়ে কাঁচা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে! সামনে ছড়িয়ে রয়েছে লোমে ঢাকা একটা বিড়ালের কাটা মাথা…! কাকিমা তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারালেন কিন্তু সেই মুহূর্তেও উনি লক্ষ্য করলেন সে কি অমানবিক পৈশাচিক চেহারা মা মেয়ের! সারা মুখ সাদা রক্তহীন, চোখগুলো যেন অনেকটা বড় হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, ঠোঁট দুটো চিরে একরাশ দাঁত দুপাশে গালে বরাবর কান অবধি পৌঁছে গেছে! সেদিন বেশ রাতে পাড়ার লোকজন মীরা কাকিমাকে খুঁজতে খুঁজতে বিন্তিদের বাড়ির উঠোনে অজ্ঞান অবস্থায় পায় কিন্তু বাসন্তীদি বা বিন্তি কাউকেই আর পাওয়া যায়নি।

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *