micro-story-chain

চেন
মানস দে


“পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে অন্তরায় হতে পারে। তাই না থাকাই ভালো, তবে সততা থাকাটা জরুরী। কাজের আগে ট্রেনিং দেওয়া হবে আর মাসের শেষে মাইনে। বেশ মোটা। আগ্রহী? তাহলে শীঘ্রই যোগাযোগ করুন।” খবরের কাগজের ভেতরের একটা পাতায় ছোট্ট বিজ্ঞাপণটা খানিকটা ক্যামুফ্লাজ করে থাকলেও সজলের চাকরি সন্ধানী চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। বিজ্ঞাপণটা কয়েকবার পড়ে ঐ পাতাটা সরিয়ে রাখে সজল।

সজল এম কম পাস। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে এখন যেন ইতি টানার আগে শেষ চেষ্টা, খানিক টি টোয়েন্টির অন্তিম পর্বের মতো। আস্কিং রেট যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। হাতে আর উইকেট নেই। হার নিশ্চিত তবুও যদি ম্যাজিক্যাল কিছু ঘটে। বিজ্ঞাপণটা বড়ো অদ্ভুত। বেশ কৌতূহল জাগানো। ঘুরে আসতে তো কোন ক্ষতি নেই?

যাইহোক সজল ইন্টারভিউ দিতে যায়। ইন্টারভিউয়ার বলে
– আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আমি আমাদের ব্যবসাটা নিয়ে কিছু বলি।
– হ্যাঁ আমিও সেটাই ভাবছিলাম।
– দেখুন কিছু মানুষ আর্টিস্টিক স্টিলিং করছেন সংগঠিত ভাবে। আমরা তাদের লোক ভাড়া দিয়ে সাহায্য করি।

সজল বেশ ভড়কে যায় বলে – চুরির ব্যবসা? অপরপ্রান্তে লোকটা বেশ নির্বিকার। সজলকে বলে – ভয়ের কিছু নেই। আগে পুরোটা তো শুনুন। তারপর আবার শুরু করে –
– আমাদের অনেক ভার্টিক্যাল আছে। যেমন – কলেজে ভর্তি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, গরু পাচার, বর্ডার ক্রসিং, প্রোমোটিং ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রত্যেকটা ভার্টিক্যালকে আমরা চেন বলি। চেনের মাথায় যিনি বসে আছেন তিনি আমাদের লোক নন। তিনি দাদা। তাদের গালভরা নাম ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। তাঁরা চেনটা চালান আমরা শুধু একটু সাহায্য করি। আমরা এই চেনের বেশ নিচের দিকের লোক। আসল কাজটা করে নিজেদের কমিশন কেটে ঠিক জায়গায় টাকাটা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কাজ।

সজল এবার বেশ ভয় পেয়ে যায়। সজলের মুখ দেখে লোকটা বুঝতে পারে। তারপর লোকটা বলে
– আমাদের পুরো চেনটা সেট করা আছে। এর মধ্যে সবাই তার ভাগ বুঝে নেয়। কোন রিস্ক নেই। মাঝে মাঝে দু-একটা লোক ধরা পড়লে দাদাকে বলে আমরা ঠিক ছাড়িয়ে আনি। ওনার হাত খুব লম্বা। ওনার হাত মাথায় থাকলে আর ভগবানকেও লাগবে না। তবে আপনাকে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হবে না। তার জন্যে লোক আছে।
– তাহলে আমাকে কি করতে হবে?
– আপনি পড়াশোনা জানা মানুষ। আপনি একাউন্টিংয়ের দায়িত্বে থাকবেন। চেনের টাকা যেন সবাই ঠিকভাবে পায়। ব্যবসা এখন অনেকটা বেড়ে গেছে। পাল্লা দিয়ে কোম্পানিতে চুরিও বেড়েছে। হিসাব রাখার খুব সমস্যা হচ্ছে। এই লাইনে সততাটা খুব জরুরি। আমরা একজন সৎ ও শিক্ষিত মানুষকে চাই। মাস গেলে আপনি আপনার মাইনে পেয়ে যাবেন। আপনাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। এক সপ্তাহ সময় দিলাম তারমধ্যে জানাবেন।

সজল অনেক ভেবেচিন্তে কাজে যোগ দিতে মনঃস্থ করে। কি করবে চাকরি নেই? তাছাড়া সে তো আর নিজে চুরি করছে না। বছরখানেক কেটে গেছে। ব্যবসা বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে দু-একটা ঘটনা ঘটে, তবে তেমন কিছু না। একদুমাস অন্তর অন্তর নতুন নতুন চেন দেখতে পায় সজল। যেমন ভর্তির ব্যাপারে যে কলেজ আগে চেন ছিল না সেখানে নতুন চেন খোলা হয়। কখনো কখনো সম্পূর্ণ নতুন ভার্টিক্যাল খোলা হয় যেমন স্কুলের পরীক্ষায় পাস করানো, চাকরির পরীক্ষায় ভুয়ো পরীক্ষার্থী ইত্যাদি। সজলের আগে বেশ খারাপ লাগত, এখন আর লাগে না।

বছরখানেক পর সজলের শরীরটা একটু খারাপ হয়। সজল ভালো একটা হসপিটালে ভর্তি হয়। আরোগ্য নিকেতন। সে জানে যে এই হসপিটালে এখনো কোন চেন তৈরী হয়নি। দিন দশেক চিকিৎসার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর বাড়িতে আরেকটু সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দেয়। এদিকে মাসখানেক না আসায় প্রচুর কাজ বাকি পড়ে থাকে সজলের জন্যে। কম্পিউটারে হিসাব এন্ট্রি করতে থাকে। হটাৎ নজরে আসে নতুন একটা চেন। আরোগ্য নিকেতন। গা দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় যেন। ঝুঁকে পড়ে চিরকুটটার ওপর। তাতে বেড নাম্বার আর তারিখ লেখা। পাশে লেখা কিডনি। আরে ওই তারিখে ওই বেড নাম্বারেই তো ও ছিল। ওকে তো অজ্ঞান করে সার্জারি করা হয়েছিল। পিঠের বাঁদিকে তলার কাটাটা তবে কি…? মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। দুই চোখে কেমন একটা অন্ধকার নেমে আসে।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “micro-story-chain

  1. ভালো লিখেছেন। লেখা থেকে লেখকের যে নিরাপদ দূরত্ব থাকলে পাঠক ইনভলভড নয়া হয়ে এনগেজড হয়ে যান,সেই ব্যাপারটা পূর্ণতঃ রয়েছে; এবং এতো ছোট পরিসরে সেটাই প্রাপ্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *