চাঁদের বুড়ি এলো ঘরে
মোস্তাফিজুল হক

ডানপিটে ছেলে নিপু। ডানপিটে হলেও বেশ মেধাবী আর কল্পনাবিলাসী। কেন চাঁদ ওঠে, চাঁদের আলোর কেন তেজ নেই – এসব নিয়ে ভাবতে ওর বেশ ভালো লাগে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে – ‘চাঁদে কি সত্যিই একটা বুড়ি থাকে?’
নিপুর চন্দ্রিমা দিদি প্রায়ই বলত, ‘জানিস নিপু, চাঁদে এক বুড়ি থাকে; বুড়ি চরকা কাটে আর রুপালি সুতো তৈরি করে!’
নিপু চোখ বড়ো বড়ো করে বলত, ‘তাহলে তো বুড়িমা অনেক চাদর বানিয়ে ফেলেছে দিদি!’
নিপুর দিদির বিয়ে হয়ে গেল; নিপু-ও একটু বড়ো হলো – তারপর ওর বিয়ে হয়ে যাওয়া দিদির গল্পটা বেশি করে মনে পড়তে লাগল। গল্পটা বিশ্বাস করে নিপু পূর্ণিমা রাতে জানালার পাশে বসে থাকে। এমনই একরাতে চাঁদটা ছিল বেশ গোলগাল আর ঝলমলে, যেন চাঁদের পিঠ থেকে তরল রুপা গড়িয়ে পড়ছে। সেইরাতে নিপু হঠাৎ দেখতে পেল, আকাশ থেকে যেন একটা আলোর ধারা নেমে আসছে। সে চোখ মুছে আবার তাকাল – ‘কী আজব ঘটনা! একটা আলোই তো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে!’
রুপালি আলোটা ধীরে ধীরে মানুষের আকার ধারণ করল। নিপু বেশ ভয় পেয়ে গেল। তবে খেয়াল করে দেখল, ভীষণ হাসিখুশি আর মমতাময়ী এক বুড়ি। সাদা চুলে চন্দ্রিমা দিদির মতোই বিনুনি গেঁথেছে। বুড়ির হাতে ঈষৎ নীল রঙের একটা চরকা; কাঁধে একটা আকাশি রঙের ঝুলি; পরনে জোছনামাখা ধূতি।
নিপুর দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বুড়িমা বললেন, ‘ভয় পেয়ো না নিপু – আমি চাঁদের বুড়ি। তুমি ঘুমোবার আগে তোমার দিদির মুখে বহুদিন আমার গল্প শুনেছ। তোমার দিদি তো নেই, তাই ভাবলাম খোকাটাকে একটু দেখে আসি। রাতে যখন তোমার শীত লাগত, তখন তোমার দিদি তোমার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিতেন। এখন তো তুমি নিজেই গায়ে চাদর জড়িয়ে নিতে পারো। তাই নিজের হাতে-বোনা একটা চাদর তোমাকে উপহার দিতে এসেছি।’
নিপু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি! তুমি কি সত্যিই চাঁদের বুড়ি’?
বুড়ি হেসে মাথা নাড়লেন। তারপর ঝলমলে ঝুলি থেকে একটা রুপালি সুতোয় বোনা চাদর বের করলেন। কী আশ্চর্য! চাদরটার গায়ে ছোটো ছোটো ঝলমলে তারা, মাঝে একটুকরো চাঁদ আর চাদরের এককোনায় লেখা ‘নিপুর চাদর’।
নিপুর সাথে বুড়িমা’র কত কথা হলো! তিনি বললেন, ‘এই চাদর বানিয়েছি রুপালি তুলো দিয়ে। চরকা কাটার সময় মিশিয়েছি সাতরঙের স্বপ্ন। তুমি এই চাদর গায়ে জড়ালে এমন সব স্বপ্ন দেখবে, যা এর আগে কেউ দেখেনি!’
নিপু খুশিতে আটখানা। সে তক্ষুনি চাদরটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে ওর চোখে ঘুম জড়িয়ে এল।
ঘুমের ভেতরে ঘটে গেল এক জাদুকরী ঘটনা – পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে নিপু। তখন নিচে পড়ে রইল ওর চিরচেনা বাড়ি, পুকুর, মাঠ। সবকিছু কেমন জানি ছোটো হয়ে যাচ্ছে। নিপুর চারপাশে তারা, ধূমকেতু, আর দূরে এক গোল পাহাড়ের মতো চকচকে আলো। সে বুঝতে পারল, চাঁদের দিকেই উড়ে যাচ্ছে।
নিপু চাঁদে পৌঁছে দেখল বিশাল এক মাঠÑ যেখানে শত শত চাঁদের বুড়ি তুলা কুটছেন, চরকা ঘুরাচ্ছেন, আর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে ঘুরে ঘুরে সেই চাদরের সুতো ছুঁয়ে দেখছে।
এই তো চাঁদবুড়ির দেশ’ – নিপু চিৎকার দিয়ে বলে ফেলল। এক বুড়িমা হেসে বললেন, ‘এসো নিপু, তুমি এখন আমাদের অতিথি। যাদের তোমার মতো ভাবুক মন, তারাই শুধু এখানে আসতে পারে।’
তারপর নিপু সেই দেশে খেলল, গল্প করল; রুপালি সুতো দিয়ে লালসবুজ রং মিশিয়ে ছোট্ট একটা পতাকাও বানাল। দূর থেকে সূর্যদাদু সেই পতাকা দেখে বললেন – তুমি এক ‘স্বপ্নদূত’।
হঠাৎ একটা দোয়েল পাখি উড়ে এসে বলল, ‘আজ স্কুলে যাবে না নিপু?’
চাঁদের বুড়ি বললেন, ‘আজকে তবে যাও; আর প্রিয় চাদরটা সযতনে রেখো ভাই – ওটা শুধু চাদর নয়, তোমার স্বপ্নের চাবি।’
পরদিন সকালে নিপু ঘুম থেকে উঠে দেখল, সে তার বিছানায় শুয়ে আছে। ওর পাশে রাখা আছে সেই রুপালি চাদর। চাদরের গায়ে এখনো ওর নাম চকচক করছে।
নিপু মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলল, ‘মা, মা! চাঁদের বুড়ি এসেছিল গতকাল রাতে! দেখো না, কী কা-! আমার জন্য একটা চাদর এনেছে!’
মা হেসে বললেন, ‘আবার স্বপ্ন দেখেছিস বুঝি?’
নিপু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তাহলে ওই চাদরটা কোত্থেকে এলো?’
মা বললেন, ‘ওটা রাজশাহীর রেশমি সুতোর জামদানি চাদর – তোর চন্দ্রিমা দিদি এনেছেন।’
কখন যেন পাশের ঘর থেকে চুপটি করে চন্দ্রিমা দিদি নিপুর পাশে এসে বসেছেন। দিদি নিপুর থুতনি উঁচিয়ে তুলে ভাইটিকে দেখে হাসতে লাগলেন।