micro-story-boomerang

বুমেরাং
নীলা নাথদাস

 

বিনিতা বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে ঢুকেই বুঝতে পেরেছিল যে, দে আর নট হার কাপ অফ টী। মন বসছিল না কিছুতেই। আগে রমিত ওকে বলেনি যে ওদের নিজস্ব বাড়ি নেই। ভাড়া বাড়িতে থাকে। এই মিথ্যাচারও মেনে নিয়েছিল ও। কারণ, রমিতকে দুঃখ দিতে চায়নি। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল যে, আরো কিছু দিন পেরোলে হয়ত মন বসে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? বিনিতাকে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ নানা ভাবে লাঞ্ছণা করে ওর শাশুড়ি, রমিতের ছোট বোন রিপা, বড়দিদি অনিমা। এমন ভাব দেখায় আড়েঠারে যেন রমিতের ঘাড়ে এসে বিনিতা চেপে বসেছে। বিনিতা শিক্ষিতা এম.এ, বি.এড। রমিত সাধারণ গ্র্যাজুয়েট। প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে, বাড়ির অবস্থাও স্বচ্ছল নয়। নিজে চাকরি করে সংসারের হাল ফেরাবে একথাও মনে মনে ভেবে রেখেছে বিনিতা। অথচ, ওরা বিবাহিতা, বয়স্কা ননদেরা জ্ঞাতিগুষ্টির লোকজনের সামনে এমন করে ওকে ওর কাজকর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করে যে, কোনমতে চোখের জল লুকিয়ে হাসি মুখে কথা বলতে হয় ওকে। বিয়ের আগে নারী নির্যাতন নিয়ে কত প্রতিবাদী ছিল বিনিতা। এখন সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কত বড় বাড়ির মেয়ে ও। কত সোনাদানা দিয়ে বিয়ে দিয়েছে বাবা। এ বিয়েতে রাজিই ছিল না ওর বাড়ির লোক। শুধু বিনিতা চেয়েছে বলে বিয়েটা হয়েছে। এখন গোপনে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোন উপায়ই নেই। উপায় কি নেই? রমিতকে বলেছে, ও সদুত্তর দেয়নি। বরং,ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বুঝিয়েছে, ওর পরিবারের লোকজন এসব করতেই পারে না। অত্যন্ত মনখারাপ হয়েছিল সেদিন। বুঝেছিল, একটা ফাঁদে পড়ে গেছে ও। ছোটবেলায় মেলাতে দেখা মঁত কি কুয়ার কথা মনে পড়েছিল। বেরোনো মুস্কিল, তবে নির্দ্দিষ্ট পদ্ধতিতে বেরোনো যায় বটে। ডিভোর্স নিলে বাবাকে দুঃখ দেওয়া হবে। তার থেকে স্বাবলম্বী হলে কারোর কিছু বলার থাকবে না। ভেবেছিল শাশুড়ি হয়ত ওর এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবেন। তাই, সেদিন আবাসনের ছাদে ঘোরার জন্য সন্ধ্যেবেলায় যখন শাশুড়ি বললেন, তখন কথায় কথায় শাশুড়ির কাছে চাকরী করার অনুমতিও নিয়ে নেওয়া যাবে, ভেবে খুশি হল বিনিতা। সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে উঠতেই, শাশুড়ি ওর গয়নাগুলো কোথায় আছে, লকারে না রেখে ছোট মেয়ের কাছে থাকলে নিরাপদে থাকবে ইত্যাদি বোঝাতে শুরু করলেন। ছাদের এককোণে পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ওরা দুজন। আকাশ অপূর্ব এক লালিমায় ভরে গেছে। অনেকদিন পর বিনিতা মনখারাপির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এল। মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল পাখিদের ঘরে ফেরা। খেয়ালই করল না শাশুড়ি কখন ওর পিছনে চলে গেছেন। হঠাৎ ইচ্ছে হল এই আনন্দ শাশুড়ির সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু পিছনদিকে মোড় নিতেই ও ভয়ে চিৎকার করে উঠল। ওর ঠিক সামনেই শাশুড়ি দাঁড়িয়ে। দুহাত সামনে রেখে ধাক্কা দেওয়ার ভঙ্গিতে। থুড়ি ধাক্কা দিয়েই দিয়েছে। ও তৎক্ষণাৎ নিজের অবস্থান থেকে একলাফে সরে দাঁড়াল। আর, টাল সামলাতে না পেরে রেলিংবিহীন চারতলার ছাদ থেকে ওর চোখের সামনেই শাশুড়ি পড়ে গেলেন। আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠল বিনিতা। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে পড়ল। ঝুঁকে দেখার সাহস পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে ও। সম্বিত ফিরতেই মনে হল রমিতকে জানাতে হবে। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মন বলল, নাহ, ওকেইতো ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন উনি। তবে, সত্যিকথা বললেও কেউ ওর কথা বিশ্বাস করবে না। রমিতও না। তারচেয়ে চুপচাপ নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যাওয়াই সমীচীন। আজ রোববার বলে ওঁর মেয়েরা আসবে না। তাছাড়া উনি আবাসনের পিছনে জঙ্গলে পড়েছেন। খোঁজ পেতে পেতে রাত পেরিয়ে যাবে। রমিত ওর অফিসে কলিগের বাড়িতে গেছে। ওখান থেকে ফিরে এসে খোঁজ শুরু করবে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল বিনিতা। কেউ ওকে দেখে ফেলার আগেই ফ্ল্যাটে পৌঁছতে হবে। ভাগ্যিস শাশুড়ি ফ্ল্যাট লক করে যাননি। বিনিতাকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ঘরে ফেরার তাড়া ছিল যে!

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *