-লজ্জা করে না তোমার! এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাও।
-আচ্ছা যাচ্ছি।
-চলে যাচ্ছ! ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি?
-বাহ্! তুমিই তো যেতে বললে!
নীহারিকা ভীষণ রেগে গেছে। ওর মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। এমন কৃপণ একটা মানুষের সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে হবে তাকে? একটা সামান্য জিনিসও যে মনে রাখতে পারে না? বাপি আর মামনি কী ভেবে গেল ওকে? ছিঃ ছিঃ! আজ নীহারিকা আর অমলের প্রথম বিবাহ-বার্ষিকী। এই দিনটা বিশেষভাবে কাটাবে ভেবেছিল নীহারিকা। অথচ অমল আজ সকাল থেকে কেমন যেন মন মরা। নীহারকার কেনা নতুন শার্টটা ছুঁয়েও দেখল না। একটা পুরনো শার্ট পরে অফিসে গেল। ফিরেও এসেছে একেবারে খালি হাতে। শ্রাবণের এমন সুন্দর দিনে একমুঠো জুঁইফুলও কি হাতে করে আনতে পারল না? তার উপর মামনি বাপিদেরও ডিনারে কিছু স্পেশাল খাওয়ালও না। নীহারিকাই হোটেল থেকে অর্ডার করে খাবার আনিয়ে ব্যাপারটা একভাবে ম্যানেজ করল। অমল সারাদিন ধরে খালি সিগারেট ধরাচ্ছে আর খাচ্ছে। নীহারিকার সিগারেটের গন্ধ একেবারে অসহ্য লাগে, নাকে এলেই তার বমি পায় ।
অমল বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সবাই চলে গেছে। নীহারিকা অভিমান করে বিছানায় শুয়ে আছে। অমল চোখ বুঁজে একজনকে মনে করতে লাগল। আজ কতদিন সে অমলের জীবন থেকে বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে। টুপুর। আজ টুপুরের জন্মদিন। নিজের বিয়ের তারিখটাও জেদ করে ওই দিনটাতেই ফেলেছিল সে। সারাদিন অমলের আজ ওকে মনে পড়েছে। অমলের বুকের ভেতর কীসের একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণাবোধ। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল একটা চেনা শ্যাম্পুর সুগন্ধ। টুপুরদের শ্যামনগরের বাড়ির অন্ধকার বারান্দায় ওরা সবাই কারেন্ট অফ হলে বসে বসে গানের লড়াই খেলত। কলেজ থেকে ফিরে টুপুর কী একটা অজানা শ্যাম্পু দিয়ে মাঝে মাঝে মাথা ধুয়ে একপিঠ খোলা চুল ছড়িয়ে এসে বারান্দায় বসত। শ্যাম্পুর সেই ঘ্রাণে শ্বাস নিয়ে অমলের মনে কেমন মাদকতা আসত। অমল তখন ইচ্ছে করেই গাইত,” দিল ক্যায়া করে যব কিসি কো, কিসি সে প্যায়ার হো যায়ে—।” টুপুর কোনো সাড়া না দিয়ে নিশব্দে বসে শুনত। একরাশ ভেজা চুল ঘিরে রাখত বৃষ্টিস্নাত জুঁইফুলের মত পবিত্র ওর মুখটাকে। লোডশেডিং এ অন্ধকার বারান্দায় তখন চাঁদের খুব মৃদু আলো এসে পড়ত। টুপুরদের উঠোনের বিরাট চাঁপা গাছটা থেকে চাঁপা ফুলের গন্ধ ভেসে আসত। বারান্দায় টুপুরের জ্ঞাতি ভাইবোনেদের ভীড়, তবুও অমলের মনে হত ওখানে যেন সে আর টুপুর একদম একা।
অমলের সিগারেটের গন্ধটা ওর খুব প্রিয় ছিল। প্রাণভরে ধোঁয়া গিলছে অমল। তার ঠোঁটের উপর সিগারেটের আগুনটা ধকধক করে জ্বলতে থাকে। বাইরে প্রবল এলোমেলো হাওয়া বইছে, বৃষ্টি নেমেছে। ব্যালকনির খোলা পরিসরে মাথাটা নামিয়ে এল অমল। ফিসফিস করে বৃষ্টি এসে পড়ছে তার মুখে-কপালে। একটা ভালো করে মনে না পড়া প্রিয় সুর যেন চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছে অমল তার জীবন থেকে। বৃষ্টির জলকনা গায়ে মাখতে মাখতেও ভেতরটা তার পুড়তেই থাকে।